আলাউদ্দিন খলজির দাক্ষিণাত্য অভিযানের কারণ

আলাউদ্দিন খলজির দাক্ষিণাত্য অভিযানের কারণ প্রসঙ্গে শুধুমাত্র লুন্ঠন নয়, করদ রাজ্যের নীতি, বিশাল সেনাবাহিনী, বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি, সম্পদ শূন্য উত্তর ভারত, ধনরত্নের খবর পাওয়া, ধর্ম্মতত্ত্ব প্রচার, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণ সম্পর্কে জানবো।

আলাউদ্দিন খলজির দাক্ষিণাত্য অভিযানের কারণ

ঐতিহাসিক ঘটনাআলাউদ্দিন খলজির দাক্ষিণাত্য অভিযানের কারণ
সুলতানআলাউদ্দিন খলজি
অন্যতম উদ্দেশ্যধনরত্ন লুন্ঠন
প্রধান সেনাপতিমালিক কাফুর
হিন্দু রাজ্যচারটি
আলাউদ্দিন খলজির দাক্ষিণাত্য অভিযানের কারণ

ভূমিকা :- চতুর্দশ শতকে আলাউদ্দিনের রাজত্বকালে বিন্ধ্য পর্বতের দক্ষিণে কোনো কেন্দ্রীয় রাজশক্তির অস্তিত্ব ছিল না। এই সময় দক্ষিণের চারটি হিন্দু রাজ্যে তিনি অভিযান শুরু করেন।

আলাউদ্দিন খলজির দাক্ষিণাত্য অভিযানের কারণ

সুলতান আলাউদ্দিন কি কারণে দক্ষিণ ভারত বিজয়ে উদ্যম দেখান সে সম্পর্কে বিভিন্ন ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। যেমন –

(ক) শুধুমাত্র লুন্ঠন নয়

কেবলমাত্র লুণ্ঠনের জন্যই আলাউদ্দিন খলজির দাক্ষিনাত্য অভিযান পরিচালিত হয় এই মত অনেকে গ্রহণ করেন না। দক্ষিণের ধনসম্পদ লুণ্ঠনের জন্য আলাউদ্দিনের লোভ হয়ত ছিল। প্রথম দেবগিরি অভিযানের সময় থেকে তিনি দক্ষিণের অপরিমিত ধনরত্নের সন্ধান পান একথা সত্য।

(খ) করদ রাজ্যের নীতি

তৎকালীন ভৌগোলিক পরিবেশে আলাউদ্দিন দক্ষিণকে তার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করার অসুবিধা বুঝতেন। ডঃ ইউ. এন. দের মতে, “আলাউদ্দিন দক্ষিণের হিন্দু রাজ্যগুলিকে ধাপে ধাপে করদ রাজ্যে পরিণত করার নীতি নেন।

(গ) বিশাল সেনাবাহিনী

আলাউদ্দিনের হাতে ছিল ৪,৭৫,০০০ সেনা। উত্তর ভারত জয়ের পর এই বিরাট সেনাদলকে নিষ্ক্রিয় রাখা সম্ভব ছিল না। কাজেই আলাউদ্দিন এই বাহিনীকে দক্ষিণে পাঠান।

(ঘ) বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি

সুতরাং আলাউদ্দিনের সাম্রাজ্যবাদের পশ্চাতে তার সামরিক একনায়কতন্ত্র, রাজ্য বিস্তারের স্পৃহা, সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা ও সংহতি, লুণ্ঠনের লক্ষ্য এবং দক্ষিণে করদ রাজ্য স্থাপনের দৃষ্টিভঙ্গি কার্যকরী ছিল।

