আকবরের বাল্য জীবন

মুঘল সম্রাট আকবরের বাল্য জীবন প্রসঙ্গে রাজকীয় আতিথ্য, আকবরের জন্মের সুসংবাদ, হুমায়ুনের প্রার্থনায় আকবরের খ্যাতি, চরম দুঃখের বাল্যজীবন, কান্দাহারে আকবর, কাবুলে আকবর, জনসমক্ষে আকবর, ধাত্রীমাতাদের কাছে লালিত পালিত, শিক্ষা ও সমরবিদ্যায় পারদর্শিতা সম্পর্কে জানবো।

মুঘল সম্রাট আকবরের বাল্য জীবন

বিষয়আকবরের বাল্যজীবন
রাজ্যাভিষেক১৫৫৬ খ্রি
রাজত্বকাল১৫৫৬-১৬০৫ খ্রি
পূর্বসূরিহুমায়ুন
উত্তরসূরিজাহাঙ্গীর
মুঘল সম্রাট আকবরের বাল্য জীবন

ভূমিকা :- ১৫৪২ খ্রিস্টাব্দের ১৫ অক্টোবর মধ্যযুগের ভারত ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নরপতি হ্যাভেল যাঁকে “Indian of Indians” বলে অভিহিত করেছেন, সেই মহামতি আকবর সিন্ধুপ্রদেশের অন্তর্গত অমরকোটের রাজা রানা বীরসলের গৃহে আশ্রিতা হুমায়ুন পত্নী হামিদাবানুর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন।

রাজকীয় আতিথ্য

আকবরের পিতা-মাতা শের শাহ কর্তৃক দিল্লির সিংহাসনচ্যুত হয়ে আশ্রয়ের জন্য যখন দেশ-দেশান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, তখনই অমরকোটের রাজা বীরসল হুমায়ুনকে থাট্টা ও ভাক্কার অভিযানে সবিশেষ সাহায্য করবেন এই আশ্বাস দিয়ে হুমায়ুনকে তাঁর প্রাসাদে রাজকীয় আতিথ্য গ্রহণের সুযোগ করে দেন।

আকবরের জন্মের সুসংবাদ

  • (১) হুমায়ুন ১৫৪২ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে থাট্টা ও ভাক্কারের দিকে অগ্রসর হন। পথিমধ্যে তার্দি বেগ খান হুমায়ুনকে তাঁর পুত্রের জন্মের আনন্দ সংবাদটি এনে দেন।
  • (২) হুমায়ুনের তখন এমনই দুঃসময় চলছিল, যার জন্য তাঁর পুত্রের জন্মের সুসংবাদে কোনো আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থা করা, কিংবা তাঁর সঙ্গীদের কোনো পুরস্কার দিতেও তিনি অক্ষম হন। তখন তিনি একটি কস্তুরী বা মৃগনাভি কেটে কেটে সঙ্গীদের বিতরণ করেন।
  • (৩) এই সময় তিনি বলেন, “আমার আজ আপনাদের দেওয়ার মতো কিছুই নেই। কিন্তু আমার বিশ্বাস এই কস্তুরীর সৌগন্ধ যেমন তাঁবুর মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে, একদিন আমার পুত্রের যশ ও খ্যাতিও এই কস্তুরীর সৌগন্ধের মতো সমগ্র দেশব্যাপী বিস্তৃত হবে।”

হুমায়ুনের প্রার্থনায় আকবরের খ্যাতি

সত্যিই এখানে উল্লেখ্য, বাবর -এর মতো পিতৃপ্রার্থনায় হুমায়ুন যেমন জীবন ফিরে পেয়েছিলেন, হুমায়ুনের মতো পিতৃপ্রার্থনায় আকবরও তেমন তাঁর যশ ও খ্যাতি শুধুমাত্র ভারতবর্ষে নয়, সমগ্র বিশ্বে বিস্তৃত করতে সমর্থ হয়েছিলেন।

চরম দুঃখের আকবরের বাল্য জীবন

  • (১) আকবরের বাল্য জীবন চরম দুঃখকষ্টের মধ্যে অতিবাহিত হয়। থাট্টা ও ভাক্কার অভিযানে তাঁর পিতা হুমায়ুন সামান্যই সফল হন। হুমায়ুনের সভাসদদের ভুলের জন্য সহৃদয় অমরকোটের রাজা রানা বীরসলের সঙ্গে তাঁর দ্বন্দ্ব শুরু হয়।
  • (২) এর ফলে ১৫৪২ খ্রিস্টাব্দের ৮ ডিসেম্বর হামিদা বানু ও আকবরকে বীরসলের প্রাসাদ থেকে নিয়ে আসা হয় অমরকোট থেকে ৭৫ মাইল দূরে, যেখানে হুমায়ুন অবস্থান করছিলেন সেই জুন নামক শহরে।

