আলাউদ্দিন খলজির মোঙ্গল নীতি

আলাউদ্দিন খলজির মোঙ্গল নীতি প্রসঙ্গে মোঙ্গল বাহিনীর ভারত অভিযান, কাদার খানের আক্রমণ ও তার প্রতিরোধ, আমীর সলদির আক্রমণ ও তার প্রতিরোধ, কতলু খাজার আক্রমণ ও তার প্রতিরোধ, তার্ঘি বেগের আক্রমণ ও তার প্রতিরোধ, মোঙ্গলদের রণকৌশল বদল, মোঙ্গলদের সমবেত আক্রমণ ও আলাউদ্দিন খলজির প্রতিরোধ ব্যবস্থা সম্পর্কে জানবো।

আলাউদ্দিন খলজির মোঙ্গল নীতি

ঐতিহাসিক ঘটনাআলাউদ্দিন খলজির মোঙ্গল নীতি
সুলতানআলাউদ্দিন খলজি
আক্রমণের সূচনাচেঙ্গিস খান
সেনাপতিজাফর খাঁ
মোঙ্গল নেতাআমীর তার্ঘি, কতলু খাজা
আলাউদ্দিন খলজির মোঙ্গল নীতি

ভূমিকা :- চেঙ্গিজ খানের আমল থেকে ভারত -এ মোঙ্গল আক্রমণের সূচনা হয়। তারপর থেকে বিভিন্ন সুলতানদের রাজত্বকালে ভারতে মোঙ্গল আক্রমণ চলতে থাকে। আলাউদ্দিনের রাজত্বকালে ভারতে মোঙ্গল আক্রমণ প্রবল হয়ে ওঠে।

মোঙ্গল বাহিনীর ভারত অভিযান

আলাউদ্দিন খলজির সময় মোঙ্গলরা আফগানিস্থান জয় করে। এখান থেকে বন্যার জলের মতই মোঙ্গল বাহিনী ভারতের দিকে ছুটে আসে।

মোঙ্গল নেতা কাদার খানের আক্রমণ ও তার প্রতিরোধ

মোঙ্গল সেনাপতি কাদার খান ১২৯৬ খ্রিস্টাব্দে পাঞ্জাব ও সিন্ধু আক্রমণ করেন। তিনি লাহোর নগর লুঠ করেন। আলাউদ্দিনের দুই সেনাপতি জাফর খান ও উলুগ খান জলন্ধরের যুদ্ধে কাদার খানকে পরাস্ত করেন ও বহু মোঙ্গল সেনাকে নিহত করলে মোঙ্গলরা পিছু হঠে যায়।

আলাউদ্দিনের সময় মোঙ্গল নেতা আমীর সলদির আক্রমণ ও তার প্রতিরোধ

১২৯৮ খ্রিস্টাব্দে মোঙ্গল সেনাপতি আমীর সলদির নেতৃত্বে মোঙ্গল সেনা সিন্ধু আক্রমণ করলে, আলাউদ্দিনের বীর সেনাপতি জাফর খাঁ মোঙ্গল সেনাপতি সলদিকে নিহত করেন।

মোঙ্গল নেতা কতলু খাজার আক্রমণ

এর পর মোঙ্গল আক্রমণকারীরা তাদের রণকৌশল বদল করে। সীমান্তে যুদ্ধ যারা শক্তিক্ষয় না করে, মোঙ্গল সেনাপতি কতলু খাজা সরাসরি দিল্লী আক্রমণ করে খলজিদের সিংহাসনচ্যুত করার লক্ষ্য নেন। মোঙ্গল সেনা দিল্লীর উপকণ্ঠে পৌঁছে গেলে রাজধানীতে ভীতি ছড়িয়ে পড়ে। লোকে মোঙ্গলদের ভয়ে পালাতে থাকে।

