প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানিতে প্রতিষ্ঠিত ওয়েমার প্রজাতন্ত্র প্রসঙ্গে কাইজারের পদত্যাগ, ওয়েমার প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, কমিউনিস্ট বিদ্রোহ দমন, সংবিধান, প্রজাতন্ত্রের সংকট, হিটলারের ক্ষমতা দখল ও প্রজাতন্ত্রের পতনের কারণ সম্পর্কে জানবো।
ওয়েমার প্রজাতন্ত্র
বিষয় | ওয়েমার প্রজাতন্ত্র |
স্থান | জার্মানি |
সময় | প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী কাল |
প্রতিষ্ঠাতা | ফ্রেডারিখ ইবার্ট |
পতন | ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দ |
ক্ষমতা দখল | হিটলার |
ভূমিকা:- প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষদিকে জার্মানির পরাজয় অনিবার্য হয়ে ওঠে, যা আত্মগর্বী জার্মান জাতির মনে প্রবল অসন্তোষ সৃষ্টি করে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় প্রবল খাদ্যাভাব, বেকারত্ব ও নানা ধরনের অর্থনৈতিক দুরবস্থা। জার্মান জাতি এই সবের জন্য জার্মান সম্রাট কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়ম-কে দায়ী করে।
জনতার দাবি
জার্মানির নানা স্থানে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। বিদ্রোহী জনতার দাবি ছিল – যুদ্ধের অবসান ও কাইজারের পদত্যাগ।
গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব
১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে কিয়েল বন্দরে জার্মান নৌবাহিনী বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং রাশিয়ার অনুকরণে শ্রমিক ও সেনাদের নিয়ে সেখানে একটি ‘সোভিয়েত’ স্থাপিত হয়। কিয়েলের অনুকরণে জার্মানির বিভিন্ন শহরে গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব শুরু হয়।
গণ-অভ্যুত্থান ও শ্রমিক ধর্মঘট
শ্রমিক ও সৈনিকরা স্থানীয় শাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করে। ব্যাভেরিয়ায় গণ-অভ্যুত্থান দেখা দেয় এবং সেখানে একটি স্বতন্ত্র প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। বার্লিনে শ্রমিকরা ধর্মঘট করে।
জার্মানির কাইজারের পদত্যাগ
অভ্যন্তরীণ অরাজকতা ও তীব্র গণ-আন্দোলনে ভীত কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়ম ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের ১০ই নভেম্বর জার্মানির সিংহাসন ত্যাগ করে নেদারল্যান্ডস -এ আশ্রয় নেন। তাঁর অনুকরণে জার্মানির বেশ কিছু রাজা দেশত্যাগী হন।
জার্মানিতে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা
এর ফলে জার্মানিতে দীর্ঘকাল ধরে প্রতিষ্ঠিত রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে এবং জার্মানির বিশিষ্ট সমাজতান্ত্রিক নেতা ‘সোস্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি’-র ফ্রেডারিখ ইবার্টের নেতৃত্বে সেখানে একটি সামরিক প্রজাতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের বিপ্লব
এইভাবে ‘পরাজয় ও নৈরাশ্যের অন্ধকারময় সময়ে’ জার্মান সাম্রাজ্য-এর স্থলে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এই ঘটনাকে ‘১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের বিপ্লব’ বলা হয়। বলা হয় যে, এই বিপ্লব হল বিশৃঙ্খলতারই ফলশ্রুতি। এই অস্থায়ী সরকার রাশিয়ার অনুকরণে ‘কাউন্সিল অব পিপলস্ কমিসার’ নামে পরিচিত হয়।
ওয়েমার প্রজাতন্ত্র
রাজধানী বার্লিনে নানা গোলমাল চলতে থাকায় নিকটবর্তী ওয়েমার শহরে এই প্রজাতান্ত্রিক সরকারের কর্মকেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এই কারণে এই প্রজাতন্ত্র ‘ওয়েমার প্রজাতন্ত্র’ নামে পরিচিত।
‘আগ্নেয়গিরির উপর নৃত্য’
জন্মলগ্ন থেকেই এই প্রজাতন্ত্রকে নানা জটিল সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। হতাশা, ক্ষুধা, বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতি, আর্থিক সংকট, সন্ত্রাস ও বিদ্রোহকে নিত্যসঙ্গী করে প্রজাতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়। অধ্যাপক রাইডার এই অবস্থাকে ‘আগ্নেয়গিরির উপর নৃত্য’ বলে অভিহিত করেছেন।
কমিউনিস্ট বিদ্রোহ দমন
- (১) এই সময় জার্মানিতে কমিউনিজম বা সাম্যবাদী ভাবধারা যথেষ্ট পরিমাণে প্রসার লাভ করে। বলশেভিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ জার্মান কমিউনিস্টরা ‘স্পার্টাকাস’ নামে এক দল গঠন করে এবং ‘সর্বহারার একনায়কত্ব’ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে দেশের নানা অঞ্চলে ‘সোভিয়েত’ প্রতিষ্ঠা করতে থাকে।
- (২) তাদের উদ্যোগে নানা স্থানে শ্রমিক ধর্মঘট শুরু হয়। তারা সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পরিকল্পনা করে। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে তারা বার্লিন নগরী দখলের চেষ্টা করলে সরকারের অনুগামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী বা ফ্রি কোর সেনাদল সেই চেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়।
- (৩) তাদের হাতে দুই ‘স্পার্টাসিস্ট’ নেতা কার্ল লিবনেই ও রোজা লুক্সেমবার্গ-সহ বহু স্পার্টাসিস্ট নিহত হয়। এক সপ্তাহ গোলযোগের পর ১৫ই জানুয়ারি স্পার্টাকাসদের পতন ঘটে। ব্যাভেরিয়ার প্রতিবাদী কমিউনিস্ট সরকার এবং মিউনিখের কমিউনিস্ট বিদ্রোহ দমিত হয়। জার্মানির উপর জাতীয় সরকারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
জাতীয় পরিষদ গঠন
- (১) স্পার্টাসিস্ট বিদ্রোহ দমনের পর পূর্ব-নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী ১৯শে জানুয়ারি প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে জাতীয় পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। স্পার্টাকাস দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে নি। সমগ্র জার্মানির প্রায় সাড়ে তিন কোটি নাগরিকের মধ্যে ৩ কোটি নারী-পুরুষ এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে।
- (২) মোট ৪২১টি আসনের মধ্যে চ্যান্সেলার ইবার্টের সোস্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি ১৬৩টি আসন পায়। এছাড়া সেট্রিস্ট বা খ্রিস্টান ডেমোক্রাটসরা ৮৮, ডেমোক্রেটিক দল ৭৫, ন্যাশনালিস্ট দল ৪২, ইন্ডিপেন্ডেট সোস্যালিস্টরা ২২, পিপলস্ দল ২১টি আসন পায়। বাকি ১০টি আসন লাভ করে চারটি ছোটো ছোটো দল। ৬ই ফেব্রুয়ারি ওয়েমার শহরে এই প্রতিনিধি সভার অধিবেশন বসে।
সংবিধান
ওয়েমার শহরে সমগ্র জার্মানির জন্য একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রজাতান্ত্রিক সংবিধান গৃহীত হয়। এই সংবিধান পূর্বেই প্রস্তুত ছিল। এই কারণে এই সংবিধান গৃহীত হতে বেশি সময় লাগে নি। অধ্যাপক ডেভিড টমসন এই সংবিধানকে কাগজে-কলমে পৃথিবীর এক অসাধারণ গণতান্ত্রিক সংবিধান বলে অভিহিত করেছেন।
সংবিধানের বিধি সমূহ
সংবিধান অনুসারে স্থির হয়ে যে,
- (১) প্রাপ্তবয়স্কদের সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বা রাষ্ট্রপতি হবেন রাষ্ট্রপ্রধান বা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ শাসক। তিনি সাত বছরের জন্য এই পদে নির্বাচিত হবেন।
- (২) একটি দুই কক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট তাকে শাসনকার্য পরিচালনায় সাহায্য করবে। পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ ‘রাইখস্ট্যাড’ এবং নিম্নকক্ষ ‘রাইখস্ট্যাগ’ নামে পরিচিত হয়।
- (৩) উচ্চকক্ষ গঠিত হবে জার্মানির বিভিন্ন রাজ্যের প্রতিনিধিদের নিয়ে। অন্যদিকে নিম্নকক্ষ গঠিত হবে প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটে। ২০ বছর বয়স্ক নারী-পুরুষরা ভোটাধিকার পায়।
- (৪) রাষ্ট্রপতি চ্যান্সেলার বা প্রধানমন্ত্রীকে নিয়োগ করবেন এবং মন্ত্রিসভা নিম্নকক্ষ বা ‘রাইখস্ট্যাগ’-এর, কাছে দায়ী থাকবে।
