পাল যুগের ভাস্কর্য

পাল যুগের ভাস্কর্য ও চিত্রকলা প্রসঙ্গে ভাস্কর্য রীতি, ভাস্কর, মনুষ্য মূর্তি, মাটির মূর্তি, কৃষ্ণ মূর্তি, ভাস্কর্যের প্রধান কেন্দ্র, লোক শিল্প, মূর্তি নির্মাণের উপাদান, পাল যুগের চিত্রকলা ও তার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানবো।

পাল যুগের ভাস্কর্য ও চিত্রকলা

ঐতিহাসিক ঘটনাপাল যুগের ভাস্কর্য ও চিত্রকলা
সাম্রাজ্যপাল সাম্রাজ্য
প্রতিষ্ঠাতা গোপাল
শ্রেষ্ঠ রাজাদেবপাল
ভাস্করধীমান ও বীতপাল
পাল যুগের ভাস্কর্য ও চিত্রকলা

ভূমিকা :- পাল যুগে বাংলার যে স্বাতন্ত্র্য তার রাষ্ট্রীয় অভ্যুত্থান, ভাষা, সাহিত্যের বৈশিষ্ট্যে দেখা দেয়, ভাস্কর্য ও চিত্রকলার ক্ষেত্রেও সেই বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে।

পাল যুগের ভাস্কর্য রীতি

গুপ্ত যুগের ভাস্কর্য রীতির একঘেয়েমী মুক্ত হয়ে পাল যুগে বাংলার ভাস্কর্য শিল্প নিজ বৈশিষ্ট্যে মণ্ডিত হয়।

পাল যুগের ভাস্কর

ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে পাল যুগের দুই শ্রেষ্ঠ ভাস্কর ছিলেন বীতপাল ও ধীমান। ব্রোঞ্জ, পাথর খোদাই ও চিত্র আঁকার কাজে এঁদের খুবই খ্যাতি ছিল। পোড়ামাটি ও কালো পাথরের ওপরেই পাল যুগের ভাস্কর্য বেশী কাজ করত।

পাল যুগে মনুষ্য মূর্তি

প্রধানত মনুষ্য মূর্তি নির্মাণই ছিল পাল ভাস্কর্যের প্রধান বিষয়বস্তু। মূর্তির নির্মাণে নানা “ভঙ্গ” ও “মুদ্রা” ব্যবহার করা হত। মহীপাল -এর রাজত্বকালে তৈরি বাঘাউরার বিষ্ণুমূর্তি, তৃতীয় গোপালের রাজত্বকালে তৈরি সদাশিব মূর্তি পাল ভাস্কর্যের উৎকর্ষের পরিচয় দেয়।

পাল যুগের মাটির মূর্তি

সমকালীন যুগে মাটির তৈরি মূর্তির দ্বারা লোকশিল্পের বিকাশ ঘটেছিল। পাহাড়পুর ও ময়নামতীর মৃৎশিল্পে লোকের জীবনের সাধারণ চিত্রকে ভাস্কর্যে রূপায়িত করা হত। এক্ষেত্রে দেবদেবীকে শিল্পের বিষয়বস্তু না করে লোকের জীবন-যাত্রাকেই শিল্পে রূপায়িত করা হয়। মাটির ও পাথরের মূর্তিগুলির সজীবতা ও সূক্ষ্ম কাজ পাল যুগের ভাস্কর্য শিল্পের উন্নতির পরিচয় দেয়।

পাল যুগের ভাস্কর্যের প্রধান কেন্দ্র

পাহাড়পুর ছিল পাল ভাস্কর্যের প্রধান কেন্দ্র। পাহাড়পুরের প্রধান মন্দিরের ভিত্তির গায়ে পাথরের ফলকে ভাস্কর্য সজ্জা বিস্ময়কর। এই ভাস্কর্যে অনেক ক্ষেত্রে মৌলিক কাজ দেখা যায়। তাছাড়া মন্দিরটি বৌদ্ধ মন্দির হলেও পুরাণ ও অন্যান্য ব্রাহ্মণ্য উপাখ্যান ফলকের কাজে বিষয়বস্তু হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে। ডঃ সরস্বতীর মতে, হয়ত এগুলি পরবর্তীকালের সংযোজন।

পাল যুগের কৃষ্ণ মূর্তি

রাধা-কৃষ্ণ বা কৃষ্ণের অন্যান্য পত্নীর সঙ্গে কৃষ্ণ মূর্তির ভাস্কর্যের কাজ আকর্ষণীয়। মূর্তিগুলির ভঙ্গি, হাতের মুদ্রা, পোষাকের ছাদ মার্জিত রুচির পরিচয় দেয়। এছাড়া শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলা সম্পর্কিত মূর্তি, বলরাম, শিব মূর্তিগুলিতে গুপ্তরীতির সঙ্গে পূর্ব ভারতের ইন্দ্রিয়তা ও ভাবাবেগ যুক্ত হয়েছিল।