মোঙ্গল নেতা কতলু খাজার আক্রমণ প্রতিরোধ

  • (১) আলাউদ্দিন এই বিপদে না দমে মোঙ্গল সেনাদের সম্মুখ যুদ্ধে পরাস্ত করার সঙ্কল্প নেন। সেনাপতি জাফর খাঁ, উলুগ খা এবং তিনি নিজে দিল্লী থেকে ৬ মাইল উত্তরে কিলিতে মোঙ্গলদের পথ আটকান। দুই পক্ষে প্রচণ্ড হতাহত হওয়ার পর মোঙ্গল সেনা পিছু হঠতে থাকে।
  • (২) জাফর খাঁ মোঙ্গল বাহিনীর পিছু নিয়ে আক্রমণ চালান। তিনি এই যুদ্ধে নিহত হন। মোঙ্গলরা প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির জন্য আপাতত খাইবার গিরিপথ সীমান্তের অপর পারে চলে যায়। দিল্লী রক্ষা পায়। আলাউদ্দিনের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায়।

মোঙ্গল নেতা তার্ঘি বেগের আক্রমণ ও তার প্রতিরোধ

প্রায় দুবছর নিরস্ত থাকার পর ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে মোঙ্গল সেনাপতি আমীর তার্ঘি বেগ ১ লক্ষ ২০ হাজার সেনা সহ দিল্লী অবরোধ করেন। ৪০ দিন দিল্লী অবরোধের পর সুলতানি সেনা মোঙ্গলদের বাইরে থেকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করলে, মোঙ্গল সেনাপতি আমীর তার্ঘি দিল্লী অধিকারের সঙ্কল্প ত্যাগ করেন। তিনি খাইবার গিরিপথ পার হয়ে নিজ অঞ্চলে ফিরে যান।

আলাউদ্দিনের সময় মোঙ্গলদের রণকৌশল বদল

বারে বারে পরাস্ত হলেও মোঙ্গলরা ভারত আক্রমণের লক্ষ্য ছাড়েনি। এবার তারা রণকৌশল পাল্টায়। সম্মুখ যুদ্ধ অথবা অবরোধ এড়িয়ে মোঙ্গল সেনারা অরক্ষিত গ্রামাঞ্চল ও নগরগুলি লুঠ করার কাজে মন দেয়।

আলাউদ্দিনের সময় মোঙ্গলদের সমবেত আক্রমণ

মোঙ্গোল সেনারা ১৩০৫ খ্রিস্টাব্দে চেঙ্গিজের বংশধর আলি বেগ এবং সেনাপতি খাজা তাশ ও আমীর তার্ঘির নেতৃত্বে মূলতান, পাঞ্জাবকে লুঠপাট ও অগ্নিসংযোগ দ্বারা ছারখার করে দেয়। তারা সুরক্ষিত দিল্লীর পাশ কাটিয়ে গঙ্গা-যমুনা দোয়াবে ঢুকে লুঠপাট, হত্যা ও অগ্নিসংযোগ দ্বারা ব্যাপক বিভীষিকা সৃষ্টি করে।

আলাউদ্দিনের সময় মোঙ্গলদের সমবেত আক্রমণ প্রতিরোধ

সুলতান আলাউদ্দিন তার সেনাপতিদ্বয় মালিক কাফুর ও গাজি মালিকের সহায়তায় লুন্ঠনকারী, অসংগঠিত মোঙ্গল সেনাদের ঘিরে ফেলেন এবং নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেন। যুদ্ধক্ষেত্রে বহু মোঙ্গল সেনা মারা পড়ে। ৮ হাজার মোঙ্গলকে বন্দী করে দিল্লীতে আনা হয়। সুলতানের আদেশে তাদের হত্যা করা হয়। আলি বেগ ও খাজা তাশও নিহত হন।

