সুলতানি যুগে ইক্তা প্রথা প্রসঙ্গে ইক্তা প্রথার বৈশিষ্ট্য, ইক্তাদার, ইক্তাদারের দায়িত্ব, সুলতানী আধিপত্য বিস্তার, কর্তব্য, বলবনের আমলে ইক্তা প্রথা, আলাউদ্দিনের দ্বারা ইক্তা প্রথার সংস্কার, গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের আমলে ইক্তা প্রথা, মহম্মদ বিন তুঘলকের আমলে ইক্তা প্রথা ও ফিরোজ শাহ তুঘলকের আমলে ইক্তা প্রথা সম্পর্কে জানবো।
সুলতানি যুগে ইক্তা প্রথা
ঐতিহাসিক ঘটনা | ইক্তা প্রথা |
প্রবর্তক | ইলতুৎমিস |
অর্থ | অংশ বা এলাকা |
প্রাপক | মাকতি বা ইক্তাদার |
ভূমিকা :- ইক্তা প্রথা ভারত-এ আসার আগে তুর্কি জাতির মধ্যে প্রচলিত ছিল। মধ্য ও পশ্চিম এশিয়ার প্রশাসনিক অঙ্গের অনুকরণে ভারতেও ইক্তা প্রথা প্রবর্তিত হয়। প্রকৃতপক্ষে ইলতুতমিসই প্রথম ইক্তা ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন।
ইক্তা প্রথার বৈশিষ্ট্য
একাদশ শতকে তুসী নামে এক তুর্কী লেখকের মতে, ভারতে আসার আগে ইক্তাদারী প্রথার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি ছিল –
- (১) ইক্তা গ্রহীতার খেতাব ছিল “মাকতি”।
- (২) প্রজাদের কাছ থেকে নিয়মিত হারে রাজস্ব আদায় ছাড়া মাকতি প্রজাদের ওপর অন্য কোনো অধিকার পেত না।
- (৩) প্রজারা প্রদেয় রাজস্ব পরিশোধ করার পর তাদের জীবন, সম্পত্তি, পরিবার পরিজনের ওপর মাকতির কোনো এক্তিয়ার ছিল না।
- (৪) মাকতিকে একথা মানতে হত যে, ভূমি ও কৃষক সমাজ ছিল সুলতানের সম্পত্তি। মাকতির তাতে কোনো অধিকার ছিল না।
- (৫) নিজাম-উল-মুলকের মতে, ইক্তাদার বা মাকতি সুলতানের ইচ্ছাক্রমে পদে থাকত। সুলতান না চাইলে পদ ছাড়তে হত।
- (৬) ইক্তা জমির রাজস্বের আয়ে মাকতিকে একটি সেনাদল রাখতে হত। সুলতান চাইলে তাকে সেই সেনাদলের সাহায্য দিতে মাকতি বাধ্য ছিল।
দিল্লির সুলতানি যুগে ইক্তাদার
সুতরাং তুর্কী লেখকদের মতে ইক্তাদার ছিল একাধারে “রাজস্ব সংগ্রহকারী, সেনাদলের বেতন প্রদানকারী, সেনাধ্যক্ষ”।
সুলতানি যুগে ইক্তা প্রথা সম্পর্কে হাবিবের অভিমত
ডঃ ইরফান হাবিবের মতে, ইসলামীয় জগতে কৃষকের উৎপন্ন ফসলের উদ্বৃত্ত কর হিসেবে গণ্য হত। কৃষির এই উদ্বৃত্ত কৃষকের কাছ হতে সংগ্রহ এবং মুসলিম শাসক শ্রেণীর মধ্যে তা বণ্টনের জন্য একটি প্রথার উদ্ভাবন করা হয়। এই প্রথা ছিল ইক্তা প্রথা। ইক্তা মাধ্যমে একাধারে কর সংগ্রহ ও তা বন্টন করা সম্ভব হত।
সুলতানি যুগে ইক্তাদারদের দায়িত্ব
