মোগল সাম্রাজ্যের জায়গিরদারি সংকট, খাজনা বন্ধ, কেন্দ্রীয় সরকারের দুর্বলতা, শোচনীয় অবস্থা, মোরল্যাণ্ড-এর অভিমত, বার্নিয়ারের অভিমত, জায়গির ব্যবস্থা, জায়গিরদারি সংকটের সূত্রপাত, জমা ও হাসিলের ফারাক, জায়গিরের অভাব, রেষারেষি ও স্বার্থপরতা, দক্ষিণী অভিজাতদের ক্ষোভ, দলাদলি বৃদ্ধি, দুর্নীতি ও অনাচার, রাজস্ব আদায়ে জোর, কৃষকদের উপর শোষণ ও অপদার্থ সেনাবাহিনী সম্পর্কে জানবো।
জায়গিরদারি সংকট প্রসঙ্গে জায়গির ব্যবস্থা, জায়গিরদারি সংকটের সূত্রপাত, এক দুরূহ অর্থনৈতিক সংকট, জায়গিরদারি সংকটের ফলে ভূমিহারা কৃষক, জমি বা জায়গিরের অভাব, জায়গিরদারি সংকটের সময়কাল, রাজনৈতিক কাঠামো ক্ষয়, দক্ষিণী অভিজাতদের ক্ষোভ, কৃষকদের ওপর শোষণ ও মোগল সাম্রাজ্যের পতনে জায়গিরদারি সংকটের প্রভাব সম্পর্কে জানব।
জায়গিরদারি সংকট
ঐতিহাসিক ঘটনা | জায়গিরদারি সংকট |
জায়গির অর্থ | বেতনের পরিবর্তে জমি |
জায়গির প্রাপক ব্যক্তি | জায়গিরদার |
সংকটের কারণ | জমির স্বল্পতা ও মনসবদারদের সংখ্যা বৃদ্ধি |
চরম আকার ধারণ | ঔরঙ্গজেব -এর রাজত্বকালে |
ভূমিকা :- শাহজাহান -এর আড়ম্বর প্রিয়তার ফলে মোগল রাজকোষ অনেকখানি শূন্য হয়ে পড়ে। উত্তর ভারত ও দাক্ষিণাত্যে বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে ঔরঙ্গজেব রাজকোষকে একেবারে শূন্য করে ফেলেন।
খাজনা বন্ধ
ঔরঙ্গজেবের আমলে সাম্রাজ্য-এর বিভিন্ন অংশে বিদ্রোহ দেখা দেয় এবং বিদ্রোহী জমিদার ও প্রজারা খাজনা বন্ধ করে দিলে রাজস্বের পরিমাণ কমতে থাকে।
কেন্দ্রীয় সরকারের দুর্বলতা
কেন্দ্রীয় সরকারের দুর্বলতার সুযোগে প্রাদেশিক শাসনকর্তারাও নিয়মিত রাজস্ব প্রদান বন্ধ করে দেন। এই সময় বাংলার শাসনকর্তা মুর্শিদকুলি খাঁ-ই একমাত্র নিয়মিতভাবে তাকে রাজস্ব পাঠাতেন।
শোচনীয় অবস্থা
অবস্থা এমনই দাঁড়ায় যে, অর্থাভাবে সেনাদল ও রাজকর্মচারীদের বেতন মেটানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ দুর্গগুলি মেরামতের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থও পাওয়া যেত না।
মোরল্যাণ্ড-এর অভিমত
ঐতিহাসিক মোরল্যাণ্ড মন্তব্য করছেন যে, “ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে দেশ যে দেউলিয়া, তা স্পষ্ট হয়ে উঠল।”
বার্নিয়ারের অভিমত
বিদেশি পর্যটক বার্নিয়ার লিখছেন যে, “বিশাল দরবারের জাঁকজমক বজায় রাখা এবং জনগণকে দমন করে রাখার জন্য বিশাল সেনাদল পালন করা হত। এর বিপুল ব্যয়ভার বহন করতে গিয়ে দেশ সর্বস্বান্ত হচ্ছে।”
জায়গির ব্যবস্থা
মোগল যুগে মনসবদারদের নগদ বেতনের পরিবর্তে জায়গির দেওয়া হত এবং এই জায়গিরদারি ব্যবস্থাই বহুলাংশে মোগল শাসনব্যবস্থার ভিত্তি ছিল।
জায়গিরদারি সংকটের সূত্রপাত
ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকালের শেষ দিকে জায়গিরদারি ব্যবস্থা প্রবল সংকটের সম্মুখীন হয়, যদিও এই সংকটের সূত্রপাত হয়েছিল জাহাঙ্গীর -এর আমলেই।
জমা ও হাসিলের ফারাক
জাহাঙ্গীর ও শাহজাহানের আমলে মনসবদারদের সংখ্যা যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। এই সময় থেকেই কাগজে-কলমে দেখানো রাজস্ব (জমা’) ও আদায়ীকৃত প্রকৃত রাজস্বের (‘হাসিল’) মধ্যে ফারাক দেখা দিতে শুরু করে। এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেও তাঁরা সফল হন নি।
জায়গিরের অভাব
ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকালে মনসবদারের সংখ্যা প্রচুর বৃদ্ধি পায়, কিন্তু বন্টনযোগ্য জমির পরিমাণ সে তুলনায় বৃদ্ধি পায় নি। এছাড়া, যুদ্ধ-বিধ্বস্ত অশান্ত দাক্ষিণাত্য থেকে জায়গিরদাররা কখনোই পুরোপুরি রাজস্ব আদায় করতে পারত না। এ কারণে সকলেই উত্তর ভারতে উর্বর জায়গির পেতে চাইত। বলা বাহুল্য, এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব ছিল। না।
জায়গির পাওয়ার জন্য স্বার্থপরতা ও রেষারেষি
জায়গির প্রার্থী মনসবদারকে জায়গিরের জন্য দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হত এবং জায়গির পেলেও সর্বদা ‘জমা’ ও ‘হাসিল’-এর মধ্যে সামঞ্জস্য হত না। এমতাবস্থায় জায়গির পাওয়ার জন্য মনসবদারদের মধ্যে দলাদলি চরমে ওঠে, জাত ও ধর্মের সুপ্ত মনোভাব জাগিয়ে তোলা হয় এবং অভিজাত সম্প্রদায় থেকে হিন্দুদের বিতাড়নের জিগির তোলা হয়।
দক্ষিণী অভিজাতদের ক্ষোভ
‘দক্ষিণী’ অভিজাতদের দলে টানার জন্য ঔরঙ্গজেব তাদের মনসব দিয়েছিলেন, কিন্তু নিম্নমানের মনসব পাওয়ায় তারাও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
জায়গির প্রাপ্তির ক্ষেত্রে দলাদলি বৃদ্ধি
উত্তর ভারতে উন্নত মানের জায়গির পাওয়ার জন্য সকলেই দরবারে নিজ নিজ প্রভাব বৃদ্ধিতে সচেষ্ট হয়—এমনকী সম্রাটকে পর্যন্ত প্রভাবিত করার চেষ্টা শুরু হয়। দরবারে অবাধে উৎকোচ দেওয়া-নেওয়া শুরু হয়। বলা বাহুল্য, এতে দলাদলিই বৃদ্ধি পায়।
জায়গির না পেয়ে দুর্নীতি ও অনাচার
জায়গির না পাওয়ায় বা নিম্নমানের জায়গির পেয়ে ‘জমা’ ও ‘হাসিল’-এর মধ্যে সামঞ্জস্য না হওয়ায় সাম্রাজ্যে নানা দুর্নীতি ও অনাচার দেখা দেয় এবং এর ফলে সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে।
জায়গিরদারদের রাজস্ব আদায়ে জোর
জায়গিরের ওপর জায়গিরদারের অধিকার স্থায়ী ছিল না—কয়েক বছরের মধ্যেই তাকে অন্যত্র বদলি করা হত। এই কারণে সব জায়গিরদারই চাইত যতটা বেশি সম্ভব রাজস্ব আদায় করতে। এর ফলে অনেকেই যুদ্ধকরা অপেক্ষা রাজস্ব আদায়েই বেশি মনোযোগী ছিল।
কৃষকের ওপর জায়গিরদারদের শোষণ
জায়গিরদারদের শোষণে জায়গিরগুলি মরুভূমিতে পরিণত হয়। অনেক সময় আবার জায়গিরদাররা নিজেরা রাজস্ব আদায় না করে ব্যবসায়ী ও মহাজনদের জায়গির ইজারা দিত। এর ফলে দরিদ্র কৃষকের ওপর অত্যাচার ও শোষণের মাত্রাই বৃদ্ধি পেত এবং তারা কৃষিকার্য পরিত্যাগ করে পলায়ন করত।
যুদ্ধক্ষেত্র থেকে জায়গিরদারদের পলায়ণ
অধিকাংশ জায়গিরের আয় মনসবদারের বেতন অপেক্ষা কম হওয়ায় অনেকেই নির্দিষ্ট পরিমাণ সেনা, অশ্ব বা অস্ত্র রাখত না—এমনকী সেনা ও অশ্ব বাঁচাবার জন্য অনেক সময় তারা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করত।
অপদার্থ সেনাবাহিনী
মোগল সেনাবাহিনীতে অসংখ্য সৈনিক থাকলেও তাদের কোনও যুদ্ধ শিক্ষা ছিল না। এইভাবে মোগল সেনাবাহিনী নীতিহীন, দুর্বল ও অকর্মণ্য জনসমষ্টিতে পরিণত হয়। বলা বাহুল্য, এর ফলাফল রাষ্ট্রের পক্ষে কল্যাণকর হয় নি।
উপসংহার :- জায়গির লাভের জন্য অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা রাজনৈতিক সংকট বৃদ্ধি করতে থাকে, যা মোগল সাম্রাজ্যের পতনের পথকে প্রশস্ত করে।
(FAQ) জায়গিরদারি সংকট সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
বন্দোবস্তকৃত জমি।
মোগল সাম্রাজ্যে।
জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে।
ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকালে।