হেরোডোটাস

“ইতিহাসের জনক” নামে পরিচিত হেরোডোটাস (৪৮৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ – ৪২৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) একজন প্রাচীন গ্রীক ইতিহাসবিদ। তিনি তাঁর গ্রন্থ Histories এ পারস্য যুদ্ধ এবং বিভিন্ন প্রাচীন সভ্যতা সম্পর্কে বিশদ বিবরণ প্রদান করেছেন। হেরোডোটাস তাঁর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা এবং বিভিন্ন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ করেছেন, যা পরবর্তীকালে ইতিহাস চর্চার ভিত্তি স্থাপন করেছে।

ইতিহাসের জনক হেরোডোটাস

ঐতিহাসিক চরিত্রহেরোডোটাস
জন্মআনুমানিক ৪৮৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ
জন্মস্থানহালিকারনাসাস, এশিয়া মাইনর (বর্তমান তুরস্ক)
পেশাইতিহাসবিদ, লেখক
বিখ্যাত রচনাHistories
উপাধি“ইতিহাসের জনক”
ভাষাপ্রাচীন গ্রীক
ইতিহাসচর্চার বিষয়পারস্য যুদ্ধ, বিভিন্ন প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতি
প্রভাবইতিহাস চর্চার প্রাথমিক ভিত্তি স্থাপন
মৃত্যুআনুমানিক ৪২৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ
হেরোডোটাস

ভূমিকা :- ইউরোপ-এর কাব্য-ইতিহাসে হোমার যেমন প্রথম মহাকবি, তেমনি গদ্যরচনার ক্ষেত্রে প্রথম ব্যক্তিত্ব হলেন হেরোডোটাস। তাঁর মহান সৃষ্টি যুগ যুগ ধরে প্রেরণা জুগিয়ে চলেছে পরবর্তী লেখকদের। শ্রেষ্ঠ রচনার একটা মান নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন হেরোডোটাস। গদ্য সাহিত্যের যেমন তেমনি হেরোডোটাসকে বলা হয় ইতিহাসেরও জনক। ইউরোপের ইতিহাসের সূচনা হয়েছিল তাঁরই হাতে। প্রাচীন ঘটনাবলী ফিরছিল লোকের মুখে মুখে। সেই সব কাহিনী যাতে মহাকালের গর্ভে চিরতরে হারিয়ে না যায় সেই কারণে সে সব সংগ্রহ করে হেরোডোটাস রচনা করেছেন তাঁর ইতিহাস গ্রন্থ। গ্রীক আর বর্বর জাতিগুলির মধ্যে যে সব যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, যুদ্ধের কারণ নির্ধারণ করেছিল যেসব উল্লেখযোগ্য ঘটনা-সমস্তই দীর্ঘ গবেষণার মধ্য দিয়ে তিনি প্রন্থবদ্ধ করেছেন। বিগতকালের বিলীয়মান ঘটনাবলী সযত্বে সংগ্রহ করে সাজিয়ে যিনি রচনা করেছিলেন ইতিহাস, সেই ইতিহাস-পুরুষ হেরোডোটাসের নিজের জীবনকাহিনী কিন্তু হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে। মহাকালের কী বিচিত্র পরিহাস।

ঐতিহাসিক হেরোডোটাসের জন্ম

হেরোডোটাসের জন্ম সাল নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদের নিষ্পত্তি হয় নি আজও। কারোর মতে সময়টা ৪৮৪ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ। কেউ বলেন ৪৮০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ। তবে জন্মস্থান নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। হেরোডোটাস জন্মেছিলেন এশিয়া মাইনরের দক্ষিণ-পশ্চিমে কাবিয়ার প্রসিদ্ধ নগরী হেলিকারনাসসে। রানী আর্টেমিসিয়া তখন রাজত্ব করতেন সেখানে।

হেরোডোটাসের যুবা বয়সে রানী আর্টেমিসিয়া

শৌর্য ও বীরত্বের জন্য রানী আর্টেমিসিয়া সেই কালে সকলের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করেছিলেন। তিনি সালামিসের বিখ্যাত জলযুদ্ধে জেরেক্সের জন্য লড়াই করে বিজয়িনী হয়েছিলেন। হেরোডোটাসের যখন যুবা বয়স সেই সময় হেলিকারনাসাস নগরের শাসন ভার ছিল রানীর নাতি কুখ্যাত লিগডামিসের ওপর। প্রজানিপীড়নের জন্য এই শাসক অর্জন করেছিলেন কুখ্যাতি। সেই সময় এই দেশের অধিপতি ছিলেন পারস্যের মহান রাজা আর্টাক্সেরক্স।

ঐতিহাসিক হেরোডোটাসের কাকা পানিয়াসিস

অত্যাচারী লিগডামিসের উৎপীড়নে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল প্রজা সাধারণ। পারস্য অধিপতির অধীনতা মুক্ত হয়ে, অত্যাচারী শাসককে দলিত করে গ্রীক নগরের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে গড়ে উঠেছিল এক গোপন বিপ্লবী দল। সেই দলের প্রধান নেতা ছিলেন হেরোডোটাসের কাকা পানিয়াসিস। তিনি সুখ্যাত হয়েছিলেন মহাকাব্য রচনা করেও। গুপ্তচরদের মাধ্যমে খবর সংগ্রহ করে বিপ্লবীদলের কর্মোদ্যোগ বন্ধ করতে উদ্যোগী হলেন লিগডামিস। পানিয়াসিসকে অবিলম্বে বন্দী করলেন তিনি এবং তাঁকে দিলেন মৃত্যুদণ্ড।

সামোসে হেরোডোটাস

এই ঘটনার ফলে অনিবার্যভাবেই রাজনৈতিক সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লেন হেরোডোটাস। ফলে তাঁকেও দেশ ছেড়ে পালাতে হল। তিনি আশ্রয় নিলেন সামোসে। নির্বাসনের দিনগুলো খুব সুখকর ছিল না তাঁর। তবু দীর্ঘ সাত বছর তাঁকে সেখানেই থাকতে হয়েছিল। এই সময়ের মধ্যে তিনি শিখে নিলেন আইওনিয়া প্রদেশের ভাষা। পরবর্তীকালে এই ভাষাতেই তিনি লিখেছেন তাঁর ইতিহাসগ্রন্থ। মহাকালের ইতিহাসে হেরোডোটাসের স্বেচ্ছা-নির্বাসনের ঘটনাটি হয়তো কোনো গুরুত্বই পেত না কোনো দিন যদি না তিনি ইতিহাস রচনার কাজে হাত দিতেন। আর নির্বাসনে না এলে ইতিহাস রচনার প্রেরণাও তাঁর মধ্যে কোনো দিন জাগত না। সেই কারণে অত্যাচারী লিগডামিসের সঙ্গে হেরোডোটাসের রাজনৈতিক সংঘর্ষ ও তাঁর নির্বাসিত জীবন মানবজাতির ইতিহাসে বিশেষ দিকচিহ্ন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে।

উদ্যমী পুরুষ হেরোডোটাস

সামোসে আসার পর নিষ্ক্রিয় বসে থাকেন নি হেরোডোটাস। উদ্যমী পুরুষ ছিলেন তিনি। পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ছিল জন্মগত। তাই কোনো নির্দিষ্ট কাজে এক জায়গায় আবদ্ধ থাকেন নি তিনি। কর্মান্তরের সঙ্গে ঘোরাঘুরি করেছেন স্থানান্তরে। এক দেশ থেকে আরেক দেশে ঘুরেছেন, সেখানকার জনজীবনের সঙ্গে মিশেছেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতির খোঁজখবর নিয়েছেন।

দেশের প্রাচীন ইতিবৃত্তের প্রতি হেরোডোটাসের আকর্ষণ

এই পর্যটক জীবনেই তাঁর দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় দেশের প্রাচীন ইতিবৃত্তের প্রতি। যত্নের সঙ্গে সেসব তিনি সংগ্রহ করেছেন, প্রথিত করেছেন তাঁর ইতিহাস গ্রন্থে। গোটা গ্রীক সাম্রাজ্যই পরিভ্রমণ করেছিলেন তিনি। মিশর-এর প্রাচুর্য ও সম্পদ, তার জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পচর্চার বৈচিত্রা তাঁকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করেছিল।

পেরিক্লিসের সঙ্গে হেরোডোটাসের সাক্ষাৎ

হোরোডোটাস এথেন্সও পরিভ্রমণ করেছিলেন। শোনা যায়, পেরিক্লিসের সঙ্গেও তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল। এখানেই ৪৪৬ খ্রিঃ পূঃ এথেন্সের নগর সমাজে তিনি প্রথম তাঁর ইতিহাস পড়ে শোনান এবং পুরস্কার হিসেবে তাঁকে দেওয়া হয় দশটি মুদ্রা।

