রংপুর বিদ্রোহ -এর সময়, স্থান, কৃষকদের দূরবস্থা, বিদ্রোহের কারণ, সূত্রপাত, বিদ্রোহীদের উদ্দেশ্য, নেতা নির্ধারণ, সরকার প্রতিষ্ঠা, বিদ্রোহের প্রসার, বিদ্রোহের প্রাবল্য, বিদ্রোহ দমন, বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য, গুরুত্ব ও ফলাফল সম্পর্কে জানবো।
রংপুর বিদ্রোহ প্রসঙ্গে রংপুর বিদ্রোহের সময়কাল, রংপুর বিদ্রোহের এলাকা, রংপুর বিদ্রোহের স্থান, রংপুর বিদ্রোহের নেতা, রংপুরের অত্যাচারি ইজারাদার দেবী সিংহ, রংপুর বিদ্রোহের কারণ, রংপুর বিদ্রোহে ডিং খরচা, রংপুর কৃষক বিদ্রোহের দুজন নেতা নুরুল উদ্দিন, দয়ারাম শীল, রংপুর বিদ্রোহ প্রথম শুরু গ্ৰামের নাম, রংপুর বিদ্রোহ দমনে ব্রিটিশ বাহিনীর নেতৃত্ব, রংপুর বিদ্রোহের সূত্রপাত, রংপুর বিদ্রোহের উদ্দেশ্য, রংপুর বিদ্রোহের প্রসার, রংপুর বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য, রংপুর বিদ্রোহের গুরুত্ব ও ফলাফল।
১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দের রংপুর বিদ্রোহ
ঐতিহাসিক ঘটনা | রংপুর বিদ্রোহ |
সময়কাল | ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দ |
স্থান | দিনাজপুর, রংপুর |
নেতৃত্ব | নুরুল উদ্দিন, দয়ারাম শীল |
ফলাফল | ব্যর্থতা |
ভূমিকা :- ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইজারাদারি শোষণের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়া ছিল ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দের রংপুর বিদ্রোহ। দিনাজপুর এবং রংপুরের ইজারাদার দেবী সিংহের বিরুদ্ধে এই কৃষক বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল ।
রংপুরের ইজারাদার দেবী সিংহ
- (১) দেবী সিংহ ছিলেন ব্যবসায়ী। ভাগ্য অন্বেষণের জন্য তিনি উত্তর ভারত থেকে মুর্শিদাবাদ -এ আসেন।
- (২) পলাশীর যুদ্ধ -এ অংশ নিয়েছিলেন ইংরেজদের পক্ষে। একারণে ছিলেন ব্রিটিশদের সুনজরে।
- (৩) রেজা খাঁর কৃপায় দেবী সিংহ প্রথমে পূর্ণিয়ার ইজারা ও শাসনভার গ্রহণ করে প্রজাদের ওপর তুমুল অত্যাচার শুরু করেন। বাধ্য হয়ে হেস্টিংস দেবী সিংহকে পদচ্যুত করেন ।
- (৪) এর পর দেবী সিংহ উৎকোচ প্রদান করে প্রাদেশিক রেভিনিউ বোর্ডের সহকারী কার্যাধ্যক্ষের পদ দখল করেন।
- (৫) এখানেও দেবী সিংহ নামে-বেনামে বিভিন্ন জমিদারির ইজারা নেন এবং নিজের সম্পত্তি বাড়াতে থাকেন। বাধ্য হয়ে হেস্টিংস ‘রেভেনিউ বোর্ড’ ভেঙ্গে দেন ।
রংপুরের ইজারা গ্ৰহণ
দেবী সিংহ নামের জনৈক ব্যক্তি ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে সরকারের কাছ থেকে দিনাজপুর, রংপুর ও একাদ্রপুর পরগনার ইজারা নেন।
রংপুর বিদ্রোহের সময়কাল
ইজারাদার দেবী সিংহের অত্যাচারে জর্জরিত কৃষকরা ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দে রংপুর বিদ্রোহ শুরু করে।
রংপুর বিদ্রোহের স্থান
রংপুর, দিনাজপুর ও কোচবিহার জেলার বিস্তীর্ণ এলাকায় এই বিদ্রোহ সংগঠিত হয়। তবে এই বিদ্রোহের মূল কেন্দ্র ছিল রংপুর। এজন্য এই বিদ্রোহ রংপুর বিদ্রোহ নামেই পরিচিত হয়।
রংপুরের কৃষকদের দূরবস্থা