পারস্যের উদ্দেশ্যে হুমায়ুনের যাত্রা

  • (১) প্রায় ছ’মাসের বেশি সময় সিন্ধু বিজয়ের ব্যর্থ চেষ্টা করে অবশেষে হুমায়ুন পারস্যরাজ শাহ তাহমাস্প এর সাহায্যের প্রত্যাশায় পারস্যের দিকে যাত্রা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
  • (২) হুমায়ুন পারস্যের উদ্দেশ্যে যখন কুয়েতার দক্ষিণে অবস্থিত মুডাজ-এ পৌঁছোন, তখন তিনি সংবাদ পান, তাঁর ভ্রাতা আসকরী তাঁদের আক্রমণের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছেন। আসকরীকে বাধা দেওয়ার মতো ক্ষমতা তখন ছিল না।

কান্দাহারে বালক আকবর

স্বভাবতই হুমায়ুন হামিদবানুকে একটি ঘোড়ায় চাপিয়ে শিশুপুত্র আকবরকে আসকরীর কাছে ফেলে রেখে পারস্যের রাজদরবারে উপস্থিত হন। আসকরী শিশুপুত্র আকবরকে কান্দাহারে নিয়ে আসেন এবং তাঁর স্ত্রীর অতি যত্নে আকবর বড়ো হতে থাকেন।

কাবুলে শিশু আকবর

  • (১) ইত্যবসরে হুমায়ুন পারস্যরাজের সাহায্য নিয়ে ১৫৪৫ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে তাঁর ভাই আসকরীর কাছ থেকে কান্দাহার এবং ১৫৪৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ নভেম্বর তাঁর ভাই কামরানের কাছ থেকে কাবুল দখল করেন।
  • (২) কাবুল দখলের সঙ্গে সঙ্গে ১৫৪৪-৪৫ খ্রিস্টাব্দের শীতকালে শিশুপুত্র আকবরকে কান্দাহার থেকে কাবুলে আনা হয়েছিল। স্বভাবতই হুমায়ুন কাবুলে আকবরকে ফিরে পান তখন আকবরের বয়স মাত্র তিন বছর। আবুল ফজল-এর মতে, আকবর তাঁর মাতা হামিদবানুকে দেখেই চিনতে পারেন এবং তাঁর কোলে লাফিয়ে উঠে পড়েন।

জনসমক্ষে বালক আকবর

১৫৪৫ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে আকবরকে জনসমক্ষে প্রথম দেখা যায় ‘সুন্নত’ অনুষ্ঠানে। ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথের মতে, উক্ত অনুষ্ঠানেই আকবরের জন্মের সময় দেওয়া নাম বদরউদ্দিনের পরিবর্তে ‘জালালউদ্দিন মহম্মদ আকবর’ নামকরণ করা হয়।

ধাত্রীমাতাদের কাছে লালিত পালিত শিশু আকবর

  • (১) তৎকালীন রীতি অনুযায়ী রাজপুত্ররা যেভাবে মানুষ হতেন, আকবরও সেইভাবে ধাত্রীমাতাদের কাছে লালিত-পালিত হতে থাকেন। এই ধাত্রীমাতাদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিলেন মাহম আনগা।
  • (২) এই মাহম আনগার স্বামী সামসউদ্দিন ১৫৪০ খ্রিস্টাব্দের কনৌজের যুদ্ধ-এর পর হুমায়ুনের জীবনরক্ষা করেছিলেন। হুমায়ুন তারই কৃতজ্ঞতাস্বরূপ সামসউদ্দিনকে ‘আগা খান’ উপাধিতে ভূষিত করেন।
  • (৩) মাহম আনাগা ছিলেন ধাত্রীমাতাদের প্রধান এবং তাঁর পুত্র ছিলেন কুখ্যাত আদন খান। এই সময় ভ্রাতাদের আচরণে হুমায়ুনের নিজের জীবন যেমন অনিশ্চিত ছিল, ঠিক তেমনই শিশুপুত্র আকবরের জীবনেরও কোনো স্থায়ী ঠিকানা ছিল না।

বালক আকবরের শিক্ষা

  • (১) ১৫৪৭ খ্রিস্টাব্দে পাঁচ বছর বয়সে আকবরের উপযুক্ত শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। একের পর এক শিক্ষক নিয়োগ করা হয়, কিন্তু তাঁরা সকলেই আকবরকে লেখাতে ও অক্ষর পরিচয় করাতে ব্যর্থ হন।
  • (২) আকবর লেখাপড়ার চেয়ে খেলাধুলা ভালোবাসতেন এবং বিভিন্ন জীবজন্তু বিশেষ করে উট, ঘোড়া, কুকুর ও পায়রা ভালোবাসতেন। বাল্যকাল থেকেই তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল অসাধারণ, কিন্তু বসে অক্ষর পরিচয় করার মতো ধৈর্য তাঁর ছিল না।

সমর বিদ্যায় পারদর্শী আকবর

তিনি অল্পবয়স থেকেই ঘোড়ায় চড়া ও অস্ত্রবিদ্যায় তীক্ষ্ণ পারদর্শী হয়ে ওঠেন। হুমায়ুনের মতো বিদ্বান পিতার পক্ষেও পুত্র আকবরকে লেখাপড়ার প্রতি মনোযোগী করে তোলা সম্ভব হয় নি।