ঐতিহাসিক হেরোডোটাসের লিপিবদ্ধ বিবরণ

প্রচলিত পুরাতন কাহিনীগুলো যা তিনি তাঁর ইতিহাস গ্রন্থে বিবৃত করেছিলেন, সবই সংগ্রহ করেছিলেন প্রাচীন মানুষদের কাছ থেকে। প্রতিটি কাহিনীই তিনি যুক্তি দিয়ে বিচার করে যথার্থতা নিরূপণ করতেন। সতর্কভাবে বিচারবিশ্লেষণ না করে কোনো বিষয়ই লিপিবদ্ধ করতেন না তিনি। তাঁর এই ইতিহাস চর্চা ছিল গভীর গবেষণার নামান্তর।

হেরোডোটাসের সময় ইস্টরি শব্দ

বস্তুতঃ গবেষণা ও সত্যাসত্য নিরূপণ এই দুটি বিষয়কে বোঝাবার জন্যই হেরোডোটাসের সময়ে গ্রীক ভাষায় একটি শব্দ প্রচলিত হয়েছিল। তা হল ইস্টরি। এই ইস্টরি শব্দ থেকেই গবেষণালব্ধ পুরাকাহিনী বা ইতিহাসের ইংরাজি প্রতিশব্দ তৈরি হয়েছে হিস্টরি।

ঐতিহাসিক হেরোডোটাসের গ্রন্থে গ্রিসের গৌরব গাথা

হেরোডোটাসের গ্রন্থে প্রধানত স্থান পেয়েছে প্রাচীন গ্রিস-এর গৌরব গাথাগুলি। গ্রীকদের সঙ্গে যুক্ত নয় এমন কীর্তি-কাহিনীও তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন। গ্রীক এবং পারস্য সম্রাটদের বিভিন্ন সময়ের সংঘর্ষের ইতিবৃত্তের নির্ভরযোগ্য বিবরণ তাঁর ইতিহাস গ্রন্থ থেকেই পাওয়া যায়। বলাবাহুল্য এই সব ঘটনার উৎস যে রাজনীতি বা অর্থনৈতিক চাহিদা, তা তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। বৃহৎ ঘটনা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের বিবরণের পাশাপাশি ছোটখাট চরিত্র বা ঘটনার কৌতূহলোদ্দীপক দিকগুলিও তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন। ফলে পুরাকাহিনীগুলির সঙ্গে সমাজ ও জনজীবনের চিত্রও নির্ভরযোগ্য ভাবে পাওয়া সম্ভব হয়েছে।

নয় খন্ডে বিভক্ত হেরোডোটাসের গ্রন্থ

হেরোডোটাসের ইতিহাস গ্রন্থ নটি খণ্ডে বিভক্ত। প্রতি খণ্ডের নামকরণ হয়েছে নয় জন দেবীর নামে। অবশ্য হেরোডোটাস নিজে তাঁর রচনার এই বিভাগীকরণ বা নামকরণ করে যান নি। কাজটি করেছিলেন আলেকজান্দ্রিয়ার এক বিশিষ্ট পণ্ডিত ব্যক্তি। তিনিই গ্রন্থটি সম্পাদনা করেছিলেন।

এথেন্সে হেরোডোটাস

সামোসে সাত-আট বছর ছিলেন হেরোডোটাস। অত্যাচারী লিগডামিসের পতন হলে তিনি আবার হেলিকারনাসাসে ফিরে আসেন। হেলিকারনাসাস তখন নতুন শাসক গোষ্ঠীর অধীন। দুর্ভাগ্যের বিষয় তাদের সঙ্গেও তিনি মানিয়ে চলতে পারেন নি। ফলে তাঁকে আবার দেশ ছাড়তে হল। তিনি এলেন এথেন্সে। সেই সময় এথেন্স মহানগরী বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র রূপে স্বীকৃত। বিশিষ্ট জ্ঞানী-গুণীর সমাবেশ এখানে। হেরোডোটাস পাকাপাকিভাবে এথেন্সেই বসবাস শুরু করলেন। বিখ্যাত নাট্যকার সফোক্লিসের সঙ্গে এখানেই বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে তাঁর। সম্ভবতঃ পেরিক্লিসের সঙ্গেও তাঁর পরিচয় হয়েছিল।