এই সব জায়গায় কৃষক, তাঁতি ও অন্যান্য শ্রমজীবী মানুষের কাছে বারো মাসের পরিবর্তে সতেরো মাসের রাজস্ব আদায় করা হত। এমনকি ‘লাখোয়াজ’ বা নিষ্কর জমি বাজেয়াপ্ত করা হয়। অসহায় কৃষকরা তখন নিরুপায় হয়ে মহাজনদের দ্বারস্থ হয়ে এবং ঋণের দায়ে শেষ পর্যন্ত ভিটেমাটি ছাড়া হয়েছিল।
রংপুর বিদ্রোহের কারণ
রংপুর বিদ্রোহ সংঘটিত হওয়ার বিভিন্ন কারণ ছিল। যেমন –
(১) কর আরোপ
দেবী সিংহ দিনাজপুর, রংপুর ও একাদ্রপুর পরগনার ইজারা নিয়ে সেখানকার জমিদার ও প্রজাদের উপর রাজস্বের হার বহুগুণ বৃদ্ধি করেন এবং নানা নতুন কর আরোপ করেন।
(২) কৃষকের উপর অন্যায় অত্যাচার
রাজস্ব আদায়ের জন্য এখানকার জমিদার ও কৃষকদের ওপর চরম অত্যাচার শুরু হয়। এছাড়া রংপুরেও অত্যাচার চরমে ওঠে। কৃষকদের কারাগারে অনাহারে বন্দি রাখা, বেত্রাঘাত প্রভৃতি চালাতে থাকে।
(৩) নির্যাতনের মাত্রা বৃদ্ধি
কৃষকরা গরু বাছুর, সম্পত্তি এমনকি নিজের সন্তানদের বিক্রি করেও দেবী সিংহের শোষণ থেকে মুক্ত হতে পারত না।
রংপুর বিদ্রোহের সূত্রপাত
শেষ পর্যন্ত দিনাজপুর এবং রংপুরের কাজিরহাট, কাকিনা, ফতেপুর, ডিমলা গ্রামের কৃষকরা ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দের ১৮ জানুয়ারি ‘তেপা’ গ্রামে মিলিত হয়ে দেবী সিংহের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।
রংপুর বিদ্রোহীদের উদ্দেশ্য
রংপুর বিদ্রোহীদের প্রধান লক্ষ্য ছিল দেবীর সিংহের অমানবিক শোষণ এবং অত্যাচার থেকে মুক্তি পাওয়া।
রংপুর বিদ্রোহের নেতা নির্ধারণ
বিদ্রোহী কৃষকরা সমবেতভাবে নূরুলউদ্দিন নামে এক ব্যক্তিকে তাদের নেতা নির্বাচিত করেন। নূরুলউদ্দিন ‘নবাব’ উপাধি নিয়ে বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন। বিদ্রোহের খরচ চালাবার জন্য কৃষকদের ওপর ‘ডিং খরচা’ নামে চাঁদা ধার্য করেন ।
রংপুর বিদ্রোহের নেতৃত্ব
রংপুর বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন নুরুল উদ্দিন, দয়ারাম শীল, দির্জিনারায়ণ, কেনা সরকার, ইজ্রায়েল খাঁ প্রমুখ
রংপুর বিদ্রোহীদের স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠা
বিদ্রোহীরা একটি স্থানীয় স্বাধীন সরকার গঠন করেন। এই সরকারের নবাব বা নেতা হন নুরুল উদ্দিন এবং তার সহকারী নেতা হন দয়ারাম শীল।
রংপুর বিদ্রোহের প্রসার
বিদ্রোহীরা দেবী সিংহ কে খাজনা দেওয়া বন্ধ করে এবং তার রাজস্ব বিভাগের কর্মচারীদের বিতাড়িত করে। বহু কর্মচারী নিহত হয়। বিদ্রোহের ব্যয় নির্বাহের জন্য ‘ডিং খরচা’ নামে চাঁদা ধার্য করা হয়।
রংপুর বিদ্রোহের প্রাবল্য
তেপা এবং ফতেপুরে বিদ্রোহ প্রবল আকার ধারণ করে । তেপার জমিদার বিদ্রোহীদের বাধা দিতে গিয়ে বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হন। বিদ্রোহীদের হাতে কয়েকজন কর সংগ্রাহক নিহত হয়।
রংপুর বিদ্রোহ দমন
দেবী সিংহ নিজেকে বাঁচানোর তাগিদে রংপুরের কালেক্টর গুডল্যান্ডের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন। বিশাল ইংরেজ বাহিনীর সাথে মোগলহাট ও পাটগ্রামের যুদ্ধে বিদ্রোহীরা পরাজিত হয় এবং নূরুলউদ্দিন গুরুতর আহত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। ব্রিটিশ বাহিনী গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়, অসংখ্য বিদ্রোহী কে হত্যা করে।
