আকবরের দাক্ষিণাত্য নীতি প্রসঙ্গে দাক্ষিণাত্য অভিযানের কারণ, পর্তুগীজ সমস্যা, দক্ষিনে অরাজকতা, দুত প্রেরণ, মুরাদ ও খান-ই-খানানের অভিযান, আহমদ নগরের পতন, খান্দেশের বিরুদ্ধে আকবরের অভিযান, অসিরগড় দুর্গ জয় ও আকবরের দক্ষিণে অভিযানের চরিত্র সম্পর্কে জানবো।
আকবরের দাক্ষিণাত্য নীতি
ঐতিহাসিক ঘটনা | আকবরের দক্ষিণাত্য নীতি |
সম্রাট | আকবর |
১৫৮০ খ্রি | পোর্তুগীজদের গোয়া দখল |
১৫৯৫ খ্রি | আহমদনগর দুর্গ অবরোধ |
১৬০১ খ্রি | আকবরের অসিরগড় দুর্গ জয় |
ভূমিকা :- ভারত ইতিহাসে বিশেষ কৃতিত্বের দাবিদার সম্রাট আকবর ছিলেন মুঘল সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ সম্রাট। উত্তর ভারতে আকবর তার আধিপত্য স্থাপন করার পর দক্ষিণে রাজ্য বিস্তারের নীতি নেন।
আকবরের দাক্ষিণাত্য অভিযানের কারণ
- (১) ভারত ইতিহাসে বার বার দেখা গেছে যে, উত্তরে কোনো রাজবংশ প্রভূত্ব পেলে দক্ষিণে আধিপত্য লাভের জন্য চেষ্টা চালায়। মৌর্য সাম্রাজ্য, গুপ্ত সাম্রাজ্য, খলজি বংশ ও তুঘলক বংশ-এর আমলে এটা লক্ষ্য করা যায়। দক্ষিণ ছিল উত্তরের সম্রাটদের Manifest Destiny বা অনিবার্য নিয়তি।
- (২) সুতরাং আকবর উত্তর ভারতে সার্বভৌম ক্ষমতা পাওয়ার পর স্বাভাবিক কারণে দক্ষিণে দৃষ্টি দেন। তাছাড়া মালব, গুজরাট ও উড়িষ্যা প্রভৃতি রাজ্যগুলির সঙ্গে দক্ষিণের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক ছিল। দক্ষিণের সঙ্গে এই রাজ্যগুলির সীমান্ত যুদ্ধ চলত।
- (৩) আকবর গুজরাট ও মালব অধিকার করার পর এই কারণে দক্ষিণের ব্যাপারে আগ্রহ বোধ করেন। দক্ষিণের রাজ্যগুলিকে জয় করে এক সর্বভারতীয় সাম্রাজ্য গঠনের স্বপ্নকে তিনি বাস্তব রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেন।
আকবরের আমলে পর্তুগীজ সমস্যা
- (১) দক্ষিণ ভারতে পর্তুগীজদের অনুপ্রবেশ আকবরকে বিশেষভাবে চিন্তিত করে। গুজরাট অভিযানের সময় তিনি সর্বপ্রথম পর্তুগীজদের সংস্পর্শে আসেন। তিনি পর্তুগীজদের নৌশক্তি দেখে বিস্মিত হন। আরব সমুদ্রে ভারতীয় বাণিজ্য জাহাজগুলি তারা লুঠ করত এবং হজ যাত্রীদের আক্রমণ করত।
- (২) পর্তুগীজরা ছিল ধর্মান্ধ। তারা ভারতীয় হিন্দু ও মুসলমানদের জোর করে খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষিত করত। ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দে তারা বিজাপুরের সুলতানকে পরাস্ত করে গোয়া দখল করে এবং বহু নর-নারীকে হত্যা করে।
- (৩) আকবর বুঝতে পারেন যে, পর্তুগীজদের ভারতের মাটি থেকে এখনই বিতাড়ন না করলে পরে আর পারা যাবে না। দক্ষিণের রাজ্যগুলি ছিল দুর্বল ও আত্মরক্ষায় অক্ষম। এজন্য আকবর দক্ষিণে তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তার করে পর্তুগীজদের বহিষ্কারের চেষ্টা করেন।
সম্রাট আকবরের আমলে দক্ষিণে অরাজকতা
- (১) দক্ষিণে এই সময় বাহমনী রাজ্য ভেঙে ৪টি সুলতানি গড়ে ওঠে, যথা, আহমদনগর, বিজাপুর, খাদেশ ও গোলকুন্ডা। এই সুলতানিগুলি ১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দে জোট বেঁধে বিজয়নগর সাম্রাজ্যকে তালিকোটার যুদ্ধে বিধ্বস্ত করে।
