ফ্রান্সে থার্মিডোরীয় প্রতিক্রিয়া, এর বৈশিষ্ট্য, প্রতিবিপ্লব, শ্বেত সন্ত্রাস, পরারাষ্ট্র ক্ষেত্রে সাফল্য, থার্মিডোর বিরোধী অভ্যূত্থান, ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দের সংবিধান, সংবিধানের বিষয়সমূহ, ভাদেমিয়ার উত্থান, গণবিদ্রোহ ও মধ্যপন্থী বুর্জোয়াদের ক্ষমতা দখল সম্পর্কে জানবো।
থার্মিডোরীয় প্রতিক্রিয়া
ঐতিহাসিক ঘটনা | থার্মিডোরীয় প্রতিক্রিয়া |
সময়কাল | ২৭ জুলাই, ১৭৯৪ – ২৬ অক্টোবর, ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দ |
স্থান | ফ্রান্স |
রোবসপিয়ার বন্দী | ২৭ জুলাই, ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দ |
ক্ষমতা লাভ | জিরণ্ডিন দল |
জাতীয় মহাসভা রক্ষা | নেপোলিয়ন |
ভূমিকা:- ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দের ২৭শে জুলাই রোবসপিয়র বন্দি ও ক্ষমতাচ্যুত হন। বিপ্লবী বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী থার্মিডোর (সেপ্টেম্বর) মাসে এই ঘটনা ঘটে।
থার্মিডোরীয় প্রতিক্রিয়া
রোবসপিয়রের ক্ষমতাচ্যুতির পর থেকে ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাস পর্যন্ত কনভেনশনের শাসনকাল চলে। জাতীয় মহাসভা -র শেষ চৌদ্দমাসের এই শাসনকাল ‘থার্মিডোরীয় প্রতিক্রিয়া’ নামে পরিচিত।
থার্মিডোরীয় প্রতিক্রিয়ার পূর্ব কালপর্বের বৈশিষ্ট্য
- (১) এই কালপর্বে উগ্র জেকোবিনদের পরিবর্তে দক্ষিণপন্থী জিরণ্ডিন ও মধ্যপন্থী বা Plain-রা ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হয়।
- (২) সন্ত্রাসের শাসনপর্বে জাতীয় কনভেনশনের উপর প্যারিসের বিপ্লবী কমিউন ও সাঁকুলেৎদের অবৈধ প্রভাব প্রতিষ্ঠিত ছিল। থার্মিডোরীয় প্রতিক্রিয়ার ফলে এই অবৈধ প্রভাবের অবসান ঘটে, এবং এর পরিবর্তে মধ্যবিত্ত ও বুর্জোয়াদের প্রাধান্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।
- (৩) নতুন এই নেতাদের মধ্যে কিছু আদর্শবাদী মানুষ থাকলেও অধিকাংশই ছিলেন স্বার্থান্বেষী—তাঁদের লক্ষ্য ছিল বিপ্লবকে সামনে রেখে নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করা।
প্রতি-বিপ্লব থার্মিডোরীয় প্রতিক্রিয়া
ঐতিহাসিক কোবান-এর মতে, থার্মিডোরীয় প্রতিক্রিয়া হল একটি প্রতি-বিপ্লব। এই ঘটনার ফলে –
- (১) জেকোবিন ক্লাব ও অন্যান্য বিপ্লবী সংগঠনগুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়।
- (২) কারাগার থেকে আশি হাজার বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হয় এবং সব গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বাতিল করা হয়।
- (৩) বিপ্লবী আদালতগুলি ক্ষমতা হারায় এবং ‘প্রেইরিয়াল’ আইন বাতিল করা হয়।
- (৪) প্যারিস কমিউন ভেঙে দেওয়া হয় এবং কমিউনের নব্বইজন উগ্র বিপ্লবীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
