সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের কৃতিত্ব প্রসঙ্গে দিল্লি সুলতানির সুরক্ষা আলাউদ্দিন খলজির পথপ্রদর্শক, শান্তি শৃঙ্খলা স্থাপন, স্বৈরতন্ত্র স্থাপন ও অভিজাত দমন, বিদ্রোহ দমন, বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিরোধ, অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, নিষ্ঠুরতা সম্পর্কে জানবো।
সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের কৃতিত্ব
বিষয় | বলবনের কৃতিত্ব |
সুলতান | গিয়াসউদ্দিন বলবন |
বাংলায় বিদ্রোহ | তুঘ্রিল খাঁ |
মোঙ্গল আক্রমণ | তৈমুর খাঁ |
মৃত্যু | ১২৮৭ খ্রিস্টাব্দ |
ভূমিকা :- ডাঃ ঈশ্বরী প্রসাদ তাঁর Short History of Muslim Rule in India গ্রন্থে সুলতান গিয়াসুদ্দিন বলবন সম্পর্কে বলেছেন যে, “বলবন ছিলেন এক মহান যোদ্ধা, শাসক ও রাষ্ট্রনীতিজ্ঞ।”
দিল্লী সুলতানির সুরক্ষা
তিনি দিল্লী সুলতানির শিশু রাষ্ট্রকে মোঙ্গল আক্রমণ, মেওয়াটী বিদ্রোহ, তুঘ্রিল খানের বিদ্রোহ, তুর্কী আমীরগণের স্বাধিকার-প্রমত্ততা থেকে রক্ষা করেন।
আলাউদ্দিনের পথপ্রদর্শক
বলবন ছিলেন আলাউদ্দিনের পূর্বসূরী ও পথপ্রদর্শক। যদি বলবন মেওয়াটী ও হিন্দু বিদ্রোহীদের দমন এবং পাঞ্জাব থেকে বিহার পর্যন্ত শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য দৃঢ় প্রশাসনিক ব্যবস্থা গঠন না করতেন, তবে আলাউদ্দিনের রাজত্বকালের সাম্রাজ্য বিস্তার সম্ভব হত না।
শান্তি-শৃঙ্খলা স্থাপন
বলবন তার কর্মচারীদের খলিসা গ্রাম ও নগরগুলির প্রশাসনিক দায়িত্ব ও আইনশৃঙ্খলা রাখার ভার দেন। হিন্দু রাজাদের রাজ্যে রাজাদের অনুরূপ দায়িত্ব দেন। এর ফলে সাম্রাজ্যে সর্বত্র শান্তি-শৃঙ্খলা স্থাপিত হয়, ব্যবসা-বাণিজ্যের ও কৃষির উন্নতি হয়।
স্বৈরতন্ত্র স্থাপন ও অভিজাত দমন
- (১) বলবন যখন সিংহাসনে বসেন তখন সুলতানি সিংহাসনের মর্যাদা হ্রাস পেয়েছিল। উচ্চাকাঙ্খী তুর্কী আমীরদের ধ্বংস করে এবং দরবারে নানা আড়ম্বর ও প্রথা চালু করে বলবন সুলতানি সিংহাসনের মর্যাদা বিশেষ উঁচুতে স্থাপন করেন।
- (২) রাজতন্ত্রের মর্যাদা বৃদ্ধি করে তিনি সুলতানি সিংহাসনের স্থায়িত্ব বাড়ান। আলাউদ্দিনের যুগের অপ্রতিহত স্বৈরতন্ত্রের ভিত্তি বলবনই স্থাপন করেন। বলবন তাঁর রাজতন্ত্রের মর্যাদা প্রধানত সামরিক শক্তি ও সুলতানের ঐশ্বরিক ক্ষমতার দাবীর ওপর দাঁড় করান। তিনি ধর্মনিরপেক্ষ রাজতন্ত্রের কথা চিন্তা করেননি।
ডঃ ত্রিপাঠীর মন্তব্য
ডঃ ত্রিপাঠীর মতে, “বলবনের রাজতান্ত্রিক শক্তি সিংহাসনের মর্যাদা, সুলতানদের সামরিক শক্তি ও তাঁর ন্যায় বিচার নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল” (Prestige, power and justice)।