গজনির নামমাত্র শাসক আকবর

  • (১) ১৫৫১ খ্রিস্টাব্দে হুমায়ুনের অপর ভ্রাতা হিন্দালের মৃত্যু হলে, আকবরকে আনুষ্ঠানিকভাবে গজনির শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হয় এবং হিন্দালের কন্যা রুকিয়া বেগমের সঙ্গে আকবরের বিবাহ দেওয়া হয়।
  • (২) হুমায়ূন যখন ভারতবর্ষ পুনরুদ্ধারের জন্য অভিযান করেন তখন পর্যন্ত অর্থাৎ ১৫৫৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত আকবর গজনির নামমাত্র শাসক ছিলেন।

আকবরের অভিভাবক মুনিম খান

হুমায়ুন ভারতবর্ষ পুনরুদ্ধারের জন্য অভিযান করার সময় মুনিম খানকে আকবরের ‘অভিভাবক’ নিযুক্ত করে যান।

সিরহিন্দের যুদ্ধ

শের শাহের এক ভাইপো সিকন্দার শূর যিনি দিল্লির সিংহাসনের দাবিদার ছিলেন তিনি ১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দের ২২ জানুয়ারি সিরহিন্দের যুদ্ধে পরাজিত হন এবং আকবর বিজয়ীর মর্যাদা পান। অতঃপর আকবর আনুষ্ঠানিকভাবে সাম্রাজ্য-এর উত্তরাধিকারী হিসেবে ঘোষিত হন।

লাহোরের শাসক আকবর

এই ঘটনার কয়েক মাসের মধ্যেই হুমায়ুন দিল্লির সিংহাসন পুনরুদ্ধার করলে, আকবরকে লাহোরের শাসক নিযুক্ত করা হয়।

আকবরের অভিভাবক বৈরাম খাঁ

হুমায়ুনের বিশ্বস্ত বিখ্যাত কূটনীতিবিদ ও প্রতিভাসম্পন্ন দক্ষ সৈনিক বৈরাম খাঁকে মুনিম খানের স্থলে আকবরের অভিভাবক নিযুক্ত করা হয়। আকবরের তখন বয়স মাত্র তেরো বছর।

হুমায়ুনের মৃত্যু

১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২৭ জানুয়ারি হুমায়ূন দিল্লিতে শেরমণ্ডলে অবস্থিত তাঁর পাঠাগার থেকে মসজিদের আজানের শব্দ শুনে তাড়াতাড়ি সন্ধ্যাকালীন প্রার্থনায় যোগদানের জন্য নামতে গিয়ে সিঁড়ি থেকে পা পিছলে পড়ে যান এবং তারই ফলে তাঁর মৃত্যু ঘটে।

বদায়ুনির মন্তব্য

ঐতিহাসিক বদায়ুনীর কাছ থেকে জানা যায় যে, বিনা বাধায় আকবরের সিংহাসনে আরোহণ সুনিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে হুমায়ুনের মৃত্যুসংবাদ বৈরাম খান গোপন রাখেন।

তুর্কি নৌ অধ্যক্ষের বর্ণনা

তুর্কি নৌ-অধ্যক্ষ সিদি আলি রইস তখন সৌভাগ্যবশত দিল্লিতে উপস্থিত ছিলেন। তাঁর কাছ থেকে জানা যায়, হুমায়ুনের মতো দেখতে এক ব্যক্তিকে সাজিয়ে জনসমক্ষে হাজির করে আশ্বস্ত করা হয় যে, হুমায়ুন আরোগ্য লাভ করেছেন।

আনুষ্ঠানিক ভাবে হুমায়ুনের মৃত্যু ঘোষণা

১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১১ ফেব্রুয়ারি হুমায়ুনের মৃত্যুসংবাদ জনসমক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয় এবং দিল্লিতে আকবরের নামে ‘খুতবা’ পাঠ করা হয়। আকবর তখন পাঞ্জাবে সিকন্দার শূরের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ব্যস্ত ছিলেন।

উপসংহার :- আকবরের কাছে হুমায়ুনের মৃত্যু সংবাদ পৌঁছোলে অভিভাবক বৈরাম খান তৎক্ষণাৎ সিরহিন্দ দুর্গ -এ একটি ইটের মঞ্চ তৈরি করেন। ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি সেই মঞ্চে আকবরের সিংহাসনে আরোহণের অভিষেক ক্রিয়া সম্পন্ন করেন। তখন আকবরের বয়স তেরো বছর চার মাস।

(FAQ) মুঘল সম্রাট আকবরের বাল্য জীবন সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. আকবরের জন্ম কোথায় হয়?

অমরকোটে।

২. আকবরের জন্ম কখন হয়?

১৫৪২ খ্রিস্টাব্দের ১৫ অক্টোবর।

৩. আকবরকে “Indian of Indians” কে বলেছেন?

ঐতিহাসিক হ্যাভেল।

৪. আকবরের পিতা-মাতা কে ছিলেন?

হুমায়ুন, হামিদাবানু।

Leave a Comment