ফরাসি বিপ্লবে বৈদেশিক হস্তক্ষেপ প্রসঙ্গে পাদুয়ার ঘোষণা, পিলনিজের ঘোষণাপত্র, অস্ট্রিয়া ও প্রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ, ব্রান্সউইক ঘোষণা, দ্বিতীয় ফরাসি বিপ্লব, ভামির যুদ্ধ, বিদেশি হস্তক্ষেপের প্রকৃতি সম্পর্কে টমসনের মন্তব্য, গুয়েদালার মন্তব্য, নতুন সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা, বিপ্লব বনাম প্রতিক্রিয়াশীলতার দ্বন্দ্ব, ফরাসি বিপ্লবের আদর্শের বিস্তার, অভিজাতদের দমন , অস্ট্রিয়াকে দমন ও সীমান্তের সুরক্ষা সম্পর্কে জানবো।
ফ্রান্সে সংঘটিত ফরাসি বিপ্লবে বৈদেশিক হস্তক্ষেপ
ঐতিহাসিক ঘটনা | ফরাসি বিপ্লবে বৈদেশিক হস্তক্ষেপ |
ফরাসি বিপ্লব | ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দ |
পাদুয়ার ঘোষণা | ৬ জুলাই, ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দ |
পিলনিজের ঘোষণাপত্র | ২০ আগস্ট, ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দ |
ভামির যুদ্ধ | ২০ সেপ্টেম্বর, ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দ |
ভূমিকা:- ফরাসি বিপ্লব সমগ্র ইউরোপ-এ এক বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। বিপ্লব শুরু হলে বহু অভিজাত ও রাজতন্ত্রী দেশত্যাগ করে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নেন এবং প্রতি-বিপ্লবী প্রচার কার্য চালাতে থাকেন। ইউরোপীয় রাজন্যবর্গের পক্ষে ফরাসি বিপ্লবের আদর্শগুলি মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না।
ফরাসি বিপ্লবে বিদেশি হস্তক্ষেপ
অস্ট্রিয়ার সম্রাট লিওপোল্ড ছিলেন ফরাসি-রাজের শ্যালক। এছাড়া সার্ডিনিয়া, স্পেন ও নেপলসের রাজারা ছিলেন ফরাসি-রাজের আত্মীয়। তাঁরা ফরাসি-রাজার নিরাপত্তা সম্পর্কে চিন্তিত ছিলেন।
(১) পাদুয়ার ঘোষণা
১৭৯১ খ্রিস্টাব্দের ৬ই জুলাই অস্ট্রিয়ার সম্রাট লিওপোল্ড পাদুয়া নামক স্থান থেকে এক ঘোষণাপত্র জারি করে ইউরোপীয় রাজন্যবর্গকে ফরাসি রাজতন্ত্রের অনুকূলে সশস্ত্র হস্তক্ষেপের আহ্বান জানান। এই ঘোষণা ‘পাদুয়ার ঘোষণা’ নামে পরিচিত।
(২) পিলনিজের ঘোষণাপত্র
২০শে আগস্ট অস্ট্রিয়ার সম্রাট লিওপোল্ড এবং প্রাশিয়া-রাজ দ্বিতীয় উইলিয়ম ফ্রেডারিক পিলনিজ নামক স্থানে মিলিত হয়ে এক ঘোষণাপত্র দ্বারা ইউরোপের সব রাজাকে ফরাসি রাজতন্ত্রের পক্ষে সশস্ত্র হস্তক্ষেপের আহ্বান জানান। এই ঘোষণাপত্র ‘পিলনিজের ঘোষণাপত্র’ নামে পরিচিত। এই ঘোষণা ফরাসি জনগণ ও আইনসভাকে প্রবল ক্ষুব্ধ করে।
(৩) অস্ট্রিয়া ও প্রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ
১৭৯২ খ্রিস্টাব্দের ১লা মার্চ সম্রাট লিওপোল্ডের মৃত্যু হলে তাঁর পুত্র দ্বিতীয় ফ্রান্সিস সিংহাসনে বসেন। ফরাসি আইনসভার আবেদন সত্ত্বেও তিনি প্রতি-বিপ্লবী ফরাসি শরণার্থীদের অস্ট্রিয়া থেকে বহিষ্কার করতে বা ফরাসি সীমান্ত থেকে সৈন্য সরাতে রাজি হলেন না। এর ফলে আইনসভার চাপে ষোড়শ লুই অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন (২০শে এপ্রিল, ১৭৯২ খ্রিঃ)। অস্ট্রিয়া ও প্রাশিয়ার প্রায় আশি হাজার সৈন্য ফ্রান্স অভিমুখে অগ্রসর হয়।
(৪) ব্রান্সউইক ঘোষণা
এই সময় আগস্ট মাসে প্রাশিয়ার সেনাবাহিনীর প্রধান ব্রান্সউইক এক ঘোষণাপত্র মারফত জানান যে, ফরাসি রাজপরিবারের নিরাপত্তা কোনওভাবে বিপন্ন হলে তিনি প্যারিস শহর ধ্বংস করে দেবেন। এটি ব্রান্সউইক ঘোষণা নামে পরিচিত।
