অশোকের ধম্ম নীতি

অশোকের ধম্ম নীতি প্রসঙ্গে বৌদ্ধ ধর্মে অনুরক্তি, বৌদ্ধ সঙ্ঘে সংহতি রক্ষা, বৌদ্ধ নীতির অনুপস্থিতি, অশোকের প্রচারিত ধর্মের চরিত্র, অশোকের ধম্ম প্রচারের বিষয়, ব্যক্তি জীবনের পরিশুদ্ধি, সমাজ জীবনে সংহতি ও ঐক্য, অশোকের ধম্মের চরিত্র বিচার সম্পর্কে জানবো।

অশোকের ধম্ম নীতি

ঐতিহাসিক ঘটনাঅশোকের ধম্ম
রাজাসম্রাট অশোক
যুদ্ধকলিঙ্গ যুদ্ধ
ধর্ম গ্ৰহণবৌদ্ধ ধর্ম
দীক্ষা গ্রহণউপগুপ্ত
কলহনরাজতরঙ্গিনী
অশোকের ধম্ম নীতি

ভূমিকা :- কলিঙ্গ যুদ্ধের সময় পর্যন্ত অশোক শৈবধর্মের অনুরাগী ছিলেন বলে কলহনের রচনা রাজতরঙ্গিনী থেকে জানা যায়। কলিঙ্গ যুদ্ধে অসংখ্য নরনারী নিহত হলে অশোক অনুতাপে দগ্ধ হন। তিনি ভিক্ষু উপগুপ্তের কাছে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা নিয়ে বৌদ্ধধর্মের অহিংসা মন্ত্রের সাধনা করে তার প্রাণে শান্তি পান।

অশোকের বৌদ্ধধর্মে অনুরক্তি

  • (১) প্রথম ও দ্বিতীয় অপ্রধান শিলালিপিতে অশোক তার বৌদ্ধধর্মের প্রতি গভীর শ্রদ্ধার কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন যে, প্রায় আড়াই বছর হল তিনি উপাসকত্ব গ্রহণ করেছেন। এই সময় তিনি ‘সম্বোধি’ অর্থাৎ বুদ্ধগয়া সহ বুদ্ধের জন্ম ও জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত তীর্থগুলিতে ভ্রমণ করেছেন।
  • (২) তিনি জনসাধারণের কাছে গৌতম বুদ্ধের অহিংসার মন্ত্র প্রচার করেছেন। বৌদ্ধধর্মের প্রচারের জন্য তিনি বুদ্ধের বাণী পাহাড়, স্তম্ভের গায়ে খোদাই করে দিয়েছেন। অষ্টম শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, তিনি বিহার যাত্রাকে ধর্মযাত্রায় পরিণত করেছেন।
  • (৩) বৈরাট, ভাবরু শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, অশোক বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মতই ‘বুদ্ধ, ধম্ম ও সঙ্ঘের প্রতি তার আনুগত্য জানিয়েছেন। সাঁচি, সারনাথ এলাহাবাদ শিলালিপি থেকেও আশ্রমিক বৌদ্ধধর্মের প্রতি অশোকের ব্যক্তিগত অনুরক্তির কথা প্রমাণিত হয়।

