মার্কেনটাইলবাদ

মার্কেনটাইলবাদ প্রসঙ্গে মার্কেন্টাইলবাদের জনপ্রিয়তা, মার্কেন্টাইলবাদের প্রয়োগ, মার্কেন্টাইলবাদ কথাটির প্রথম ব্যবহার, মার্কেন্টাইলবাদের জনপ্রিয়তার সময়কাল, মার্কেন্টাইলবাদের একনিষ্ঠ সমর্থক, মার্কেন্টাইলবাদের প্রভাব, বিশ্লেষণ ও গুরুত্ব সম্পর্কে জানবো।

অর্থনৈতিক মতবাদ মার্কেনটাইলবাদ প্রসঙ্গে মার্কেনটাইল অর্থনীতি, মার্কেনটাইলবাদের আর্বিভাব বা উদ্ভব, শিল্পবিপ্লবের পূর্বেকার এক অর্থনৈতিক ধারণা মার্কেনটাইলবাদ, মার্কেন্টাইলবাদ মূল বক্তব্যসমূহ বা বৈশিষ্ট্যসমূহ, রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত বা সুরক্ষিত অর্থনৈতিক নীতি মার্কেনটাইলবাদ, মার্কেন্টাইলবাদের প্রয়োগ ও মার্কেন্টাইলবাদের সমালোচনা সম্পর্কে জানব।

মার্কেনটাইলবাদ

ঐতিহাসিক ঘটনামার্কেন্টাইলবাদ
সময়কালষোড়শ-অষ্টাদশ শতক
কথাটির ব্যবহারঅ্যাডাম স্মিথ
বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা“War for trade”
সমালোচনাডেভিড হিউম
মার্কেনটাইলবাদ

ভূমিকা :- ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদের সূচনাকালে মার্কেন্টাইলবাদ নামে একটি অর্থনৈতিক মতবাদ ইউরোপ-এর সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলিকে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের প্রসারে প্রেরণা জোগায়। মার্কেন্টাইলবাদের গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস পাওয়ার পরবর্তীকালে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক মতবাদও ইউরোপের দেশগুলিকে উপনিবেশ স্থাপনে উৎসাহিত করে।

ইউরোপীয় দেশগুলির উপনিবেশ স্থাপন

পঞ্চদশ শতকের শেষদিকে স্পেন ও পোর্তুগাল বিভিন্ন সফল ভৌগোলিক অভিযানের মাধ্যমে এশিয়া, আফ্রিকা ও আমেরিকার বিভিন্ন অংশে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। ক্রমে এসব স্থানে শুরু হয় উপনিবেশ স্থাপনের প্রক্রিয়া। উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতায় স্পেন ও পোর্তুগালের সঙ্গে পরবর্তীকালে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, হল্যান্ড বা নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক প্রভৃতি দেশগুলিও যুক্ত হয়।

মার্কেন্টাইলবাদের জনপ্রিয়তা

ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ভৌগোলিক অভিযানে অংশ নিয়ে বিভিন্ন নতুন ভূখণ্ড আবিষ্কার করে এবং সেইসব অঞ্চলে নিজেদের উপনিবেশ গড়ে তোলে। এই পরিস্থিতিতে ইউরোপে মার্কেন্টাইলবাদ নামে এক ‘সংরক্ষণবাদী’ অর্থনৈতিক মতবাদ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

মার্কেন্টাইলবাদের প্রয়োগ

তবে এই অর্থনৈতিক মতবাদ কোনো সুসংবদ্ধ তত্ত্ব হিসেবে গড়ে ওঠে নি, কোনো বিশেষ অর্থনীতিবিদও এই মতবাদের প্রতিষ্ঠা করেন নি বা কোনো দেশের সরকারও নিরবচ্ছিন্নভাবে এই অর্থনৈতিক মতবাদ প্রয়োগ করেননি।

মার্কেন্টাইলবাদ কথাটির প্রথম ব্যবহার

প্রখ্যাত ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত তাঁর ‘ওয়েলথ অব নেশন্‌স’ নামক গ্রন্থে অবজ্ঞাভরে সর্বপ্রথম ‘Mercantilism’ বা ‘মার্কেন্টাইলবাদ’ কথাটি ব্যবহার করেন।

মার্কেন্টাইলবাদের জনপ্রিয়তার সময়কাল

মার্কেন্টাইলবাদ ষোড়শ থেকে অষ্টাদশ শতকের মধ্যে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এই মতবাদ বিভিন্ন দেশের সরকার ও জনগণের সমর্থন লাভ করে।