হেরোডোটাসের প্রথম ইতিহাস পাঠ

সমকালীন পণ্ডিতদের সমক্ষে এথেন্সেই হেরোডোটাস প্রথম তাঁর ইতিহাস পাঠ করেন। শোনা যায়, অলিম্পিক ক্রীড়ার সময় তাঁর গ্রন্থ পড়ে শোনানো হয়েছিল।

পর্যটক হেরোডোটাস

(১) ইতিহাসের নেশায় হেরোডোটাস এবারে পুরোপুরি পর্যটকের জীবন গ্রহণ করেন। এথেন্সকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি। যেখানেই গেছেন সেখানেই সন্ধান করেছেন ইতিহাসের নানা তথ্য, উপাদান। শুনেছেন, জেনেছেন, বিচার-বিশ্লেষণের পরে সেসব লিপিবদ্ধ করেছেন।

(২) সেকালে একস্থান থেকে অন্যস্থানে ভ্রমণ বা পর্যটন ব্যবস্থা মোটেই নিরাপদ ছিল না। দস্যু-তস্করের ভয় ছিল সর্বত্র। তাছাড়া পথ ছিল দুর্গম। এই সমস্ত কিছু অগ্রাহ্য করে ইতিহাসের উপাদান সংগ্রহ করেছেন তিনি তাঁর উত্তরপুরুষদের কথা ভেবে।

(৩) মিশরের দক্ষিণাঞ্চলেও পরিভ্রমণ করেছেন তিনি। পারস্যের আবাদান অঞ্চলে লুসা এবং একবাটানা নগরেও গেছেন তিনি ব্যাবিলন হয়ে। ক্রিমিয়া এবং বর্তমান জর্জিয়া অঞ্চল ছাড়াও সমগ্র সিরিয়া উপকূল অঞ্চল তিনি জলপথে পরিভ্রমণ করেন। লিবিয়া, এপিরাস, থেসালি, অ্যাটিকা, পিলোপনিজ গ্রাঁসের সমস্ত প্রান্তেই ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি।

(৪) কেবল ইতিহাসের উপাদান সংগ্রহের জন্য হেরোডোটাসই প্রথম এমন ব্যাপক ভ্রমণ করেছেন। সংগৃহীত প্রতিটি বিবরণ বা তথ্য তিনি বিভিন্ন ভাবে যাচাই করার পর লিপিবদ্ধ করেন। এবিষয়ে তাঁর নিষ্ঠা ছিল অসাধারণ। তাঁর দ্বিতীয় গ্রন্থে তিনি নিজেই উল্লেখ করেছেন, একটি মাত্র তথ্য যাচাই করার জন্যই তাঁকে যেতে হয়েছিল সুদূর টাইরেতে।

থুরি নগরে হেরোডোটাস

ইতালির দক্ষিণ প্রান্তে ৪৪৪ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে এথেন্স নতুন উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। পত্তন হয়েছিল নতুন নগর থুরির। দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা বসবাস করেছেন সেখানে। এথেন্সের সুবিখ্যাত বাগ্মী লাইসিয়াস এখানে ছিলেন। হেরোডোটাসও বসবাস করেছেন এই নগরে। তিনি এথেন্সে এসেছিলেন ১৩২ খ্রিঃ-পূর্বাব্দে।

হেরোডোটাস সম্পর্কে গিলবার্ট-এর মন্তব্য

গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডোটাসের জীবন ও কর্মকৃতিত্বের বিশ্লেষণ করে অধ্যাপক গিলবার্ট বলেছেন, দেশ ছেড়ে কথকতার বৃত্তি নিয়ে পুরোপুরি পর্যটকের জীবন যাপন করেছেন তিনি। চারণদের কবিতার ভাষার বদলে গদ্য ভাষাকে আশ্রয় করে তিনি স্থান থেকে স্থানান্তরে মানুষকে শুনিয়েছেন নতুন নতুন স্থান, সংস্কৃতি ও জনজীবনের নানা কাহিনী। তাঁর ভাষা ও কথন ভঙ্গী ছিল এমনই মনোহারিণী যে কেউ তা না শুনে পারত না।

হেরোডোটাসের রচনায় গ্রীস ও পারস্যের সংগ্রামের কাহিনী

গ্রীস ও পারস্যের মধ্যের সংগ্রামের কাহিনী শোনাতে গিয়ে তিনি তুলে ধরেছেন মানুষের সত্যকার পরিচয়। যেমন মন্দ দিকের আলোচনা করেছেন, তেমনি একজন মানুষের চরিত্রের ভাল দিকগুলির চুলচেরা বিশ্লেষণ তিনি করেছেন। আলোচনা বা সমালোচনা যাই তিনি করেছেন, সবকিছুর মধ্যেই রয়েছে হৃদয়ের উত্তাপের স্পর্শ। নিছকই সমালোচনায় বিদ্ধ করেন নি তিনি কাউকে।

বিচিত্র বিষয়ের সমাহার হেরোডোটাসের ইতিহাস

হেরোডোটাসের ইতিহাস হল বিচিত্র বিষয়ের সমাহার। আধুনিক ইতিহাস-এর সংজ্ঞা মেনে তাঁর গ্রন্থবদ্ধ বিষয় নিছকই ইতিহাস মাত্র নয়। তাঁর গ্রন্থে যেমন রয়েছে বিভিন্ন স্থানের ভৌগোলিক বিবরণ, তেমনি রয়েছে পুরাকাহিনী, লোককথা, গীতিকাহিনী, বিজ্ঞান বিষয়ের আলোচনা এবং প্রচলিত জনশ্রুতি সহ নতুন নতুন গল্প। বৈজ্ঞানিক গবেষকের দৃষ্টি দিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করে প্রতিটি বিষয়ের সত্যতা যাচাই করার চেষ্টা করেছেন হেরোডোটাস এবং নিঃসন্দেহ হবার পর লিপিবদ্ধ করেছেন। তথাপি, বহু বিষয়ের পাশাপাশি সমাবেশ হেতু অনেক সময় তাদের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। অভিযোগ তোলা হয়েছে অতিরঞ্জনের।

ঐতিহাসিক হেরোডোটাসের সংগৃহীত তথ্যের দুটি ধারা

গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডোটাসের সংগৃহীত তথ্যের ছিল দুটি ধারা। প্রথমটি হল তিনি নিজের চোখে দেখে, গবেষণার ভিত্তিতে যা লিপিবদ্ধ করেছেন। অপরটি হল, জনশ্রুতি থেকে প্রাপ্ত তথ্য। তাঁর দ্বিতীয় গ্রন্থে মিশর সম্পর্কে কিংবদন্তি গুলো লিপিবদ্ধ করার সময় তাঁর লেখার এই বিভাজন সম্পর্কে স্পষ্ট উক্তি করেছেন। হেরোডোটাস উল্লেখ করতে ভোলেন নি যে, জনরব থেকে যা কিছু তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন, সেখানে তাঁর নিজস্ব কোনো মতামত নেই, উল্লিখিত সব বিষয়েই যে তাঁর বিশ্বাস রয়েছে, এমন ভাবাও ঠিক হবে না।

হেরোডোটাসের দুর্বলতা

বস্তুতঃ প্রকৃত ঐতিহাসিকের নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গী নিয়েই হেরোডোটাস সমস্ত বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তবে একটা বিষয়ে তাঁর দুর্বলতা স্পষ্ট ধরা পড়েছে তাঁর রচনার সর্বত্র। যখনই ভালো কিছু ঘটেছে, তাকেই তিনি দেবীকৃপা বলে বর্ণনা করেছেন। এই সূত্রে অনেক সমালোচক এই বলেও হেরোডোটাসের বিরুদ্ধে অভিযোগ উচ্চারণ করেছেন যে, নানা কাহিনীর মধ্যে দিয়ে তিনি নীতিকথা প্রচার করতে চেয়েছেন। তবে এটা অস্বীকার করা চলে না যে, কোনো কোনো কাহিনীকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্যই তিনি সচেতন ভাবে নীতিকথার অবতারণা করেছেন। কোনো ধর্মীয় তত্ত্ব বা নীতিবাণী প্রচারের কোনো উদ্দেশ্য তাঁর ছিল না। একথা নিঃসংশয়ে বলা যায়।