- (১) ভারতে ঘুরী বিজয় সম্পন্ন হলে, বিজিত অঞ্চল বিজয়ী সেনাপতিদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়। এই সেনাপতিরা তাদের অধীনস্থ সেনাদলের ভরণপোষণের জন্য অধীনস্থ অঞ্চল থেকে কর আদায় এবং প্রতিদ্বন্দ্বী হিন্দু রাজাদের পরাজিত করে ‘খামস’ আদায় করতেন।
- (২) এই সকল আঞ্চলিক সেনাপতিরা মাকতি ও তাদের অধীনস্থ অঞ্চল ইক্তা নামে পরিচিত হয়। এই সকল ইক্তাদার বা সামরিক শাসকরা ছিলেন কার্যত স্বায়ত্ব শাসনভোগী, অর্ধ স্বাধীন সেনাপতি। এই ইক্তাগুলি ছিল নামে মাত্র বিজিত।
- (৩) এগুলিতে সুলতানি শাসন তেমন কিছু ছিল না। কাজেই এই সকল অঞ্চলে সুলতানি আধিপত্য বিস্তার, আইন-শৃঙ্খলা স্থাপনের দায়িত্ব এই সকল সামরিক প্রশাসক বা ইক্তাদারদের ওপর বর্তায়।
ইক্তাদারী প্রথার মাধ্যমে সুলতানী আধিপত্য বিস্তার
কুতুবউদ্দিন আইবক এবং ইলতুৎমিস ইক্তাদারী প্রথার মাধ্যমেই তুর্কী আধিপত্য উত্তর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বিস্তার করেন। ইলতুৎমিস দিল্লী ও তৎসংলগ্ন অঞ্চল এবং দোয়াব নিজ খালিসা জমি হিসেবে রাখেন। বাকি অঞ্চলে তিনি ইক্তাদারদের মাধ্যমে তুর্কী আধিপত্য বিস্তার ও দৃঢ় করেন। তিনি ইক্তাদারী প্রথাকে প্রাদেশিক শাসনের ভিত্তি হিসেবে নেন।
সুলতানি যুগে ইক্তা প্রাপকের কর্তব্য
ইক্তাদারের প্রধান কর্তব্য ছিল ইক্তার শাসনের জন্য খরচপত্র মিটিয়ে বাকি উদ্বৃত্ত অর্থ রাজকোষে জমা দেওয়া। সাধারণত মাকতি এমনভাবে হিসেব দেখাত যে, কোনো উদ্বৃত্ত থাকত না। যেহেতু মাকতি ছিল একাধারে রাজস্ব সংগ্রাহক ও সেনাদলের ভরণ-পোষণকারী সেহেতু মাকতি একাধারে আর্থিক ও সামরিক ক্ষমতার অধিকারী ছিল।
বলবনের আমলে ইক্তা প্রথা
- (১) বলবন-এর আমলে ইক্তাদারী প্রথায় বেশ কিছু সংস্কার করা হয়। তিনি জানতেন যে ইক্তাদাররা সুলতানের প্রাপ্য রাজস্ব ফাঁকি দেয়। জিয়াউদ্দিন বরণীর মতে, এজন্য বলবন কঠোর নির্দেশ দেন যে মাকতি বা ইক্তাদাররা তাদের সংগৃহীত উদ্বৃত্ত রাজস্ব সরকারে জমা দিতে বাধ্য থাকবে।
- (২) এই উদ্বৃত্ত বলতে ইক্তাদারের অধীনস্থ সেনার ব্যয় নির্বাহের পর উদ্বৃত্ত অর্থ বুঝায়। যাতে ইক্তাদাররা সরকারের প্রাপ্য অর্থ ফাঁকি না দিতে পারে এজন্য খোয়াজা নামে একশ্রেণীর হিসেব পরীক্ষক নিয়োগ করা হয়। তাছাড়া ইক্তাদারকে নিদ্দিষ্ট সংখ্যক সেনা ইক্তার আয় থেকে রাখতে বাধ্য করা হয়।
- (৩) বলবন এই কড়াকড়ি দ্বারা ইলতুৎমিসের আমলের ঢিলেঢালা প্রথাকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করেন। তিনি ইক্তাদারদের সমঝে দেন যে, এই পদটি বংশানুক্রমিক নয়। ইলতুৎমিসের আমলের যে সকল সামসী অভিজাত ইক্তাগুলি বেআইনী দখলে রাখেন তাদের তিনি উচ্ছেদ করেন। সুলতান মাকতির ক্ষমতা কমাবার জন্য এক ইক্তা থেকে অন্য ইক্তায় বদলির নিয়ম চালু করেন।
আলাউদ্দিনের দ্বারা ইক্তা প্রথার সংস্কার
আলাউদ্দিন খলজির শাসনকালে ইক্তা প্রথায় বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটান হয়। যেমন –
- (১) যেহেতু আলাউদ্দিনের আমলে সাম্রাজ্য-এর বিশেষ বিস্তার ঘটে, সেহেতু দিল্লীর নিকটস্থ স্থানগুলিকে খালিসা জমিতে পরিণত করে দূরবর্তী অঞ্চলগুলিকে ইক্তায় পরিণত করা হয়।
- (২) আলাউদ্দিন তাঁর সেনাদলকে ইক্তার পরিবর্তে নগদ বেতন দেওয়ার প্রথা চালু করলে বহু ইক্তা জমি খালিসা জমিতে পরিণত হয়।
- (৩) খালিসা জমির পুরো আয় এখন রাজকোষে জমা হয়।
- (৪) আলাউদ্দিন তাঁর সেনাপতিদের জন্য ইক্তা বরাদ্দ করেন।
- (৫) কিন্তু ইজার রাজস্বের হার তিনি বেঁধে দেন এবং তাঁর আদেশ মত ইক্তার রাজস্ব আদায় করতে হয়।
- (৬) দেওয়ান-ই-উজীরত থেকে প্রতি ইক্তার রাজস্বের পরিমাণ স্থির করে দেওয়া হয়। ইক্তার রাজস্ব থেকে “মোওয়াজিব ও দাসান” অর্থাৎ ইক্তাদারের বেতন ও সেনাদলের বেতনের জন্য ইক্তার একটি অংশ আলাদা করে ফেলা হয়। বাকি অংশের রাজস্ব পুরো সুলতানি সরকারে জমা দিতে আদেশ দেওয়া হয়।
- (৭) আলাউদ্দিনের উজির শরফ কাই ইক্তার আয়-ব্যয় পরীক্ষার জন্য গ্রাম স্তরে পাটোয়ারীর কাগজপত্র পরীক্ষা করতেন।
- (৮) ইক্তাদাররা রাজস্বের পরিমাণ গোপন করলে দোষী রাজস্ব কর্মচারীদের দৈহিক শাস্তি দেওয়া হত।
গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের আমলে ইক্তা প্রথা
গিয়াসুদ্দিন তুঘলক ক্ষমতায় এলে কিছুটা নমনীয় নীতি নেন। তিনি রাজস্ব দপ্তরকে মাকতিদের প্রদেয় রাজস্বের পরিমাণ বছরে ১/১০ বা ১/১১ বেশী বৃদ্ধি করতে দেন নি। তিনি আশঙ্কা করেন যে মাকতিদের ওপর চাপ দিলে শেষ পর্যন্ত কৃষকদের ওপর চাপ বাড়বে। যদি কোনো মাকতি তার প্রাপ্য অপেক্ষা ১/১০ বা ১/২০ ভাগ বেশী অর্থ আত্মসাৎ করত, তিনি তাদের ক্ষমার চোখে দেখেন।
মহম্মদ বিন তুঘলকের আমলে ইক্তা প্রথা
- (১) সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলক-এর আমলে ইক্তাদারী প্রথায় আরও পরিবর্তন ঘটে। তিনি বিচার করেন যে, যেহেতু সেনাদের তিনি নগদ বেতন দেন, সেহেতু সেনাদলের খরচার জন্য ইক্তাদারের হাতে কোনো ইক্তা রাখার দরকার নেই।
- (২) ইক্তাদারদের হাতে এই বাবদে যে সকল ইক্তা ছিল তা খালিসা জমিতে পরিণত করা হয়। একমাত্র সেনাপতি অথবা ইক্তাদারের নিজ বেতন বাবদ কিছু ইক্তা তাকে দেওয়া হয়। সেনাপতিদের বেতন নগদে দেওয়া হত না।
- (৩) তবে সেনাপতির প্রকৃত বেতন যা ছিল সেই বেতন বাবদ প্রদত্ত ইক্তার আয় সর্বদাই তা থেকে কম থাকত। অর্থাৎ বেতন অপেক্ষা কম আয়ের ইক্তা সেনাপতিকে দেওয়া হত। মহম্মদের ধারণা ছিল যে, প্রজাদের কাছ থেকে অন্যায়ভাবে বেশী টাকা আদায় করে তারা এই ঘাটতি পুষিয়ে নেবে।
- (৪) বাকি ইক্তা থেকে সুলতান পুরো রাজস্ব আদায় করতেন। এজন্য মহম্মদের বিরুদ্ধে তাঁর অভিজাত সেনাপতিরা বিশেষ অসন্তুষ্ট ছিল। দক্ষিণ ভারতে আমিরণ-ই-সাধাইদের বিদ্রোহ এই কারণে ঘটে।
ফিরোজ শাহ তুঘলকের আমলে ইক্তা প্রথা
- (১) ফিরোজ শাহ তুঘলক মাকতির প্রদেয় জমা নির্দিষ্ট করে দেন। অর্থাৎ সরকারের সর্ব মোট প্রাপ্য রাজস্ব ৬ কোটি ৭৫ লক্ষ টাকা ধার্য করা হয়। এই টাকা পেলে ইক্তাদাররা এই টাকার অতিরিক্ত আদায় করে আত্মসাৎ করলেও, সুলতান তা নিয়ে মাথা ঘামাতেন না।
- (২) সরকার ইক্তাদারের কাছে উপরোক্ত পরিমাণ রাজস্বের বেশী কখনও দাবী করেন নি। তিনি সেনাপতি ও আমীরদের বেতন প্রচুর বাড়ান। যেক্ষেত্রে মহম্মদ তুঘলক তাঁর আমীরদের সর্বোচ্চ বেতন দিতেন ২ লক্ষ টঙ্কা, সেক্ষেত্রে ফিরোজ তাঁর খান ও আমীরদের বেতন ৪-৮ লক্ষ টঙ্কা ধার্য করেন।
- (৩) এই বাড়তি বেতনের জন্য খালিসা জমি থেকে কেটে আলাদা ইক্তা দেওয়া হয়। তিনি সেনাদলকেও নগদ বেতনের বদলে ইক্তা দেন। এর ফলে খালিসা জমির পরিমাণ খুবই কমে যায়।
- (৪) সেনাদল অনেক সময় ইক্তার রাজস্ব নিজেরা আদায় না করে মোট রাজস্বের ১/২ বা ১/৩ পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে ইক্তাগুলি ইজারা দিয়ে দিত। ফিরোজ তুঘলকের আমলে অধিকাংশ ইক্তা বংশানুক্রমিকভাবে ইক্তাদারের দখলে চলে যায়।
উপসংহার :- ইক্তাপ্রথা বংশানুক্রমিক না হলেও পরবর্তীকালে সুলতান ফিরােজশাহ তুঘলকের শাসনকালে তা বংশানুক্রমিক হয়ে পড়ে। ফলে ইক্তা প্রথার মাধ্যমে ভারতে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা দূরীকরণের যে প্রয়াস প্রথম দিকে সুলতানগণ গ্রহণ করেছিলেন, তা ব্যর্থ হয়ে যায়।