মুঘল সম্রাট শাহজাহানের মধ্য এশিয়া নীতি প্রসঙ্গে বাল্ক অভিযানের কারণ, শাহজাহানের অজুহাত, শাহজাহানের কাছে নজর মহম্মদের সাহায্য প্রার্থনা, মুরাদের নেতৃত্বে অভিযান প্রেরণ, নজর মহম্মদের রাজ্য লুট, ঔরঙ্গজেবের অভিযান, বালখ অধিকার, বোখারার বশ্যতা, বালখ প্রত্যার্পণ, ঔরঙ্গজেবের প্রত্যাগমন ও মধ্য এশিয়ার নীতির ফলাফল সম্পর্কে জানবো।
মুঘল সম্রাট শাহজাহানের মধ্য এশিয়া নীতি
ঐতিহাসিক ঘটনা | শাহজাহানের মধ্য এশিয়া নীতি |
সম্রাট | শাহজাহান |
কারণ | পিতৃভূমি উদ্ধার |
প্রথম অভিযান | যুবরাজ মুরাদ |
দ্বিতীয় অভিযান | ঔরঙ্গজেব |
ভূমিকা :- আফগানিস্থানের উত্তরে বালখ ও বাদাখশান প্রদেশ দুইটি দক্ষিণে হিন্দুকুশ ও উত্তরে অক্ষু নদীর মধ্যে অবস্থিত। এই অক্ষু উপত্যকার ওপর একদা বাবর ও তার পূর্বপুরুষরা রাজত্ব করতেন। পরে উজবেগীদের আক্রমণে বাবর এই অঞ্চল থেকে বিতাড়িত হন।
বালখ অভিযানের কারণ
মুঘল সম্রাটরা তাদের পিতৃভূমি উদ্ধার করতে সর্বদা ইচ্ছা পোষণ করতেন। তাছাড়া তাদের পূর্বপুরুষ তৈমুরের বীরত্বের কথাও তাদের অনুপ্রাণিত করে।
ঈশ্বরীপ্রসাদের অভিমত
ঐতিহাসিক ডঃ ঈশ্বরীপ্রসাদের মতে, শাহজাহানের মধ্য এশিয়া অভিযান ছিল পুরো সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব ও ভাবাবেগ প্রসূত। দক্ষিণ ভারতের অভিযানে সফলতার পর শাহজাহানের রাজ্য জয়ের ক্ষুধা বাড়ে। তিনি কাবুলের আফগান উপজাতিদের বিদ্রোহ উপেক্ষা করে অস্ত্রাখান বা বালখ-বাদাখশান অভিযানের সিদ্ধান্ত নেন।
শাহজাহানের অজুহাত
- (১) শাহজাহান তার এই অভিযানের অজুহাত হিসেবে কাবুলে উজবেগী উপজাতির আক্রমণকে ব্যবহার করেন। মধ্য এশিয়ার স্তেপী ভূমির অধিবাসী এই উজবেগী ও মোঙ্গল জাতির মানসিকতা ছিল যাযাবরদের মতই। তারা কখন কার রাজ্য আক্রমণ করবে তার কোনো ঠিক ছিল না।
- (২) এই লুণ্ঠনপ্রিয় ও আক্রমণপরায়ণ উজবেগীদের হাত থেকে উত্তর-পশ্চিম সীমান্তকে নিরাপদ করার জন্য শাহজাহান বালখ ও বাদাখশান আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। সুতরাং শাহজাহানের মধ্য এশিয়া নীতিকে পুরো সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ বলা চলে না।
শাহজাহানের কাছে নজর মহম্মদের সাহায্য প্রার্থনা
বোখারা ও বালখের শাসনকর্তা নজর মহম্মদের স্বৈরাচারী শাসনের ফলে তাঁর বিরুদ্ধে উজবেগী সর্দাররা বিদ্রোহ করে। নজরের পুত্র আবদুল আজিজও বিদ্রোহ ঘোষণা করে। নজর মহম্মদ এই অবস্থায় শাহজাহানের সাহায্য চান।
মুরাদের নেতৃত্বে অভিযান
শাহজাহান ভুলে যান যে, হিন্দুকুশ পার হয়ে বালুকাময় শুষ্ক মরু অঞ্চলে তাঁর সেনাদের অভিযান করা কষ্টকর। তিনি যুবরাজ মুরাদের নেতৃত্বে ৫০ হাজার অশ্বারোহী ও ১০ হাজার পদাতিক পাঠান। এই সেনাদল ১৬৪৬ খ্রিস্টাব্দে বালখ অধিকার করে।
নজর মহম্মদের রাজ্য লুট
নজর মহম্মদ ইতিমধ্যে পারস্যের শাহের প্রতি আনুগত্য স্থাপন করেছিলেন। মুঘল বাহিনী তার সঞ্চিত ৭২ লক্ষ মুদ্রা লুঠ করে। এছাড়া ১২ লক্ষ টাকা, ২৫০০ ঘোড়া, ৩০০ উট অধিকার করে। নজর মহম্মদ রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে যান।
মুরাদের প্রত্যাগমন
- (১) মুরাদ ছিলেন বিলাসী ও আরামপ্রিয়। মধ্য এশিয়ার শুষ্ক ঠাণ্ডা আবহাওয়া, দরিদ্র ও নিরানন্দময় জীবন তার সহ্য হয় নি। তিনি পিতার অনুমতি না নিয়ে আগ্রায় ফিরে আসেন।
