তেলেঙ্গানা আন্দোলন

তেলেঙ্গানা আন্দোলন -এর সময়কাল, আন্দোলনের সম্প্রসারণ, তেলেঙ্গানার শাসক গোষ্ঠী, সামন্ততান্ত্রিক শাসন, কৃষকদের দুর্দশা, অন্ধ্র মহাসভা গঠন, কমিউনিস্ট পার্টি গঠন, প্রচার, সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি, সেচ্ছাসেবক বাহিনী, অস্ত্রের অপ্রতুলতা, বৈপ্লবিক কার্যক্রম, হায়দ্রাবাদের ভারতভূক্তি, আন্দোলন প্রত্যাহার ও আন্দোলনের গুরুত্ব সম্পর্কে জানবো।

তেলেঙ্গানা আন্দোলন (১৯৪৬-৫১ খ্রিঃ)

ঐতিহাসিক ঘটনাতেলেঙ্গানা আন্দোলন
সময়কাল১৯৪৬-১৯৫১ খ্রিস্টাব্দ
বৈশিষ্ট্যগেরিলা কৃষক যুদ্ধ
হায়দ্রাবাদের ভারতভুক্তি১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দ
আন্দোলন প্রত্যাহার১৯৫১ খ্রিস্টাব্দ
তেলেঙ্গানা আন্দোলন

ভূমিকা:- স্বাধীনতার ঊষালগ্নে ১৯৪৬-এর জুলাই থেকে ১৯৫১ এর অক্টোবর পর্যন্ত সময়কালে নিজাম-শাসিত হায়দ্রাবাদের তেলেঙ্গানায় সংঘটিত হয় ভারতের আধুনিক ইতিহাস-এর এখনও পর্যন্ত সংঘটিত সব চেয়ে বড় গেরিলা কৃষক যুদ্ধ।

তেলেঙ্গানায় আন্দোলনের সম্প্রসারণ

এই গেরিলা যুদ্ধ সম্প্রসারিত হয়েছিল ১৬ হাজার বর্গমাইল-ব্যাপী ৩ হাজার গ্রামে এবং তাতে অংশ নিয়েছিল ৩০ লক্ষ দরিদ্র কৃষক।

তেলেঙ্গানার শাসক গোষ্ঠী

ইংরেজ শাসনাধীনে হায়দ্রাবাদ ছিল নিজাম-শাসিত একটি দেশীয় রাজ্য। এর অধিকাংশ প্রজাই ছিল হিন্দু। উর্দু ভাষাভাষী স্বল্পসংখ্যক ধনী মুসলিম শাসকগোষ্ঠী কানাড়ি, তেলুগু ও মারাঠি ভাষাভাষী হিন্দু প্রজাদের ওপর শাসন চালাত।

তেলেঙ্গানা অঞ্চল

হায়দ্রাবাদের পূর্ব দিকে আটটি তেলুগু-ভাষী জেলা নিয়ে গড়েউঠেছিল তেলেঙ্গানা অঞ্চল।জেলাগুলি হল ওয়ারাঙ্গল, নালগোণ্ডা, মহবুবনগর, হায়দ্রাবাদ, মেদাক, নিজামাবাদ, করিমনগর এবং আদিলাবাদ।

তেলেঙ্গানার আয়তন ও জনসংখ্যা

ব্রিটিশ শাসনকালে তেলেঙ্গানার আয়তন ছিল ইংল্যান্ড-এর চেয়ে কিছু বড় এবং এর জনসংখ্যা ছিল প্রায় এক কোটি, যার অধিকাংশই ছিল কৃষক।

তেলেঙ্গানায় সামন্ততান্ত্রিক শাসন

  • (১) নিজাম-শাসিত তেলেঙ্গানা ছিল মধ্যযুগীয় সামন্ততান্ত্রিক শাসন ও শোষণের জ্বলন্ত উদাহরণ। শোষক গোষ্ঠীর প্রধান ছিলেন নিজাম স্বয়ং। তিনি ছিলেন বিশাল পরিমাণ জমির মালিক।
  • (২) গোটা হায়দ্রাবাদের সব জমিই ছিল নিজামের মালিকানাধীন। তাঁর নিজস্ব জমির পরিমাণ ছিল ১ কোটি ৫০ লক্ষ বিঘা। ১৫ লক্ষ ভূমিদাস সেই বিপুল পরিমাণ জমি চাষ করত।
  • (৩) এর পরে ছিল মুসলিম জায়গিরদার, জমিদার ও হিন্দু দেশমুখরা। মুসলিম জায়গিরদাররা হল বড় জমিদার। তেলেঙ্গানার প্রায় অর্ধেক জমি ছিল তাদের দখলে।
  • (৪) বাকি অর্ধেকের অধিকাংশ জমির মালিক ছিল হিন্দু দেশমুখরা। এক সময় তারা রাজস্ব আদায় করত। পরে সেই দায়িত্ব অন্যদের ওপর অর্পিত হয়–বিনিময়ে দেশমুখরা বিপুল পরিমাণ উর্বর জমি লাভ করে। তাদের অনেকেই হাজার হাজার বিঘা— এমনকী লক্ষ লক্ষ বিঘা জমির মালিক ছিল।