- (২) সেই সময় আকবর রাজপুতানা জয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তালিকোটার যুদ্ধের পর দক্ষিণের সুলতানিগুলি অরাজকতা এবং পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শক্তি ক্ষয় করে ফেলে।
- (৩) দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে মাহাদিপন্থী ও শিয়াপন্থী ধর্মোন্মত্ততার ফলে বহু লোক নিহত হয়। বিজাপুর, আহমদনগর প্রভৃতি রাজ্যগুলি শিয়াপন্থীদের কুশাসনের ফলে খুবই দুর্বল হয়ে পড়ে।
আকবরের দাক্ষিনাত্য অভিযান সম্পর্কে ত্রিপাঠির অভিমত
ডঃ আর. এস. ত্রিপাঠীর মতে, “রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা, ধর্মীয় ও জাতিগত উন্মত্তার কুৎসিৎ বিকার এবং বিধর্মীদের নিগ্রহ মুঘল সাম্রাজ্যের দক্ষিণ সীমান্তে ঘটতে থাকায় আকবরের পক্ষে তা নীরবে সহ্য করা কঠিন ছিল।” তাছাড়া মুঘল সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষায় দক্ষিণের রাজ্যগুলি অক্ষম ছিল।
দাক্ষিনাত্যে আকবরের দূত প্রেরণ
আকবর প্রথমে দূত দ্বারা দক্ষিণের সুলতানিগুলিকে (১৫৯১ খ্রি) তার বশ্যতা স্বীকারের জন্য আহ্বান জানান। কিন্তু খান্দেশের সুলতান রাজা আলি খাঁ ছাড়া অন্য সুলতানিগুলি এই প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি। সুতরাং আকবর দক্ষিণে সামরিক অভিযানের সঙ্কল্প নেন।
মুরাদ ও খান-ই-খানানের দাক্ষিনাত্য অভিযান
যুবরাজ মুরাদ ও বৈরাম খাঁর পুত্র আবদুর রহিম-খান-ই-খানানের নেতৃত্বে আকবর একটি বাহিনী আহমদনগরের বিরুদ্ধে পাঠান। ১৫৯৫ খ্রিস্টাব্দে মুঘল বাহিনী আহমদনগর দুর্গ অবরোধ করে। কিন্তু মুরাদ ও খান-ই-খানানের মধ্যে মতভেদের জন্যে মুঘল বাহিনী পুরো সফল হতে পারে নি।
আকবরের সময় আহমদনগরের সাথে সন্ধি
- (১) বিজাপুর ও গোলকুন্ডা থেকে আহমদনগরে মুঘলের বিরুদ্ধে সাহায্য আসার সম্ভাবনা দেখা দেয়। আহমদনগরের নাবালক সুলতানের পক্ষে চাঁদ সুলতানা বিপুল বিক্রমে দুর্গ রক্ষা করেন।
- (২) শেষ পর্যন্ত ১৫৯৬ খ্রিস্টাব্দে এক সন্ধি স্বাক্ষরিত হয়। বাহাদুর শাহকে আহমদনগরের সুলতান হিসেবে মুঘলের পক্ষ থেকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। চাদবিবি ও বাহাদুর শাহ মুঘলের প্রতি বশ্যতা জানান। এবং বেরার প্রদেশ মুঘলকে ছেড়ে দেন।
সম্রাট আকবরের সময় আহমদনগরের পতন
- (১) আহমদনগরের একশ্রেণীর অভিজাত এই সন্ধির ঘোর বিরোধিতা করেন। তারা চাঁদ সুলতানাকে ক্ষমতাচ্যুত করে, বেরার প্রদেশ পুনরায় অধিকারের চেষ্টা করলে, যুবরাজ দানিয়েলের নেতৃত্বে মুঘল বাহিনী দৌলতাবাদ অধিকার করার পর ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে আহমদনগর অধিকার করে।
- (২) চাঁদ সুলতানা আত্মহত্যা করেন। আহমদনগরের সুলতান বাহাদুর নিজাম শাহকে গোয়ালিয়র দুর্গে বন্দী করা হয়। আহমদনগরের অভিজাতরা আরও কিছুকাল বাধাদানের পর শেষ পর্যন্ত মুঘলের বশ্যতা মেনে নেন।
আকবরের আমলে খান্দেশের মুঘল বিরোধিতা
খান্দেশের সুলতান রাজা আলি খাঁ ১৫৯১ খ্রিস্টাব্দে আকবরের আহ্বানে শান্তিপূর্ণভাবে আকবরের প্রতি বশ্যতা জানান। ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে আহমদনগরের যুদ্ধে তিনি মুঘল বাহিনীর হয়ে লড়াই করে প্রাণ দেন। তাঁর পুত্র মীরণ বাহাদুর শাহ পিতার সিংহাসনে বসে মুঘলের প্রতি বশ্যতা তুলে নেন এবং মুঘলের বিরুদ্ধে কাজ করেন।
খান্দেশের বিরুদ্ধে আকবরের অভিযান
আকবর নিজেই খান্দেশের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে বুরহানপুর অধিকার করেন। এর পর দক্ষিণের অন্যতম দুর্ভেদ্য দুর্গ আসিরগড় তিনি অবরোধ করেন। আসিরগড় দুর্গ রক্ষায় পর্তুগীজরা মীরণ বাহাদুরকে সাহায্য করে। মুঘল সেনা বহু চেষ্টায় এই দুর্গ দখলে ব্যর্থ হয়। এদিকে
আকবরের অসিরগড় দুর্গ জয়
- (১) উত্তর ভারতে যুবরাজ সেলিম বিদ্রোহ ঘোষণা করায় আকবর আগ্রায় ফিরে আসার জন্য ব্যস্ত হন। তিনি সন্ধির শর্ত আলোচনার ছলে মীরণ বাহাদুরকে শিবিরে এনে বন্দী করেন। তিনি দুর্গ রক্ষীদের উৎকোচ দিয়ে আসিরগড় ১৬০১ খ্রিস্টাব্দে অধিকার করেন।
- (২) এইভাবে অস্ত্রের পরিবর্তে সোনার চাবিকাঠি দিয়ে আকবর আসিরগড়ের দরজা খুলে ফেলেন। এজন্য ঐতিহাসিক স্মিথ তাঁর নিন্দা করেছেন। আসিরগড়ই ছিল আকবরের রাজ্যজয় নীতির শেষতম ঘটনা। এর পর তিনি তার বিজয়ী তরবারি কোষবদ্ধ করেন।
সম্রাট আকবরের দক্ষিণ অভিযানের চরিত্র
- (১) দক্ষিণের দুই সুলতানি বিজাপুর ও গোলকুণ্ডা আকবর জয় করার চেষ্টা করেন নি। দক্ষিণে তিনি কোনো ধর্মীয় উন্মত্ততা নিয়ে শিয়া রাজ্যগুলিকে আক্রমণ করেন নি। তাঁর দক্ষিণ বিজয় ছিল পুরোপুরি রাজনৈতিক ও সামরিক প্রয়োজনের ফল।
- (২) আকবরের সর্বভারতীয় সাম্রাজ্য স্থাপনের অভিলাষ এবং পর্তুগীজ শক্তির উচ্ছেদ ছিল তাঁর দক্ষিণী অভিযানের প্রধান কারণ। তিনি দক্ষিণের রাজ্যগুলিকে নিয়ে আহমদনগর, বেরার ও খান্দেশ এই তিনটি সুবা গঠন করেন। দাক্ষিণাত্য অভিযানের ফলে তাঁর সাম্রাজ্য কৃষ্ণা নদীর উপত্যকা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।
আকবরের দাক্ষিণাত্য নীতি সম্পর্কে ত্রিপাঠীর মন্তব্য
ডঃ ত্রিপাঠী মন্তব্য করেছেন যে, “আকবরের দাক্ষিণাত্য নীতি কেবলমাত্র তাঁর ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও সাম্রাজ্যবাদী নীতির ফল ছিল না। এই মহান সম্রাটের আলোকিত নীতির ফল ছিল দাক্ষিণাত্য বিজয়।
উপসংহার :- সমগ্র ভারতবর্ষে শান্তি, শৃঙ্খলা স্থাপন, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যগুলির মধ্যে বিবাদ দূর করা ও সমগ্র ভারতে একই প্রকার আইন ও শাসন স্থাপনের আগ্রহ ছিল তার দাক্ষিণাত্য বিজয়ের ফল।
(FAQ) আকবরের দাক্ষিণাত্য নীতি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
সর্বভারতীয় সাম্রাজ্য স্থাপনের অভিলাষ ও পর্তুগীজ শক্তির উচ্ছেদ।
১৫৮০ খ্রিস্টাব্দে।
১৫৯৫ খ্রিস্টাব্দে।
১৬০১ খ্রিস্টাব্দে।
অসিরগড় দুর্গ জয়।