বহুত্ববাদ

বহুত্ববাদ প্রসঙ্গে বহুত্ববাদ কথার ব্যবহার, বহুত্ববাদ কথার অর্থ, বহুত্ববাদের উদ্ভব, বহুত্ববাদের সূচনা কাল, বহুত্ববাদের রূপ, বহুত্ববাদের বৈশিষ্ট্য ও ইউরোপে বহুত্ববাদ সম্পর্কে জানবো।

ধর্মীয় বহুত্ববাদ প্রসঙ্গে বহুত্ববাদ কথার অর্থ, বহুত্ববাদ কথার ব্যবহার, বহুত্ববাদের উদ্ভব, বহুত্ববাদের রূপ, বহুত্ববাদের বৈশিষ্ট্য ও বহুত্ববাদের সূচনা কাল সম্পর্কে জানব।

বহুত্ববাদ

ঐতিহাসিক ঘটনাবহুত্ববাদ
সূচনাকালআনুমানিক ৫০০ খ্রিস্টপূর্ব
অর্থবহু দেবতার উপাসনা
ইংরেজি শব্দ‘Polytheism’
গ্ৰিক শব্দ polyবহু
গ্ৰিক শব্দ theoiঈশ্বর
কথাটির প্রথম ব্যবহারইহুদি লেখক ফিলো
বহুত্ববাদ

ভূমিকা :- বাংলা বহু ঈশ্বরবাদ বা ‘বহুত্ববাদ’ অর্থাৎ ইংরেজি ‘Polytheism’ কথাটির উৎপত্তি হয়েছে গ্রিক শব্দ poly (যার অর্থ হল ‘বহু’) এবং theoi (যার অর্থ হল ‘ঈশ্বর’) থেকে। সেই অর্থে বহুত্ববাদ বলতে বহু ঈশ্বর বা বহু দেবতার উপাসনাকে বোঝায়।

বহুত্ববাদ কথার ব্যবহার

আলেকজান্দ্রিয়ার ইহুদি লেখক ফিলো ‘বহুত্ববাদ’ কথাটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন। আধুনিককালে ফরাসি লেখক জাঁ বোঁদা ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দে এবং ইংরেজ লেখক স্যামুয়েল পার্কাস ১৬১৪ খ্রিস্টাব্দে ‘বহুত্ববাদ’ কথাটি ব্যবহার করেন।

বহুত্ববাদের অর্থ

  • (১) সাধারণভাবে বহুত্ববাদ বলতে বহু দেবতার উপাসনা বোঝায়। বহুত্ববাদে বিভিন্ন দেবতার অস্তিত্বে বিশ্বাস করা হয় এবং বিভিন্ন দেবতাকে পৃথক পৃথক ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কল্পনা করা হয়।
  • (২) বহুত্ববাদী মতবাদ হল একেশ্বরবাদী মতবাদ অর্থাৎ একটি মাত্র ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাসের বিপরীত একটি ধারণা। ‘ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়’ – একেশ্বরবাদের এই ধারণায় বহুত্ববাদ বিশ্বাস করে না।
  • (৩)  বহুত্ববাদীরা সর্বদা তাদের সকল দেবতাকে একই সঙ্গে এবং সমানভাবে উপাসনা করে না। তারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেবতার উপাসনা বা আরাধনা করে থাকে।
  • (৪) বেশিরভাগ লোকধর্মে যে সর্বপ্রাণবাদী ধারণার অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায় তার সঙ্গে প্রাচীন বহুত্ববাদী ধর্মের খুব বেশি পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায় না।
  • (৫) বহুত্ববাদে বিভিন্ন দেবদেবীকে পৃথক পৃথক ক্ষেত্রে দক্ষ বলে কল্পনা করা হয়। পৃথক পৃথক দক্ষতা ও ক্ষমতাবিশিষ্ট এই সকল দেবদেবীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন সৃষ্টির দেবতা, জীবন ও মৃত্যুর দেবতা, প্রেমের দেবতা, আকাশের দেবতা, সূর্যের দেবতা, জলের দেবতা, উর্বরতার দেবতা প্রমুখ।

বহুত্ববাদের উদ্ভব

প্রাচীনকালে আত্মা, দৈত্যদানব এবং অন্যান্য আধ্যাত্মিক ও অতি-প্রাকৃতিক শক্তির প্রতি মানুষের ভয় ও বিশ্বাস ছিল। সম্ভবত বিভিন্ন বিষয়ে এই ভয় ও বিশ্বাস থেকেই প্রাচীনকালের মানুষ বিভিন্ন দেবতার অস্তিত্বে বিশ্বাস করতে শুরু করে। বহু দেবতার বিশ্বাসে যে বিষয়গুলি সহায়ক উপাদান হিসেবে কাজ করেছিল সেগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল সর্বপ্রাণবাদে বিশ্বাস, পূর্ব- পুরুষের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা এবং টোটেম প্রথায় আস্থা। যেমন  –

(১) সর্বপ্রাণবাদের ভূমিকা

সর্বপ্রাণবাদের ধারণার বশবর্তী হয়ে প্রাচীন মানুষ প্রকৃতির বিভিন্ন বস্তুতেই প্রাণের অস্তিত্ব কল্পনা করত।

(২) পূর্বপুরুষের প্রতি শ্রদ্ধা

পূর্বপুরুষের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তারা পূর্বপুরুষের পুজো করত।

(৩) ধর্মীয় প্রতীকের ভূমিকা

কোনো জাতিগোষ্ঠীর ধর্মীয় প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত প্রাণী বা উদ্ভিদের প্রতীককে টোটেম বলা হয়। টোটেম প্রথায় বিশ্বাস করে তারা বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতীকের উপাসনা করত। এভাবে কোনো একটি মানবগোষ্ঠীতে বিভিন্ন দেবদেবীর আরাধনা শুরু হয়।

(৪) দেবদেবীর পরিবার

বহুত্ববাদী মতবাদে দেবদেবীদের একটি মহাজাগতিক পরিবারের সদস্য বলে চিন্তা করা হয়। এই দেবদেবীদের পরিবার কোনো মানবগোষ্ঠী বা মানব সংস্কৃতির ধর্মীয় বিশ্বাসের কেন্দ্রে অবস্থান করে। উক্ত মানব-সংস্কৃতির ধর্মীয় বিশ্বাসের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে কল্পিত ঈশ্বরের পরিবারে সদস্য-সংখ্যা অর্থাৎ দেবতার সংখ্যাও ক্রমে বাড়তে থাকে। এভাবে মানুষের ধর্মীয় চিন্তায় বহুত্ববাদী ধারণার প্রসার ঘটে।

বহুত্ববাদের সূচনাকাল

প্রাচীনত্ব এবং একাধিক ধর্মের উপস্থিতির কারণে এই মতবাদের সঠিক উদ্ভবকাল নির্ণয় করা যায় নি। তবে কোনো কোনো ঐতিহাসিকের অনুমান বহু ঈশ্বরবাদের উদ্ভব ঘটেছিল ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। বাইবেল অনুসরণে বলা হয় যে, পৃথিবী পাপে পরিপূর্ণ হওয়ায় ঈশ্বর একটি বন্যা সৃষ্টি করেন এবং পৃথিবীর সমস্ত কিছুকে ধ্বংস করে দেন। এই সময় কেবলমাত্র ঈশ্বরের অনুগত নোয়া ও তার লোকজন বেঁচে যায়। মহাপ্রলয় নামে অভিহিত এই বন্যার আগে পৃথিবীতে বহু-দেবত্ববাদ ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল।

বহুত্ববাদের রূপ

মূলত দুটি রূপে বহুত্ববাদ প্রতিভাত হয়। যেমন –

(১) চরমপন্থী বহুত্ববাদ

চরমপন্থী বহুত্ববাদীদের বিশ্বাস অনুযায়ী দেবতারা হলেন পরস্পরের থেকে পৃথক। এঁদের আলাদা আলাদা অস্তিত্ব অবশ্যই রয়েছে। চরমপন্থী বহুত্ববাদী মতে, স্বর্গস্থিত দেবতারা কোনোমতেই মনগড়া সত্তা নন। তাঁরা নিছক সেইসব প্রাকৃতিক শক্তি নন, যাঁদের ভয়-ভক্তিতে পূজা করা হয়। চরমপন্থীদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল স্বর্গে দেবদেবীরা অবশ্যই বিরাজ করেন। “সব দেবতারাই আসলে এক ঈশ্বরেরই বিভিন্ন রূপ” – এরকম মতবাদকে চরম বহুত্ববাদীরা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁরা এই বিশ্বাসকেও আমল দেন না যে, সমস্ত সংস্কৃতি ও সভ্যতায় পূজিত দেবতারা সমভাবে অস্তিত্ববান।

(২) নরমপন্থী বহুত্ববাদ

এর বিপরীতে নরমপন্থী বহুত্ববাদীরা মনে করেন যে, বিভিন্ন দেবতা ও দেবীরা হলেন এক ঈশ্বরেরই ভিন্ন ভিন্ন রূপ। তাঁদের মতে, বহু দেবতার কল্পনা সম্পূর্ণ এক মনগড়া বিষয়। ভয়ভীতি থেকে প্রাকৃতিক শক্তিতে দেবসত্তা আরোপ করার মধ্যে দিয়েই অহেতুক বহু দেবদেবীর প্রতিষ্ঠা ঘটেছে।

বহুত্ববাদের বৈশিষ্ট্য

এই বহুত্ববাদ তত্ত্বের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য গুলি হল –

  • (১) বহু-দেবতাবাদ তত্ত্বে উল্লিখিত হয়েছে দেবদেবীরা অত্যন্ত শক্তিশালী। তাঁরা প্রাজ্ঞ, ন্যায়বিচারক এবং অমর।
  • (২) এই সমস্ত দেবদেবী বিভিন্ন রূপ ও বৈচিত্র্যের অধিকারী। অর্থাৎ তাঁরা নিজেদেরকে নানাভাবে প্রকট করেন। তাঁরা বিশেষ বিশেষ জড় বা চেতন শরীরে প্রচ্ছন্ন থাকেন। আবার সেই শরীরকে অতিক্রম করেও তাঁরা প্রকট হন।
  • (৩) বহুত্ববাদে উল্লিখিত দেবদেবীরা জীবকুল বা জড়বস্তু দ্বারা সীমাবদ্ধ নন।
  • (৪) এই সমস্ত দেবদেবী সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং সকলেই সমানভাবে স্বর্গীয় সত্তার অধিকারী। অন্য কোনো শক্তি বা সত্তা এঁদের নিয়ন্ত্রণ করে না।

ইউরোপে বহুত্ববাদ

বহুত্ববাদ ইউরোপ-এ দ্রুত বিস্তার লাভ করে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন দিক গুলি হল –

(১) বিভিন্ন দেবতার সৃষ্টি

প্রাচীন বিশ্বে প্রাকৃতিক শক্তির কাছে মানুষ বড়োই অসহায় ছিল। এজন্য যা কিছু বৃহৎ, প্রবল ও রহস্যাবৃত তার পেছনে এক-একটি শক্তি কাজ করে চলেছে বলে ভীত মানুষ কল্পনা করে নিয়েছিল। এভাবে মানুষের কল্পনা থেকেই প্রাচীনকালে বিভিন্ন দেবদেবীর সৃষ্টি হয়েছে।

(২) ইউরোপে বিভিন্ন দেবতার সৃষ্টি

বিভিন্ন দেবদেবীর সৃষ্টির ধারণাটি প্রাচীন গ্রিস, রোম ও অন্যান্য বহুত্ববাদী ধর্মগুলির ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়। প্রাচীন ইউরোপে গ্রিসের বিভিন্ন নগর-রাষ্ট্রে, প্রাচীন রোমে, প্রাচীন কেল্টিক, জার্মান, স্লাভ, বাল্টিক প্রভৃতি বিভিন্ন মিশ্র উপজাতির ধর্মচিন্তায় বহু দেবতার অস্তিত্বে বিশ্বাস করা হত। তবে ইউরোপে বহুত্ববাদী ধর্মের প্রধান কেন্দ্র ছিল প্রাচীন গ্রিস ও প্রাচীন রোম।

(৩) গ্রিসে বহুত্ববাদ

প্রাচীন গ্রিসের বিভিন্ন উপকথাতেও বহু দেবতার অস্তিত্বে বিশ্বাসের প্রমাণ রয়েছে। গ্রিসবাসী মনে করতেন, দেবতারা প্রায়শই মানুষের শারীরিক চেহারায় আবির্ভূত হয়ে প্রত্যক্ষভাবে মানুষের কাজকর্মে হস্তক্ষেপ করেন। এইভাবে প্রাচীন গ্ৰিসে বহুত্ববাদ ছড়িয়ে পড়ে।

(৪) রোমে বহুত্ববাদ

পরে যখন রোমানরা গ্রিস দখল করে নেয় তারপরও দেখা যায় যে, রোমানরা গ্রিসের বহুত্ববাদী ধর্ম-ভাবনা গ্রহণ করে নিয়েছে। পরবর্তীকালে রোমানরা যখন আরও বহু দেশ ও ভূখণ্ড দখল করে তাদের সাম্রাজ্য-এর প্রসার ঘটায় তখন দেখা যায় যে, অন্যান্য পরাজিত মানবজাতির উপাস্য দেবতারাও রোমান উপাসনা, র্ম ও সংস্কৃতিতে প্রবেশ করেছে। এভাবে রোমান ধর্মে দেবতার সংখ্যা ক্রমে বাড়তে থাকে। ফলে প্রাচীন রোমে বহত্ববাদ বিস্তার লাভ করে।

উপসংহার :- প্রাচীন মিশর, গ্রিস ও রোমের ধর্মীয় সংস্কৃতি থেকে বহুত্ববাদের আদর্শ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল।

(FAQ) বহুত্ববাদ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. বহুত্ববাদ কথার অর্থ কি?

 বহু দেবতার উপাসনা।

২. টোটেম কি?

কোনো জাতি গোষ্ঠীর ধর্মীয় ক্ষেত্রে ব্যবহৃত প্রাণী বা উদ্ভিদের প্রতীককে টোটেম বলা হয়।

৩. গ্রিস দখল করে কারা?

রোমানরা।

৪. বহুত্ববাদ কথাটি ইংরেজি কোন শব্দ থেকে এসেছে?

‘Polytheism’

Leave a Comment