- (৫) গণ-নিরাপত্তা কমিটি ও সাধারণ নিরাপত্তা কমিটি ভেঙে দেওয়া হয় এবং তাদের জায়গায় ন্যাশনাল কনভেনশন ১২টি কমিটি গঠন করে দেশ-শাসনের ব্যবস্থা করে।
- (৬) প্রদেশে ডেপুটিদের ক্ষমতা ও স্বাধীনতা বৃদ্ধি করা হয়।
- (৭) সন্দেহভাজন আইনে আটক ব্যক্তিদের মুক্তি দেওয়া হয়।
- (৮) মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত বা নির্বাসিত ব্যক্তিদের সম্পত্তি ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
- (৯) দেশত্যাগীদের স্বদেশে ফেরার অনুমতি দেওয়া হয়।
- (১০) ধর্মাচরণের স্বাধীনতা স্বীকৃত হয় এবং গির্জার দরজা খুলে দেওয়া হয়।
- (১১) ‘সর্বোচ্চ মূল্যের আইন’ (Law of Maximum) তুলে দেওয়া হয়।
শ্বেত সন্ত্রাস
- (১) সন্ত্রাস শাসনের নায়ক জেকোবিনদের ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে মধ্যবিত্ত বুর্জোয়াদের নেতৃত্বে পাল্টা সন্ত্রাস শুরু হয়। ‘লাল সন্ত্রাস‘-এর পাল্টা এই সন্ত্রাসের নাম হল ‘শ্বেত সন্ত্রাস’ (‘White Terror)।
- (২) ভবঘুরে, বেকার এবং নিম্নশ্রেণির মানুষদের নিয়ে গঠিত গুণ্ডাবাহিনীর হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া হয় এবংতারা প্রকাশ্যে পুলিশের সামনে জেকোবিনদের উপর অত্যাচার করে অবাধে তাদের হত্যা করতে থাকে।
- (৩) ফ্রান্সের সর্বত্র এমনকী গ্রামাঞ্চলে এই ধরনের হত্যাকাণ্ড চলতে থাকে। এই হত্যালীলা জেকোবিন সন্ত্রাসকেও ছাড়িয়ে যায়। সুযোগ বুঝে রাজতন্ত্রীরা শত্রুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে অবাধে জেকোবিনদের ঘর-বাড়ি লুণ্ঠন ও তাদের হত্যা করতে থাকে।
সাংস্কৃতিক উদ্যম
- (১) এই পর্বে রুশোর মতবাদের ভিত্তিতে ফ্রান্স-এর শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো হয়। জাতীয় শিক্ষার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়, কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়, শিক্ষক-শিক্ষণ কেন্দ্র, চিকিৎসা বিদ্যালয় এবং কারিগরি বিদ্যালয়গুলিকে পুনর্গঠিত করা হয়।
- (২) এই সময়েই মিউজিয়াম বা জাদুঘর ও প্রচুর পাঠাগার স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ সময়েই প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব আর্টিস্ অ্যান্ড সায়েন্স’ নামক প্রতিষ্ঠান। নির্ভুল ওজন ও মাপের জন্য এই প্রতিষ্ঠানটি ‘মেট্রিক পদ্ধতি’ চালু করে।
পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে সাফল্য
পররাষ্ট্র ক্ষেত্রেও ফ্রান্স উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করে। যেমন –
- (১) প্রাশিয়া বাসেল-এর সন্ধি (এপ্রিল, ১৭৯৪ খ্রিঃ) দ্বারা ফ্রান্সের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করতে বাধ্য হয়।
- (২) নেদারল্যান্ডস-এ প্রতিষ্ঠিত বাটাভিয়ান প্রজাতন্ত্র ফ্রান্সের সঙ্গে আত্মরক্ষামূলক ও আক্রমণাত্মক সন্ধি স্থাপন করে (মে, ১৭৯৪ খ্রিঃ)।
