শেরশাহের অভ্যুত্থান

শেরশাহের অভ্যুত্থান প্রসঙ্গে জন্ম, পিতৃপরিচয়, প্রথম জীবন, পিতার জায়গীরের শাসন ভার, বাহার খাঁ লোহানীর অধীনে চাকরি, বাবরের অধীনে চাকরি, জালাল খাঁর অধীনে চাকরি, বিবাহ, দাদরার যুদ্ধ, শেরশাহের মর্যাদা বৃদ্ধি, সুরজগড়ের যুদ্ধ ও সুরজগড়ের যুদ্ধের গুরুত্ব সম্পর্কে জানবো।

শেরশাহের অভ্যুত্থান

ঐতিহাসিক ঘটনাশেরশাহের অভ্যুত্থান
রাজাশেরশাহ
বংশসুরি বংশ
রাজত্বকাল১৫৪০-১৫৪৫ খ্রি
পূর্ববর্তী রাজাহুমায়ুন
শেরশাহের অভ্যুত্থান

ভূমিকা :- ষোড়শ শতকে দিল্লীর সুলতানির পতন আসন্ন হলে ভারত-এর রাজনৈতিক ভাগ্য কয়েকজন দুঃসাহসিক, উচ্চাকাঙ্ক্ষী, অভিযানকারীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। জাহিরুদ্দিন মহম্মদ বাবর ছিলেন এই অভিযানকারীদের অন্যতম। তার মৃত্যুর পর শেরশাহের অভ্যুত্থান ঘটে।

শেরশাহের সাহসীকতার যুগ

এই সময় সাহসী ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী লোকেরা তরবারি সম্বল করে ভারতে সাম্রাজ্য স্থাপন করেন। বাবর আফগানিস্তান থেকে এসে যেমন তরবারির দ্বারা সাম্রাজ্য গড়েন শেরশাহ বিহারের সামান্য জাগীরদার থেকে তরবারির দ্বারা সাম্রাজ্য স্থাপন করেন।

শেরশাহের জন্ম

আফগাণ নেতা শের শাহের জন্ম হয় ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর জন্ম তারিখ ও জন্মস্থান সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য প্রমাণ না থাকায় এই বিষয়ে বিতর্ক আছে। সম্ভবত পাঞ্জাবের নারনুল পরগণায় তাঁর জন্ম হয়।

আফগাণ নেতা শেরশাহের পিতৃ পরিচয়

তাঁর পিতার নাম ছিল হাসান খাঁ শূর। হাসান খাঁ, জামাল বা লোহানীর অধীনে চাকুরী নিয়ে বিহারের সাসারামের জাগীরদার নিযুক্ত হন।

শেরশাহের প্রথম জীবন

আফগাণ নেতা শেরশাহের বাল্যকালের নাম ছিল ফরিদ। তিনি তার পিতার প্রথমা পত্নীর সন্তান ছিলেন। কিন্তু হাসান খাঁ তার চতুর্থ পত্নীর প্রভাবে ফরিদকে অবহেলা করেন। এজন্য বাল্যকাল থেকে ফরিদ আত্মনির্ভরশীল ও উদ্যমী হয়েছিলেন।

শেরশাহ কর্তৃক পিতার জায়গীরের শাসন ভার গ্রহণ

  • (১) যৌবনে পা দিয়েই ফরিদ তার ভাগ্য অন্বেষণে বেরিয়ে পড়েন এবং জামাল বা লোহানীর অধীনে চাকুরী নেন। জামাল খাঁর প্রভাবে তার পিতার সঙ্গে শের খাঁ বা ফরিদের মিলন ঘটে এবং তিনি পিতার জাগীরের শাসনভার পান।
  • (২) এই জাগীর প্রায় ২১ বছর (১৪৯৭–১৫১৮ খ্রীঃ) দেখাশোনা করার সময় শের ভবিষ্যতে হিন্দুস্থানের শাসনকার্য সম্পর্কে হাতে-কলমে শিক্ষা লাভ করেন।

বাহার খাঁ লোহানীর অধীনে শেরশাহের চাকরি

  • (১) ফরিদের পক্ষে পিতৃগৃহে বেশীদিন থাকা সম্ভব ছিল না। তিনি বিমাতার অত্যাচারে পুনরায় সাসারাম ছেড়ে দক্ষিণ বিহারের অধিপতি বাহার খাঁ লোহানীর অধীনে চাকুরী নেন। এই সময় তিনি একা নিজ হাতে একটি বাঘ মারার ফলে তার সাহসিকতার জন্য শের খাঁ উপাধি পান।
  • (২) বাহার খাঁ তাকে সহকারী শাসনকর্তার পদ দেন। বাহার খাঁর অধীনে শের খাঁ কিছুদিন কাজ করার পর তার বিরুদ্ধে লোহানী আফগান সর্দারদের চক্রান্তে বিরক্ত হয়ে এই চাকুরী ছেড়ে দেন।