বিদ্রোহ দমন
বলবন তার সাম্রাজ্যে বিদ্রোহ দমনে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি বাংলার তুঘ্রিল খানের বিদ্রোহ দমন করেন, মেওয়াটী দস্যুদের দমন করেন এবং রায়চুর দোয়াবের দস্যুদের ধ্বংস করেন।
বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিরোধ
বলবন মোঙ্গল আক্রমণ নিরোধে সর্বশক্তি ব্যয় করেন। মোঙ্গল আক্রমণের গুরুত্ব তিনি বিশেষভাবে উপলব্ধি করেন। এজন্য তিনি সীমান্তে অতন্দ্র প্রহরার ব্যবস্থা করেন।
সামরিক বাহিনী
তিনি রাজ্য জয় অপেক্ষা রাজ্য রক্ষাকে বেশী দরকারি মনে করতেন। বলবন সামরিক বাহিনীকে যত্নসহকারে গঠন করেন। সুলতানি শক্তির উৎস ছিল এই সামরিক বাহিনী। এরাই আপদে-বিপদে সুলতানের পাশে দাঁড়াত এবং দিল্লী সুলতানিকে রক্ষা করত। প্রশাসন ও সামরিক বাহিনী গঠন করে বলবন দিল্লী সুলতানিকে এক মজবুত ভিতের ওপর বসিয়ে দেন।
অসাধারণ ব্যক্তিত্ব
সর্বোপরি ছিল তাঁর নিজের অভ্রভেদী ব্যক্তিত্ব এবং অসাধারণ পরিচালনা শক্তি। এইভাবে বলবন দিল্লী সুলতানি শাসনকে এক নতুন মহিমায় মণ্ডিত করেন। তাঁর দরবারের আড়ম্বর, তাঁর সিস্থানী ও তুর্কীস্থানী সেনাদের আকৃতি ও অস্ত্র পরিচালনা এবং কুচ-কাওয়াজ দেখে দর্শকরা “বিসমিল্লাহ, বিসমিল্লাহ” বলে বিস্ময় প্রকাশ করত।
নিষ্ঠুরতা
বলবন অবশ্য নিষ্ঠুর প্রকৃতির শাসক ছিলেন। তিনি প্রতিদ্বন্দ্বী এবং শত্রুদের ক্ষমা করতেন না। তাদের ধ্বংস না করে তিনি নিশ্চিন্ত হতেন না। বন্দেগী-ই-চাহালগানীর সদস্যদের হত্যা এবং তুঘ্রিল খানের সমর্থকদের হত্যা বলবনের রক্ত ও লৌহনীতির পরিচয় দেয়। কিন্তু অরাজকতা দমন করতে নিষ্ঠুরতা ছাড়া আর কোনো পথ বলবনের যুগে খোলা ছিল না।
জ্ঞানী গুণীদের সমাদর
বলবন জ্ঞানী ও গুণীদের সমাদর করতেন। মধ্য এশিয়া ও পারস্যে মোঙ্গল আক্রমণের ফলে বহু মুসলিম পণ্ডিত ভারতে চলে আসেন। বলবন তাদের সমাদর করেন। বিখ্যাত কবি আমীর খসরু তার পৃষ্ঠপোষকতা পান।
নিষ্ঠাবান সুন্নী মুসলমান
বলবন ব্যক্তিগতভাবে নিষ্ঠাবান সুন্নী মুসলমান ছিলেন। তিনি উলেমাদের সঙ্গ পছন্দ করতেন। কিন্তু তিনি রাজকার্যে উলেমাদের হস্তক্ষেপ করতে দেননি।
বলবনের শাসননীতির দুর্বলতা
- (১) বলবনের রাজ্য শাসন নীতির আলোকিত দিক থাকলেও এর একটি অন্ধকারময় দিক ছিল। বলবন রাজ্যে আইন-শৃঙ্খলা স্থাপন করেন একথা সত্য। তিনি পুলিশী দায়িত্ব পালনে সফলতা দেখালেও কোনো গঠনমূলক আইন রচনা করেননি।
- (২) ডঃ শ্রীবাস্তব এজন্য মন্তব্য করেছেন যে, “বলবনের গঠনমূলক প্রতিভা ছিল না” (Balban was not a constructive genius)। তার শাসননীতিতে কোনো উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় পাওয়া যায় নি। তিনি কোনো সামরিক বা অসামরিক প্রতিষ্ঠান বা উল্লেখযোগ্য সংস্কার প্রবর্তন করেননি।