(ঙ) সম্পদ শূন্য উত্তর ভারত

উত্তর ভারতের কৃষি সম্পদ দীর্ঘকাল লুণ্ঠন করার পর এই অঞ্চলে এমন কিছু উদ্বৃত্ত অর্থসম্পদ ছিল না, যা সুলতানি সম্রাট আলাউদ্দিনকে প্রয়োজন মত অর্থের যোগান দিতে পারে। দক্ষিণে বহুকাল কোনো বৈদেশিক আক্রমণ হয়নি। এজন্য দক্ষিণের রাজারা পুরুষানুক্রমে তাদের উদ্বৃত্ত সম্পদ সঞ্চিত করেন।

(চ) ধনরত্নের খবর পাওয়া

দক্ষিণের রাজ দুর্গ, প্রাসাদ, মন্দিরগুলি ধনসম্পদে পরিপূর্ণ ছিল। প্রত্যক্ষদর্শী আমীর খসরু, সমকালীন লেখক বরণী, ইসামি প্রমুখ সকলেই দক্ষিণের বিশাল ধনসম্পদের কথা বলেছেন। ১২৯৬ খ্রিস্টাব্দে আলাউদ্দিন তাঁর প্রথম দেবগিরি অভিযানের সময় দক্ষিণে সঞ্চিত ধন-রত্নের কথা জানতে পারেন।

(ছ) শাসন স্থাপনে বাধা

রাজপুতানার রাজ্য জয়ের পর শাসন স্থাপন করতে গিয়ে আলাউদ্দিন বহু বাধার সম্মুখীন হন। সুতরাং এই অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি দক্ষিণের রাজাদের কর দানের প্রতিশ্রুতি ও আনুগত্য লাভকেই তার অভিযানের লক্ষ্য হিসেবে নেন।

(জ) ধর্মপ্রচার তত্ত্ব

কোনো কোনো ঐতিহাসিক আলাউদ্দিনের দক্ষিণী অভিযানকে দাক্ষিণাত্যে ইসলাম ধর্ম ও সংস্কৃতি প্রবর্তনের প্রথম প্রয়াস বলে মনে করেন। এই ধারণার কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। সমকালীন কোনো লেখক বরণী বা ইসামী একথা বলেননি। আলাউদ্দিন দক্ষিণের ধনরত্ন ও আনুগত্য পেয়েই সন্তুষ্ট হন। তিনি ধর্ম প্রচারের কোনো চেষ্টা করেননি।

(ঝ) আধুনিক মত

আধুনিক কালে আলাউদ্দিনের দাক্ষিণাত্য অভিযানের কারণ প্রসঙ্গে নানা ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়। যেমন –

(১) ডঃ লালের অভিমত

ডঃ কে. এস. লাল প্রমুখ ঐতিহাসিকেরা আলাউদ্দিনের দাক্ষিণাত্য অভিযানের প্রকৃতি বিচার করে বলেছেন যে, “প্রকৃতপক্ষে উত্তরে সুলতান মামুদের অভিযানের যে লক্ষ্য ছিল দক্ষিণে আলাউদ্দিনের তাই ছিল”। অর্থাৎ লুণ্ঠন ছিল তাঁর লক্ষ্য।

(২) ডঃ দে -এর অভিমত

ডঃ ইউ এন দে নামে এক গবেষক আমীর খসরু ও ইসামীর বিবরণ এবং একটি সমকালীন জৈন রচনার ভিত্তিতে বলেছেন যে, আলাউদ্দিন ধাপে ধাপে দক্ষিণের রাজ্যগুলিকে করদ রাজ্যে পরিণত করার নীতি নেন।

(৩) নিছক লুন্ঠন নয়

আলাউদ্দিন চেয়েছিলেন যে, দক্ষিণের রাজ্যগুলি তার সার্বভৌমত্ব স্বীকার করবে। তাকে বার্ষিক কর দেবে ও তাঁর আদেশ পালন করবে। এজন্য তিনি দেবগিরিকে কেন্দ্র করে তার আধিপত্যকে দৃঢ় করার চেষ্টা করেন। নিছক লুণ্ঠন তার লক্ষ্য ছিল একথা বলা যায় না।

