মহম্মদ বিন তুঘলকের রাজস্ব নীতি প্রসঙ্গে রাজস্ব সংস্কার, দোয়াবে কর বৃদ্ধি, দোয়াবে কর বৃদ্ধির সময়কাল, অর্থনৈতিক সংকট নিরসনে কর বৃদ্ধি, সামরিক অভিযানের অতিরিক্ত খরচ, দান ক্ষয়রাতের ক্ষতিপূরণ, কর বৃদ্ধির পরিমাণ, করদানে অসম্মতির কারণ, প্রজাদের ক্ষোভ ও দুর্ভিক্ষ জনিত অবস্থা সম্পর্কে জানবো।
মহম্মদ বিন তুঘলকের রাজস্ব নীতি
ঐতিহাসিক ঘটনা | মহম্মদ বিন তুঘলকের রাজস্ব নীতি |
সুলতান | মহম্মদ বিন তুঘলক |
কর বৃদ্ধি | দোয়াব |
উদ্দেশ্য | অর্থনৈতিক সংকট নিরসন |
পরিমাণ | ১০-২০ ভাগ |
ভূমিকা :- জিয়াউদ্দিন বরণী তার তারিখ-ই-ফিরোজ শাহী গ্রন্থে সুলতান মহম্মদের ৫টি পরিকল্পনা ও সংস্কারের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। দোয়াবে ভূমি রাজস্ব বৃদ্ধি, দিল্লী থেকে দেবগিরিতে রাজধানী স্থানান্তর, নির্দেশক বা প্রতীক মুদ্রা প্রবর্তন, খোরাসান অভিযান ও কারাজল অভিযান।
মহম্মদ বিন তুঘলকের রাজস্ব সংস্কার
- (১) মহম্মদ বিন তুঘলক সিংহাসনে বসার পর রাজস্ব বিভাগে কয়েকটি সংস্কার প্রবর্তন করেন। তিনি সরকারের আয়-ব্যয়ের হিসাব রাখার ওপর জোর দেন। প্রতি প্রাদেশিক শাসনকর্তাকে প্রদেশের বার্ষিক আয় ও ব্যয়ের রিপোর্ট দিল্লীতে পাঠাতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
- (২) সুলতান নির্দেশ দেন যে, সকল ধরনের জমির ওপর যেন নিয়মিত কর ধার্য করা হয় এবং সাম্রাজ্য-এর সর্বত্র যেন একই হারে ভূমি রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা করা হয়। পরবর্তীকালে নানা বিষয়ে ব্যস্ত থাকার ফলে সুলতান তাঁর এই নির্দেশকে চালু রাখতে পারেননি এবং কিছুদিন বাদে এই আইনটি চাপা পড়ে যায়।
মহম্মদ বিন তুঘলক কর্তৃক দোয়াবে কর বৃদ্ধি
জিয়াউদ্দিন বরণীর মতে, সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলক দোয়াবের কৃষকদের ওপর ভূমি রাজস্বের হার বৃদ্ধি করেন। তিনি রাজস্ব কর্মচারীদের কড়া নির্দেশ দেন যেন এই কর আদায় করা হয়।
দোয়াবে কর বৃদ্ধির সময়কাল
দোয়াবে ভূমি-রাজস্ব কোন সময় বৃদ্ধি করা হয়, এ সম্পর্কে বরণী কোনো সন-তারিখ দেন নি। ফেরিস্তা ও বাদাওনির মতে এই নির্দেশ নামা ৭২৫ অথবা ৭৩০ আল হিজরতে কার্যকরী করা হয়। স্যার উলসলী হেইগ ও ডঃ ঈশ্বরীপ্রসাদ প্রমুখ আধুনিক ঐতিহাসিক ৭০০ আল হিজরতকেই সঠিক তারিখ বলে গণ্য করেছেন।
অর্থনৈতিক সংকট নিরসনে কর বৃদ্ধি
ডঃ আগা মাহাদি হাসান বলেন যে, খোরাসান ও কারাজল অভিযানের ব্যর্থতার পর অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে মুক্ত হতে তুঘলক দোয়াবে কর বাড়ান। অর্থাৎ ১৩৩০-এর পরে দোয়াবে কর বাড়ান হয়।
