বাঙালি জাতির পরিচয়

বাঙালি জাতির পরিচয় প্রসঙ্গে পলিনেশীয় জাতিগোষ্ঠী, ভেদিদ ও মোঙ্গলীয় প্রভাব, প্রকৃত জাতিগোষ্ঠীর পরিচয় বহন, প্রাক আর্য প্রভাব, আর্য সভ্যতায় বাংলার মিশ্রণ, বিশিষ্ট সংস্কৃতির উদ্ভব ও বাংলার স্বকীয়তা সম্পর্কে জানবো।

বাঙালি জাতির পরিচয়

বিষয়বাঙালি জাতির পরিচয়
স্থানবাংলা বা বঙ্গদেশ
প্রধান ভাগচারটি
নগরতাম্রলিপ্ত, কর্ণসুবর্ণ
আইন-ই-আকবরীআবুল ফজল
রঘুবংশকালিদাস
বাঙালি জাতির পরিচয়

ভূমিকা :- বৈদিক সাহিত্য -এ বাংলাদেশকে আর্য সভ্যতার বাইরে এক বর্বর দেশ বলে গণ্য করা হয়েছে। তাই একথা মনে করা যায় যে, আদি বাঙালীরা আর্য জাতিসম্ভূত ছিল না। বাংলায় আর্য সভ্যতা বিস্তৃত হলে তারপর বাংলাকে পবিত্র দেশ বলে গণ্য করা হয়। নতুবা বৌধায়ণের মতে, এদেশে এলে প্রায়শ্চিত করার দরকার ছিল।

পলিনেশীয় জাতিগোষ্ঠী

অধ্যাপক সিলভ্যাঁ লেভি বাংলা ভাষার আদি রূপ পরীক্ষা করে বলেছেন যে, আদিতে বাংলার অধিবাসীরা যে ভাষায় কথা বলত তা আর্য, দ্রাবিড় কোনো ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত ছিল না। অনেকে মনে করেন যে, বাংলায় এই যুগে পলিনেশীয় জাতিগোষ্ঠীর লোকেরা বসবাস করত।

ভেদিদ ও মোঙ্গলীয় প্রভাব

ডঃ নীহাররঞ্জন রায়ের মতে, বাঙালী জাতির উদ্ভবের পশ্চাতে ভেদিদ জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে ইন্দো-আর্য জাতিগোষ্ঠীর মিশ্রণ কাজ করেছিল। বাংলার একেবারে পূর্ব সীমার অধিবাসীদের মধ্যে মোঙ্গোলীয় প্রভাব দেখা যায়।

প্রকৃত জাতিগোষ্ঠীর পরিচয় বহন

ডঃ পি. সি মহালবনীশের মতে, সদগোপ, কৈবর্ত ও কায়স্থরাই বাংলার প্রকৃত জাতিগোষ্ঠীর পরিচয় বহন করছেন।

প্রাক আর্য প্রভাব

বাংলার অনেক সামাজিক আচার, বিবাহ অনুষ্ঠানের আচার এবং ধান, পান, তেঁতুল প্রভৃতির ব্যবহার প্রাক-আর্য প্রভাবের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

আর্য সভ্যতায় বাংলার মিশ্রণ

আদিতে বাঙালী জাতি যে গোষ্ঠী ও সভ্যতার লোক হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত তারা আর্য সত্যতা গ্রহণ করে। বাংলা অবশেষে আর্য রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে মিশে যায়। মহাভারতের যুগ থেকে এই প্রক্রিয়া আরম্ভ হয় এবং খ্রিস্ট পূর্ব যষ্ঠ শতকে বাংলা পুরা আর্য সভ্যতার ছত্রছায়ায় এসে যায়।

উর্বরা জমির লোভ

কেবলমাত্র আর্য সভ্যতার উন্নত অবস্থার জন্য আর্য সভ্যতায় বাংলার সংমিশ্রণ ঘটেনি। এর পশ্চাতে অর্থনৈতিক কারণও কাজ করে। বাংলার উর্বরা জমির লোভে আর্যরা এ দেশে বসবাস করতে আসে।