মার্কেন্টাইলবাদের একনিষ্ঠ সমর্থক

ইউরোপের জ্ঞানদীপ্তির যুগের রাজারা মার্কেন্টাইলবাদের একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন লর্ড অ্যাক্টনের মতে, মার্কেন্টাইলবাদ ছিল জ্ঞানদীপ্তির যুগের স্বৈরতন্ত্রের পরিপূরক অর্থনৈতিক মতবাদ।

মার্কেন্টাইলবাদের প্রভাব

মার্কেন্টাইল মতবাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ইউরোপের রাষ্ট্রগুলি ষোড়শ থেকে অষ্টাদশ শতকের মধ্যে তাদের ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের প্রসার ঘটায়। এই পর্যায়ের উপনিবেশগুলি ইউরোপের ঔপনিবেশিক দেশগুলির বাসিন্দাদের বসবাসস্থল হয়ে উঠেছিল।

মার্কেন্টাইলবাদের বিশ্লেষণ

মোটামুটিভাবে মার্কেন্টাইলবাদ বিশ্লেষণ করে যা বলা যায় তা হল –

(ক) অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ

এই প্রথম রাষ্ট্রের অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রের অধীন হয়ে পড়ে। রাষ্ট্রের স্বার্থ এবং বণিক ও উৎপাদকদের স্বার্থ অভিন্ন বলে বিবেচিত হতে শুরু করে। দেশের অর্থনৈতিক কার্যকলাপ গিল্ডের স্থানে জাতীয় সরকারের হাতে চলে যায়। এইভাবে মার্কেন্টাইলবাদ অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের রূপ নেয়।

(খ) কৃষিনীতি

  • (১) মার্কেন্টাইল মতবাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সরকার এবং সাধারণ মানুষ মনে করতে থাকে যে, দেশের বাইরে খাদ্যশস্য রপ্তানি করলে দেশে খাদ্যসংকট দেখা দেবে। এজন্য সরকার দেশের খাদ্যশস্য দেশের বাইরে রপ্তানি নিষিদ্ধ করে।
  • (২) খাদ্যশস্যের অবাধ বিক্রয় এবং বাইরে রপ্তানি নিষিদ্ধ হওয়ায় কৃষকরা তাদের উৎপাদিত খাদ্যশস্যের ন্যায্য দাম পেত না। এজন্য সে যুগে ইউরোপের কৃষকরা মূলত নিজ পরিবারের প্রয়োজন মেটানো এবং সরকারি খাজনা পরিশোধ করার উদ্দেশ্যে খাদ্যশস্য উৎপাদন করত। কৃষির উন্নতি ঘটিয়ে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির কোনো উদ্যোগ দেখা যেত না।

(গ) আমদানি হ্রাস ও রপ্তানি বৃদ্ধি

মার্কেন্টাইল মতবাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল সম্পদের সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার এবং সেই উদ্দেশ্যে আমদানি কমিয়ে রপ্তানি বাড়ানোর কথা বলা হয়।

(ঘ) সোনা ও রূপার গুরুত্ব

মার্কেন্টাইল নীতি অনুসারে, সোনা ও রুপার ভাণ্ডার স্ফীততর করার ওপর জাতীয় সম্পদ বৃদ্ধি নির্ভরশীল। যে সকল দেশের এই ভাণ্ডার কম তাদের রপ্তানি বৃদ্ধি করতে হবে।

(ঙ) সামুদ্রিক বাণিজ্যের প্রসার

মার্কেন্টাইল মতবাদ অনুসারে, মুদ্রা তৈরি, সেনা ও নৌবাহিনীর শক্তিবৃদ্ধির জন্য এবং জাতীয় মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য বুলিয়ন অর্থাৎ সোনা ও রুপার সময় বাড়ানো অত্যাবশ্যক। এই উদ্দেশ্যে ষোড়শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই বহু ইউরোপীয় রাষ্ট্র সামুদ্রিক বাণিজ্যের প্রসার এবং উপনিবেশ স্থাপনে উদ্যোগী হয়।

(চ) অবাধ বাণিজ্যের বিরোধিতা

  • (১) মার্কেন্টাইলবাদীরা অবাধ বাণিজ্যের বিরোধী ছিলেন। তারা মনে করতেন অন্য দেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করেই স্বদেশের সমৃদ্ধি সাধন সম্ভব। জাতীয় অর্থনীতির অবনমন রোধে সরকারি হস্তক্ষেপ অত্যাবশ্যক বলে বিবেচিত হয়।
  • (২) এই উদ্দেশ্যে বহু নিষেধাজ্ঞা জারি, আমদানি শুল্ক চাপানো, বিভিন্ন শিল্পোদ্যোগকে ভর্তুকি ও প্রিভিলেজ দান, একচেটিয়া বাণিজ্য ইত্যাদি ব্যাপক হয়ে ওঠে। এরফলে বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে শুরু হয় “War for trade”।

(ছ) মার্কেন্টাইলবাদের প্রয়োগ

  • (১) মার্কেন্টাইলবাদের সংরক্ষণ নীতির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ইউরোপের শিল্পোন্নত দেশগুলি বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে থাকে। মার্কেন্টাইলবাদের উল্লেখযোগ্য প্রয়োগ দেখা যায় ইংল্যান্ডের নেভিগেশন আইন এবং ফরাসি মন্ত্রী কোলবার্টের সরকারি অর্থ নিয়ন্ত্রণের ঘোষণায়।
  • (২) কোলবার্ট মনে করতেন যে, সার্বভৌম রাষ্ট্রের সম্পদ ও ক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রকে মার্কেন্টাইল মতবাদ মেনে চলা উচিত। ফ্রান্স মার্কেন্টাইল নীতি কার্যকর করতে গিয়ে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বিভিন্ন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে যা তাদের ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের যথেষ্ট ক্ষতি করে।

(জ) উপনিবেশ স্থাপন

মার্কেন্টাইল নীতি অনুসারে, ইউরোপীয় দেশগুলি কাঁচামাল সংগ্রহ ও শিল্পজাত পণ্য বিক্রির বাজার দখলের উদ্দেশ্যে এশিয়া, আফ্রিকা ও আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে উপনিবেশ স্থাপন করে, উপনিবেশগুলিতে একাধিপত্য বজায় রাখতে নৌসেনা, শক্তিশালী নৌবহর গঠন, অস্ত্র উৎপাদন বৃদ্ধি ইউরোপীয় দেশগুলির মধ্যে সংঘাত তীব্র করে।

মার্কেন্টাইলবাদের সমালোচনা

ষোড়শ, সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে ইউরোপে মার্কেন্টাইলবাদ যথেষ্ট গুরুত্ব লাভ করেছিল। তথাপি এই অর্থনৈতিক মতবাদের বিভিন্ন ভুলত্রুটি ছিল। অ্যাডাম স্মিথ, মার্ক ব্লখ, টি. এইচ. মার্শাল, হিল্টন, মরিস ডব প্রমুখ ঐতিহাসিক ও অর্থনীতিবিদ মার্কেন্টাইলবাদের সমালোচনা করেছেন। যেমন –

(ক) সম্পদের পুনর্বিনিয়োগ

অ্যাডাম স্মিথের বন্ধু ডেভিড হিউম মার্কেন্টাইলবাদের সমালোচনা করে বলেন যে, সঞ্চিত অর্থ ও সম্পদের ভাণ্ডার বৃদ্ধি করে নয়, তা পুনরায় বিনিয়োগের মাধ্যমেই দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী হতে পারে।

(খ) সরকারি হস্তক্ষেপের বিরোধিতা

ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ প্রমুখ বলেন যে, বাণিজ্যে সংরক্ষণ নীতি বা অযথা সরকারি হস্তক্ষেপের দ্বারা নয়, অবাধ বাণিজ্যের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি মজবুত হতে পারে।

(গ) বৈদেশিক বাণিজ্যে ক্ষতি

মার্কেন্টাইলবাদের ফলে দেশীয় শিল্প বৈদেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার হাত থেকে রক্ষা পায় ঠিকই, তবে শিল্প সংরক্ষণ নীতির ফলে বৈদেশিক বাণিজ্য বাধাপ্রাপ্ত হয়। কারণ প্রতিটি দেশই নিজের দেশের পণ্যের রপ্তানি বাড়িয়ে আমদানি কমানোর চেষ্টা চালায়।

(ঘ) সুস্পষ্ট ধারণার অভাব

মার্কেন্টাইলবাদে অর্থনীতির বিভিন্ন দিক সম্পর্কে সচেতনতা, বাস্তবতাবোধ, উৎপাদন, বাণিজ্যিক লাভ লোকসান প্রভৃতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণার অভাব ছিল।

উপসংহার :- তিন শতক ধরে গুরুত্ব লাভ করলেও বেশ কিছু ত্রুটিবিচ্যুতির ফলে মার্কেন্টাইলবাদ বিশ্ব অর্থনীতিতে কিছুকালের মধ্যেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে।

(FAQ) মার্কেনটাইলবাদ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. মার্কেন্টাইলবাদ কথাটি প্রথম ব্যবহার করেন কে?

অ্যাডাম স্মিথ।

২. ‘ওয়েলথ অব নেশন্‌স’ গ্ৰন্থের রচয়িতা কে?

অ্যাডাম স্মিথ।

৩. মার্কেন্টাইলবাদ কোন সময়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে?

ষোড়শ থেকে অষ্টাদশ শতকের মধ্যে।

৪. মার্কেন্টাইলবাদের সমালোচনা করেন কে?

ডেভিড হিউম।

Leave a Comment