মহম্মদ বিন তুঘলকের সামরিক অভিযানের অতিরিক্ত খরচ
অধিকাংশ ঐতিহাসিক এই মত সমর্থন করেন না। দোয়াবে কর বৃদ্ধির কারণ হিসেবে বলা হয়ে থাকে যে মহম্মদ সাধারণভাবে রাজস্ব সংস্কারে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। তার পরিকল্পিত সামরিক অভিযানগুলির অতিরিক্ত খরচ মিটাবার জন্য তিনি দোয়াবের উর্বরা জমিতে করের হার বাড়িয়ে দেন।
দান ক্ষয়রাতের ক্ষতিপূরণ
গিয়াসুদ্দিন তুঘলকের মৃত্যুর পর বিভিন্ন অভিজাত ও উলেমাদের সহায়তা পেতে মহম্মদ প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন। এই ক্ষতিপূরণও ছিল তাঁর লক্ষ্য।
মহম্মদ বিন তুঘলকের কর বৃদ্ধির পরিমাণ
- (১) বরণীর বিবরণ থেকে জানা যায় যে মহম্মদ শতকরা ৫ থেকে শতকরা ১০ ভাগ কর বাড়ান। অপর এক স্থানে বরণী বলেছেন যে মহম্মদ ১০ থেকে ২০ ভাগ কর বাড়ান। মোট কথা, বরণী সঠিকভাবে করের হার কতটা বাড়ান হয় তা উল্লেখ করেননি।
- (২) ফেরিস্তার মতে মহম্মদ শতকরা ১০ থেকে ৪০ ভাগ কর বৃদ্ধি করেন। বরণী অথবা ফেরিস্তা দোয়াবে সঠিক কত হারে কর বাড়ান হয় তা উল্লেখ করেননি।
- (৩) ডঃ ঈশ্বরী প্রসাদ ও ডঃ ত্রিপাঠী প্রমুখ গবেষক এই কারণে সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, মহম্মদ যতই রাজস্ব বাড়ান না কেন তা আলাউদ্দিনের আমলের ফসলের ৫০ ভাগ নিয়মকে ছাড়িয়ে যায়নি। মুসলিম শরীয়তী আইন অনুযায়ী ফসলের ৫০ ভাগ রাজস্ব দাবী করা ছিল বৈধ।
- (৪) কাজেই মহম্মদ প্রচলিত প্রথা ও আইন-কানুন অগ্রাহ্য করে করের হার বাড়িয়ে দেন একথা মনে করার কারণ নেই। আমরা জানি যে আলাউদ্দিনের আমলে শতকরা ৫০ ভাগ কর চাপান হলেও কুতুবউদ্দিন মোবারক খলজি ও গিয়াসউদ্দিন তুঘলক তা রহিত করেন। মহম্মদ আলাউদ্দিন খলজির ব্যবস্থাকে বড় জোর ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন।
করদানে অসম্মতির কারণ
- (১) এখন প্রশ্ন আসে যে দোয়াবের প্রজারা কেন এই কর দিতে নারাজ হয়। বরণী বলেছেন যে, যাদের আর্থিক সঙ্গতি ও সামরিক শক্তি ছিল অর্থাৎ খুৎ, মুকাদ্দমরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে।
- (২) হিন্দু প্রজারা তাদের শস্য আগুনে পুড়িয়ে দেয়, গরু-বাছুরগুলিকে তাড়িয়ে দেয় এবং নিজেরা ঘর-বাড়ী ছেড়ে চলে যায়। অনেকে পালিয়ে জঙ্গলে আশ্রয় নেয়।
- (৩) সুলতান শিকদার ও ফৌজদারদের কৃষকদের শস্য লুট করার আদেশ দেন। মুকাদ্দম ও চৌধুরীদের হত্যা ও চোখ অন্ধ করার নির্দেশ দেন। বরণী আরও বলেছেন যে, সুলতানের আরোপিত করের চাপে দোয়াবের কৃষকরা হতাশ হয়ে পড়ে।