বৌদ্ধ সংঘে অশোকের সংহতি রক্ষা

  • (১) বৌদ্ধ সঙ্ঘে মতভেদ এবং সঙ্ঘে ভাঙন দেখা দিলে অশোক তা নিবারণের জন্য পাটলিপুত্র -এ বৌদ্ধ সম্মেলন বা সঙ্গীতির অধিবেশন ডাকেন। বৌদ্ধ শাস্ত্রের ব্যাখ্যা সম্পর্কে এই সম্মেলনে মতভেদ দূর করার চেষ্টা করা হয় এবং সঙ্ঘে ঐক্য রাখার ব্যবস্থা করা হয়।
  • (২) যারা বিভেদকামী ছিল অশোক তাদের বহিষ্কার করেন। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, অশোক ব্যক্তিগতভাবে প্রচলিত হীনযান বৌদ্ধধর্মের অনুরাগী ছিলেন। এই ধর্মমত প্রচারের জন্য তিনি নানা দেশে ধর্ম প্রচারক পাঠান।
  • (৩) তাঁর পুত্র (মতান্তরে ভাই) মহেন্দ্র ও কন্যা সঙ্ঘমিত্রা (মতান্তরে ভগিনী) ধর্ম প্রচারের জন্য সিংহলে (শ্রীলঙ্কা) যান। অশোক দাবী করেন যে, তার রাজধানী থেকে ৬০০ যোজন ব্যাস নিয়ে সকল দেশেই তিনি ধর্ম প্রচার করেছেন।

অশোকের ধম্মে বৌদ্ধ নীতির অনুপস্থিতি

  • (১) অশোকের ব্যক্তিগত ধর্মমত বৌদ্ধধর্ম ছিল এতে সন্দেহ নেই। অশোক তাঁর শিলালিপির দ্বারা জনসাধারণের কাছে যে ধর্মমত প্রচার করেন তাকে ‘ধম্ম’ বা ধর্ম বলা হত। এই ধম্মের সঙ্গে বৌদ্ধধর্মের সম্পর্ক কি ছিল তা বিতর্কের বিষয়।
  • (২) তিনি শিলালিপির দ্বারা জনসাধারণের কাছে যে ধর্মমত প্রচার করেন, তা বৌদ্ধধর্ম ছিল কিনা এ সম্পর্কে সন্দেহ আছে। কারণ, অশোকের প্রচারিত বৌদ্ধধর্মের প্রধান অনুশাসনগুলি যথা আর্যসত্য, নির্বাণ, অষ্টমার্গ, কার্যকারণ সম্পর্ক প্রভৃতি এতে দেখা যায় নি।
  • (৩) এতে অশোক, বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের রীতি অনুযায়ী বুদ্ধ, ধম্ম, সঙ্ঘের প্রতি আস্থা জানাতে বলেননি। তিনি এই ধর্মের নাম বৌদ্ধধর্ম বলে উল্লেখ করেননি। তিনি এর নাম দিয়েছেন ধম্ম। পালিভাষায় ‘ধর্ম’কে ধম্ম বলা হয়। মাস্কি লিপিতে তিনি প্রথম ‘ধর্ম’ শব্দটির উল্লেখ করেছেন।

অশোকের প্রচারিত ধর্মের চরিত্র

  • (১) অধিকাংশ পণ্ডিতেরা অশোকের প্রচারিত ধর্মনীতিকে বৌদ্ধধর্ম বলে মনে করেন না। তারা বলেছেন যে, অশোকের শিলালিপিকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। একভাগে তিনি তার ব্যক্তিগত ধর্মমত বা বৌদ্ধধর্মের কথা বলেছেন।
  • (২) এই লিপিগুলি তিনি জনসাধারণের উদ্দেশ্যে প্রচার করেন নি। এগুলি সঙ্ঘের জন্য ক্ষোদিত হয়। ভাবরু লেখ, সারনাথ, লুম্বিনী বা রুম্মিনদেই লেখ এই শ্রেণীর অন্তর্গত। অশোকের ধম্ম বা ধম্মনীতি তাঁর অন্য ধরনের শিলালিপি যথা সপ্তম স্তম্ভলিপি, নবম স্তম্ভলিপি, সপ্তম শিলালিপি প্রভৃতি থেকে পাওয়া যায়।
  • (৩) এই লিপি গুলি জনসাধারণকে লক্ষ্য করে ক্ষোদিত হয়। ধম্ম ছিল অশোকের নিজস্ব আবিস্কার। তিনি হিন্দু ও বৌদ্ধভাবধারার সমন্বয়ে ধম্মের নৈতিক নিয়মগুলি রচনা করেন। অশোক কোনো জটিল দার্শনিক তত্ত্বের কথা না বলে নৈতিক ও ধর্মীয় আচরণের উপর গুরুত্ব দেন।

