রাজপুত জাতির উৎপত্তি প্রসঙ্গে অগ্নিকুল তত্ত্ব, অগ্নিকুল তত্ত্বের সমালোচনা, গৌরিশঙ্কর ওঝার অভিমত, ওঝার মতের সমালোচনা, হূণ ও শক উৎপত্তি ও ক্রুকের অভিমত সম্পর্কে জানবো।
রাজপুত জাতির উৎপত্তি
ঐতিহাসিক ঘটনা | রাজপুত জাতির উৎপত্তি |
তত্ত্ব | অগ্নিকুল তত্ত্ব |
খাঁটি আর্য জাতি | গৌরিশঙ্কর ওঝা |
পৃথ্বিরাজ রসো | চাঁদ বরদাই |
শক, হূণ উৎপত্তি | কর্ণেল টড |
ভূমিকা :- হর্ষবর্ধন -এর মৃত্যুর পর থেকে মুসলিম বিজয় পর্যন্ত উত্তর ভারত -এর রাজনৈতিক ইতিহাসকে “রাজপুত যুগ” বলে অভিহিত করা হয়। এই সময় উত্তর ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে রাজপুত জাতির বিভিন্ন শাখা শাসন করত।
রাজপুত যুগ নাম অর্থহীন
নেপাল, কাশ্মীর, কামরূপ রাজ্য -এ রাজপুত শাসন ছিল না। সেই অর্থে রাজপুত যুগ নামকরণ অর্থহীন। তবে বেশীর ভাগ রাজ্যগুলিই রাজপুতদের অধিকারে ছিল।
রাজপুত জাতির উৎপত্তি সম্পর্কে অগ্নিকুল তত্ত্ব
- (১) রাজপুত জাতির উৎপত্তি নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে। রাজপুত, কিংবদন্তি অনুসারে সূর্য বা চন্দ্র বংশ বা বৈদিক সভ্যতা থেকে প্রচলিত বংশ মর্যাদা দাবী করা হয়। প্রচলিত অর্থে ‘রাজপুত্র’ শব্দটির অপভ্রংশ হিসেবে রাজপুত শব্দটি এসেছে।
- (২) বাণভট্টের মতে, উচ্চবংশজাত ক্ষত্রিয়কে ‘রাজপুত’ বলা হত। সুতরাং বাণভট্টের সময় অর্থাৎ সপ্তম খ্রিস্টাব্দে রাজপুতদের উচ্চ সামাজিক মর্যাদা ছিল বলে জানা যায়।
- (৩) কবি চাঁদ বরদাই তার পৃথ্বীরাজ রসো কাব্যে বলেছেন যে, পারমার, চৌহান, প্রতিহার প্রভৃতি রাজপুতরা আবু পাহাড়ে বশিষ্ঠের যজ্ঞকুণ্ড থেকে জন্মলাভ করেছিল। এই তত্ত্বকে বলা হয় অগ্নিকুল তত্ত্ব।
অগ্নিকূল তত্ত্বের সমালোচনা
অগ্নিকুল তত্ত্বের সমালোচনা করে আধুনিক পণ্ডিতেরা বলেন যে,
- (১) অগ্নিকুল তত্ত্বই প্রমাণ করছে যে, রাজপুতরা বৈদেশিক বংশজাত। তাদের যজ্ঞ দ্বারা শুদ্ধ করা হয়, একথাই প্রমাণ করে তারা স্বাভাবিকভাবে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের জাতিগোষ্ঠীর লোক ছিলেন না। ম্লেচ্ছ বা বৈদেশিক চরিত্র দূর করার জন্যই তাঁদের যজ্ঞের দ্বারা শুদ্ধিকরণ করতে হয়।
- (২) পৃথ্বীরাজ রসো কাব্যে বহু ঐতিহাসিক তথ্যের বিকৃতি ঘটেছে। ব্ৰাহ্মণ কবি চাঁদ বরদাই তার পৃষ্ঠপোষক রাজবংশগুলির গুণগান করার জন্য উচ্চবংশ ও বশিষ্ঠের যজ্ঞকুণ্ডের কথা বলেছেন। এর ঐতিহাসিক সত্যতা নেই।
- (৩) রাজপুতানায় পাণ্ড্য লিপি প্রভৃতি অগ্নিকুল তত্ত্বকে সমর্থন করে না। গুহিলোৎ লিপি থেকে জানা যায় যে, এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন এক ব্রাহ্মণ। সুতরাং অগ্নিকুল তত্ত্বকে অধিকাংশ ঐতিহাসিক স্বীকার করেন না।
রাজপুত জাতির উৎপত্তি সম্পর্কে গৌরীশঙ্কর ওঝার অভিমত
ডঃ গৌরীশঙ্কর ওঝা তাঁর হিস্ট্রী অফ রাজপুতানা গ্রন্থে বলেছেন যে, কিংবদন্তী ও নৃতাত্ত্বিক প্রমাণ অনুসারে রাজপুতরা ছিল খাঁটি আর্য জাতির লোক। তাঁর এই মতের সমর্থনে যুক্তি দেখান। যে,
- (১) রাজপুতদের সূর্য পুজো, সতীদাহ প্রথা, জহর ব্রত প্রভৃতি প্রমাণ করে যে, রাজপুত জাতি আর্য আচার দৃঢ়ভাবে পালন করে।
- (২) রাজপুত রাজারা অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করতেন।
- (৩) তাঁরা হিন্দুধর্ম ও সভ্যতা রক্ষার জন্য মুসলিম আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন।
- (৪) নৃতাত্ত্বিক পরীক্ষায় রাজপুতদের শারীরিক গঠন আর্য জাতির মতই বলে জানা যায়।
গৌরীশঙ্কর ওঝার মতের সমালোচনা
ডঃ গৌরীশঙ্কর ওঝার অভিমতের সমালোচনা করে বলা হয় যে,
- (১) অশ্বমেধ যজ্ঞ বা সতীদাহ প্রথা প্রভৃতি আচার কোনো নির্ভরযোগ্য প্রমাণ নয়। ভারতে দীর্ঘকাল এই সকল প্রথা ছিল। নবাগত জাতিগুলি এই প্রথা গ্রহণ করে।
- (২) হিন্দু সভ্যতা ও ধর্মরক্ষার জন্য রাজপুত জাতির উগ্র প্রচেষ্টা অনেকটা তাদের নতুন ধর্মমতকে রক্ষার নবীন উদ্যম বলা চলে। কারণ যারা নতুন ধর্মমত গ্রহণ করে তারা সেই ধর্মমতের প্রতি উগ্র ও অন্ধ অনুরাগ দেখায়।
- (৩) নৃতত্ত্বমূলক পরীক্ষা খুব নির্ভরযোগ্য নয়।
- (৪) অগ্নিকুল তত্ত্ব প্রমাণ করে যে, রাজপুত জাতি বৈদেশিক জাতির বংশধর।
হূণ ও শক উৎপত্তি
কর্ণেল টড, উইলিয়াম ক্রুক প্রমুখ বলেন যে, রাজপুতরা ছিল শক, হূণ ও গুর্জরদের বংশধর। এদের মধ্যে যারা উঁচুশ্রেণীর ছিল তারাই রাজপুত নামে পরিচিত হয়।
রাজপুত জাতির উৎপত্তি সম্পর্কে ক্রুকের অভিমত
উইলিয়াম ক্রুকের মতে, বৈদিক ক্ষত্রিয় ও রাজপুতদের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য দেখা যায়। পঞ্চম ও ষষ্ঠ খ্রিস্টাব্দে ভারতে হূণ আক্রমণ -এর ফলে জাতীয় সমাজে বহু ওলোট-পালট হয়। এর ফলে নতুন সমাজ ও জাতি গঠন হয়। এরই ফলে রাজপুত জাতির উদ্ভব হয়।
উপসংহার :- হূণ, গুর্জর প্রভৃতি জাতি ভারতীয় ভাষা, ধর্ম ও সভ্যতার প্রচারে সম্পূর্ণ ভারতীয় হয়ে যায়। এদের মধ্যে যারা শাসক জাতিতে পরিণত হয় তাদের নাম হয় রাজপুত। শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, রাজপুত জাতি বহিরাগত। এই মতই অধিকাংশ পণ্ডিত মেনে নিয়েছেন।
(FAQ) রাজপুত জাতির উৎপত্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
কবি চাঁদ বরদাই রচিত পৃথ্বীরাজ রাসো কাব্য অনুসারে রাজপুতরা আবু পাহাড়ে বশিষ্ঠের যজ্ঞকুন্ড থেকে জন্ম লাভ করেছিল। এই তত্ত্বকে বলা হয় অগ্নিকুল তত্ত্ব।
ডঃ গৌরিশঙ্কর ওঝা।
কর্ণেল টড।
রাজপুত জাতি বহিরাগত।