যুগান্তর পত্রিকা প্রসঙ্গে পত্রিকার সম্পাদক, লেখক, যুবসমাজের চেতনা জাগরণে যুগান্তর পত্রিকার ভূমিকা, যুগান্তর পত্রিকার মাধ্যমে বৈপ্লবিক সংগ্ৰামের সূচনা, দেশ ও দেশের বাইরে প্রভাব, যুবসম্প্রদায়ের বৈপ্লবিক দীক্ষাদাতা যুগান্তর পত্রিকা, সম্পাদকীয় স্তম্ভে ঘোষণা, যুগান্তর পত্রিকার মাধ্যমে বাংলার যুবকদের ভরসা দান, অস্ত্রের সন্ধান, অস্ত্র লাভের উপায়, বিশেষ পত্রের প্রকাশ ও বিদ্রোহের উন্মাদনা জাগিয়ে তোলার চেষ্টা সম্পর্কে জানব
যুগান্তর পত্রিকা
ঐতিহাসিক পত্রিকা | যুগান্তর পত্রিকা |
প্রথম প্রকাশ | মার্চ, ১৯০৬ খ্রি: |
সম্পাদক | ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত |
লেখক | অরবিন্দ ঘোষ, বারীন্দ্র ঘোষ |
ভূমিকা :- ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে ‘যুগান্তর’ পত্রিকা প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে এই পত্রিকাটির প্রচার সংখ্যা ছিল সাত হাজার। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে ‘আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলা‘ শুরু হবার পর এটি যখন বন্ধ হয় তখন এর প্রচার সংখ্যা ছিল প্রায় পঁচিশ হাজার।
যুগান্তর পত্রিকার সম্পাদক
জাতীয়তাবাদী যুগান্তর পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন বিপ্লবী ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত।
বিপ্লবী যুগান্তর পত্রিকার লেখক
‘যুগান্তর’ পত্রিকার র লেখক ছিলেন অরবিন্দ ঘোষ, বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, দেবব্রত বসু (প্রজ্ঞানন্দ স্বামী), সখারাম গণেশ দেউস্কর, উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ।
গুপ্ত সমিতি যুগান্তর দলের মুখপত্র
জাতীয়তাবাদী যুগান্তর পত্রিকা ছিল যুগান্তর দলের মুখপত্র।
বিপ্লবী যুবসমাজের চেতনা জাগরণে যুগান্তর পত্রিকার ভূমিকা
এই পত্রিকাটি বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে দেশব্যাপী, বিশেষ করে বাঙলাব্যাপী নূতন জাতীয়তাবাদী জাগরণের সঙ্গে সঙ্গে বাংলার যুব-সম্প্রদায়ের চেতনার জড়তা কাটিয়ে তাদের মধ্যে শক্তি-সাধনার মনোভাব ও বৈপ্লবিক প্রেরণা জাগিয়ে তুলবার কাজে এক বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল।
যুগান্তর পত্রিকার মাধ্যমে বৈপ্লবিক সংগ্ৰামের সূচনা
- (১) এই পত্রিকাটি ধর্মের সাথে স্বাধীনতার আদর্শ মিশিয়ে বাংলার যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে এক নতুন বৈপ্লবিক প্রেরণা জাগিয়ে তোলে এবং বৈপ্লবিক সংগ্রামের সূচনা করে।
- (২) এই উদ্দেশ্যে পত্রিকায় মহাভারতের ধর্মযুদ্ধে অর্জুনকে প্রেরণা দানের জন্য শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ, চণ্ডীপুরাণের সুরাসুরের যুদ্ধ, রাজপুতদের ও শিবাজির স্বাধীনতা-সংগ্রামের কাহিনী, ইতালির ম্যাৎসিনি ও গ্যারিবল্ডির বৈপ্লবিক সংগ্রামের কথা জ্বালাময়ী ভাষায় বর্ণনা করে প্রবন্ধ প্রকাশিত হত।
- (৩) এই সকল প্রবন্ধের মাধ্যমে লেখকগণ বাংলার যুব-সম্প্রদায়কে বৈপ্লবিক স্বাধীনতা-সংগ্রামে যোগদানে উৎসাহিত করে আত্মত্যাগের জন্য উদ্বুদ্ধ করে তুলতেন।