পাল যুগের লোকশিল্প

  • (১) পাল রিলিফের কাজ বর্ণনামূলক কিন্তু ভাস্কর্য গুণে হীন মানের। দেব-দেবীর মূর্তি ছাড়া লোকশিল্পের চিহ্ন হিসেবে মিথুন মূর্তি, দ্বারপাল মূর্তি, সুন্দরী নারী মূর্তিগুলির শিল্পগত উৎকর্ষ তেমন উঁচু নয়। তবে মূর্তিগুলির লোকায়ত দিক আছে।
  • (২) কৃষ্ণ মূর্তিতে লোকশিল্পের ছাপ বেশী, দৈবী ভাব ও শিল্প-সুষমা অপেক্ষাকৃত কম। এখানে কৃষ্ণ যশোদা দুলাল, ননীচোরা, রাধার প্রেমিক, ঢলঢল অঙ্গে লাবনি বহে যায়। এখানে শিল্প শাস্ত্রের কড়া হাতের বাধন নেই।

রীতিগত পার্থক্য হীন

পাল যুগের শিল্প রচনায় ধনী ও বিত্তবান শ্রেণীর আনুকূল্য নিশ্চয় ছিল। ধর্মীয় চিন্তাধারাও এই শিল্পকে নিয়ন্ত্রিত করে। বৌদ্ধ, জৈন, ব্রাহ্মণ্য শিল্পের রীতিগত তেমন কোনো পার্থক্য ছিল না।

পাল যুগে মূর্তি নির্মাণের উপাদান

মূর্তিগুলি প্রধানত কষ্টি পাথরে তৈরি। পিতল, কাসা ও অষ্ট ধাতুর তৈরি মূর্তিও দেখা যায়। মূর্তিগুলি হয় পৃষ্ঠপটের গায়ে ভার দিয়ে ক্ষোদিত অথবা স্বাধীন, স্বতন্ত্রভাবে দাঁড়ান। নারী মূর্তিগুলি উন্নত বক্ষ, শুরু নিতম্ব, হাতের মুদ্রা শাস্ত্র-সম্মত। নর মূর্তিগুলি সিংহগ্রীব, বৃষস্কন্দ, ক্ষীণ কটি। তান্ত্রিক চিন্তা ও ইন্দ্রিয়তার অভিজ্ঞতা মূর্তিগুলির রচনায় প্রত্যক্ষ। পাল যুগের মৃৎ শিল্পও বিশেষ উন্নত ছিল।

পাল যুগের চিত্রকলা

  • (১) পাল যুগের চিত্রকলার নিদর্শন রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গল, কেমব্রিজ সংগ্রহশালায় দেখতে পাওয়া যায়। বজ্রযান ও তন্ত্রযানের ধর্মমতকে বিষয়বস্তু করে অধিকাংশ চিত্র আঁকা হয়েছিল। বৌদ্ধ পাণ্ডুলিপিগুলিকে অলঙ্করণের জন্য সম্ভবত এই চিত্রগুলি আঁকা হয়।
  • (২) রাজশাহীর বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি, অক্সফোর্ডের বোডেলিয়ান গ্রন্থাগারেও পাল যুগের চিত্রকলার নিদর্শন রক্ষিত আছে। অনেকে বলেন যে, এই সবগুলি চিত্র বাংলাদেশ-এ রচিত হয়নি। পাল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে রচিত হয়।

পাল চিত্রগুলির বৈশিষ্ট্য

  • (১) এগুলি প্রাচীন চিত্রের মত তবে সঠিক মিনিয়েচার পেইন্টিং নয়। চিত্র ভাস্কর্য রীতি অনুসরণ করা হয়। প্রতিমা, পাশে লতা, পাতা, ফল, ফুল, অলঙ্করণ, সহচরীর দ্বারা ভরাট করা হয়েছে। মূল চিত্রটি রূপে সমৃদ্ধ।
  • (২) রং-এর ব্যবহারে নানা কৌশল করা হয়। তবে অজন্তার মত সুখম রং-এর ব্যবহার দেখা যায় না। চিত্রগুলির বর্ডার বা বর্হিরেখা কালো বা লাল রং-এ আঁকা, সরু রেখায় চিত্রিত। ভেতরে চিত্র মোটা রেখায় আকা। ডঃ সরসীকুমার সরস্বতী পাল যুগের চিত্রকলার ওপর গবেষণামূলক রচনা লিপিবদ্ধ করেছেন।

উপসংহার :- পাল যুগে বাংলার সংস্কৃতি বিশেষ বিকাশ লাভ করেছিল। সমকালীন ভাষা, সাহিত্য, শিল্প, স্থাপত্য, ভাস্কর্য, চিত্রকলা পাল সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছিল।

(FAQ) পাল যুগের ভাস্কর্য ও চিত্রকলা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. পাল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা কে?

গোপাল।

২. গোপালের পর কে সিংহাসনে আরোহণ করেন?

ধর্মপাল

৩. কোন পাল রাজার সময় ত্রিশক্তি দ্বন্দ্ব শুরু হয়?

ধর্মপাল।

৪. পাল সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ রাজা কে ছিলেন?

দেবপাল।

৫. পাল যুগের বিখ্যাত ভাস্কর কারা ছিলেন?

ধীমান ও বীতপাল।

Leave a Comment