- (৩) স্পেনও ফ্রান্সের সঙ্গে দ্বিতীয় বাসেল-এর সন্ধি (জুলাই, ১৭৯৪খ্রিঃ) স্বাক্ষরে বাধ্য হয়।
- (৪) ফ্রান্স বেলজিয়াম দখল করে নিলে প্রথম শক্তিজোট (FirstCoalition) দুর্বল হয়ে পড়ে।
থার্মিডোরীয় বিরোধী অভ্যুত্থান
- (১) সন্ত্রাসের শাসনকালে নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি প্রবর্তিত হয়। ধার্মিডোরীয় শাসনের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হল অবাধ অর্থনীতি। এই পর্বে ‘দ্রব্যমূল্যের সর্বোচ্চ আইন’ বাতিল করা হলে অবাধ ফাটকাবাজি শুরু হয়। এইসব নানা কারণে দ্রব্যমূল্য আকাশচুম্বী হয়ে ওঠে এবং মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি পায়।
- (২) মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ায় উৎপাদনও বন্ধ হয়ে যায়। দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এর ফলে জনরোষ বৃদ্ধি পায়। দেশে বিদ্রোহ শুরু হয়। জনতা ও জোকোবিনরা ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে (বিপ্লবী ক্যালেন্ডার অনুসারে ‘জার্মিনাল’) রুটি ও সংবিধানের দাবিতে জাতীয় মহাসভা আক্রমণ করে।
- (৩) জেনারেল পিশেগ্রু-র নেতৃত্বে জাতীয় রক্ষীবাহিনী এই বিদ্রোহ দমন করে এবং বেশ কিছু বিদ্রোহী নেতার প্রাণদণ্ড হয়। জাতীয় রক্ষীবাহিনী এতদিন ছিল বিপ্লবীদের সহযোগী। এখন সেই বাহিনী পুনর্গঠন করে তার বিপ্লবী চরিত্র নষ্ট করে দেওয়া হয়।
- (৪) খাদ্যাভাব ও আর্থিক সংকটের দরুন বিপ্লবী প্রেইরিয়াল মাসে (মে, ১৭৯৫ খ্রিঃ) আবার বিদ্রোহী জনতা জাতীয় মহাসভা আক্রমণ করে। সেনাপতি মুরাট সেনাবাহিনীর সাহায্যে বিদ্রোহ দমন করেন।
- (৫) ‘শ্বেত সন্ত্রাস’ লাগাম ছাড়া হয়ে ওঠে। বেশ কিছু আন্দোলনকারীর প্রাণদণ্ড হয়। নিষ্ঠুর দমননীতির মাধ্যমে সাঁকুলের জনতার মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া হয়।
১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দের সংবিধান
- (১) ইতিমধ্যে দেশত্যাগী অভিজাত ও যাজকরা দেশে ফিরতে শুরু করেন। তাঁরা রাজতান্ত্রিক যড়যন্ত্র শুরু করেন। ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে ষোড়শ লুই-এর কারারুদ্ধ শিশু সন্তান সপ্তদশ লুই মারা যান। অষ্টাদশ লুই ভেরোনা থেকে এক ঘোষণাপত্র মারফত ‘পুরাতন ব্যবস্থা’ ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দেন।
- (২) এই অবস্থায় রাজতন্ত্রের প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা নির্মূল করার উদ্দেশ্যে কনভেনশন অতি দ্রুত একটি সংবিধান প্রণয়ন করে, যা ‘তৃতীয় বর্ষের সংবিধান (Constitution of the year III) নামে পরিচিত। প্রজাতান্ত্রিক ফ্রান্সের তৃতীয় বৎসরে এই সংবিধান রচিত হয়েছিল বলে এর এই নামকরণ।
- (৩) এই সংবিধানের রচয়িতা হলেন ধনী ও সম্পত্তিবান শ্রেণির মুখপাত্র বয়েসি দ্য এ্যাংলাস (Boissy of Anglas)। এর দ্বারা বুর্জোয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সর্ববিধ ব্যবস্থা করা হয়।