দেশ ও দেশের বাইরে যুগান্তর পত্রিকার প্রভাব
‘যুগান্তর’ পত্রিকাটি কেবল বাংলার যুব-সম্প্রদায়কেই বৈপ্লবিক প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করে তোলে নি, এর বৈপ্লবিক প্রভাব ভারতবর্ষ-এর অন্যান্য প্রদেশেও বিস্তার লাভ করেছিল। এমন কি সুদূর আমেরিকা প্রবাসী গদর বিপ্লবীরাও এর থেকে প্রেরণা লাভ করেছিলেন। গদর-বিপ্লবীরা নাকি ‘যুগান্তর’ পত্রিকার নাম অনুসারে তাঁদের আমেরিকায় প্রতিষ্ঠিত একটি রাজনীতিক মন্দিরের নাম রেখেছিলেন ‘যুগান্তর মন্দির’।
বিপ্লবী যুবসম্প্রদায়ের বৈপ্লবিক দীক্ষাদাতা যুগান্তর পত্রিকা
১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে ‘যুগান্তর’ সমগ্র বঙ্গদেশের শিক্ষিত যুবসম্প্রদায়ের বৈপ্লবিক দীক্ষাদাতা রূপে গৃহীত হয়, যুব-সমাজের মধ্যে এই পত্রিকা এক বৈপ্লবিক মনোভাবের জোয়ার এনে দেয়। সাহসী যুবকগণ ক্রমশ অধিক সংখ্যায় ‘যুগান্তর’ পত্রিকার সংস্পর্শে আসতে থাকে।
জাতীয়তাবাদী যুগান্তর পত্রিকার সম্পাদকীয় স্তম্ভে ঘোষণা
বৈপ্লবিক চাঞ্চল্য লক্ষ্য করেই ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দের ১১ই এপ্রিল ‘যুগান্তর’-এর সম্পাদকীয় স্তম্ভে সদম্ভে ঘোষণা করা হয়, “অশান্তির আগুন জালিয়ে দিতেই হবে। আমরা আহ্বান করি সেই অশান্তিকে যার নাম বিদ্রোহ।”
যুগান্তর পত্রিকার মাধ্যমে বাংলার যুবকদের ভরসা দান
সেই সময় বঙ্গভঙ্গ উপলক্ষ করে সারা বাংলায় অশান্তির আগুন জ্বলছিল। বিপ্লবীরা সেই আগুনকে দেশময় এক বিরাট দাবাগ্নিতে পরিণত করে বিদেশী ইংরেজ শাসনকে ভস্মসাৎ করে ফেলবার জন্য এই উন্মাদনাময় আহ্বান ধ্বনিত করেন। বিপ্লবের জন্য অস্ত্র চাই, চারদিক থেকে দাবি আসতে থাকে, – ‘অস্ত্র চাই’। ‘যুগান্তর’ বাঙলার যুবকদের ভরসা দিল, অস্ত্র পাওয়া যাবে।
জাতীয়তাবাদী যুগান্তর পত্রিকার মাধ্যমে অস্ত্রের সন্ধান
১৯০৭ খ্রিস্টাব্দের ১২ই আগস্টের সম্পাদকীয় স্তম্ভে লেখা হয়, “দেশের মধ্যেই অস্ত্র আছে, তা সহজেই পাওয়া যায়, আর বোমা তৈরীর ব্যবস্থা তো আছেই। কিন্তু এই সম্পর্কে সম্পূর্ণ গোপনতা অবলম্বন করতে হবে।”
যুগান্তর পত্রিকার মাধ্যমে অস্ত্র লাভের উপায়
- (১) অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করবার একটি চমংকার উপায় আছে। অনেকেই জানেন, রুশ বিপ্লব-এ দেখা গেছে যে রাশিয়ার সম্রাট ‘জার’-এর সৈন্যবাহিনীর মধ্যে অনেক সৈন্য রুশ বিপ্লবীদের সমর্থক। এই সৈন্যরা বিপ্লবের সময় বিভিন্ন প্রকারের অস্ত্রশস্ত্রসহ বিপ্লবীদের পক্ষে যোগদান করেছিল।
- (২) এই উপায়টি যথেষ্ট কার্যকরী বলে ফরাসী বিপ্লবে প্রমাণিত হয়েছে। যে দেশের শাসকগণ বিদেশী সে দেশে বিপ্লবীদের আরও অনেক সুযোগ আছে, কারণ শাসকদের বাধ্য হয়ে ঐ পরাধীন দেশের অধিবাসীদের মধ্য থেকেই প্রায় সকল সৈন্য সংগ্রহ করতে হয়। এই সকল দেশীয় সৈন্যদের মধ্যে স্বাধীনতার মন্ত্র প্রচার করে বিপ্লবীরা যথেষ্ট সুবিধা করতে পারে।
- (৩) যখন শাসকশক্তির সাথে প্রকৃত সংঘর্ষ আরম্ভ হয়, তখন বিপ্লবীরা কেবল এই সৈন্যদেরই তাদের দলে পায় না, শাসকগণ ঐ সৈন্যদের হাতে যে সকল অস্ত্র দেয় তাও বিপ্লবীদের হাতে আসে। ইহা ব্যতীত, শাসকদের মনে ভয়ংকর ত্রাস সৃষ্টি করে তাদের এত উৎসাহ, এত সাহস সকলই চূর্ণ করে দেওয়া যায়।
