ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা

ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে বাবরের ভারত আক্রমণের কারণ, সীমান্ত আক্রমণ, বাবরের কাছে সাহায্য প্রার্থনা, লাহোর ও দীপালপুর অধিকার, ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা, পাঞ্জাব জয়, দিল্লি অভিযান, ইব্রাহিম লোদীর পরাজয়, বাবরের জয় লাভের কারণ ও পানিপথের প্রথম যুদ্ধ সম্পর্কে জানবো।

ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা

ঐতিহাসিক ঘটনাভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা
প্রতিষ্ঠাতাজহিরুদ্দিন মহম্মদ বাবর
সময়কাল১৫২৬ খ্রিস্টাব্দ
পরাজিত রাজাইব্রাহিম লোদী
ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা

ভূমিকা :- গাজদাওয়ানের যুদ্ধে পরাজয়ের পর বাবর উপলব্ধি করেন যে, সমরখন্দ জয় করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। এরপর ১৫১২ খ্রিস্টাব্দ থেকে তিনি একদিকে কাবুলে তাঁর ক্ষমতাকে দৃঢ় করার চেষ্টা করেন, অন্যদিকে তিনি কাবুলের পার্বত্যভূমি থেকে পূর্বদিকে ভারত-এর সমতল অঞ্চলের প্রতি দৃষ্টি দেন।

মোঘল নেতা বাবরের ভারত অভিযানের কারণ

  • (১) বাবরের মত উচ্চাকাঙ্ক্ষী সাম্রাজ্যবাদী শাসকের পক্ষে ক্ষুদ্র পার্বত্য রাজ্য আফগানিস্তান নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা সম্ভব ছিল না। ফলে ভারতের সমতলভূমির শ্যামল হাতছানি তাকে আকৃষ্ট করে।
  • (২) তিনি এক বর্ষীয়ান মহিলার কাছে তৈমুরের দিল্লী বিজয়ের কাহিনী শুনেন। তখন থেকেই ভারতবর্ষ সম্পর্কে তার আগ্রহ জন্মায়। মধ্য এশিয়ায় তাঁর রাজ্য বিস্তারের সম্ভাবনা সুদূরপরাহত হলে তিনি স্বভাবতই ভারতের দিকে দৃষ্টি ফেরান।
  • (৩) উত্তর ভারতের রাজনৈতিক অস্থিরতা, লোদী সর্দারদের মধ্যে অন্তর্বিরোধ বাবরের অজানা ছিল না। তাছাড়া ভারতের ঐশ্বর্য ও ধন-সম্পদের প্রলোভনও তাঁর ছিল।

বাবর কর্তৃক ভারতের সীমান্ত আক্রমণ

১৫১৯-১৫২৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ৪ টি প্রাথমিক অভিযান চালিয়ে বাবর ভারতের সীমান্ত অঞ্চলে তার প্রবেশের পথ পরিষ্কার করেন। ১৫১১ খ্রিস্টাব্দে তিনি বাজাউর ও ভেরা নামক সীমান্তের স্থান অধিকার করেন। ১৫২০ খ্রিস্টাব্দে তিনি পাঞ্জাবের শিয়ালকোট পর্যন্ত এগিয়ে আসেন।

বাবরের কাছে দিল্লির অভিজাতদের সাহায্য প্রার্থনা

  • (১) ইতিমধ্যে দিল্লীর সুলতান ইব্রাহিম লোদীর সঙ্গে তার সামন্ত দৌলত খাঁ লোদী ও আলম খাঁ লোদীর বিবাদ বাধলে, শেষের দুইজন বাবরের সাহায্য চান। পাঞ্জাবের শাসক দৌলত খাঁ লোদী তাঁর পুত্র দিল ওয়াক খাঁ লোদির প্রতি দিল্লীর সুলতান ইব্রাহিমের নিষ্ঠুরতার জন্য প্রতিশোধ চান।
  • (২) আলম খাঁ তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র ইব্রাহিম লোদীর হাত থেকে দিল্লীর সিংহাসন দখল করতে ইচ্ছুক ছিলেন। দৌলত খাঁ ও আলম খাঁ ভেবেছিলেন যে, তাঁরা ইব্রাহিমের বিরুদ্ধে বাবরকে ব্যবহার করে নিজেদের উচ্চাশা পূরণ করবেন।
  • (৩) কিন্তু তাদের এই ধারণা শীঘ্রই দূর হয়। তাঁরা বুঝতে পারেন যে, বাবর ভারতে তাঁর স্থায়ী আধিপত্য স্থাপনে দৃঢ়-প্রতিজ্ঞ।

মোঘল নেতা বাবরের লাহোর ও দীপালপুর অধিকার

বাবর ১৫২৪ খ্রিস্টাব্দে লাহোর ও দীপালপুর অধিকার করেন। তিনি কাবুলে ফিরে গেলে দৌলত খাঁ লোদী লাহোর পুনরায় অধিকার করেন। কিন্তু বাবর পুনরায় ভারতে ফিরে আসেন।

ভারতের উদ্দেশ্যে বাবরের যাত্রা

বাবর তার আত্মজীবনী বাবরনামা বা তুজুক-ই-বাবরীতে বলেছেন যে, ১৫২৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘হিন্দুস্থান’ বিজয়ের জন্য ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।

মোঘল নেতা বাবরের পাঞ্জাব জয়

ইব্রাহিম লোদীর সামন্ত দৌলত খাঁ লোদী বাবরকে প্রতিহত করা অসম্ভব দেখে তার বশ্যতা স্বীকার করেন। বাবর পাঞ্জাব জয় করে দিল্লীর দিকে এগিয়ে যান।

বাবরের দিল্লি অভিযান

  • (১) ইব্রাহিম লোদী দিল্লী রক্ষার জন্য তাকে পানিপথের প্রান্তরে বাধা দিলে ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে পানিপথের প্রথম যুদ্ধ সংঘটিত হয়। বাবর তার আত্মজীবনীতে বলেছেন যে, তাঁর হাতে মাত্র ১২ হাজার সেনা ছিল।
  • (২) ঐতিহাসিক রাশব্রুক উইলিয়ামসের মতে, পানিপথে শেষ পর্যন্ত বাবরের হাতে মাত্র ৮ হাজার সেনা ছিল। এর সঙ্গে কিছু অতিরিক্ত সেনা পাঞ্জাব জয়ের পর যোগ দেয়। আহমদ ইয়াদগারের মতে, বাবরের হাতে মোট ২৪ হাজার সেনা ছিল।

বাবরের বিরুদ্ধে ইব্রাহিম লোদীর সেনা

ইব্রাহিম লোদীর এক লক্ষ সেনা ছিল বলে জানা যায়। গবেষকদের মতে, প্রকৃতপক্ষে ইব্রাহিমের ৪০ হাজার সেনা ছিল।

বাবরের নিকট ইব্রাহিম লোদীর পরাজয়

ইব্রাহিমের বিরাট বাহিনীর সম্মুখীন হয়ে বাবর হতাশ হন নি। তিনি উজবেগী ও তুর্কীদের কাছ থেকে নতুন রণকৌশল শিখেছিলেন। এর নাম ছিল ‘তুলঘুমা’ যুদ্ধরীতি। বাবরের নতুন ব্যূহ গঠন, তাঁর আগ্নেয়াস্ত্র – কামান ও বন্দুকের উপযুক্ত ব্যবহার এবং উজবেগী অশ্বারোহীদের দ্বারা আক্রমণ, এই তিন কৌশলে তিনি পানিপথে ইব্রাহিমের বাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করে দেন। ইব্রাহিম যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হন। এই প্রথম ভারতে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার হয়।

ভারতে বাবরের জয়লাভের কারণ

  • (১) রাশব্রুক উইলিয়ামস এবং কেমব্রিজ ঐতিহাসিকসহ প্রায় অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে, পানিপথের প্রথম যুদ্ধ এবং খানুয়ার যুদ্ধ-এ বাবর তাঁর কামান ও হাত কামানের সাহায্যে জয় লাভ করেন। জনৈক ভারতীয় ঐতিহাসিক এই মতের বিরোধিতা করেন।
  • (২) তিনি বলেন যে, পানিপথের যুদ্ধের সময় বাবরের হাতে দুটির বেশি কামান ছিল না। এই যুদ্ধে তিনি তার তীরন্দাজ বাহিনীর সাহায্যে জিতেন। তবে এই প্রসঙ্গে বাবরের আত্মজীবনী তুজুক-ই-বাবরীই প্রধান উপাদান। এই গ্রন্থে বাবর তার জয়লাভের কৃতিত্ব তাঁর গোলন্দাজ বন্দুক বাহিনীকেই দিয়েছেন।

পানিপথের প্রথম যুদ্ধ ও মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা

২১ এপ্রিল, ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত এই পানিপথের প্রথম যুদ্ধ ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে আফগান শক্তি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। ডঃ আর. পি. ত্রিপাঠী পানিপথের যুদ্ধ সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন যে, “এই যুদ্ধ ছিল এক চূড়ান্ত ক্ষমতা নির্ণায়ক যুদ্ধ (A decisive war)।” এরপর সুরু হয় মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাস।

উপসংহার :- পানিপথের যুদ্ধে জয়লাভের ফলে মহান মুঘল সাম্রাজ্যের পত্তন হয়। এই সাম্রাজ্য তার বিশালতা, আড়ম্বরে ও সংস্কৃতির দিক থেকে মুসলিম জগতে শ্রেষ্ঠতম ছিল এবং তা রোমান সাম্রাজ্যের সমকক্ষতা দাবী করতে পারত।”

(FAQ) ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা কে?

জহিরুদ্দিন মহম্মদ বাবর।

২. পানিপথের প্রথম যুদ্ধ কখন হয়?

২১ এপ্রিল, ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে।

৩. পানিপথের প্রথম যুদ্ধ কাদের মধ্যে হয়?

ইব্রাহিম লোদি ও বাবর।

৪. ভারতে কোন যুদ্ধে প্রথম আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হয়?

পানিপথের প্রথম যুদ্ধ।

Leave a Comment