অশোকের ধম্ম প্রচারের বিষয়

সম্রাট অশোকের ধম্ম বা ধম্মনীতিকে বিচার করতে হলে আগে ধম্মের মাধ্যমে তিনি কি মত প্রচার করেছেন তা জানা দরকার। ডঃ আর. কে. মুখার্জ্জীর মতে, অশোক তাঁর ধম্মে ব্যক্তিজীবন ও সমাজজীবন উভয়কেই পরিশুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। দ্বিতীয় ও সপ্তম স্তম্ভলিপির অনুশাসন গুলি এই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই অনুশাসন গুলি থেকে ধম্ম সম্পর্কে অশোক কি করতে চেয়েছেন তা জানা যায়।

অশোকের ধম্মের ব্যক্তি জীবনের পরিশুদ্ধি

  • (১) প্রথমে অশোক প্রতি ব্যক্তিকে কতকগুলি নৈতিক গুণ অনুশীলনের কথা বলেন। এগুলি ছিল দয়া, দান, সাচে বা সত্য কথা বলা, শোচয়ে বা পবিত্রতা পালন, মাদবে বা ভদ্রতা বা নম্রতা পালন। এই সঙ্গে বহু-কয়ানে বা সৎকর্ম করার কথা তিনি বলেন। যাতে এই গুণগুলিকে দৈনন্দিন জীবনে পালন করা যায়।
  • (২) এর জন্য অশোক কতকগুলি আচরণ বিধি নির্দেশ করেন। যেমন – প্রাণী হত্যা থেকে বিরত থাকা, প্রাণীর দৈহিক ক্ষতি না করা, পিতা-মাতা গুরুজনদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন, গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন, দাস-ভৃত্যদের প্রতি সৎ ব্যবহার, অহিংসা, অল্প সঞ্চয় ও অল্প ব্যয়।
  • (৩) ‘অশিনব’ অর্থাৎ পাপ বা কলুষতা থেকে যাতে লোক মুক্ত থাকে এজন্য অশোক প্রতি ব্যক্তিকে চণ্ড বা উগ্রতা, হিংসা, নিথুলিয়ে বা নিষ্ঠুরতা, ক্রোধ, ঈর্ষা প্রভৃতি ত্যাগ করতে পরামর্শ দিয়েছেন। জীবনে নীতিবোধ কতটা প্রকৃত পালিত হচ্ছে তা পরীক্ষার জন্য তিনি ‘পর্যবেক্ষণ’ বা আত্ম সমালোচনার কথা বলেছেন।

অশোকের ধম্মের দ্বারা সমাজ জীবনে সংহতি ও ঐক্য

সপ্তম স্তম্ভলিপিতে অশোক সমাজের উন্নতির জন্য কয়েকটি নীতি পালনের ওপর জোর দিয়েছেন। এগুলি হল –