মোঙ্গল নেতা ইকবালমন্দের আক্রমণ ও তার প্রতিরোধ

১৩০৬ খ্রিস্টাব্দে আলাউদ্দিনের রাজত্ব কালে শেষ মোঙ্গল আক্রমণ ঘটে। দুই মোঙ্গল সেনাপতি ইকবালমন্দ ও কুবাক ৫০ হাজার মোঙ্গল সেনা সহ লাহোর ও নাগোর আক্রমণ করেন। আলাউদ্দিনের সেনাপতি গাজি মালিক ও মালিক কাফুরের আক্রমণে বহু মোঙ্গল নিহত হয়। কুবাক বন্দী হয়ে নিহত হন।

আলাউদ্দিনের সময় মোঙ্গলদের ব্যর্থ অভিযান

বারে বারে অভিযান চালিয়ে ব্যর্থ হওয়ার ফলে আলাউদ্দিনের রাজত্বের অবশিষ্টকালে আর মোঙ্গল আক্রমণ ঘটেনি।

আলাউদ্দিনের মোঙ্গল প্রতিরোধ ব্যবস্থা

সম্মুখ যুদ্ধে মোঙ্গলদের বারবার পরাজিত করলেও, মোঙ্গল আক্রমণ সম্পর্কে আলাউদ্দিন কোনো আত্মসন্তুষ্টির মনোভাব নেননি। “রক্ত ও লৌহ” নীতির প্রয়োগ ছাড়াও কতকগুলি স্থায়ী প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেন। যেমন –

(১) সামরিক ঘাঁটি ও দুর্গ নির্মাণ

তিনি গোটা পাঞ্জাব ও সিন্ধু অঞ্চলে বহু সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেন। পুরাতন দুর্গগুলির সংস্কার করেন এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নতুন দুর্গ তৈরি করেন। দুর্গগুলিতে দক্ষ সেনাপতিদের অধীনে সেনা সন্নিবেশ করেন।

(২) রাস্তাঘাট তৈরি ও গুপ্তচর নিয়োগ

দিল্লী থেকে পাঞ্জাব পর্যন্ত তিনি রাস্তাঘাট তৈরি করে সেনা চলাচলের সুবিধা করেন। সীমান্তে গুপ্তচর নিয়োগ করে মোঙ্গলদের গতিবিধির ওপর নজর রাখা হয়।

(৩) রাজধানীর সুরক্ষা

রাজধানী দিল্লীর সুরক্ষার জন্য তিনি দিল্লী দুর্গের সংস্কার করেন এবং সিরিতে একটি নতুন দুর্গ নির্মাণ করেন। তিনি তাঁর সেনা সংখ্যা বৃদ্ধি করেন এবং অশ্বারোহী বাহিনী গঠনের ওপর জোর দেন।

উপসংহার :- আলাউদ্দিন তাঁর সামরিক শক্তি ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার দ্বারা মোঙ্গল আক্রমণকারীদের মেরুদণ্ড ভেঙে দেন। ভারতীয় সামন্ত ও রাজশক্তিগুলিও তার পরাক্রম দেখে ভীত হয়। তাঁকে মান্য করতে তারা বাধ্য হয়। মোঙ্গল আক্রমণ সাফল্যের সঙ্গে প্রতিহত করার ফলে আলাউদ্দিন নিশ্চিন্ত হয়ে দক্ষিণে অভিযান পাঠান।

(FAQ) আলাউদ্দিন খলজির মোঙ্গল নীতি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. আলাউদ্দিন খলজি কোথায় নতুন দুর্গ নির্মাণ করেন?

সিরি।

২. কার নেতৃত্বে ভারতে মোঙ্গল আক্রমণের সূচনা হয়?

চেঙ্গিস খান।

৩. কোন সুলতানের আমলে মোঙ্গল আক্রমণ প্রবল হয়ে ওঠে?

আলাউদ্দিন খলজি।

৪. মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিরোধে আলাউদ্দিন খলজির দক্ষ সেনাপতি কে ছিলেন?

জাফর খাঁ।

Leave a Comment