তেলেঙ্গানার কৃষকদের দুর্দশা

  • (১) মধ্যযুগীয় সামন্ততান্ত্রিক শাসনে নিপীড়িত কৃষকদের কোনো প্রকার অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক অধিকার ছিল না। তাদের অধিকাংশেরই কোনো নিজস্ব জমি ছিল না। তারা ছিল অবাধ বেআইনি শোষণ ও জুলুমের শিকার।
  • (২) তাদের ওপর চাপানো হয় নানা ধরনের অসংখ্য কর, যা দেবার সামর্থ তাদের ছিল না। ‘বেটি’ প্রথা অনুযায়ী তারা জমিদার ও দেশমুখদের জমিতে বেগার খাটতে বাধ্য হত।
  • (৩) সুপ্রকাশ রায় লিখছেন যে, “প্রকৃতপক্ষে জমিজমার উপর সাধারণ চাষিদের কোনো অধিকারই ছিল না। দেশমুখ আর জমিদার গোষ্ঠী অসংখ্য করের দায়ে আর নানা ছলে চাষিদের সমস্ত ফসলই কেড়ে নিত।
  • (৪) মাথা গোঁজবার জন্য একখানা কুঁড়েঘর তুলতে হলেও জমিদারের অনুমতি নিতে হত। তেলেঙ্গানার চাষিরা এত দরিদ্র যে অধিকাংশই শুধু নেংটি পরে লজ্জা নিবারণ করত। ক্ষেত মজুরদের খাটতে হত দিনে ১৪ ঘণ্টা করে।
  • (৫) নিজাম জায়গিরদার-জমিদারদের জমিতে তাদের ‘বেগার খাটতেই হত। তাদের কোনো রাজনৈতিক অধিকার বা ব্যক্তি স্বাধীনতা বলতে কিছু ছিল না।
  • (৬) সরকারের অনুমতি ছাড়া সেখানে কোন সভা—এমনকী গানের আসরও বসানো যেত না। নিজামের পুলিশ মিলিটারি এবং ‘রাজাকার’ নামে গুণ্ডা বাহিনী তাদের ওপর ইচ্ছামত অত্যাচার চালাত।

অন্ধ্র মহাসভা ও কমিউনিস্ট পার্টি গঠন

এই অবস্থার প্রতিকারের জন্য অন্ধ্র মহাসভা গঠিত হয়। কংগ্রেসের সদস্য রবি নারায়ন রেড্ডি ও ইয়েলো রেড্ডি-র উদ্যোগে সেখানে কমিউনিস্ট পার্টি-ও প্রতিষ্ঠিত হয়। কমিউনিস্ট পার্টি ক্রমে হয়ে ওঠে ‘অন্ধ্র মহাসভা’-র প্রাণ।

প্রচার

কমিউনিস্ট ও ‘অন্ধ্র মহাসভা’-র কর্মীরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে ও প্রচার পুস্তিকা মারফত নিজামশাহীর বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করে এবং বেগার খাটা, বেআইনি খাজনা, জমি থেকে উচ্ছেদ ও জমিদার-রাজাকার-পুলিশ-মিলিটারির অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার মাস্থান জানায়।

সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি

কৃষকরা দলে দলে সংগ্রামের পতাকাতলে সমবেত হতে থাকে এবং অচিরেই মহাসভার সদস্যসংখ্যা দেড় লক্ষ অতিক্রম করে।

তেলেঙ্গানা আন্দোলনের সেচ্ছাসেবক বাহিনী

তেলেঙ্গানার গ্রামে গ্রামে গড়ে উঠল ‘অন্ধ্র মহাসভা’-র শাখা, ‘পঞ্চ কমিটি’ (পঞ্চায়েত) এবং ভলান্টিয়ার বাহিনী। হাজার হাজার দরিদ্র কৃষক নাম লেখায় সেচ্ছাসেবক বাহিনীতে।

সেচ্ছাসেবক বাহিনীর হাতে অস্ত্র

হায়দ্রাবাদে তখন অস্ত্র আইনের কোনো কড়াকড়ি না থাকায় খোলা বাজারে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলা-বারুদ পাওয়া যেত। সেই সব অস্ত্র তুলে দেওয়া হল স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর হাতে। সংগঠিত পুলিশ ও মিলিটারির বিরুদ্ধে লড়তে গেলে যে পরিমাণ অস্ত্র দরকার, তা তাদের ছিল না।

অস্ত্রের অপ্রতুলতা

যথেষ্ট পরিমাণ অস্ত্র না থাকায় তারা অস্ত্র হিসেবে ভাঙ্গা ইট, কাঁচা বেল, পাথরের টুকরো, লঙ্কার গুঁড়ো, “বাদিশাল” নামে এক ধরনের বড় গুলতি, লাঠি ও তীর-ধনুক ব্যবহার করত এবং যুদ্ধ চলত গেরিলা কায়দায়।