  • (১) অন্য ধর্ম ও অন্য সম্প্রদায়কে নিন্দা বা ঘৃণা করা থেকে বিরত থাকা। নিজ ধর্মকে শ্রেষ্ঠ জ্ঞান ও পর ধর্মকে হেয় জ্ঞান করাকে তিনি পাপ বলে অভিহিত করেছেন। ভারতীয় ঐতিহ্য হল ধর্মসহিষ্ণুতা। অশোক তাঁর ধম্মে এই নীতিকে বিশেষ মর্যাদা দেন।
  • (২) সকল সম্প্রদায়ের মানুষ যাতে পরস্পরকে ভালবাসতে পারে এজন্য তিনি তাদের একত্রে বসবাস করতে। এর ফলে তাদের মনের সঙ্কীর্ণতা দূর হবে বলে তিনি মনে করতেন।
  • (৩) পঞ্চম শিলালিপিতে তিনি ধর্মমহামাত্রদের সকল সম্প্রদায় যথা, ব্রাহ্মণ, শ্রমণ, নিগ্রন্থ, আজীবিক সকলের মঙ্গলের জন্য কাজ করতে বলেছেন। দ্বাদশ শিলালিপিতে তিনি সকল সম্প্রদায়কে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবান থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি সকল সম্প্রদায়কে পরস্পরের প্রতি বাকসংযম দেখাতে বলেছেন।
  • (৪) জীবহিংসা ও পশুবলির তিনি নিন্দা করেছেন। যে সকল সমাজ বা গোষ্ঠী উৎসবে জীবহত্যা হত তা তিনি নিষিদ্ধ করেছেন।
  • (৫) মহামাত্রদের তিনি “ইভ্য” বা বৈশ্য বা গৃহপতি, ব্রাহ্মণ প্রমুখের কাজে এবং গৃহিনীদের ধর্মমঙ্গল পালনে উৎসাহ দিতে বলেছেন।
  • (৬) তাঁর ধর্ম পালন করলে মৃত্যুর পর স্বর্গলাভ হবে বলে অশোক আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি বৌদ্ধধর্মের নির্বাণ বা জন্মান্তরের নিবৃত্তির কথা বলেন নি। তিনি সাধারণ লোকে যা বুঝত সেভাবে তাদের স্বর্গলাভের কথাই বলেছেন।

অশোকের ধর্মের চরিত্র বিচার

  • (১) অশোকের এই ধম্মনীতির সূত্রগুলি পরীক্ষা করে পণ্ডিতেরা এটি প্রকৃত বৌদ্ধ ধর্ম কিনা তা নিয়ে মহা বিতর্ক করেছেন। তাঁর ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাস নিশ্চয়ই বৌদ্ধধর্ম ছিল, একথা আগেই বলা হয়েছে। কিন্তু তিনি যা লোকের কাছে প্রচার করেন, যাকে তিনি ধম্ম বলতেন, তাতে বৌদ্ধধর্মের মূল নীতি অনুপস্থিত।
  • (২) বৌদ্ধধর্মের মূলনীতিগুলি যথা – আর্য সত্য, অষ্টমার্গ, কার্যকারণ সম্পর্ক, নির্বাণ তত্ত্ব এতে নেই। ফ্লিট, স্মিথ, মুখার্জ্জী প্রমুখ পণ্ডিতেরা অশোকের ধম্মকে কয়েকটি মূল নীতির সমষ্টি বলেছেন। সকল ধর্মের সার কথা এতে আছে, অথচ এতে কোনো বিশেষ ধর্মের ছাপ নেই।
  • (৩) তাদের মতে ‘ধম্ম’ ছিল মানবতা প্রসূত নীতিসমূহ। রিস ডেভিডসের মতে, অশোকের ধম্ম প্রকৃতপক্ষে কোনো ধর্মমত ছিল না। মানুষের যা কর্তব্য তিনি তাই বলতে চেয়েছেন। তাদের মতে, অশোকের গ্রীক ভাষায় অনূদিত শিলালিপিগুলো পড়লে বোঝা যায় যে অশোক কোন ব্যক্তিগত ধর্মে চৌহদ্দির মধ্যে তার ‘ধম্মকে আবদ্ধ করেন নি।
  • (৪) সকল ধর্মের উর্দ্ধে সকল ধর্মের অন্তর্গত মূল নীতিবোধের সারবস্তুকেই তিনি তার ‘ধম্ম’ বলে প্রচার করেছেন। অশোক তার ধর্ম মহামাত্রদের ব্রাহ্মণ, ভ্রমণ, জৈন, আজীবিক সকল সম্প্রদায়ের স্বার্থে নিয়োগ করেন। কারণ, তার ধর্মমত কোনো বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ ছিল না।