রংপুর বিদ্রোহের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য
রংপুর বিদ্রোহের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে। যেমন –
(১) কৃষক বিদ্রোহ
রংপুর বিদ্রোহ ছিল একটি কৃষক বিদ্রোহ। শোষিত কৃষকেরা এই বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেছিল।
(২) ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম
রংপুর বিদ্রোহ ছিল একটি ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম। হিন্দু-মুসলিম কৃষকরা জাতি-ধর্ম ভুলে ঐক্যবদ্ধ ভাবে বিদ্রোহ চালিয়ে গিয়েছিল।
(৩) জমিদারদের অংশগ্ৰহণ
রংপুর বিদ্রোহে কৃষকদের পাশাপাশি কিছু জমিদাররাও বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেছিল।
রংপুর বিদ্রোহের গুরুত্ব ও ফলাফল
বিদ্রোহটি ক্ষুদ্র সময়ের জন্য হলেও এটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে ইজারাদারির কুফলের প্রকাশ ঘটে। অধ্যাপক নরহরি কবিরাজ বলেন, ‘১৭৮৩ সালের বিদ্রোহ ছিল একটি সফল কৃষক অভিযান।’
(১) রাজস্ব অনাদায়
রংপুর বিদ্রোহের ফলে দেবী সিংহ রাজস্ব আদায়ে ব্যর্থ হলে সেই অঞ্চলে প্রায় ৩৯০২০০ টাকা রাজস্ব অনাদায় হিসেবে পড়ে থাকে ।
(২) দেবী সিংহের অপসারণ
রংপুর বিদ্রোহের ফলে দেবীসিংহ তার ক্ষমতা থেকে অপসারিত হয়।
(৩) ইজারাদারি ব্যবস্থার অবসান
এই বিদ্রোহের পর লর্ড কর্নওয়ালিস ইজারাদারি বন্দোবস্ত এর অবসান ঘটিয়ে শুরু করেন দশসালা বন্দোবস্ত।
(৪) অনুপ্রেরণা লাভ
রংপুর বিদ্রোহ পরবর্তী কৃষক বিদ্রোহীদের আত্মবিশ্বাস ও অনুপ্রেরণা দান করেছিল।
(৫) হিন্দু-মুসলিম ঐক্য
সর্বোপরি এই রংপুর বিদ্রোহের ফলে হিন্দু মুসলিম ঐক্যবদ্ধতা লক্ষ্য করা যায়।
উপসংহার :- সে কৃষক বিদ্রোহ ছিল মাটির মানুষের। সেই অতি সাধারণ কৃষকেরাই আমাদের নায়ক, আমাদের গল্পের নায়ক, আমাদের প্রেরণার নায়ক। তবু আমরা হয়তো ভুলে যাই নুরুল উদ্দিনের মত মানুষদেরকে। কিন্তু নুরুল উদ্দিনরা আসে মানুষের জন্য, মানবতার বিজয়ের লড়াইকে সমুন্নত রাখতে।
প্রিয় পাঠক/পাঠিকা আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ সময় করে আমাদের এই “রংপুর বিদ্রোহ” পোস্টটি পড়ার জন্য। এই ভাবেই adhunikitihas.com ওয়েবসাইটের পাশে থাকুন। যে কোনো প্রশ্ন উত্তর জানতে এই ওয়েবসাইট টি ফলো করুণ এবং নিজেকে তথ্য সমৃদ্ধ করে তুলুন।
সবশেষে আপনার কাছে আমাদের অনুরোধ যদি এই পোস্টটি আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে Comment ও Share করে দিবেন, (ধন্যবাদ)।
(FAQ) রংপুর বিদ্রোহ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
ম্যাকডোনাল্ড।
১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দে।
নুরুল উদ্দিন, দয়ারাম শীল।
অন্যান্য ঐতিহাসিক ঘটনাগুলি
- কেন্দ্রীয় চোল শাসন
- সাম্রাজ্য ও রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মধ্যে পার্থক্য
- অর্থনীতিতে দাসপ্রথার গুরুত্ব
- রোমের দাসদের মুক্তির উপায়
- রোমান সাম্রাজ্য ও উপমহাদেশীয় সাম্রাজ্যগুলির মধ্যে যোগাযোগের প্রভাব
- জাস্টিনিয়ান পরবর্তী রাজবংশ
- রোমান সমাজে নারীর অবস্থান
- বাইজানটাইন সভ্যতা-সংস্কৃতির নানা দিক
- রোমান সাম্রাজ্য ও ভারতীয় উপমহাদেশ