- (৩) তিনি যে সামরিক বাহিনী গঠন করেন তা প্রকৃতপক্ষে তেমন শক্তিশালী ছিল না। ইসামী বলেছেন যে, মোঙ্গল বাহিনী অপেক্ষা সুলতানি বাহিনী দুর্বল ছিল। তুঘ্রিল খানের বিদ্রোহ দমন করতে বলবনের ছয় বৎসর সময় লাগে। তিনি রাজপুত রাজাদের রাজ্য জয় করতে সাহস করেন নি। মোঙ্গল যুদ্ধে তার জ্যেষ্ঠ পুত্র মহম্মদ নিহত হন।
- (৪) বলবনের বাহিনীর দুর্বলতার কারণ ছিল যে, তিনি তুর্কী ছাড়া আর কোনো জাতির লোকদের সেনাদলে উচ্চ পদ দিতেন না। মোঙ্গল আক্রমণের ফলে মধ্য এশিয়া থেকে নতুন তুর্কী সেনার আসা বন্ধ হলে, তুর্কী সেনাদলে উচ্চ কর্মচারী ও সাধারণ সেনার সংখ্যা হ্রাস পায়।
- (৫) বলবন হিন্দুস্থানী মুসলমান ও রাজপুতদের বিশ্বাস করতেন না। ফলে ভারতীয় কোনো ব্যক্তিকে তিনি সেনাদলে নিয়োগ করতেন না। এজন্য তাঁর বাহিনী দুর্বল হয়ে পড়ে। বলবনের মৃত্যুর পর জালালুদ্দিন খলজি সহজেই তুর্কীদের উৎখাত করে ফেলেন।
ভারতীয় জনগণ হতে বিচ্ছিন্ন
বলবন যদি তার সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে ও সেনাদলে ভারতীয় নিয়োগ করতেন তবে তাঁর শাসন এত দুর্বল হত না। বলবন সরকারী পদে তুর্কী নিয়োগ করার জন্য জেদ করায় তাঁর সরকার ভারতীয় জনগণ হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
বিরাদরী আন্দোলন ব্যাহত
বলবনের নীতির ফলে বিরাদরী আন্দোলন ব্যাহত হয়। নিম্নবর্ণের হিন্দুরা এই সময় অনেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। একেই বিরাদরী আন্দোলন বলা হত। কিন্তু বলবন হিন্দুস্থানী মুসলমানদের ঘৃণা করায় এই আন্দোলনে ভাটা পড়ে।
খলজি বিপ্লব
এদিকে শাসনকার্যে হিন্দুস্থানী মুসলমানদের নিয়োগ না করায় তাঁদের মনে ক্ষোভ দেখা দেয়। এর ফলেই খলজি বিপ্লব ঘটে।
ইলবারী তুর্কী শক্তির পতন
বলবন নেতৃস্থানীয় তুর্কীদের তার প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে হত্যা করায় তুর্কীদের নেতৃত্বে শূন্যতা দেখা দেয়। এজন্য বলবনের মৃত্যুর পর দ্রুত ইলবারী তুর্কী শক্তির পতন ঘটে।
উপসংহার :- আসলে বলবনের শাসনব্যবস্থা “রক্ত ও লৌহ” নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। জন-কল্যাণমূলক সংস্কার দ্বারা তিনি তাঁর শাসন ব্যবস্থার ভিত মজবুত করা থেকে বিরত থাকেন।
(FAQ) সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের কৃতিত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
বলবন।
রক্ত ও লৌহ নীতি।
আলাউদ্দিন খলজি।
তৈমুর খাঁ।
তুঘ্রিল খাঁ।