প্রজাদের ক্ষোভ
- (১) আধুনিক ঐতিহাসিকদের মতে দোয়ারে কর বৃদ্ধি করে সুলতান মহম্মদ কেবলমাত্র আলাউদ্দিনের প্রবর্তিত কর ব্যবস্থাকে পুনঃ-প্রবর্তনের উদ্যোগ নেন। ডঃ ত্রিপাঠীর মতে গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের নমনীয় কর নীতির পরে মহম্মদ কর বৃদ্ধি করায় প্রজারা চটে যায়।
- (২) আলাউদ্দিন খলজির সময় মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য সামরিক খরচ বৃদ্ধি পায়। এজন্য প্রজারা বাড়তি কর দেয়। মহম্মদের আমলে কোনো বৈদেশিক আক্রমণ না থাকা সত্ত্বেও কর বৃদ্ধি করা হলে প্রজারা অসন্তুষ্ট হয়।
ডং হোসেনের অভিমত
ডঃ আগা মেহেদি হোসেনের মতে খোরাসান অভিযানের জন্য সুলতান যখন প্রস্তুতি নেন, তিনি দোয়াবের বেশ কিছু কৃষক ও রাজপুতকে সেনাদলে ভর্তি করেন। বিনিময়ে তিনি দোয়াবের জমি তাদের বিনা খাজনায় ভোগ করতে দেন। খোরাসান অভিযান পরিত্যাগ হলে, তিনি সেনাদল ভেঙে দেন এবং দোয়াবের এই সকল ভূতপূর্ব সেনা তথা কৃষকদের কর দানের আদেশ দিলে তারা বিদ্রোহ করে।
হোসেনের ব্যাখ্যা যুক্তিহীন
ডঃ হোসেনের এই ব্যাখ্যা অনেকে যুক্তিযুক্ত মনে করেন না। কারণ, কোনো সমকালীন ঐতিহাসিক একথা বলেন নি। তাছাড়া ফেরিস্তা দোয়াবে বিদ্রোহের যে সন-তারিখ দিয়েছেন তা খোরাসান অভিযানের আগে ৭২৫ বা ৭৩০ আল হিজরত।
দুর্ভিক্ষ জনিত অবস্থা
আসলে সুলতান দোয়াবে যখন কর বৃদ্ধি করেন, সেই সময় অনাবৃষ্টির জন্য দুর্ভিক্ষজনিত অবস্থা দেখা দেয়। সুলতানকে তার কর্মচারীরা এই বিষয়ে অবহিত করেন নি। এই অবস্থায় কড়াকড়ি করে কর আদায়ের উদ্যোগ নেওয়ায় বহু লোক মারা পড়ে।
মহম্মদ বিন তুঘলকের কর বৃদ্ধির ব্যর্থতা
দোয়াবে কর বৃদ্ধি করে মহম্মদ লাভবান হননি। কারণ দুর্ভিক্ষপীড়িত প্রজাদের ত্রাণের জন্য তাঁকে বহু অর্থ ব্যয় করতে হয়। প্রজাদের দুর্দশার কথা জানতে পেরে মহম্মদ কাজী ও কারকুনদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণের নির্দেশ দেন।
উপসংহার :- ডঃ ঈশ্বরীপ্রসাদ মন্তব্য করেছেন যে, “যদিও এই কর বৃদ্ধিকে সুলতানের খামখেয়াল বলা ভুল, তথাপি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে এই পরিকল্পনাটি সুচিন্তিত ছিল না। প্রজারা বাধ্য হয়ে বিদ্রোহ করেছিল তাতে সন্দেহ নেই।”
(FAQ) মহম্মদ বিন তুঘলকের রাজস্ব নীতি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
মহম্মদ বিন তুঘলক।
১৩৩০ সালের পর।
শতকরা ১০-২০ ভাগ।
মহম্মদ বিন তুঘলক।