(৫) দ্বিতীয় ফরাসি বিপ্লব
এই ‘ব্রান্সউইক ঘোষণা’ ফরাসি জাতির আত্মমর্যাদায় আঘাত হানে। তারা মনে করে যে, বিদেশি শত্রুদের সঙ্গে রাজপরিবারের যোগাযোগ আছে। ১০ই আগস্ট উত্তেজিত জনতা রাজপ্রাসাদ আক্রমণ করে এবং ‘দ্বিতীয় ফরাসি বিপ্লব’ অনুষ্ঠিত হয়।
(৬) ভামির যুদ্ধ
প্রাথমিক বিপর্যয় সত্ত্বেও বৈদেশিক যুদ্ধে ফ্রান্স শেষ পর্যন্ত জয়যুক্ত হয়। ২০শে সেপ্টেম্বর ভামির যুদ্ধে অস্ট্রো-প্রাশিয়ান বাহিনী ফরাসি জাতীয় বাহিনীর কাছে পরাজিত হয়। এর ফলে আপাতত বৈদেশিক যুদ্ধ স্থগিত হয়।
ফরাসি বিপ্লবে বিদেশি হস্তক্ষেপের প্রকৃতি
এই যুদ্ধের প্রকৃতি সম্পর্কে নানা কথা বলা যায়। যেমন –
(১) টমসনের মন্তব্য
ঐতিহাসিক ডেভিড টমসন বলেন যে, এই যুদ্ধ কে শুরু করে তা বলা কঠিন।
(২) গুয়েদালার মন্তব্য
ফিলিপ গুয়েদালা-র মতে, “এই যুদ্ধ ছিল বিপ্লবী ফ্রান্সের আদর্শবাদের সঙ্গে রাজতন্ত্রবাদী শক্তিগুলির লড়াই।”
(৩) নতুন সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা
বিপ্লবের ফলে ফ্রান্সে পুরাতনতন্ত্র ভেঙে যে নতুন সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে ওঠে তাতে ইউরোপীয় রাজন্যবর্গ আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন। তাঁরা আশঙ্কা করেন যে, ফরাসি বিপ্লবের বিধ্বংসী স্রোতধারা অচিরেই সারা ইউরোপকে প্লাবিত করে ফেলবে।
(৪) বিপ্লব বনাম প্রতিক্রিয়াশীলতার দ্বন্দ্ব
তাঁরা বিপ্লবী আদর্শকে ফ্রান্সের সীমানার মধ্যেই ধ্বংস করতে উদ্যোগী হন। ঐতিহাসিক সোবুল তাই বলেন, “এই সংঘর্ষ ছিল মূলত বিপ্লব বনাম প্রতিক্রিয়াশীলতার দ্বন্দ্ব।”
(৫) ফরাসি বিপ্লবের আদর্শের বিস্তার
ফরাসি জিরণ্ডিন দল বিদেশি যুদ্ধ সম্পর্কে আগ্রহী ছিল। তারা মনে করত যে, ফরাসি বিপ্লবের সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার আদর্শকে কেবল ফ্রান্সের অভ্যন্তরে ব্যাপৃত না রেখে পুরাতনতন্ত্রের নিগড়ে আবদ্ধ সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে দিতে হবে। তারা মনে করত “যে, ফরাসি বাহিনী ইউরোপের কোনও দেশ আক্রমণ করলে সেই দেশের নিপীড়িত জনতা বিপ্লবী বাহিনীর সঙ্গেই যোগ দেবে।
(৬) অভিজাত ও অস্ট্রিয়াকে দমন
বিপ্লবীদের অনেকেরই ধারণা ছিল যে, দেশত্যাগী অভিজাতদের সঙ্গে ফরাসি-রাজের গোপন যোগাযোগ আছে এবং তারা অস্ট্রিয়ার সহযোগিতায় রাইন অঞ্চল থেকে ফ্রান্স আক্রমণ করবে। তাই দেশত্যাগী অভিজাত ও অস্ট্রিয়াকে দমনের উদ্দেশ্যে বিপ্লবীরা অনেকেই যুদ্ধ চান।
(৭) সীমান্ত সুরক্ষা
অনেক বিপ্লবী নেতা মনে করতেন যে, ফ্রান্সের সীমান্ত যথেষ্ট সুরক্ষিত নয়। বিপ্লবীরা তাই যুদ্ধ শুরু করে ফ্রান্সের সীমান্তকে প্রাকৃতিক সীমারেখায় স্থাপন করতে উদ্যোগী হন। এজন্য উত্তর-পূর্বে বেলজিয়াম, পূর্বে রাইন নদী এবং দক্ষিণ-পূর্বে স্যাভয় ও নিস দখল করে ফ্রান্সের সীমান্তকে সুরক্ষিত করার পরিকল্পনা করা হয়।
উপসংহার:- ঐতিহাসিক ফিশার বলেন, “যুদ্ধের মাধ্যমে ফ্রান্স একাধারে ফরাসি বিপ্লবের আদর্শ প্রচারক এবং পররাজ্য অপহরণকারী দস্যু – এই দুই ভূমিকায় কাজ করে।”
(FAQ) ফরাসি বিপ্লবে বৈদেশিক হস্তক্ষেপ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে।
ষোড়শ লুই।
অস্ট্রিয়ার সম্রাট লিওপোল্ড ৬ জুলাই ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দ।
২০ সেপ্টেম্বর, ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দ।