মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বৈশিষ্ট্য

মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বৈশিষ্ট্য প্রসঙ্গে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের প্রাধান্য, পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ, আর্থিক সংগতি, সংখ্যায় স্বল্পতা, সাম্প্রদায়িক সচেতনতা, কর্মহীনতা, শহরকেন্দ্রিকতা, জাতীয় আন্দোলনের মেরুদন্ড, মধ্যবিত্তদের সম্পর্কে দেশাইয়ের মন্তব্য ও মধ্যবিত্তদের বিশেষ অবদান সম্পর্কে জানবো।

মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বৈশিষ্ট্য

ঐতিহাসিক বিষয়মধ্যবিত্ত শ্রেণির বৈশিষ্ট্য
উদ্ভবকালব্রিটিশ শাসনকাল
প্রথম উল্লেখবঙ্গদূত পত্রিকা
সংখ্যাগরিষ্ঠউচ্চবর্ণের হিন্দু
শিক্ষা পদ্ধতিপাশ্চাত্য শিক্ষা
মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বৈশিষ্ট্য

ভূমিকা :- ব্রিটিশ শাসনকালে ভারত -এ মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। সংস্কারের বাধা দূরে ঠেলে দিয়ে তারাই সর্বপ্রথম পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণে অগ্ৰণী হয়। পরবর্তীকালে তাদের মাধ্যমেই ভারতে সামাজিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু হয়। বাংলায় রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠী ও অন্যান্যরা, বাংলার বাইরে নারায়ণ গুরু, বীরসালিঙ্গম, স্যার সৈয়দ আহমদ খান ও অন্যান্য সমাজসংস্কারকগণ সমাজসংস্কারের কাজে গুরুত্বপূর্ণ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন।

মধ্যবিত্ত শ্রেণি

সমাজে উচ্চবিত্ত শ্রেণি এবং কায়িক শ্রমজীবী শ্রেণির মানুষের মধ্যবর্তী স্তরে যে সামাজিক গোষ্ঠী অবস্থান করে তারা সাধারণভাবে মধ্যবিত্ত শ্রেণি নামে পরিচিত। ভারতে ব্রিটিশ শাসনকালে মধ্যবিত্ত শ্রেণির ব্যাপক উত্থান ও প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

উদ্ভবের ভিত্তিতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিভাগ

ঔপনিবেশিক শাসনাধীন ভারতে বিভিন্ন ধারা থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব ঘটেছিল। বি.বি. মিশ্র উদ্ভবের ভিত্তিতে ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করেছেন। যথা –

  • (১) ভূমিজ মধ্যবিত্ত শ্রেণি,
  • (২) শিল্পজ মধ্যবিত্ত শ্রেণি এবং
  • (৩) শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি।

মধ্যবিত্ত শ্রেণির বৈশিষ্ট্য

ব্রিটিশ শাসনকালে গড়ে ওঠা ভারতীয় মধ্যবিত্ত শ্রেণি ছিল ভারতে পাশ্চাত্য শাসনের অন্যতম ফসল। এই সময়ে সৃষ্ট মধ্যবিত্ত শ্রেণির কিছু সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন –

(১) উচ্চবর্ণের হিন্দুদের প্রাধান্য

ব্রিটিশ শাসনাধীনে ভারতে যে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ঘটেছিল তার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই ছিল উচ্চবর্ণের হিন্দু। ১৮৮৩-১৮৮৪ শিক্ষাবর্ষে বাংলার হিন্দু কলেজের ছাত্রদের ৮৪.৭ শতাংশই এসেছিল ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও বৈদ্য – এই তিনটি তথাকথিত ‘ভদ্রলোক শ্রেণি থেকে। সরকারি চাকরির বেশিরভাগই ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য ও ক্ষত্রিয়দের দখলে ছিল। সরকারি চাকরিতে মুসলিম ও নিম্নবর্ণের হিন্দুদের সংখ্যা ছিল খুবই কম।

