পরবর্তী বৈদিক যুগের সমাজ ব্যবস্থা প্রসঙ্গে জাতিভেদ প্রথার উদ্ভব, ক্ষত্রিয় বা রাজন্য, ব্রাহ্মণ বা পুরোহিত, বৈশ্য ও শূদ্র, শূদ্রদের দুরবস্থা, ব্রাত্য, নিষাদ ও নারীদের অবস্থার অবনতি সম্পর্কে জানবো।
পরবর্তী বৈদিক যুগের সমাজ ব্যবস্থা
ঐতিহাসিক ঘটনা | পরবর্তী বৈদিক যুগের সমাজ ব্যবস্থা |
শ্রেণি | চারটি |
প্রাধান্য | ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় |
সমাজ বহির্ভূত | ব্রাত্য ও নিষাদ |
বিদুষী নারী | গার্গী ও মৈত্রেয়ী |
ভূমিকা :- পরবর্তী বৈদিক যুগ বলতে ঋগ্বেদ -এর পরবর্তী যুগ বুঝায়। ঋকবেদের যুগের সঙ্গে পরবর্তী বৈদিক যুগের প্রভূত সময়ের ব্যবধান আছে। আর এই ব্যবধানের মধ্যে সমাজের পরিবর্তনও ঘটে যথেষ্ট পরিমাণে।
পরবর্তী বৈদিক যুগে জাতিভেদ প্রথার উদ্ভব
পরবর্তী বৈদিক যুগে বর্ণভেদ বা শ্রেণীভেদ প্রথা কঠোরতর হয়। বিভিন্ন শ্রেণী বা বর্ণের মধ্যে বৈষম্য বাড়ে। এক শ্রেণী থেকে অন্য শ্রেণীতে পরিবর্তন এমন সহজ ছিল না। অবশ্য তখনও বংশানুক্রমিক জাতিভেদ প্রথা সঠিকভাবে গড়ে ওঠে নি। তবে সমাজ অনেকটা এই দিকে এগিয়ে গিয়েছিল।
পরবর্তী বৈদিক যুগে ক্ষত্রিয় বা রাজন্য
পূর্ব ও দক্ষিণ ভারত -এ আর্য জাতি বিস্তারের সময় অনার্যদের সঙ্গে আর্যদের নিরন্তর যুদ্ধ-বিগ্রহ চলত। এজন্য আর্য সমাজে রাজন্য বা যোদ্ধা শ্রেণীর প্রাধান্য বাড়ে। রাজন্য বা ক্ষত্রিয়রা সামরিক শক্তির জোরে ভূমি ও শাসন ক্ষমতা দখল করে সমাজে বিশেষ ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে। ক্ষত্রিয়রা রাজকার্য, যুদ্ধ ও জমির উপস্বত্ব ভোগ করে একটি প্রবল শ্রেণীতে পরিণত হয়।
পরবর্তী বৈদিক যুগে পুরোহিত বা ব্রাহ্মণ
- (১) পুরোহিত বা ব্রাহ্মণরা যাগ, যজ্ঞ, পূজা প্রভৃতির একচেটিয়া অধিকার হাতে রাখে। অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে ব্রাহ্মণ শ্রেণী সমাজে বিশেষ মর্যাদা পায়। আর্য সমাজে পরিবর্তন ঘটছে বুঝে ব্রাহ্মণরা উপনয়ন প্রথার মাধ্যমে উপবীত ধারণ করে। অন্য সম্প্রদায় হতে তাদের স্বতন্ত্রতা রক্ষা পেত।
- (২) উপনয়নের ফলে ব্রাহ্মণরা দ্বিজ নাম পায়। যজ্ঞ অনুষ্ঠান ও পুজো পদ্ধতি এই যুগে জটিল হওয়ার ফলে ব্রাহ্মণ ছাড়া আর কেউ এই কাজ করতে পারত না। পুরোহিত রাজাকে মন্ত্রণা দিতেন এবং নিজেকে রাজ্যের রক্ষক মনে করতেন।
- (৩) একই পুরোহিত একাধিক রাজ্যে নিযুক্ত হতেন। ব্রাহ্মণ নিজেকে ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী বলে দাবী করেন। এইভাবে সমাজে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় শ্রেণীর প্রাধান্য স্থাপিত হয়।