- (৫) এই সংবিধানে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার, আইনের চোখে সবার সমানাধিকার, ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের অধিকার প্রভৃতি স্বীকৃত হয়।
- (৬) সংবিধান অনুসারে ফ্রেডারিখ ইবার্ট হলেন এই প্রজাতন্ত্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি। তাঁর নেতৃত্বে বিভিন্ন দলের একটি কোয়ালিশন সরকার গঠিত হল।
সংবিধান প্রবর্তনে সমস্যা
একটি আদর্শ গণতান্ত্রিক সংবিধান হলেও, এই সংবিধান প্রবর্তনে জার্মানিতে বেশ কিছু সমস্যা ছিল। যেমন –
- (১) কাইজার এবং জার্মানির বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের রাজারা পদত্যাগ করলেও কাইজারের আমলের আমলা, শিল্পপতি, জমির মালিক, সামরিক শ্রেণি তখনও জার্মানির উপর আধিপত্য করত। এই ধরনের আধা-বুর্জোয়া ও আধা-সামন্ততান্ত্রিক সমাজে ওয়েমার সংবিধান কোনও প্রভাব ফেলতে পারে নি।
- (২) যুদ্ধে জার্মানির পরাজয় ও ওয়েমার প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সমকালীন ঘটনা হওয়ায় সাধারণ জার্মানদের মনে এই ধারণাই হয় যে, যুদ্ধে জার্মানির পরাজয় ও ভার্সাই সন্ধির জন্য ওয়েমার প্রজাতন্ত্রই দায়ী। নাৎসি দলও এই মিথ্যা প্রচারে অবতীর্ণ হয়ে সাধারণ মানুষের চোখে প্রজাতন্ত্রকে হেয় করতে সচেষ্ট হয়।
ওয়েমার প্রজাতন্ত্রের সংকট
নব প্রতিষ্ঠিত এই প্রজাতন্ত্রকে নানা জটিল সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। ওয়েমার প্রজাতন্ত্রের সংকটগুলি হল –
- (১) যুদ্ধে পরাজিত জার্মানি ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ২৮ জুন অপমানজনক ভার্সাই সন্ধি স্বাক্ষরে বাধ্য হয়। এই সন্ধিকে চূড়ান্ত অনুমোদন দানের বিষয়টি প্রজাতান্ত্রিক সরকারের সামনে বিশেষ সমস্যার সৃষ্টি করে।
- (২) সরকারি কর্মচারীদের আনুগত্যের অভাব ওয়েমার প্রজাতন্ত্রের মৃত্যু ঘণ্টা বাজিয়ে দেয়।
- (৩) এছাড়া বিবিধ বিদ্রোহ, মুদ্রাস্ফীতি, ক্ষতিপূরণ সমস্যা প্রভৃতি ওয়েমার প্রজাতন্ত্রের সংকট সৃষ্টি করে।
গুস্তাভ স্ট্রেসম্যান
জাতীয় জীবনের এই শোচনীয় অবস্থায় জার্মান পিপলস পার্টির সদস্য ডক্টর গুস্তাভ স্ট্রেসম্যান জার্মানির চ্যান্সেলর পদে বৃত হন। তার সময়ে ওয়েমার প্রজাতন্ত্র যথেষ্ট স্থিতিশীলতা লাভ করে। কিন্তু ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যু প্রজাতন্ত্রের উপর যথেষ্ট আঘাত হানে।
মহামন্দা
১৯৩০ সালে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মহামন্দা শুরু হলে জার্মানিতেও তার প্রভাব পড়ে। এর ফলে ওয়েমার প্রজাতন্ত্রের প্রাণশক্তি নিঃশেষ হয়ে যায়।
হিটলারের ক্ষমতা দখল
জাতীয় জীবনে এই চরম হতাশার দিনে ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে হিটলার জার্মানির ক্ষমতা দখল করেন। তিনি হন ‘ফ্যুয়েরার’ বা জার্মানির সর্বোচ্চ নেতা।
ওয়েমার প্রজাতন্ত্রের পতনের কারণ
ওয়েমার প্রজাতন্ত্রের পতন কোনো আকস্মিক ঘটনা নয় – এর পতনের পশ্চাতে নানা কারণ ছিল। যেমন – ভার্সাই সন্ধি, সরকারের সংহতির অভাব, প্রতিকূল সামাজিক পরিবেশ, ডক্টর স্ট্রেসম্যানের মৃত্যু, গণতান্ত্রিক শাসনের ব্যর্থতা, মহামন্দা প্রভৃতি।
উপসংহার:- রবার্ট এরগ্যাং বলেন যে “অর্থনৈতিক মন্দা ওয়েমার প্রজাতন্ত্রের দিকে মৃত্যুবান ছুঁড়ে দেয়।” সরকার মহামন্দা মোকাবিলায় ব্যর্থ হলে প্রজাতন্ত্র বিরোধী দলগুলি সরকারের বিরুদ্ধে প্রচারে নামে। কর্মহীন মানুষ, বন্ধ কলকারখানার শ্রমিক, সাধারণ মানুষ নানা প্রচার অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে নাৎসি দল-এর প্রতি সমর্থন জানায়।
(FAQ) ওয়েমার প্রজাতন্ত্র সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়াম।
ওয়েমার প্রজাতন্ত্র।
ফ্রেডারিখ ইবার্ট।
হিটলার ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে।