জাহাঙ্গীরের রাজসভায় ইউরোপীয়দের আগমন

জাহাঙ্গীরের রাজসভায় ইউরোপীয়দের আগমন প্রসঙ্গে ইংরেজ বণিকদের অসুবিধা, ইংরেজ বণিকদের ব্যগ্ৰতা হকিংসের আগমন, স্যার টমাস রোর আগমন, ফর্মান গ্ৰহণ, হকিন্সের বর্ণনা ও স্যার টমাস রোর বর্ণনা সম্পর্কে জানবো।

জাহাঙ্গীরের রাজসভায় ইউরোপীয়দের আগমন

ঐতিহাসিক ঘটনা জাহাঙ্গীরের রাজসভায় ইউরোপীয়দের আগমন
সম্রাট জাহাঙ্গীর
ক্যাপ্টেন হকিন্স ১৬০৮ খ্রি
স্যার টমাস রো ১৬১৫ খ্রি
জাহাঙ্গীরের রাজসভায় ইউরোপীয়দের আগমন

ভূমিকা :- ভাস্কো-দা-গামা ভারতে আসার জলপথ আবিষ্কার করার পর থেকে পর্তুগীজদের পথ ধরে ইউরোপের অন্যান্য সামুদ্রিক জাতি ভারতে আসতে থাকে। ইংরাজরাও এভাবে ভারতের উপকূলে চলে আসে।

ইংরেজ বণিকদের অসুবিধা

ইংরাজ বণিকরা ভারতে তখন দুটি বড় অসুবিধার সম্মুখীন হয়। যেমন –

  • (১) পর্তুগীজরা তাদের বাণিজ্যে প্রবল বাধা দেয়। পর্তুগীজরা স্থানীয় রাজশক্তিগুলিকে ইংরাজের বিরুদ্ধে প্রভাবিত করায় ইংরাজের পক্ষে কোনো বন্দরে আশ্রয় পাওয়া কষ্টকর হয়।
  • (২) ভারতীয় আইন, শুল্ক ব্যবস্থা মেনে ইংরাজদের বাণিজ্য করতে হলে মুনাফা কম হত। ভারতীয় আইনকে ও মুর বা মুসলিম শাসনকর্তাদের তারা পছন্দ করত না। ইংরাজ বণিকরা চাইত যে, তারা ইংলন্ডের প্রজা হিসেবে ইংলন্ডের রাজার আইনের এক্তিয়ারে ভারতে বাণিজ্য করবে। এ সম্পর্কে তারা মুঘল সম্রাটের কাছে দূত পাঠিয়ে ফর্মান লাভের চেষ্টা চালায়।

ইংরেজ বণিকদের ব্যগ্ৰতা

এদিকে ইংলন্ডে সমুদ্রযাত্রা বাড়তে থাকে ও বৈদেশিক বাণিজ্যের মুনাফার জন্য ব্যগ্রতা বাড়ে। ইউরোপে ভারতের সুতী কাপড়, রেশম, গন্ধক, নীল প্রভৃতির ভাল বাজার ছিল। এই সকল মাল কেনার জন্য ইংরাজ বণিকরা অধীর হয়ে পড়ে।

হকিন্সের আগমন

১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে ইংলন্ডের রাজা প্রথম জেমসের পত্র নিয়ে ক্যাপ্টেন হকিন্স জাহাঙ্গীরের দরবারে প্রথম আসেন। জাহাঙ্গীর বাল্যকালে গোয়া হতে আগত পর্তুগীজ পাদ্রীদের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। সুতরাং ইউরোপীয় বা ফিরিঙ্গী সম্পর্কে তার কোনো বিরূপ ধারণা ছিল না। তিনি পর্তুগীজদের আপত্তি অগ্রাহ্য করে ইংরাজদের কিছু বাণিজ্যিক সুযোগ-সুবিধা দেন।

এডওয়ার্ডসের আগমন

এর পর এডওয়ার্ডস নামে এক ইংরাজ প্রথম জেমসের আর একটি পত্র নিয়ে জাহাঙ্গীরের দরবারে আসেন। কিন্তু তিনি বিশেষ সফল হননি।

টমাস রোর আগমন

১৬১৫ খ্রিস্টাব্দে প্রথম জেমসের দূত হিসেবে স্যার টমাস রো জাহাঙ্গীরের রাজসভায় আসেন। স্যার টমাস রো ছিলেন সংস্কৃতিবান, শিক্ষিত লোক। তিনি সম্রাটের দরবারে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেন। তিনি আসফ খাঁ ও যুবরাজ খুররমকে উপঢৌকন দ্বারা প্রভাবিত করেন।

ফর্মান গ্রহণ

  • (১) পর্তুগীজ ও বিরোধী শক্তিগুলির প্রবল বাধার ফলে টমাস রোর প্রার্থিত শর্তগুলি পূর্ণ না হলেও সম্রাট ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে একটি ফর্মান দেন যার ফলে তারা সুরাটে কুঠী স্থাপন করতে ও অবাধে বাণিজ্য করার অধিকার পায়।
  • (২) ইংরাজদের মালের ওপর সুরাটে আমদানি শুল্ক লোপ করা হয়। তারা নতুন কুঠী স্থাপনের অধিকার পায়। ইংরাজ বণিকদের ইংলন্ডের আইনে বিচার করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।
  • (৩) “স্যার টমাস রোর প্রাপ্ত ফর্মানকে ভারতের সঙ্গে ইংলন্ডের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি দিকচিহ্ন বলা যায়।” ভারতে ব্রিটিশ বাণিজ্যিক সাম্রাজ্যবাদের অনুপ্রবেশের সূচনা এই ফর্মানে হয়। বিনা শুল্কে বাণিজ্যের অধিকারের দাবী এই সময় থেকেই তোলা হয়।

হকিন্সের বর্ণনা

  • (১) জাহাঙ্গীরের আমলে আগত ইউরোপীয়রা তৎকালীন ভারতবর্ষ সম্পর্কে বহু তথ্য তাদের রচনায় রেখে গেছেন। হকিন্সের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, জাহাঙ্গীর প্রচুর সুরা পান করতেন, পান-ভোজন করতেন ও নওরোজের উৎসব করতেন। অভিজাতদের মৃত্যুর পর তাদের বাড়তি সম্পত্তি সম্রাট অধিগ্রহণ করতেন।
  • (২) এভাবে রাজকোষে বহু অর্থ জমা হয়। অভিজাতদের সঞ্চিত অর্থ ছাড়া সম্রাট বিদেশী বণিকদের আনীত মালে মোটা শুল্ক পেতেন ও ভূমি রাজস্ব পেতেন। দরবারে বিচারের ক্ষেত্রে নিষ্ঠুর ব্যবহার ও নির্দেশ দেওয়া হত।

টমাস রোর বর্ণনা

  • (১) স্যার টমাস রোর দিনপঞ্জী থেকে জানা যায় যে দরবারে অসাধারণ আড়ম্বর ছিল। অভিজাতরা আমোদ-প্রমোদে মত্ত থাকত। সাধারণ কৃষকরা দারিদ্র্য ও দুর্দশার মধ্যে জীবন কাটাত। রাস্তাঘাটে চুরি-ডাকাতি হত। স্থানীয় কর্মচারীরা দুর্নীতিগ্রস্ত ছিল।
  • (২) দেশে কোনো লিখিত আইন ছিল না। রাজার মুখের কথাই ছিল আইন। প্রাদেশিক শাসনকর্তারা ছিল স্বৈরাচারী এবং কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ তেমন ছিল না। দরবারের সকল লোকেরা যোগ্য ছিল না। অনেকে সম্রাটের অনুগ্রহের ফলে পদমর্যাদা পায়।

উপসংহার :- ইউরোপীয়দের বর্ণনায় জাহাঙ্গীর খুবই আমোদপ্রিয়, খোলা মনের লোক ছিলেন। রাত্রিকালে সম্রাট ও সভাসদরা মদ্যপানে বেহুস হয়ে পড়তেন। রাজপ্রাসাদে অসংখ্য দাস-দাসী ছিল। দরবারের ব্যয় ছিল প্রতিদিন ৫০ হাজার টাকা।

(FAQ) জাহাঙ্গীরের রাজসভায় ইউরোপীয়দের আগমন সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. ক্যাপ্টেন হকিন্স কখন কার রাজসভায় ভারতে আসেন?

১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে, জাহাঙ্গীর।

২. ক্যাপ্টেন হকিন্স কার দূত ছিলেন?

ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জেমস।

৩. স্যার টমাস রো কখন কার রাজসভায় ভারতে আসেন?

১৬১৫ খ্রিস্টাব্দে, জাহাঙ্গীর।

৪. স্যার টমাস রো কোন রাজার দূত ছিলেন?

ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জেমস।

Leave a Reply

Translate »