(ঞ) অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণ

  • (১) বিভিন্ন লেখকদের মতামত বিচার করে একথা মনে করা সঙ্গত যে আলাউদ্দিনের দাক্ষিণাত্য নীতির পশ্চাতে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উভয় প্রকার লক্ষ্য কাজ করেছিল। অর্থনৈতিক দিক থেকে দক্ষিণের সঞ্চিত ধনরত্ন দখলের লক্ষ্য নিশ্চয়ই আলাউদ্দিনের ছিল।
  • (২) কিন্তু এই সঙ্গে আরও কতকগুলি সংশ্লিষ্ট অর্থনৈতিক কারণও ছিল। রাজপুতানা ও মালব জয়ের পর এবং মোঙ্গল যুদ্ধে জয়লাভের পর আলাউদ্দিনের হাতে ছিল ৪ লক্ষ ৭৫ হাজার সেনা। এই বিশাল সেনাদলকে তিনি নগদ বেতন, প্রতি সৈন্যকে ২৩৪ টঙ্কা হারে দিতেন।
  • (৩) এই সেনাদলকে কাজে লাগাতে দক্ষিণ ভারতই ছিল একমাত্র উপযুক্ত ক্ষেত্র। কাজেই পরিস্থিতির চাপের ফলে তিনি দক্ষিণে অভিযানের নীতি নিতে বাধ্য হন। এই বিশাল সেনাদলের ব্যয়ভার বহন করার জন্য তাঁর নগদ টাকার দরকার হয়েছিল।
  • (৪) রাজনৈতিক দিক থেকে রাজপুতানা ও মালব জয়ের পর ভৌগোলিকভাবে দক্ষিণের রাস্তা তার কাছে খুলে যায়। একেই দক্ষিণে ছিল সঞ্চিত ধনভাণ্ডার। তদুপরি মালব জয়ের ফলে দক্ষিণের দরজা তাঁর কাছে উন্মুক্ত হয়।
  • (৫) দক্ষিণে এমন কোনো রাজা ছিলেন না যিনি আলাউদ্দিনকে প্রতিহত করতে সক্ষম ছিলেন। কাজেই ইতিহাসের ও পরিস্থিতির প্রভাবে আলাউদ্দিন দক্ষিণে অভিযান পরিচালনা করেন।

প্রতিশ্রুতি দানে দক্ষিণের রাজ্যগুলির বাধ্যতা

দক্ষিণের রাজ্যগুলিকে লুঠ করার পর এবং হিন্দু রাজাদের বার্ষিক রাজস্ব দিতে প্রতিশ্রুতি দিতে বাধ্য করার পর আলাউদ্দিন দক্ষিণের রাজ্যগুলিকে নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেননি।

উপসংহার :- ডাঃ কে. এস. লাল আলাউদ্দিনকে সুলতান মামুদের সঙ্গে তুলনা করেছেন। সুলতান মামুদ উত্তর ভারত লুঠ করেন, আলাউদ্দিন দক্ষিণ ভারত লুঠ করেন।

(FAQ) আলাউদ্দিন খলজির দাক্ষিণাত্য অভিযানের কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. আলাউদ্দিনকে সুলতান মামুদের সাথে তুলনা করেছেন কে?

ডঃ কে এস লাল।

২. কোন স্থানকে কেন্দ্র করে আলাউদ্দিন দক্ষিণে দৃঢ় আধিপত্য স্থাপনের চেষ্টা করেন?

দেবগিরি।

৩. আলাউদ্দিনের সময় দক্ষিণ ভারতে কতগুলি হিন্দু রাজ্য ছিল?

চারটি।

৪. আলাউদ্দিনের দাক্ষিণাত্য অভিযানের অন্যতম উদ্দেশ্য কি ছিল?

ধনরত্ন লুন্ঠন।

Leave a Comment