মোঘল সম্রাট বাবরের অধীনে শেরশাহের চাকরি

  • (১) এই সময় বাবর পানিপথের প্রথম যুদ্ধখানুয়ার যুদ্ধ-এ জিতে রাজ্য বিস্তারে রত ছিলেন। মুঘল সামরিক শক্তির প্রতাপে চমৎকৃত হয়ে এবং ভবিষ্যতে লাভবান হওয়ার আশায় শের খাঁ বাবরের অধীনে সামরিক বিভাগে চাকুরী নেন।
  • (২) তিনি বাবরকে চান্দেরী দুর্গ দখলে বিশেষ সাহায্য করেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই উচ্চাকাঙ্ক্ষী শের খাঁ বুঝতে পারেন যে, মুঘল শিবিরে কোনো আফগান উচ্চাকাঙ্ক্ষীর ভবিষ্যৎ নেই। ইতিমধ্যে তিনি মুঘল শক্তির রণকৌশল ভালভাবে বুঝে নেন।

জালাল খাঁর অধীনে শেরশাহের চাকরি

শের খাঁ বাববের চাকুরী ছেড়ে পুনরায় বিহারে ফিরে আসেন এবং লোহানী সুলতানের অধীনে চাকুরী নেন। এই সময় বাহার খাঁ লোহানীর মৃত্যু হওয়ায় তাঁর নাবালক পুত্র জালাল খাঁই ছিলেন বৈধ সুলতান। মৃত বাহার খাঁর বিধবা পত্নী শের খাঁকে নায়েব নিযুক্ত করেন। শের খাঁ এই নাবালকের অভিভাবক হিসেবে প্রায় সকল ক্ষমতা নিজ হাতে নেন।

আফগাণ নেতা শেরশাহের বিবাহ

তিনি এই সময় চুনার দুর্গের অধিপতি তাজ খাঁর বিধবা পত্নী লাড মালিকাকে বিবাহ করে চূনার দুর্গের অধিকার পান। এই সময় তিনি গাজিপুরের জাগিরদারের বিধবা পত্নী গৌহর গোসাঁইকে বিবাহ করেন।

দাদরার যুদ্ধে শেরশাহের অংশগ্রহণ

এই সময় লোদী বংশের আফগান সুলতান মহম্মদ লোদী হুমায়ূনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে, আফগান বংশীয় শের শাহ তার পক্ষ নেন। দাদরার যুদ্ধে (১৫৩১ খ্রি) শের শাহ মহম্মদ লোদীর পক্ষ ত্যাগ করেন। এর ফলে মহম্মদ লোদীর বাহিনী ধ্বংস হয়।

শেরশাহের মর্যাদা বৃদ্ধি

আফগাণ নেতা শেরশাহের ক্ষমতার কেন্দ্র চূনার দুর্গ কিছুকাল হুমায়ূন অবরোধ করার পর গুজরাট যুদ্ধের জন্য অবরোধ ত্যাগ করলে শেরশাহের মর্যাদা অনেক বৃদ্ধি পায়।

সুরজগড়ের যুদ্ধে শেরশাহের জয়লাভ

  • (১) শের খাঁর এই ক্ষমতা বৃদ্ধিতে লোহানী সর্দারেরা ঈর্ষান্বিত হন। তাঁরা গোপনে নিজেদের শক্তি সংহত করেন। বাংলার সুলতান মাহমুদ শাহ, শের খাঁর শক্তি বৃদ্ধিতে আশঙ্কিত ছিলেন। তিনিও এই জোটে যোগ দিয়ে শের খাঁকে আক্রমণ করেন।
  • (২) ১৫৩৪ খ্রিস্টাব্দে কিউলের বা সুরজগড়ের যুদ্ধ-এ শের খাঁ তাঁর বিরোধী শক্তিকে ধ্বংস করে কার্যত বিহারের আধিপত্য পান। বাংলার দরজাও তাঁর কাছে খুলে যায়।

শেরশাহের জীবনে সুরজগড়ের যুদ্ধের গুরুত্ব

সুরজগড়ের যুদ্ধকে ডঃ কে. কে. দত্ত, শের শাহের জীবনে যুগ-সন্ধিক্ষণ বলে অভিহিত করেছেন। ডঃ কে. আর কানুনগোর মতে “সুরজগড়ের যুদ্ধে জয়লাভ না করলে, সাসারামের অখ্যাত জায়গীরদারের এই পুত্র সম্ভবত তাঁর নগন্য অজ্ঞাত জীবনের আড়াল হতে সিংহাসনের দাবীদার রূপে আবির্ভূত হতে পারতেন না”।

উপসংহার :- সুরজগড়ের যুদ্ধ জয়ের ফলে সাসারামের ক্ষুদ্র জায়গীরদার হিন্দুস্থানের অধিপতি হওয়ার জন্য প্রথম পদক্ষেপ করেন। এরপর তিনি হুমায়ূনকে পরাজিত করে দিল্লির সিংহাসন দখল করেন।

(FAQ) শেরশাহের অভ্যুত্থান সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. শেরশাহের প্রকৃত নাম কি?

ফরিদ খাঁ।

২. শেরশাহের পৈতৃক জায়গির কোথায় ছিল?

বিহারের সাসারাম।

৩. কাকে পরাজিত করে শেরশাহ দিল্লির অধীশ্বরে পরিনত হন?

হুমায়ূন।

৪. শেরশাহের রাজত্বকাল কত?

১৫৪০-১৫৪৫ খ্রিস্টাব্দ।

Leave a Comment