আকবরের পথপ্রদর্শক হিসেবে শেরশাহের ভূমিকা

আকবরের পথপ্রদর্শক হিসেবে শেরশাহের ভূমিকা প্রসঙ্গে আকবরের সংস্কারের পথ প্রস্তুত, শাসন যন্ত্রের কাঠামো, আকবরের রাজস্ব নীতির ওপর শেরশাহের প্রভাব, পরগনা ও সরকারের শাসন, আকবরের সামরিক সংস্কারে শের শাহের প্রভাব, শাসন ব্যবস্থা মজবুত করা, নতুনত্ব দান, শের শাহের ধর্মসহিষ্ণুতা নীতির প্রভাব, বিচার ব্যবস্থা, জাতীয় সম্রাটের মর্যাদা অর্জন, জাতি গঠন ও কৃষকদের মঙ্গল সম্পর্কে জানবো।

আকবরের পথপ্রদর্শক হিসেবে শেরশাহের ভূমিকা

ঐতিহাসিক ঘটনাআকবরের পথপ্রদর্শক হিসেবে শেরশাহের ভূমিকা
রাজাশেরশাহ
বংশসুরি বংশ
রাজধানীদিল্লি
আকবরের পথপ্রদর্শক হিসেবে শেরশাহের ভূমিকা

ভূমিকা :- দিল্লীর সিংহাসনে যে সকল সুলতান বসেন তাদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুলতান হিসেবে শের শাহের কৃতিত্ব প্রায় সকল ঐতিহাসিক স্বীকার করেন।

ক্রুক-এর মন্তব্য

ঐতিহাসিক ক্রুক (W Crook) মন্তব্য করেছেন যে, “শের শাহ ছিলেন প্রথম সম্রাট যিনি বিশ্বাস করতেন যে, জনসাধারণের সদিচ্ছা ও সমর্থনের ওপরেই তাঁর সাম্রাজ্য নির্ভরশীল”।

স্মিথের অভিমত

ভিনসেন্ট স্মিথের মতে “যদি শের শাহ জীবিত থাকতেন তবে ভারতের ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চে মহান মুঘল সম্রাটদের আবির্ভাব হয়ত সম্ভব হত না”।

আকবরের সংস্কারের পথ প্রস্তুত

শের শাহ মহান শাসক ছিলেন সন্দেহ নেই। পরবর্তী মুঘল সম্রাট আকবর তাঁর কাছে নানা দিক থেকে ঋণী ছিলেন। তাঁর সংস্কার নীতির দ্বারা তিনি আকবরের সংস্কারের পথ প্রস্তুত করেন।

উইলিয়ামসের অভিমত

রাশব্রুক উইলিয়ামস (Rushbrooke Williams) মন্তব্য করেছেন যে, তৈমুর বংশের এক বিরল সৌভাগ্য ছিল যে, আফগান বিজেতা শের শাহ তাদের জন্য সাম্রাজ্য জয়ের দৃষ্টান্ত রেখে যান। প্রশাসক হিসেবে শের শাহ তাঁর মৌলিকতার দ্বারা তার অজ্ঞাতসারে মুঘলদের জন্যে একটি প্রশাসন যন্ত্রের কাঠামো রেখে যান”।

শাসন যন্ত্রের কাঠামো

আকবর যদিও প্রতিভাবান সম্রাট ছিলেন, তথাপি তাঁকে কখনও খালি স্লেটের ওপর লিখতে হয় নি। শের শাহ শাসনযন্ত্রের প্রধান কাঠামোগুলি রচনা করেন। আকবর সেই কাঠামোকে সংস্কার করে তাঁর সাম্রাজ্যের শাসনযন্ত্র নির্মাণ করেন।

আকবরের রাজস্ব নীতির ওপর শেরশাহের প্রভাব

  • (১) যে সকল ক্ষেত্রে আকবর শের শাহের আদর্শে অনুপ্রাণিত হন তার মধ্যে প্রধান ছিল শের শাহের ভূমি-রাজস্ব ব্যবস্থা। তিনি শের শাহ প্রবর্তিত ভাল, মাঝারি ও নিরেশ জমির উৎপাদনের গড় হারের ভিত্তিতে রাজস্ব নির্ধারণের প্রথাকে পুরোপুরি গ্রহণ করেন।
  • (২) শের শাহ প্রবর্তিত খাদ্যশস্যের গড় মূল্য তালিকা তৈরির প্রথা তিনি অনুসরণ করেন। শের শাহ জরিপের ভিত্তিতে জমির উৎপাদন ও প্রদেয় রাজস্ব নির্ধারণ করেন। আকবর তার কর্মচারী শাহমনসুর, মুজাফফর খান এবং টোডরমলের সাহায্যে জরিপ দ্বারা জাবতি প্রথা চালু করেন।

পরগণা ও সরকারের শাসন

  • (১) শের শাহ কতকগুলি গ্রামের সমষ্টির ওপর একটি করে পরগণা গঠন করেন। পরগণাই ছিল শের শাহের নিম্নতম শাসন কেন্দ্র। গ্রামগুলি তাঁর আমলে মোটামুটি স্বায়ত্ত শাসন ভোগ করত। আকবরের আমলেও পরগণা প্রথা চালু ছিল।
  • (২) শের শাহের মতই আকবরের আমলে শিকদার, আমিন, ফোতদার প্রভৃতি প্রতি পরগণায় শাসনের দায়িত্ব বহন করত। শের শাহের অনুকরণে তিনি কতকগুলি পরগণা নিয়ে সরকার গঠন করেন। রাজস্ব আদায় ও জরিপের কাজে তিনি শের শাহের মতই কানুনগো, আমিন ও পাটোয়ারীদের ওপর নির্ভর করতেন।
  • (৩) শের শাহ যে সিকান্দারী গজ জমি জরিপের জন্য ব্যবহার করতেন, আকবর তা তাঁর রাজস্বের ৩১ বছর পর্যন্ত তাই চালু রাখেন। পরে তিনি ইলাহী গজ চালু করেন।