অশোকের ধম্ম সম্পর্কে ভাণ্ডারকরের অভিমত

  • (১) অবশ্য একথা স্বীকার্য যে অশোকের প্রচারিত ধম্মের সঙ্গে বৌদ্ধধর্মের সাদৃশ্য এমন কি সম্পর্ক অনেক বেশী ঘনিষ্ঠ। ডঃ ভাণ্ডারকর দেখিয়েছেন যে, অশোক যে ধম্ম প্রচার করেন তা লৌকিক বৌদ্ধধর্ম। ভগবান গৌতম বুদ্ধ ভিক্ষু বা সন্ন্যাসীদের জন্য কঠিন ব্রত হিসেবে অষ্টপথ, নির্বাণের লক্ষ্য ঠিক করে দেন। গৃহীদের জন্য তিনি নমনীয় নীতি ঠিক করে দেন। এর নাম ‘গৃহী বিনয়’ বা গৃহীদের পালনের বিধি।
  • (২) ভাণ্ডারকর বিভিন্ন বৌদ্ধ সূত্র থেকে উল্লেখ করে তার মতের প্রমাণ দেখিয়েছেন। যেহেতু অশোক নিজে গৃহী ছিলেন এবং যে প্রজাদের কাছে তার ধম্ম প্রচার করেন তারাও গৃহী ছিল, সেহেতু বুদ্ধের গৃহী বিনয় বা গৃহীদের জন্য ধর্মকেই তিনি প্রচার করেন।
  • (৩) অনেকে বলেন যে, অশোকের ধম্মের নীতিগুলির সঙ্গে বৌদ্ধ ধম্মপাদের বর্ণিত নীতির বহু মিল দেখা যায়। একাদশ শিলালিপিতে তিনি বলেন যে “ধম্ম দান হল অন্য সকল দান অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ দান।” ধম্মপাদেও এই কথা আছে। ধম্মপাদে প্রাণীহত্যা থেকে বিরত থাকা বা অহিংসা নীতির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে. যা অশোকের ধম্মেরও মূল কথা।
  • (৪) কেবলমাত্র একটি ক্ষেত্রে অশোক ধম্মপাদের মত মানেন নি। ধম্মপাদে নির্বাণের কথা বলা হয়। অশোক স্বর্গের কথা বলেন। দীর্ঘনিকায় নামক বৌদ্ধ গ্রন্থে গৃহীদের জন্য স্বর্গের কথা বলা হয়েছে। কাজেই অশোকের ধম্মের সঙ্গে বৌদ্ধ ধর্মের গৃহী ধর্ম বা গৃহী বিনয়ের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দেখা যায়।

অশোকের ধম্ম সম্পর্কে কোশাম্বীর সামাজিক ব্যাখ্যা

  • (১) ডি. ডি. কোশাম্বি অশোকের ধম্মের একটা ব্যবহারিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। অশোক ব্যক্তিগতভাবে বৌদ্ধধর্মের অনুরাগী ছিলেন। ভাবরু, রুম্মিনদেই প্রভৃতি লিপিতে তার পরিচয় পাওয়া যায়। অন্য লিপিগুলি যাতে অশোক তাঁর ধম্মের কথা বলেছেন তাতে সমাজে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সংঘাত দূর করার জন্যে তিনি চেষ্টা চালান।
  • (২) কোশাম্বি বলেছেন যে, অশোকের আমলে সমাজে অনেক শ্ৰেণী গড়ে উঠেছিল। কৃষি ও বাণিজ্যের বিস্তারের ফলে গৃহপতি, শ্রেষ্ঠী, বণিক শ্রেণীর উদ্ভব হয়েছিল। পুরাতন জাতিভেদ বা ৪টি বর্ণের ব্যবস্থা এই পরিবর্তনকে ধরে রাখতে পারছিল না।
  • (৩) এই শ্ৰেণীসংঘাত এড়াতে অশোক তার ‘ধম্ম’ প্রচার করে রাষ্ট্রের সংহতি রক্ষা করেন। এজন্য তিনি সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতির ওপর জোর দেন। সাধারণ নীতিবোধের দ্বারা অশোক সমাজকে শুদ্ধ করতে চান।