- (৪) এই সংবিধানে কেবলমাত্র নাগরিকদের অধিকার নয়, কর্তব্যের কথাও ঘোষণা করা হয়। এখানে সর্বসাধারণের ভোটাধিকারেরপরিবর্তে সম্পত্তির ভিত্তিতে ভোটাধিকারের কথা বলা হয়।
নতুন সংবিধানের বিষয়সমূহ
- (১) নতুন সংবিধানে দ্বিকক্ষ-বিশিষ্ট আইনসভার কথা বলা হয়—‘বর্ষীয়ানদের সভা’ এবং ‘পাঁচশতের পরিষদ’। প্রথম কক্ষের সদস্যদের বয়স হবে কমপক্ষে চল্লিশ এবং তাঁরা সংখ্যায় হবেন ২৫০ জন। দ্বিতীয় কক্ষের সদস্যদের বয়স হবে অন্যূন ত্রিশ।
- (২) ‘পাঁচশতের পরিষদ’ আইনের প্রস্তাব করবে এবং প্রবীণদের অনুমোদন পেলে তা আইনে পরিণত হবে।
- (৩) রাজতন্ত্রীদের ক্ষমতা দখলের সম্ভাবনা নষ্ট করার জন্য স্থির হয় যে, নতুন আইনসভার সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশ পূর্বতন কনভেনশনের সদস্যদের মধ্য থেকে নিতে হবে। এক-তৃতীয়াংশ সদস্য প্রতি বছর অবসর নেবেন।
- (৪) শাসনকার্য পরিচালনা করবে পাঁচজন সদস্য বিশিষ্ট একটি ‘ডিরেক্টরি‘। এঁদের বয়স হবে অন্তত চল্লিশ বছর। এঁরা আইনসভা কর্তৃক নিযুক্ত হবেন। এঁদের কার্যকালের মেয়াদ পাঁচ বছর—তবে প্রতি বছর একজন করে ডিরেক্টর পদত্যাগ করবেন এবং তাঁর জায়গায় নতুন একজন নির্বাচিত হবেন।
- (৫) প্রশাসন, বৈদেশিক সম্পর্ক, সেনাবাহিনী ও স্থানীয় শাসনের উপর ডিরেক্টরির পূর্ণ কর্তৃত্ব থাকলেও আইন-প্রণয়ন বা আইন-সংক্রান্ত কোনও প্রস্তাব গ্রহণের অধিকার তাদের ছিল না।
ভাদেমিয়ারের উত্থান
এই সংবিধান সবার পছন্দ হয় নি। জাতীয় রক্ষীবাহিনী, প্যারিসের জনতা এবং অভিজাত ও রাজতন্ত্রীরা ৫ই অক্টোবর (১৩ই ভাদেমিয়ার) টুইলারিস রাজপ্রাসাদে কনভেনশনের অধিবেশন কক্ষ আক্রমণ করে। এই ঘটনা ‘ভাদেমিয়ারের উত্থান’ নামে পরিচিত।
গণবিদ্রোহ দমন
জেনারেল বারাস-কে এই গণবিদ্রোহ দমনের ভার দেওয়া হয়। তাঁর অধীনস্থ সেনাপতি পঁচিশ বছরের নেপোলিয়ন পাঁচ হাজার সৈন্য নিয়ে জাতীয় রক্ষীবাহিনীর ত্রিশ হাজার সেনাকে পরাজিত করেন।
মধ্যপন্থী বুর্জোয়াদের ক্ষমতা দখল
কয়েক ঘণ্টার লড়াইয়ে দুশোটি প্রাণের বিনিময়ে ফ্রান্সের জাতীয় সভা উচ্ছৃঙ্খল জনতা ও জাতীয় রক্ষীবাহিনীর আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পায়। মধ্যপন্থী বুর্জোয়া সম্প্রদায় আবার ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হয়।
উপসংহার:- এইভাবে ২৬শে অক্টোবর কনভেনশনের কার্যকাল শেষ হয়। এর প্রধান কৃতিত্ব হল প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা এবং গৃহযুদ্ধ ও বৈদেশিক আক্রমণের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করা।
(FAQ) থার্মিডোরীয় প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দের ২৭শে জুলাই।
মধ্যবিত্ত বুর্জোয়াদের নেতৃত্বে।
৫ অক্টোবর (১৩ ভাদেমিয়ার) ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দ।
নেপোলিয়ন বোনাপার্ট।