বিশিষ্ট সংস্কৃতির উদ্ভব

স্থানীয় অধিবাসীদের নিজস্ব সভ্যতা ও স্বতন্ত্রতাবোধকে আর্য সভ্যতা কোনোদিন পুরোপুরি লোপ করতে পারেনি। আর্য সভ্যতার সঙ্গে বাঙালীর নিজস্ব সংস্কৃতি মিশ্রিত হয়ে বাংলায় এক বিশিষ্ট সংস্কৃতির উদ্ভব হয়।

বাংলায় আর্য সভ্যতার বিস্তার

খ্রিস্ট পূর্ব চতুর্থ শতক নাগাদ মগধ থেকে পুণ্ড্র, বঙ্গ, সুহ্ম ও তাম্রলিপ্ত পর্যন্ত আর্য সভ্যতা বিস্তৃত হয়। খ্রিস্ট পূর্ব তৃতীয় শতকে পুণ্ড্র ও মহাস্থানগড়ে ব্রাহ্মী লিপির আবিষ্কার একথা প্রমাণ করে।

পৌণ্ড্রক বাসুদেব

কিংবদন্তি আছে যে, মহাভারতের যুগে বাংলায় পৌণ্ড্রক বাসুদেব বলে এক ক্ষমতাশালী রাজা ছিলেন। তিনি ছিলেন কৃষ্ণের বিরোধী এবং কৃষ্ণ উপাসক পাণ্ডবদের বিরোধী। তিনি বঙ্গ, পৌণ্ড্র ও কিরাত দেশকে ঐক্যবদ্ধ করেন এবং মগধ-এর রাজা জরাসন্ধের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করেন। তিনি কৃষ্ণের হাতে নিহত হন।

বাংলার স্বকীয়তা

ডঃ নীহার রঞ্জন রায়ের মতে, পৌণ্ড্রক বাসুদেবের কাহিনী প্রমাণ করে যে, বাংলার নিজস্ব সুশাসিত শাসন ব্যবস্থা ছিল। ডঃ হেমচন্দ্র রায়চৌধুরীর মতে, সপ্তম শতকে গৌড়-এর বিজেতাদের আদি পুরুষ হিসেবে পৌণ্ড্রক বাসুদেবের নাম উল্লেখ্য।

সিংহবাহু

সিংহলে একটি কিংবদন্তী প্রচলিত আছে যে, সিংহবাহু নামে বাংলার এক রাজপুত্র তার পিতার সিংহাসনের দাবী ছেড়ে ‘লাঢ়’ বা রাঢ় দেশে সিংহপুর নামে এক রাজ্য স্থাপন করেন। সিংহপুর সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গ -এর হুগলী জেলার সিঙ্গুর। সিংহবাহুর জ্যেষ্ঠ পুত্র বিজয়সিংহ তার পিতার আদেশে নির্বাসিত হন।

বিজয়সিংহের লঙ্কা জয়

বিজয়সিংহ তার অনুচরদের নিয়ে সমুদ্রপথে লঙ্কায় উপস্থিত হন এবং ৫৪৪ খ্রিস্ট পূর্বে এখানে একটি রাজ্য স্থাপন করেন। তার নাম অনুসারে এক রাজ্যের নাম হয় সিংহল। এই কিংবদন্তীর ঐতিহাসিক ভিত্তি জানা যায়নি। তবে বাংলার সঙ্গে সিংহলের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এর থেকে অনুমান করা যায়।

উপসংহার :- প্রাচীন বাংলার আদি অধিবাসী কারা ছিল তা নিয়ে যথেষ্ঠ মতভেদ আছে। তবে ডঃ পি. সি মহালবনীশের মতে, সদগোপ, কৈবর্ত ও কায়স্থরাই বাংলার প্রকৃত জাতিগোষ্ঠীর পরিচয় বহন করছেন।

(FAQ) বাঙালি জাতির পরিচয় সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. বাংলা কোন সভ্যতার সাথে মিশে যায়?

আর্য সভ্যতা।

২. বাংলার প্রকৃত জাতিগোষ্ঠীর পরিচয় কারা বহণ করছে?

সদগোপ, কৈবর্ত ও কায়স্থ।

৩. মহাভারতের যুগে বাংলার ক্ষমতাশালী রাজা কে ছিলেন?

পৌণ্ড্রক বাসুদেব।

৪. বাংলার সিংহপুর বলতে কোন জায়গা বোঝায়?

অধুনা হুগলি জেলার সিঙ্গুর।

Leave a Comment