অশোকের ধম্ম সম্পর্কে রোমিলা থাপারের রাজনৈতিক ব্যাখ্যা

  • (১) রোমিলা থাপার আর এক ধাপ এগিয়ে বলেছেন যে, মৌর্য শাসন ব্যবস্থা ছিল ঘোরতর কেন্দ্র-প্রবণ। অশোক দেখেন যে, এই কেন্দ্র-প্রবণতার বিরুদ্ধে তার বিশাল মৌর্য সাম্রাজ্য -এ বিচ্ছিন্নতাবাদ মাথা তুলতে পারত। মৌর্য শাসনব্যবস্থা, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও আমলাতন্ত্র এই কেন্দ্রিকতাকে অসাধারণ শক্তিশালী করেছিল।
  • (২) এর বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধ না আসে সেজন্য তিনি তার ‘ধম্ম’ নীতি প্রচার করেন। এর ফলে জনসাধারণের মধ্যে উদার অংশ তার পক্ষে চলে আসে। দেশের সর্বত্র লোকের মনে অশোক তার প্রভাব ফেলতে পারেন। তাঁর সঙ্গে প্রজাদের ব্যক্তিগত যোগাযোগ বৃদ্ধি পায়। সাম্রাজ্য মজবুত হয়।
  • (৩) কে. আন্তেনোভা নামে এক রুশ গবেষকও থাপারের মতের প্রতিধ্বনি করে বলেছেন যে, “স্বৈরতন্ত্রী রাজতন্ত্রের অধীনে সাম্রাজ্যকে ঐক্যবদ্ধ রাখার জন্য বৌদ্ধধর্মকে অশোক তত্ত্বগতভাবে ব্যবহার করেন।”
  • (৪) রুশ গবেষক বনগার্ড লেভিনও একই মত প্রকাশ করে বলেছেন, “অশোক তাঁর ‘ধম্মনীতি’ রাজনৈতিক প্রয়োজনে – সাম্রাজ্যে সংহতি স্থাপনের জন্য ঘোষণা করেন।” লেভিন বলেন যে, বিভিন্ন উপজাতি গোষ্ঠী সমন্বিত সাম্রাজ্যে সংহতি স্থাপনই ছিল অশোকের ধম্ম প্রচারের লক্ষ্য।

উপসংহার :- অশোকের ধম্মনীতি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রচারিত হয় এই ব্যাখ্যা অনেকে স্বীকার করেন নি। ভাণ্ডারকর প্রমুখের মতে, অশোক তাঁর লিপিগুলিতে তাঁর ধম্ম প্রচারের জন্য যে আকুল আবেদন করেছেন তা আমাদের অন্তর স্পর্শ করে। এই আবেদনের পশ্চাতে সম্রাটের রাজনৈতিক পরিকল্পনা ছিল একথা ভাবা কষ্টকর। কারণ, অশোক নিজেকে প্রজাদের কাছে ঋণী বলেই ভাবতেন। তিনি প্রজাদের পুত্রবৎ গণ্য করতেন। কোশাম্বী অশোকের এই ঘোষণাগুলির মধ্যে একটি চুক্তিতত্বের আভাস দেখেছেন। এই চুক্তি হল যে, সম্রাট প্রজাদের মঙ্গলের জন্য চুক্তিবদ্ধ।

(FAQ) অশোকের ধম্ম নীতি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. মৌর্য সম্রাট অশোক কার কাছে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হন?

উপগুপ্ত।

২. অশোকের প্রচারিত ধর্ম কি নামে পরিচিত?

ধম্ম।

৩. অশোকের আমলে সংঘটিত একমাত্র যুদ্ধ কোনটি?

কলিঙ্গ যুদ্ধ।

৪. অশোক ধর্ম প্রচারের জন্য সিংহলে কাদের পাঠান?

মহেন্দ্র ও সংঘমিত্রা।

Leave a Comment