(২) পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্ৰহণ

ঔপনিবেশিক আমলে ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণে তাদের আগ্রহ। মধ্যবিত্ত শ্রেণির আর্থিক সামর্থ্য সীমাহীন না হলেও মূলত পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণের ফলে ভারতীয় সমাজে তারা প্রগতিশীল মানসিকতার পরিচয় দিতে পেরেছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, প্রথমদিকে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত এই মধ্যবিত্ত শ্রেণি ভারতের পক্ষে ব্রিটিশ শাসনকে মঙ্গলজনক বলে মনে করত। তাই ডিরোজিওর অনুগামী রামগোপাল ঘোষ ব্রিটিশ সরকারের চাকরি প্রত্যাখ্যান করলেও ভারতে ব্রিটিশ শাসনের স্থায়িত্ব কামনা করেছিলেন।

(৩) আর্থিক সংগতি

মধ্যবিত্ত শ্রেণির অর্থনৈতিক অবস্থা যথেষ্ট সচ্ছল ছিল। কেউ কেউ ছিলেন যথেষ্ট সংখ্যক ভূসম্পত্তির মালিক, বড়ো ব্যবসায়ী, পুঁজি লগ্নিকারী প্রমুখ। বাকিদের অধিকাংশই ছিলেন মাঝারি আর্থিক অবস্থাসম্পন্ন। পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণকারী দুর্বল আর্থিক অবস্থা সম্পন্নরা ‘নিম্ন মধ্যবিত্ত’ হিসেবে বিবেচিত হত। আর্থিক সংগতির দ্বারা মধ্যবিত্তরা সাধারণ দরিদ্র ভারতীয়দের থেকে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে পেরেছিলেন।

(৪) সংখ্যায় স্বল্পতা

ব্রিটিশ আমলের মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় প্রচলিত অর্থে শিক্ষিত এবং আর্থিক প্রশ্নে সচ্ছল ছিলেন। এই দুইয়ের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা মধ্যবিত্ত শ্রেণির সংখ্যা ঔপনিবেশিক আমলে দেশের সমগ্র জনসংখ্যার তুলনায় খুবই সামান্য ছিল। ঊনবিংশ শতকের শেষদিকে সারা ভারতের শিক্ষিত ভারতীয় মধ্যবিত্তের সংখ্যা আজকের দিনের দিল্লির মতো ক্ষুদ্র অঞ্চলের শিক্ষিত নাগরিকের চেয়েও কম ছিল।” তাই ব্রিটিশরা প্রায়ই বলত যে উদীয়মান এই মধ্যবিত্ত শ্রেণি তাদের আয়তনের তুলনায় বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে।

(৫) সাম্প্রদায়িক সচেতনতা

মধ্যবিত্ত শ্রেণি নিজেদের সাম্প্রদায়িক স্বরূপ সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। তারা নিজেরা জাতনির্ভর কয়েকটি গোষ্ঠীতে বিভক্ত ছিলেন, আবার নিজ সম্প্রদায়ের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা বা বজায় রাখার বিষয়েও যথেষ্ট যত্নবান ছিলেন। উচ্চবর্ণজাত, ধনী, প্রভাবশালী প্রভৃতি বিষয়গুলিকে কোনো গোষ্ঠীর প্রধান হওয়ার জন্য যোগ্যতার অন্যতম মাপকাঠি হিসেবে বিবেচিত হত।

(৬) কর্মহীনতা

ভারতের এই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি প্রধানত ব্রিটিশদের অধীনে চাকুরি করে জীবিকা নির্বাহ করত। কিন্তু এই সম্প্রদায় পরবর্তীকালে ক্রমবর্ধমান কর্মহীনতার মুখোমুখি হয়। যোগ্যতা থাকলেও ভারতীয় মধ্যবিত্তরা নিম্নপদের চাকুরিগুলিতে নিযুক্ত হতে বাধ্য হত। অধ্যাপক অমলেশ ত্রিপাঠী দেখিয়েছেন যে, ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে মাসে ৭৫ টাকার বেশি বেতনের সরকারি পদের সংখ্যা ছিল ১৩,৪৩১টি। এর বেশিরভাগটাই উচ্চবিত্ত ইংরেজ ও মধ্যবিত্ত ইঙ্গ-ভারতীয়দের জন্য সংরক্ষিত ছিল।

(৭) শহরকেন্দ্রিকতা

কোম্পানির শাসনকালে ভারতে বহু নতুন শহরের প্রতিষ্ঠা হয়। কোর্টকাছারি, অফিস-আদালত, বিচারপতি ও অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্তাদের বাসভবন, রাস্তাঘাট প্রভৃতির সমন্বয়ে বহু মফসসল জেলা শহরও গড়ে ওঠে। এই শহরগুলিকে কেন্দ্র করেই পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটে এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণি এই শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ পায়। তবে জমিভিত্তিক মধ্যবিত্ত শ্রেণি, যেমন জমিদার প্রমুখ গ্রামে বাস করত।