আকবরের সামরিক সংস্কারে শের শাহের প্রভাব

শের শাহ তাঁর সেনাদলে নিয়মিত হাজিরা দান ও শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য “দাগ ও হুলিয়া” প্রথা চালু করেন। আকবর তাঁর মনসবদারি সেনাদলে যাতে নির্দিষ্টসংখ্যক অস্ত্র এবং আরোহী রাখা হয় এজন্য দাগ ও হুলিয়া প্রথা চালু করেন।

শাসন ব্যবস্থা মজবুত করা

এইভাবে রাজস্ব, প্রশাসনিক ও সামরিক সংগঠনের ক্ষেত্রে শের শাহ যে সকল মূল্যবান সংস্কার করেন আকবর তা গ্রহণ করে তার শাসনব্যবস্থাকে মজবুত করেন।

নতুনত্ব দান

শের শাহ মাত্র ৫ বৎসর রাজত্ব করার ফলে তার প্রশাসনিক পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলিকে পূর্ণতাদানের সময় পান নি। আকবর তার নিজস্ব প্রতিভার দ্বারা এই প্রথাগুলিকে মেজে ঘসে নতুনত্ব দান করেন।

শের শাহের ধর্মসহিষ্ণুতা নীতির প্রভাব

  • (১) রাজ্য শাসননীতির ক্ষেত্রেও শের শাহ আকবরের পথ প্রদর্শক ছিলেন বলা যায়। শের শাহ তাঁর হিন্দু প্রজাদের ধর্ম বিশ্বাস ও ধর্ম আচরণে হস্তক্ষেপ করেন নি। তিনি ধর্মসহিষ্ণুতা নীতি নেন।
  • (২) আকবর শের শাহের নিষ্ক্রিয় ধর্মসহিষ্ণুতাকে সক্রিয় সমদর্শী নীতিতে পরিণত করেন। যেক্ষেত্রে তার ধর্মসহিষ্ণুতা সত্ত্বেও শের শাহ জিজিয়া কর আদায় করেন, আকবর আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে জিজিয়া ও হিন্দুদের ওপর তীর্থ কর লোপ করেন। এই ধর্মসহিষ্ণুতা নীতির বীজ শের শাহই বপন করেন, আকবর এই নীতিকে পরিপূর্ণতা দেন।

বিচার ব্যবস্থা

শের শাহ বিচার ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও উদার নীতি নেন। তিনি হিন্দুদের ক্ষেত্রে তাদের আইন অনুযায়ী বিচারের নিয়ম চালু করেন। আকবরও অনুরূপ নীতি নেন। শের শাহ ইন্দো-সারাসেনীয় স্থাপত্যের যে সমন্বয় ঘটান, আকবরের আমলে তা পূর্ণতা লাভ করে।

জাতীয় সম্রাটের মর্যাদা অর্জন

আকবর, শের শাহের নীতিকে এক বৃহৎ জাতীয় প্রেক্ষাপটে স্থাপন করেন। শের শাহের মত প্রয়োজন ভিত্তিক ভাবে নয়, আদর্শ ভিত্তিক ভাবে আকবর সমন্বয়, সমদর্শী ও সহিষ্ণুতা নীতিকে প্রয়োগ করেন। এজন্য তিনি জাতীয় সম্রাটের মর্যাদা লাভ করেন।

জাতি গঠন

শের শাহ তার নিষ্ক্রিয় সহিষ্ণুতা নীতির ফলে জাতি গঠন ও জাতিকে প্রেরণা দিতে পারেননি। আকবর তাঁর প্রতিভার জোরে জাতি গঠনের কাজ সফল করেন।

কৃষকদের মঙ্গল

শের শাহ কৃষকদের মঙ্গলের জন্য চেষ্টা করতেন। কৃষি-প্রধান ভারতবর্ষে কৃষকরাই ছিল অর্থনীতির মেরুদণ্ড। আকবরের আমলে এই নীতি আরও সুপ্রযুক্ত হয়। আকবরের উদার নীতির সূচনা অবশ্যই শের শাহ করেন।

উপসংহার :- ডঃ আর পি. ত্রিপাঠী মন্তব্য করেছেন যে, “শের শাহ আর কিছুকাল জীবিত থাকলে, তিনি আকবরের পালের বাতাস কেড়ে নিতেন। দিল্লীর সুলতানদের মধ্যে তিনিই ছিলেন শ্রেষ্ঠতমদের একজন। তিনি আকবরের আলোচিত নীতির পথ রচনা করেন এবং প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন আকবরের পথ-প্রদর্শক”।

(FAQ) আকবরের পথপ্রদর্শক হিসেবে শেরশাহের ভূমিকা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. আকবরের পথপ্রদর্শক কাকে বলা হয়?

শেরশাহ।

২. শেরশাহের রাজত্বকাল কত?

১৫৪০-১৫৪৫ খ্রিস্টাব্দ।

৩. আকবরের রাজত্বকাল কত?

১৫৫৬-১৬০৫ খ্রিস্টাব্দ।

৪. শেরশাহ কাকে পরাজিত করে দিল্লি দখল করেন?

হুমায়ুন।

Leave a Comment