বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সঙ্গম বংশ

বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সঙ্গম বংশ প্রসঙ্গে হরিহর ও বুক্ক, দ্বিতীয় হরিহর, প্রথম দেব রায়, বিজয় রায়, দ্বিতীয় দেবরায়, মল্লিকার্জুন ও বিরুপাক্ষ সম্পর্কে জানবো।

বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সঙ্গম বংশ

বিষয়বিজয়নগর রাজ্যের সঙ্গম বংশ
সাম্রাজ্যবিজয়নগর সাম্রাজ্য
প্রতিষ্ঠাতাহরিহর ও বুক্ক
প্রতিষ্ঠাকাল১৩৩৬ খ্রি:
শ্রেষ্ঠ রাজাকৃষ্ণদেব রায়
বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সঙ্গম বংশ

ভূমিকা :- সঙ্গম বংশই বিজয়নগর সাম্রাজ্যের প্রথম রাজবংশ। সঙ্গমের নাম অনুসারে এই বংশের নামকরণ হয় সঙ্গম বংশ। সঙ্গমের পাঁচ পুত্রের মধ্যে হরিহর ও বুক্কই এই বংশের প্রথম শাসক হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেন।

বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সঙ্গম বংশের প্রতিষ্ঠাতা হরিহর ও বুক্ক

  • (১) এঁরা দুজনেই কোনো রাজ-উপাধি গ্রহণ করেছিলেন কিনা, তা বলা শক্ত। হোয়শল সাম্রাজ্য-এর রাজা তৃতীয় বীরবল্লাল এই রাজ্যটিকে অঙ্কুরেই বিনাশ করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তিনি মাদুরা পুনরুদ্ধারে ব্যস্ত থাকেন এবং শেষপর্যন্ত যুদ্ধে নিহত হন।
  • (২) এই অবস্থায় হরিহর ও বুক্কের সামনে সমগ্র হোয়সল রাজ্য দখলের সুযোগ উন্মুক্ত হয়ে যায় এবং ১৩৪৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই সমগ্ৰ হোয়সল রাজ্য বিজয়নগরের অধিকারভুক্ত হয়। মাদুরাও বুক্ক নিজ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন এবং বাহমনি রাজ্য-এর সঙ্গে এক দীর্ঘকালীন সংগ্রামের সূচনা করেন।
  • (৩) বুক্কের সবচেয়ে বড়ো কৃতিত্ব এই যে তিনি চীন সম্রাটের নিকট এক দূত প্রেরণ করেছিলেন। হরিহর ও বুক্ক দুজনেই যোগ্য শাসক ছিলেন। বুক্ক গোটা বিজয়নগরকে একটি কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বের মধ্যে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং সেতুবন্ধ রামেশ্বর পর্যন্ত বিজয়নগরের সাম্রাজ্য বিস্তারলাভ করে।

বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সঙ্গম বংশের নরপতি দ্বিতীয় হরিহর

  • (১) ১৩৭৭ খ্রিস্টাব্দে বুক্ক মারা গেলে, তাঁর পুত্র দ্বিতীয় হরিহর বিজয়নগরের অধিপতি হন। প্রকৃতপক্ষে, দ্বিতীয় হরিহরই বিজয়নগর সাম্রাজ্যের প্রথম নরপতি। কারণ, তিনিই প্রথম মহারাজাধিরাজ’, ‘পরমেশ্বর প্রভৃতি উপাধি গ্রহণ করেছিলেন।
  • (২) দ্বিতীয় হরিহর বিজয়নগর সাম্রাজ্যকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেন। বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সঙ্গে বাহমনি রাজ্যের যে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল, তা হরিহরের রাজত্বকালে পূর্ণ রূপ পায়। তিনি মহীশূর, কানাডা, ব্রিচিনপল্লী ও কাজী বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অধীনস্থ করেন।
  • (৩) ১৩৯৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি বাহমনি রাজ্যের অধিপতি ফিরোজ শাহের বিরুদ্ধে এক অভিযান প্রেরণ করেন, কিন্তু তিনি পরাজিত হন। এই ব্যাপারে দুটি মত দেখা যায়। ফিরিস্তা বলেছেন, এই যুদ্ধে ফিরোজ শাহ জয়লাভ করেন, কিন্তু নালগোন্ডা জেলায় প্রাপ্ত পনগল-লেখ থেকে জানা যায় যে, দ্বিতীয় হরিহর জয়লাভ করেছিলেন।
  • (৪) বিজয়নগরের ইতিহাসে দ্বিতীয় হরিহর একজন সার্বভৌম শাসক হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছেন। তিনি খুবই জনপ্রিয় শাসক ছিলেন।

দক্ষিণের বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সঙ্গম বংশের রাজা প্রথম দেবরায়

  • (১) ১৪০৪ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় হরিহরের মৃত্যুর পর বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সিংহাসনের জন্য এক গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। শেষপর্যন্ত ১৪০৬ খ্রিস্টাব্দে প্রথম দেবরায় ক্ষমতা দখল করেন। কিন্তু প্রথম দেবরায় বাহমনি রাজ্যের হাতে পরাস্ত হন।
  • (২) ফিরিস্তার বিবরণ থেকে জানা যায়, প্রথম দেবরায় বাহমনি সুলতান ফিরোজ শাহের সঙ্গে নিজকন্যার বিবাহ দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। প্রথম দেবরায়ের মৃত্যুর পর বিজয়নগরের সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ে সংশয় আছে।

বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সঙ্গম বংশের নরপতি বিজয় রায়

প্রথম দেবরায়ের মৃত্যুর পর তার পুত্র বিজয় রায় ন’বছর রাজত্ব করেন।

বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সঙ্গম বংশের অন্যতম রাজা দ্বিতীয় দেবরায়

  • (১) ১৪২২ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় দেবরায় সিংহাসনে আরোহণ করেন। দ্বিতীয় দেবরায় বংশের ঐতিহ্য অনুসারে বাহমনি রাজ্যের বিরুদ্ধে ১৪২২ খ্রিস্টাব্দে যুদ্ধ ঘোষণা করেন, কিন্তু তিনি বাহমনি সৈনাদলের হাতে পরাস্ত হন এবং বাহমনি রাজ্যকে কর দিতে স্বীকৃত হন।
  • (২) অন্য একটি তথ্য থেকে জানা যায় যে, বাহমনি সুলতান আহম্মদ শাহ বিজয়নগর আক্রমণ করে জয়লাভ করেছিলেন। কিন্তু ১৪২৯ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় দেবরায়ের একটি উৎকীর্ণ লিপি থেকে জানা যায় যে, দ্বিতীয় দেবরায় এই যুদ্ধে জয়লাভ করেছিলেন।
  • (৩) উড়িষ্যার ভানুদেব এই সময় বিজয়নগর আক্রমণ করে অন্ধ্রের উপকূলভাগে বেলমদের প্রতিষ্ঠিত করেন। দ্বিতীয় দেবরায় এই অঞ্চল থেকে ১৪২৮ খ্রিস্টাব্দে বেলমদের বিতাড়িত করেন।
  • (৪) ১৪৩৫-৩৬ এবং ১৪৪৩-৪৪ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ পুনরায় বাহমনিদের সঙ্গে দ্বিতীয় দেবাদের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। দ্বিতীয় যুদ্ধটিতে সম্ভবত বাহমনি রাজ্য জয়লাভ করে। আর একটি তথ্য থেকে জানা যায় যে, বিজয়নগর ১৪৩৮ খ্রিস্টাব্দে সিংহলের বিরুদ্ধে অভিযান করে কর আদায় করতে সমর্থ হয়েছিল।
  • (৫) এই সময় দ্বিতীয় দেবরায় বাহমনিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যখন ব্যস্ত ছিলেন, তখন উড়িষ্যার কপিলেন্দ্র বেলমদের সহযোগিতায় রাজমহেন্দ্রীর রেড্ডিদের ধ্বংস করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কপিলেন্দ্র ব্যর্থ হন।
  • (৫) দ্বিতীয় দেবরায়ের রাজত্বকালেই ইতালির বণিক নিকোলো কন্টি ও পারসিক রাষ্ট্রদূত আবদুর রাজ্জাক বিজয়নগর পরিভ্রমণ করেন। তাঁরা দুজনেই বিজয়নগর সাম্রাজ্যের এক লিখিত মনোরম বিবরণ রেখে গেছেন। তাদের লিখিত বিবরণ বিজয়নগর সাম্রাজ্যের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক উপাদান।

বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সঙ্গম বংশের রাজা মল্লিকার্জুন

১৪৪৬ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় দেবরায়ের মৃত্যুর পর তাঁর ভাই বিজয় কিছুকাল রাজত্ব করেন, কিন্তু তাঁর উত্তরাধিকারী হন দ্বিতীয় দেবরায়ের পুত্র মল্লিকার্জুন। এই বিশাল বিজয়নগর সাম্রাজ্য শাসন করার যোগ্যতা তাঁর ছিল না। তাঁর আমলেই সঙ্গম বংশের অবক্ষয়ের সূচনা হয়।

বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সঙ্গম বংশের শেষ রাজা বিরূপাক্ষ

মল্লিকার্জুনের পর তাঁর ভাই দ্বিতীয় বিরূপাক্ষ বিজয়নগরের সিংহাসনে আরোহণ করেন। তাঁর আমলে বিজয়নগর সাম্রাজ্যে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। সামন্তরাই কেন্দ্রীয় শক্তিকে অবমাননা করে প্রধান হয়ে ওঠে।

উপসংহার :- বিরূপাক্ষের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বাহমনি রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী মাহমুদ গাওয়ান গোয়া বন্দর বিজয়নগরের অধিকার থেকে ছিনিয়ে নেন। এরপর সঙ্গম বংশের পতন ঘটে।

(FAQ) বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সঙ্গম বংশ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সঙ্গম বংশের সময়কাল কত?

১৩৩৬-১৪৮৬ খ্রি:

২. সঙ্গম বংশের প্রতিষ্ঠাতা কে ছিলেন?

হরিহর ও বুক্ক।

৩. সঙ্গম বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা কে ছিলেন?

দ্বিতীয় দেবরায়।

৪. সঙ্গম বংশের শেষ রাজা কে ছিলেন?

বিরূপাক্ষ।

Leave a Comment