পরবর্তী বৈদিক যুগে বৈশ্য ও শূদ্র
- (১) আর্য বৈশ্যরা এই যুগে কৃষি ও পশুপালন ছাড়া আরও নানা বৃত্তি নেয়। জীবনযাত্রার জটিলতা বাড়ার ফলে বৃত্তির সংখ্যা বাড়ে। বৃত্তির ফলে শ্রেণীর সংখ্যা বাড়ে। পূর্বের চারটি শ্রেণী বা বর্ণের স্থলে অনেকগুলি ক্ষুদ্র বর্ণের উদ্ভব হয়।
- (২) বাণিজ্য, শিল্পের কাজ, হাতের কাজ প্রভৃতি নানা উৎপাদনমূলক কাজে বৈশ্য শ্রেণী নিজেদের নিয়োজিত করে। প্রকৃতপক্ষে সমাজের সম্পদ, খাদ্য সকল কিছুই বৈশ্য ও শূদ্রদের শ্রমে তৈরি হত।
- (৩) আর্য বৈশ্যরা কৃষির দ্বারা খাদ্য, শিল্পের দ্বারা প্রয়োজনীয় দ্রব্য এবং বাণিজ্যের দ্বারা সম্পদ উৎপাদন করলেও সমাজে তাদের মর্যাদা ও স্থান নীচে নেমে যায়। ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় যারা ছিল প্রকৃতপক্ষে পরগাছা শ্রেণী তারাই প্রাধান্য পায়।
- (৪) বৈশ্যদের এরূপ অবনতির কারণ হল এই যে, তারা যে বৃত্তি অর্থাৎ কৃষি, পশুপালন প্রভৃতি করত শূদ্ররাও সেই বৃত্তি পালন করত। ফলে শূদ্রদের সঙ্গে তাদের পার্থক্য কমে যায়।
- (৫) ঋকবৈদিক যুগ -এ আর্য বৈশ্যরা ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের সঙ্গে যে সম-মর্যাদা ভোগ করত, পরবর্তী বৈদিক যুগে তারা তা হারিয়ে ফেলে। ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়েরা আর্য-বৈশ্যদের হেয় জ্ঞান করে।
- (৬) এই যুগে অস্পৃশ্যতার চিন্তাধারাও দানা বাঁধে। এভাবে ঋকবেদের পরবর্তী যুগে জাতিভেদ প্রথার সূত্রপাত হয়। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র চারটি প্রধান শ্রেণীর গঠন হয়। বংশানুক্রমিক বৃত্তিকে অবলম্বন করে জাতিভেদ প্রথার সূচনা হয়।
পরবর্তী বৈদিক যুগে শূদ্রদের দুরবস্থা
- (১) পরবর্তী বৈদিক যুগে শূদ্রের অবস্থা সর্বাপেক্ষা খারাপ হয়। সমাজের কাঠামোয় শূদ্রের স্থান সবার নীচে স্থাপন করা হয়। আর্যরা নতুন অঞ্চলে বসতি স্থাপন করলে সমাজ সংগঠনের সময় শূদ্রকে সবার নীচে স্থান দেওয়া হয়। শূদ্রকে সমাজের তিন বর্ণের আধান ও তিন বর্ণের সম্পত্তি বলে মনে করা হত।
- (২) শূদ্র শ্রেণীর লোকেদের অপবিত্র বলে গণ্য করা হত। এজন্য শূদ্র জাতীয় লোককে যজ্ঞস্থানে বা দেব পুজোয় আসতে দেওয়া হত না। উচ্চবর্ণের লোকেরা চতুরাশ্রম পালন করলেও শূদ্রের এই অধিকার ছিল না।
পরবর্তী বৈদিক যুগে ব্রাত্য
- (১) ব্রাত্য ও নিষাদ নামে দুটি জনগোষ্ঠীর পরিচয় এই যুগে পাওয়া যায়। ব্রাত্যরা ছিল সম্ভবত সেই সকল আর্য যারা অন্যান্য আর্যগোষ্ঠীর মত কৃষিকে জীবিকা হিসেবে নিয়ে গ্রামে বসবাস করত না। যারা তখনও আর্যদের আদি জীবিকা পশুপালনকে অবলম্বন করে যাযাবর জীবন যাপন করত, তাদের ভাষা ছিল সম্ভবত প্রাকৃত ভাষা।
- (২) ব্রাত্যরা নিজেরা চাষ-আবাদ করত না। বনের ফলমূল ও পশুপাখির মাংস আহার করে বেঁচে থাকত। এরা Food gathering man অর্থাৎ খাদ্য আহরণকারী মনুষ্য গোষ্ঠীর পর্যায়ে ছিল। তারা রীতিমত কৃষিকর্ম দ্বারা Food producing man অর্থাৎ খাদ্য উৎপাদনকারী মানুষে পরিণত হয় নি।
পরবর্তী বৈদিক যুগে নিষাদ
- (১) নিষাদ ছিল অনার্য জাতি। তারা বনে জঙ্গলে পশু শিকার করে জীবিকা অর্জন করত। গ্রামের কৃষিক্ষেত্রে বন্য পশুর উৎপাত হলে তারা বন্য পশু-পাখী নিধন করে কৃষিকে রক্ষা করত। নিষাদরা নিজেরা চাষ-আবাদ করত না।
- (২) বনের ফলমূল ও পশুপাখির মাংস আহার করে বেঁচে থাকত। এরা Food gathering man অর্থাৎ খাদ্য আহরণকারী মনুষ্য গোষ্ঠীর পর্যায়ে ছিল। তারা রীতিমত কৃষিকর্ম দ্বারা Food producing man অর্থাৎ খাদ্য উৎপাদনকারী মানুষে পরিণত হয় নি।
পরবর্তী বৈদিক যুগে নারীদের অবস্থার অবনতি
- (১) পরবর্তী বৈদিক যুগে নারীর মর্যাদা অনেক কমে যায়। বেদের ব্রাহ্মণ ও সংহিতা অংশে দেখা যায় কন্যা সন্তানের জন্ম হলে লোকে দুর্ভাগ্য বলে মনে করত। ধর্মাচরণে পুরোহিত শ্রেণীর আধিপত্য বাড়লে নারীদের পুরুষের সঙ্গে ধর্মাচরণের অধিকার কমে যায়।
- (২) পুরোহিতরাই ধর্মাচরণের সকল কাজ করতে থাকেন। এই যুগে বাল্য বিবাহের প্রচলন বাড়ে। পণপ্রথার প্রসার ঘটে। নারীদের ক্ষেত্রে বিবাহের নিয়মকানুন আগের অপেক্ষা কঠোর হয়। পুরুষেরা বহু বিবাহে অভ্যস্ত হয়। রাজাদের একাধিক রাণী থাকতেন। সকল রাণীর সমান মর্যাদা ছিল না। অনেকে অবহেলিত হতেন।
- (৩) সমাজে নারীদের মর্যাদা এত কমে যায় যে, পুরুষেরা তাদের সুরা বা জুয়া খেলার মতই ব্যাসনের বস্তু বলে গণ্য করত। সম্পত্তির অধিকার থেকেও নারীদের অধিকার খর্ব করা হয়। যদিও পরবর্তী বৈদিক যুগে গার্গী, মৈত্রেয়ী প্রভৃতি ব্রহ্ম বাদিনী, দার্শনিক, জ্ঞানবর্তী নারীদের কথা জানা যায়। তবে সাধারণভাবে নারীদের সামাজিক মর্যাদার অবনমন ঘটেছিল এতে সন্দেহ নেই।
উপসংহার :- পরবর্তী বৈদিক যুগে গমের মতই চাউল একটি প্রধান খাদ্যে পরিণত হয়। লোকের মাংস খাওয়ার অভ্যাস কমে যায়। সূতী কাপড়ের সঙ্গে রেশমের ব্যবহার আরম্ভ হয়। লোকে আগের মতই সোমরস ও সুরা পান করত।
(FAQ) পরবর্তী বৈদিক যুগের সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
গার্গী ও মৈত্রেয়ী।
ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়।
ব্রাত্য ও নিষাদ।
ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য শ্রেণি।