জাতীয়তাবাদী যুগান্তর পত্রিকায় এক বিশেষ পত্রের প্রকাশ
১৯০৭ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসের ২৬ তারিখের ‘যুগান্তর’-এ জনৈক ‘যোগী’র নাম দিয়ে একটি পত্র প্রকাশিত হয়েছিল। পত্রটি নিম্নরূপ –
“আমি শুনতে পাই, আপনাদের পত্রিকার হাজার হাজার সংখ্যা বাজারে বিক্রি হয়। যদি দেশের মধ্যে পনের হাজার কাগজও বিক্রি হয়, তবে তা পড়ে প্রায় ষাট হাজার লোক। আমি একটি কথা এই ষাট হাজার লোককে বলবার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। তাই এই অসময়ে আমি কলম ধরেছি। …… আমি উন্মাদ, বিকৃতমস্তিষ্ক ও হুজুগপ্রিয়। যখন শুনিতে পাই, চারিদিকে অশান্তি শুরু হয়ে গেছে, তখন আমার আনন্দ আর ধরে না, আমি বধির ও বাকশক্তি হীনের মত চুপ করে থাকতে পারি না। আমার নিকট চারদিক থেকে লুণ্ঠনের সংবাদ আসছে, আমি স্বপ্ন দেখি, যেন ভবিষ্যত গেরিলা দলগুলি চারদিকে অর্থ লুণ্ঠন করে বেড়াচ্ছে, যেন ছোট ছোট ডাকাতির আকারে ভবিষ্যৎ-যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। – – – লুণ্ঠন ! আজ আমি তোমাকে পূজা করি, তুমি আমাদের সহায় হও! তুমি এতদিন ফুলের মধ্যে কীটের মত লুকিয়ে থেকে দেশের প্রাণশক্তি নষ্ট করে ফেলেছ ! এবার তুমি নিজ মূর্তিতে আবার আবির্ভূত হও, যততত্র অবাধে বিচরণ কর, জনসাধারণের মনে জাগিয়ে তোল সেই পুরনো সামরিক চেতনা ! – – তোমার কাছ থেকে একদিন ভরসা পেয়েছিলাম যে, যেদিন ভারতবাসীরা তোমাকে স্মরণ করবে, তোমার পূজা করবে, সেদিন তুমি অর্থ দিয়ে তাহাদের হাত ভরিয়ে দেবে, সেই অর্থ দিয়ে তারা নিজেদের সশস্ত্র করে তুলবে, সামরিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠবে। তাই আজ আমি তোমাকে পূজা করি।”
যুগান্তর পত্রিকায় বিদ্রোহের উন্মাদনা জাগিয়ে তোলার চেষ্টা
এই বিপ্লবী যোগী যে ‘যুগান্তর’-এর বিপ্লবী পরিচালকদেরই একজন এবং “উন্নততা”, “মস্তিষ্ক-বিকৃতি” ও “হুজুগপ্রিয়তা” প্রভৃতি কথার দ্বারা ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে যে একটা ব্যাপক বিদ্রোহের উন্মাদনা জাগিয়ে তুলবার চেষ্টা হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
উপসংহার :- ‘সিডিসন-কমিটি’র রিপোর্টে তাই মন্তব্য করা হয়েছে, “ব্রিটিশ জাতির (শাসক জাতির বিরুদ্ধে যুগান্তরের পরিচালকগণ) একটা জলন্ত ঘৃণা জাগিয়ে তুলছেন। ‘যুগান্তর’-এর প্রতি ছত্রে বিপ্লবের হুঙ্কার ধ্বনিত হয়, তাঁরা বিপ্লব সফল করে তুলবার পথ দেখান। যুবকদের ভাবপ্রবণ মনের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে এমন কোনো নিন্দাবাদ, কোনো কৌশলই তাঁরা তাঁদের ভাবধারা প্রচারের জন্য ব্যবহার করতে ইতস্তত করেন না।”
(FAQ) যুগান্তর পত্রিকা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত
মার্চ ১৯০৬ সালে
যুগান্তর পত্রিকা
অরবিন্দ ঘোষ, বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, দেবব্রত বসু (প্রজ্ঞানন্দ স্বামী), সখারাম গণেশ দেউস্কর, উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ।