মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ব্যর্থতা, আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণ হিসেবে গান্ধীজির একক নেতৃত্ব, খিলাফত আন্দোলনের সাথে সংযুক্তি, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সমর্থনহীনতা, বিভিন্ন মানসিকতার মানুষ, সরকারি দমননীতি, বিভিন্ন স্বার্থ, জনশক্তি ও সংঘ শক্তির অভাব এবং ব্রিটিশ সঞ্চিত অর্থ সম্পর্কে জানবো।
অসহযোগ আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণ
ঐতিহাসিক ঘটনা | অসহযোগ আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণ |
সূচনাকাল | ১৯২০খ্রিস্টাব্দ |
লক্ষ্য | স্বরাজ অর্জন |
পন্থা | অহিংস অসহযোগ |
নেতা | মহাত্মা গান্ধী |
ভূমিকা:- ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। এই বছরে মহাত্মা গান্ধী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হন এবং তাঁর নেতৃত্বে জাতীয় কংগ্রেস ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন -এর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
অসহযোগ আন্দোলনের ব্যর্থতা
অসহযোগ আন্দোলনের সূচনা (১৯২০খ্রি.১আগস্ট) থেকে সমাপ্তি কালের (১৯২২খ্রি. ২৫ফেব্রুয়ারি) মধ্যে আন্দোলনের ঘোষিত উদ্দেশ্যগুলি পূরণ হয়নি। খিলাফত সমস্যা ব্রিটিশ সরকার মীমাংসা করার আগেই তার প্রয়োজনীয়তা ফুরোয়। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড -এর নায়করা কেউ শাস্তিও পাননি। আর এক বছরের মধ্যে স্বরাজ অর্জন অধরাই থেকে যায়।
আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণ
অসহযোগ আন্দোলনের ব্যর্থতার পশ্চাতে নানা কারণের উল্লেখ করা যায়। যেমন –
(ক) গান্ধীজির একক নেতৃত্ব
- (১) এই আন্দোলন ছিল ব্যক্তিকেন্দ্রিক। গান্ধীজি ছিলেন এই আন্দোলনের অবিসংবাদী নেতা এবং সেটাই ছিল আন্দোলনের প্রধান ত্রুটি।
- (২) গান্ধীজির জন-আকর্ষণী শক্তি ছিল ঠিকই, কিন্তু তাঁর প্রতিটি সিদ্ধান্তই যে নির্ভুল হবে তা নিশ্চয় সঠিক নয়।
- (৩) মতিলাল নেহরু বলেন যে, আন্দোলন পরিচালনার জন্য গান্ধীজি কোনো দলের ওপর নির্ভর না করে, ব্যক্তিগত উদ্যোগেই আন্দোলন চালাতে চেয়েছিলেন।
(খ) খিলাফৎ আন্দোলনের সঙ্গে সংযুক্তি
- (১) খিলাফৎ আন্দোলন -এর সঙ্গে অসহযোগ আন্দোলনের সংযুক্তি এই আন্দোলনের ব্যর্থতার অন্যতম কারণ।
- (২) খিলাফৎ নেতৃমণ্ডলী উপলব্ধি করতে পারেন নি যে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ -এর পরবর্তী কালে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে যে ভাবে জাতীয়তাবাদী ভাবধারার বিস্তার ঘটছে তাতে আর খলিফার নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক মুসলিম সংহতি গড়ে তোলা সম্ভব ছিল না।
- (৩) তুরস্ক-এ কামাল আতাতুর্ক পাশার অভ্যুত্থান এবং খলিফাতন্ত্রের বিলোপ সাধন খিলাফৎ আন্দোলনের মৃত্যু সুনিশ্চিত করে দেয়।
(গ) মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সমর্থন হীনতা