- (২) তাঁর সেনাপতিরাও এই দুর্গম অঞ্চলে না থেকে ভারতের দিকে মুরাদের অনুসরণ করলে, মুঘলরা মধ্য এশিয়ায় যে সাফল্য লাভ করেছিল তা শীঘ্রই ধ্বংস হয়ে যায়। ক্রুদ্ধ সম্রাট মুরাদকে দরবার হতে নির্বাসিত করেন।
ঔরঙ্গজেবের অভিযান
শাহজাহান এর পর একটি নতুন বাহিনী গড়ে ঔরঙ্গজেবের নেতৃত্বে তা বালখ্-বাদাখশান অভিযানে পাঠান। ঔরঙ্গজেবের সঙ্গে মাত্র ২৫ হাজার সেনা দেওয়া হয়। তাকে যথেষ্ট সরঞ্জাম দেওয়া হয় নি।
বালখ অধিকার
উজবেগীরা মুঘলের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধ এড়িয়ে গেরিলা যুদ্ধে তাঁর ক্ষয়ক্ষতি করতে থাকে। কিন্তু ঔরঙ্গজেব তাঁর বিশ্বস্ত মুঘল ও রাজপুত বাহিনীর সাহায্যে উজবেগীদের যুদ্ধ করতে বাধ্য করেন এবং প্রথম যুদ্ধে তাদের পরাস্ত করেন। ঔরঙ্গজেব পরের যুদ্ধে উজবেগীদের হঠিয়ে বালখ অধিকার করেন। রাজপুত মধু সিং হাড়াকে বালখের শাসনকর্তা নিয়োগ করা হয়।
বোখারার বশ্যতা
ঔরঙ্গজেব এর পর বাদখশানের আখচার দিকে অগ্ৰসর হন। এক বিরাট উজবেগী সেনা বোখারায় তাকে ঘিরে ফেলে। কিন্তু মুঘল বাহিনী বোখারার যুদ্ধে তাদের হঠিয়ে দেয়। আর এগিয়ে যাওয়া নিরাপদ নয় দেখে ঔরঙ্গজেব বালখে ফিরে আসেন। শাহজাহান এই সময় তাঁকে কোনো নতুন সেনা সরবরাহ করেন নি। তথাপি ঔরঙ্গজেবের দৃঢ়তার কাছে আত্মসমর্পণ বিজ্ঞতার কাজ বলে বোখারার সুলতান মনে করেন।
বালখ প্রত্যার্পণ
মধ্য এশিয়ার কষ্টকর আবহাওয়ায় মুঘল সেনারা আর থাকতে রাজি না হওয়ায়, ঔরঙ্গজেব বালখ থেকে চলে আসার সিদ্ধান্ত নেন। বশ্যতা স্বীকারের বিনিময়ে নজর মহম্মদকেই শাহজাহান তাঁর রাজ্য ফিরিয়ে দিতে পরামর্শ দেন। কিন্তু নজর মহম্মদ নিজে সাক্ষাৎ না করায়, ঔরঙ্গজেব নজর মহম্মদের পৌত্রকে বশ্যতা স্বীকারের বিনিময়ে বালখ ফেরৎ দেন
ঔরঙ্গজেবের প্রত্যাগমন
এরপর ঔরঙ্গজেব স্বদেশের দিকে রওনা দেন। পথে হাজারা উপজাতির আক্রমণে মুঘল বাহিনীর বহু ক্ষয়ক্ষতি হয়। হাজারা উপজাতিকে বাধাদানের জন্য রাজপুত বাহিনীকে পিছনে রেখে ঔরঙ্গজেব কাবুলে চলে আসেন। রাজপুত সেনারা খাদ্যাভাব, শত্রুর আক্রমণ ও শীতে ধ্বংসপ্রায় হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত সামান্য কিছু লোক প্রাণ নিয়ে ফিরে আসে।
মধ্য এশিয়া নীতির ফলাফল
- (১) শাহজাহানের মধ্য এশিয়া নীতি ছিল তাঁর সাম্রাজ্যবাদের “শেষ হংস সংগীত” (Swan Song)। এই অভিযানে প্রচুর প্রাণ, সম্পদ ও অর্থ বিনষ্ট হয়। এই অভিযান ছিল শাহজাহানের অপরিণামদর্শিতার ফল।
- (২) স্যার যদুনাথ সরকার বলেছেন যে, দরবারে স্তাবকদের কথায় সম্রাট রাজনৈতিক বিজ্ঞতা ভুলে এই অপরিণামদর্শী অভিযানের গহ্বরে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজ এবং সাম্রাজ্যের সুনাম ও মর্যাদা নষ্ট করেন।
উপসংহার :- কান্দাহার ও মধ্য এশিয়া অভিযান ছিল শাহজাহানের ক্ষুদ্র বুদ্ধির পরিচায়ক। রাজকোষের ৪ কোটি টাকা ও বহু প্রাণ তিনি মধ্য এশিয়ায় তার খামখেয়াল চরিতার্থ করতে নষ্ট করেন। শীঘ্রই উত্তরাধিকারী যুদ্ধের কালো মেঘ শাহজাহানের সৌভাগ্য সূর্যকে ঢেকে ফেলে।
(FAQ) মুঘল সম্রাট শাহজাহানের মধ্য এশিয়া নীতি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
পিতৃভূমি উদ্ধার।
যুবরাজ মুরাদ।
ঔরঙ্গজেব।
মধ্য এশিয়া নীতি।