(৮) জাতীয় আন্দোলনের মেরুদণ্ড

  • (১) ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণি পরবর্তীকালে ব্রিটিশবিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মেরুদণ্ড হয়ে দাঁড়ায়। এজন্য এ. আর. দেশাই ভারতের মধ্যবিত্তদের ‘আধুনিক ভারতের স্রষ্টা’ বলে অভিহিত করেছেন।
  • (২) পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণের ফলে মধ্যবিত্ত শ্রেণিই সর্বপ্রথম জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্‌বুদ্ধ হয়। তাই ব্রিটিশ সরকারের অপশাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে মধ্যবিত্তরাই সর্বপ্রথম সরব হয় এবং জাতীয় আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসে। ব্রিটিশবিরোধী বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী সংগঠনের বেশিরভাগ সক্রিয় সদস্য ও সমর্থকই এসেছিলেন মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে।
  • (৩) আই. সি. এস. পরীক্ষায় বসার বয়স কমানোর প্রতিবাদ করে সরকারি চাকরির সুযোগবৃদ্ধির দাবিকে কেন্দ্র করেই মধ্যবিত্ত শ্রেণি সর্বপ্রথম রাজনৈতিক আন্দোলনের পথে পা বাড়ায়। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ও চাকরি থেকে বরখাস্ত হওয়ার ফলেই রাজনীতিতে প্রবেশ করেন।

মধ্যবিত্তদের সম্পর্কে দেশাইয়ের মন্তব্য

ঔপনিবেশিক শাসনকালে ভারতে যে মধ্যবিত্ত শ্রেণির আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল তারা সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় প্রভৃতি বিষয়ের চিন্তায় অগ্রণী শ্রেণি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। এ. আর. দেশাই মনে করেন যে, আধুনিক ভারতের স্রষ্টা হিসেবে এবং ভারতের রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থায় মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রভাব ছিল অসাধারণ।

মধ্যবিত্তদের বিশেষ অবদান

পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সভ্যতার সংস্পর্শে এসে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণি উপলব্ধি করেছিল যে ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতিতে এমন কিছু মধ্যযুগীয় ভাবধারার প্রচলন রয়েছে যা এদেশের সমাজ ও সংস্কৃতির অগ্রগতির পথে বাধাস্বরূপ। তাই তাঁরা ভারতীয় সমাজ ও সভ্যতার কুসংস্কার ও জরাজীর্ণতা দূর করে পাশ্চাত্যের সমাজ ও সংস্কৃতির ভালো দিকগুলি ভারতীয় সমাজ ও সভ্যতায় যুক্ত করার উদ্যোগ নেন।

মধ্যবিত্তদের সংস্কার আন্দোলন এলিটিস্ট আন্দোলন

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির সংস্কার আন্দোলন সমাজের উচ্চশ্রেণির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। সাধারণ মানুষের সঙ্গে এর বিশেষ যোগ ছিল না। এজন্য ড. অনীল শীল একে ‘এলিটিস্ট আন্দোলন’ বলে অভিহিত করেছেন।

উপসংহার :- ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকালে মধ্যবিত্তদের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে সমাজসংস্কার আন্দোলনের ব্যাপক প্রসার ঘটে।

(FAQ) মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. মধ্যবিত্ত শ্রেণি কাদের বলা হয়?

সমাজে উচ্চবিত্ত শ্রেণি এবং কায়িক শ্রমজীবী শ্রেণির মানুষের মধ্যবর্তী স্তরে যে সামাজিক গোষ্ঠী অবস্থান করে তারা সাধারণভাবে মধ্যবিত্ত শ্রেণি নামে পরিচিত।

২. ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণির সংখ্যাগরিষ্ঠ কারা ছিলেন?

উচ্চবর্ণের হিন্দুরা।

৩. ভারতের মধ্যবিত্তদের আধুনিক ভারতের স্রষ্টা বলেছেন কে?

এ আর দেশাই।

৪. চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়ে রাজনীতিতে প্রবেশকারী একজন মধ্যবিত্তের নাম লেখ।

সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।

Leave a Comment