- (১) বি. এন. পাণ্ডে বলেন যে, সামগ্রিকভাবে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পূর্ণ সমর্থন না পাওয়ার ফলে এই আন্দোলন ব্যর্থ হয়। প্রাথমিক সাফল্যের পর বয়কট আন্দোলন ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে পড়ে।
- (২) অভিভাবকের চাপে ছাত্ররা ধীরে ধীরে স্কুল-কলেজে ফিরতে শুরু করে। আইনজীবীরা আবার আদালতের কাজকর্ম শুরু করেন। খিলাফৎ আন্দোলনের অবসানের পর মুসলিম সমাজ এই আন্দোলন থেকে দূরে সরে যায়। এর ফলে আন্দোলন ভেঙ্গে পড়ে।
- (৩) ১৯২২ সালে সরকার গান্ধীজিকে গ্রেপ্তার করলে (১০ই মার্চ, ১৯২২ খ্রিঃ) ব্যঙ্গ করে বলা হয় যে, ঈশ্বর গান্ধীজির মুখ রক্ষা করেছেন।
- (৪) জুডিথ ব্রাউন বলেন যে, গান্ধীজির গ্রেপ্তার শাপে বর হয়। কারণ, এর ফলে তাঁর মুখ রক্ষা হয় এবং তাঁর ক্ষমতার ওপর জনসাধরণের আস্থা রক্ষিত হয়।
(ঘ) বিভিন্ন মানসিকতার মানুষ
বিশাল ভারত জুড়ে বিভিন্ন মানসিকতার লোক নিয়ে সম্পূর্ণ অহিংস পথে গণমুখী আন্দোলন পরিচালনা করা সত্যই অসাধ্য ছিল। সাধারণ মানুষের কাছে অহিংসার কোনো গুরুত্বই ছিল না। তারা সত্যাগ্রহ, মাদক বর্জন, চরকা প্রভৃতির তাৎপর্য বুঝতে রাজি ছিল না।
(ঙ) সরকারি দমননীতি
বড়লাট লর্ড রিডিং-অনুসৃত দমননীতি এবং অধিকাংশ নেতৃবৃন্দের গ্রেপ্তারের ফলে জনসাধারণ দিশেহারা হয়ে পড়ে। রিডিং-অনুসৃত কূটনীতি আন্দোলনকে যথেষ্ট দুর্বল করে দেয়।
(চ) বিভিন্ন স্বার্থ
বহু শ্রেণীতে বিভক্ত ভারতীয় সমাজের বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে এই আন্দোলনে যোগ দেয়। শ্রমিক কৃষকদের আসল অভিযোগ ছিল জমিদার, মহাজন ও মালিক শ্রেণীর বিরুদ্ধে — ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে নয়। বণিক শ্রেণীর লক্ষ্য ছিল মুনাফা অর্জন— ‘স্বরাজ’ লাভ নয়।
(ছ) জনশক্তি ও সংঘ শক্তির অভাব
- (১) ঐক্যবদ্ধ জনশক্তি ও অটুট সংঘশক্তির অভাব অসহযোগ আন্দোলনকে ব্যর্থ করে । এই প্রসঙ্গে জওহরলাল নেহেরু বলেন – আন্দোলনকে দীর্ঘদিন ধরে রাখার জন্য যে জনশক্তির প্রয়োজন ছিল বা ব্রিটিশ বিরোধী রোষকে কাজে লাগানোর জন্য যে সংঘশক্তির দরকার ছিল তা সেই সময়ে পাওয়া যায়নি।
- (২) তাছাড়া যুবসমাজও গ্রামোন্নয়ন এবং চরকা সম্পর্কে উৎসাহ হারিয়ে ফেলতে থাকে। সি. এফ. অ্যান্ড্রুজ গান্ধিজিকে জানিয়েছিলেন – যুবকদের মধ্যে খুব কমই উৎসাহ নিয়ে গ্রামোন্নয়নের কাজ করছে। চরকা বেশিদিন তাদের আকর্ষণ করতে পারবে না ।
(জ) ব্রিটিশ সঞ্চিত অর্থ
আন্দোলন চলাকালীন সর্বত্র সমানভাবে কৃষকশ্রেণির কাছ থেকে ব্রিটিশ কর আদায় করতে পারেনি, তবুও সঞ্চিত অর্থ থাকায় ব্রিটিশ তা কাজে লাগিয়ে আন্দোলনদমনের খরচ চালায় ।
উপসংহার:- সুভাষচন্দ্র বসু ‘দ্য ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল’ ( The Indian Struggle) গ্রন্থে বলেছেন এক বছরের মধ্যে স্বরাজ আনার প্রতিশ্রুতি শুধুমাত্র অবিজ্ঞচিতই নয়, তা ছিল শিশুসুলভ কল্পনামাত্ৰ ৷
(FAQ) অসহযোগ আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
১৯২০ খ্রিস্টাব্দে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে।
স্বরাজ অর্জন।
লর্ড রিডিং।