তেলেঙ্গানায় বিপ্লবী কার্যক্রম

  • (১) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ -এর পূর্ব থেকেই তেলেঙ্গানাবাসীর আন্দোলন শুরু হলেও তা জোরদার হয়ে ওঠে ১৯৪৬-৪৭ খ্রিস্টাব্দে। এই সময় আবার নিজাম ইংরেজ সরকারের সঙ্গে চক্রান্ত করে স্বাধীন হায়দ্রাবাদ রাজ্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে।
  • (২) অচিরেই এই আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে এবং তেলেঙ্গানার প্রায় ২৫০০ গ্রামে নিজামশাহীর অবসান ঘটে। এই সব মুক্ত গ্রামগুলিতে কৃষকেরা ভূমিরাজস্ব ও ভূমিসংক্রান্ত সব নথিপত্র ধ্বংস করে দেয়, এবং এই সব স্থানে ‘বেটি’ বা বেগার প্রথা লোপ, কৃষি মজুরির হার বৃদ্ধি, পতিত ও উদ্বৃত্ত জমি কৃষকদের মধ্যেবন্টন এবং যারা জমি হারিয়েছিল তাদের জমি ফেরৎ দেওয়া হয়।
  • (৩) এই সব অঞ্চলে সেচের উন্নতি, কলেরা প্রতিরোধের ব্যবস্থা, আলোচনার মাধ্যমে বহু কৃষক ও পরিবারের মধ্যে বিরোধের নিষ্পত্তি, নারীর মর্যাদার উন্নতি, অস্পৃশ্যতা ও কুসংস্কার দূরীকরণ এবং লোকসংগীত ও নাটকের মাধ্যমে বিপ্লবী মূল্যবোধগুলি প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়।

হায়দ্রাবাদের ভারতভুক্তি

১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীন ভারতের সেনাপতি জয়ন্তনাথ চৌধুরী-র নেতৃত্বে ভারতীয় আন্দোলন প্রত্যাহার বাহিনীর ২৬ হাজার সৈন্য হায়দ্রাবাদে প্রবেশ করে এবং হায়দ্রাবাদ ভারত-ভুক্ত হয় (১৩ই সেপ্টেম্বর, ১৯৪৮ খ্রিঃ)।

তেলেঙ্গানা আন্দোলন প্রত্যাহার

হায়দ্রাবাদ ভারতের অন্তর্ভুক্ত হলেও তেলেঙ্গানায় কৃষক সংগ্রাম চলতে থাকে। শেষ পর্যন্ত ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে এই আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।

তেলেঙ্গানা আন্দোলনের গুরুত্ব

তেলেঙ্গানা বিপ্লব ব্যর্থ হলেও এর গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। এই আন্দোলনের ফলে

  • (১) ‘বেটি’ প্রথার অবসান ঘটে।
  • (২) জায়গিরদারি প্রথা বিলুপ্ত হয়।
  • (৩) তেলেঙ্গানাথেকে সামন্ততান্ত্রিক শোষণের অবসান ঘটে এবং
  • (৪) ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের পথ প্রশস্ত হয়।

তেলেঙ্গানা আন্দোলন সম্পর্কে সুনীল সেনের অভিমত

ডঃ সুনীল সেন লিখছেন “তেলেঙ্গানা আন্দোলনের বিজয় স্বীকার্য। নিজামের শাসনের অবসান হল। পুরানো স্বৈরতন্ত্র ধ্বংস হল। হায়দ্রাবাদ ভারত ইউনিয়নে যোগ দিল। কোনো সাম্প্রদায়িক ঘটনা এখানে ঘটে নি। সাম্প্রদায়িক শক্তি পিছু হটে। শেষ পর্যন্ত অন্ধ্ররাজ্য গঠিত হল ১৯৫২ সালে। ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠনের একটি দৃষ্টান্ত। অন্ধ্র জাতির ঐক্য হলো সংহত।”

তেলেঙ্গানা আন্দোলন সম্পর্কে সুপ্রকাশ রায়ের অভিমত

সুপ্রকাশ রায় বলেন, “তেলেঙ্গানা সংগ্রামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক, তেলেঙ্গানার সংগ্রাম ছিল হায়দ্রাবাদের শ্রমিকশ্রেণীর সংগ্রামের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। শ্রমিকশ্রেণীই ছিল এই সংগ্রামের প্রধান চালিকা শক্তি।

উপসংহার:- সব কিছু সত্ত্বেও তেলেঙ্গানাই ভারতের জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রথম আহ্বান জানিয়েছে, প্রথম পথ দেখিয়েছে। তেলেঙ্গানা ভারতের কৃষি-বিপ্লব আর তার সংগ্রামের অগ্রদূত।

(FAQ) তেলেঙ্গানা আন্দোলন সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. তেলেঙ্গানা আন্দোলন কখন হয়?

১৯৪৬-১৯৫১ খ্রিস্টাব্দ।

২. ইংরেজদের অধীনে হায়দ্রাবাদে কার শাসন চলত?

নিজামের।

৩. হায়দ্রাবাদ কবে ভারতভুক্ত হয়?

১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে।

৪. তেলেঙ্গানা আন্দোলন কবে প্রত্যাহার করা হয়?

১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে।

Leave a Comment