কুমিরের প্রকৃতি সম্পর্কে হেরোডোটাসের বর্ণনা

  • (১) হেরোডোটাসের পর্যবেক্ষণ শক্তি ছিল অত্যন্ত তীক্ষ্ণ। কুমিরের প্রকৃতি সম্পর্কে তিনি তাঁর দ্বিতীয় গ্রন্থে যে বর্ণনা দিয়েছেন তা থেকেই বোঝা যায় কোনো একটি জিনিসকে কত গভীরভাবে তিনি লক্ষ্য করতেন। তিনি লিখেছেন শীতকালের চার মাস কুমিরকে খাদ্য গ্রহণ করতে দেখা যায় না। এদের পা চারটি কিন্তু এরা উভচর। ডিম পাড়ে জমিতে এবং সেখানেই ডিমে তা দেয়। দিনের বেশীর ভাগ সময় এরা থাকে ডাঙায়। কিন্তু রাত কাটায় জলের মধ্যে। কারণ হল, রাতে বাতাস বা শিশিরের চেয়ে জল অনেক গরম।
  • (২) আমাদের পরিচিত সমস্ত কিছুরই জন্মের সময় আকৃতি থাকে ছোট্ট, তারপর তারা ধীরে ধীরে পূর্ণ আকৃতি লাভ করে। কুমিরের বেলাও একই ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। প্রথম অবস্থায় তাদের ডিমগুলি থাকে হাঁসের ডিমের চেয়ে সামান্য বড়। সেই ডিমের আকারের বাচ্চাই তা থেকে বের হয়। তারপর ধীরে ধীরে তারা পূর্ণ আকৃতি লাভ করে।তাদের চোখ শুয়োরের মতো, দাঁত বড় বড়। মুখমণ্ডল শরীরের তুলনায় লম্বা।
  • (৩) প্রাণীদের মধ্যে কুমিরই একমাত্র ব্যতিক্রম যার কোনো জিভ থাকে না এবং তাদের নিচের চোয়ালও নাড়তে পারে না। তবে নিচের চোয়ালটা স্বচ্ছন্দেই এরা নিচে নিয়ে আসতে পারে যা অন্য প্রাণীরা পারে না। জলে যখন থাকে কুমিরেরা প্রায় অন্ধের মতোই কিছু দেখতে পায় না। কিন্তু ডাঙায় তাদের দৃষ্টি অত্যন্ত ধারাল। দিন রাতের বেশির ভাগ সময়টা জলে থাকে বলে তাদের মুখে বাসা নেয় জোঁকের দল।
  • (৪) সবরকম পাখি ও জন্তুই এই প্রাণীটিকে এড়িয়ে চলতে অভ্যস্ত। তবে কাদাখোঁচা জাতীয় পাখিদের সঙ্গে কুমিরের ভাব গলায় গলায়। তীরভূমিতে কুমির যখন হাঁ করে থাকে, তখন এই পাখিগুলো নির্ভয়ে তাদের মুখে ঢুকে জোঁকগুলোকে খেয়ে নেয়। এই উপকারের জন্য কুমির তাদের ওপর এমন খুশি থাকে যে কখনও তাদের ক্ষতি করে না।

হেরোডোটাসের বর্ণনায় পরোক্ষ উক্তি

প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণের বিবরণ এভাবেই বর্ণনা করেছেন হেরোডোটাস। সেখানে কোনো বিষয়ে সন্দেহমূলক কোনো উক্তি নেই। কিন্তু যেসব ঘটনা বা বিষয় জনশ্রুতি থেকে তিনি সংগ্রহ করেছেন, যার বিষয়ে তাঁর নিজেরই সন্দেহ রয়েছে, সে সব বিবরণে তিনি পরোক্ষ উক্তি ব্যবহার করেছেন।

ফিনিক্স পাখি সম্পর্কে হেরোডোটাসের বর্ণনা

  • (১) ফিনিক্স পাখি সম্পর্কে তাঁর বিবরণটি এরকম – এক রকম পাখির কথা শুনেছি, তাদের নাম ফিনিক্স। এই পাখি আমি কখনও দেখিনি, তবে ছবিতে দেখেছি। সূর্য উপাসকরা বলেন, এই পাখিদের নাকি পাঁচশো বছরে একবার দেখা যায়। এদের পূর্বপুরুষ মারা গেলে তবেই এরা আসে।
  • (২) ফিনিক্স পাখি ছবিতে যেমন দেখেছি, যদি এরা সত্য সত্য তেমনই হয় তাহলে বলা চলে এদের ডানা সোনালি আর লালে মেশানো। আকৃতি অনেকটা আমাদের ঈগলের মতো। এই পাখি সম্পর্কে এদের কাছ থেকে যেসব তথ্য আমি শুনেছি, সেগুলো সবই বিশ্বাসযোগ্য নয়। তারা বলে, পাখিগুলো আসে আরব থেকে।
  • (৩) সূর্য উপাসকরা তাদের মৃত পিতার শরীর সূর্যমন্দিরে নিয়ে আসে। তাতে গাছের আঠা বেশ করে মাখিয়ে তারপর সমাহিত করে। তারা বলে ফিনিক্স পাখি বয়ে নিয়ে আসে একটা বিরাট আঠার বল। তাতে একটা গর্ত করে তার মধ্যে মৃতদেহটা ঢুকিয়ে দেয়। তারপর আরও আঠা দিয়ে গর্তটা বন্ধ করে দেয়। পরে সেই আঠার বলটি বয়ে নিয়ে যায় মিশরে। সমস্ত কাজটাই করে নাকি সেই ফিনিক্স পাখি।

হেরোডোটাসের মৃত্যু

তাঁর ইতিহাস গ্রন্থের কাজ শেষ হবার আগেই অবশ্য ৪২৬ খ্রিঃ পূর্বাব্দ থেকে ৪১৫ খ্রিঃ পূর্বাব্দ কোন সময়ের মধ্যে তিনি মারা যান। কাজ অসমাপ্ত রেখে বিদায় নিয়েও হেরোডোটাস কর্মকৃতির যে ঐতিহ্য সৃষ্টি করে গেছেন পরবর্তীকালে সেই পথেই আবর্তিত হয়েছে ইতিহাস রচনার গতিপথ।

উপসংহার :- হেরোডোটাসের কাজের বিশেষত্ব হলো তাঁর অনুসন্ধিৎসু মনোভাব, যেখানে তিনি বিভিন্ন উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করে সমালোচনামূলকভাবে তা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন। যদিও তাঁর কাজের মধ্যে কিছু অতিরঞ্জন বা ভুল তথ্য থাকতে পারে, তবে তাঁর লেখাগুলি আজও মূল্যবান কারণ সেগুলি শুধুমাত্র ঐতিহাসিক ঘটনার বিবরণই নয়, বরং সেই সময়ের মানুষের জীবনধারা, সংস্কৃতি এবং ভাবনার প্রতিফলনও বহন করে।অতএব, হেরোডোটাস শুধু একটি নির্দিষ্ট সময়ের ইতিহাস রচনা করেন নি, বরং ইতিহাস রচনার একটি ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন, যা পরবর্তীতে ঐতিহাসিক গবেষণার মূল ভিত্তি হয়ে ওঠে।

(FAQ) হেরোডোটাস সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. হেরোডোটাসকে “ইতিহাসের জনক” বলা হয় কেন?

হেরোডোটাস তাঁর রচনায় প্রাচীন বিশ্বের ঐতিহাসিক ঘটনা, সংস্কৃতি ও সমাজের বিশদ বিবরণ প্রদান করেছেন এবং ইতিহাস চর্চার কাঠামো তৈরি করেছেন, যা তাঁকে “ইতিহাসের জনক” হিসেবে পরিচিত করেছে।

২. হেরোডোটাসের সবচেয়ে বিখ্যাত কাজ কোনটি?

হেরোডোটাসের সবচেয়ে বিখ্যাত কাজ হল Histories, যেখানে তিনি পারস্য যুদ্ধ এবং অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাস বর্ণনা করেছেন।

৩. হেরোডোটাস কোন সময়ে জীবিত ছিলেন?

হেরোডোটাস আনুমানিক ৪৮৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৪২৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত জীবিত ছিলেন।

৪. হেরোডোটাসের লেখা কোন প্রাচীন যুদ্ধের ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়?

হেরোডোটাসের লেখা প্রধানত গ্রীক এবং পারস্য সাম্রাজ্যের মধ্যে সংঘটিত পারস্য যুদ্ধের ওপর ভিত্তি করে রচিত।

৫. হেরোডোটাস কোথায় জন্মগ্রহণ করেন?

হেরোডোটাস হালিকারনাসাসে জন্মগ্রহণ করেন, যা বর্তমান তুরস্কের বোদ্রুম অঞ্চলে অবস্থিত।

৬. হেরোডোটাসের লেখা কি শুধুমাত্র ইতিহাস সম্পর্কিত?

না, হেরোডোটাস তাঁর লেখায় বিভিন্ন সভ্যতার সংস্কৃতি, ভূগোল, ধর্ম, এবং মানুষের আচরণ সম্পর্কেও তথ্য প্রদান করেছেন।

Leave a Comment