ওয়েমার প্রজাতন্ত্রের পতনের কারণ প্রসঙ্গে প্রজাতন্ত্রের পতনের কারণ হিসেবে ভার্সাই সন্ধি, সরকারের সংহতির অভাব, প্রতিকূল সামাজিক পরিবেশ, ডক্টর স্ট্রেসম্যানের মৃত্যু, গণতান্ত্রিক শাসনের দুর্বলতা, অর্থনৈতিক দুরবস্থা, মহামন্দা ও নাৎসি দলের প্রতি জনগণের সমর্থন সম্পর্কে জানবো।
ওয়েমার প্রজাতন্ত্রের পতনের কারণ
ঐতিহাসিক ঘটনা | ওয়েমার প্রজাতন্ত্রের পতনের কারণ |
স্থান | জার্মানি |
সময় | প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী কাল |
প্রতিষ্ঠাতা | ফ্রেডারিখ ইবার্ট |
পতন | ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দ |
ক্ষমতা দখল | হিটলার |
ভূমিকা :- ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে জার্মানিতে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজধানী বার্লিনে নানা গোলমাল চলতে থাকায় নিকটবর্তী ওয়েমার শহরে এই প্রজাতান্ত্রিক সরকারের কর্মকেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এই কারণে এই প্রজাতন্ত্র ‘ওয়েমার প্রজাতন্ত্র‘ নামে পরিচিত।
ওয়েমার প্রজাতন্ত্রের সংকট
নব প্রতিষ্ঠিত ওয়েমার প্রজাতন্ত্রকে নানা জটিল সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, এগুলি ছিল ওয়েমার প্রজাতন্ত্রের সংকট। যেমন – ভার্সাই সন্ধি, সরকারি কর্মচারীদের আনুগত্যের অভাব, বিবিধ বিদ্রোহ, মুদ্রাস্ফীতি, ক্ষতিপূরণ সমস্যা প্রভৃতি।
ওয়েমার প্রজাতন্ত্রের পতনের কারণ
জার্মানির ওয়েমার প্রজাতন্ত্রের পতন কোনও আকস্মিক ঘটনা নয় – এর পতনের পশ্চাতে নানা কারণ ছিল। যেমন –
(ক) ভার্সাই সন্ধি
ওয়েমার প্রজাতন্ত্রের পতনের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে ভার্সাই সন্ধিকে চিহ্নিত করা যায়। কারণ,
(১) প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালে প্রতিষ্ঠা
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয়, অপমানজনক ভার্সাই চুক্তি স্বাক্ষর এবং ওয়েমার প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা একই সময়ে ও একই আবহাওয়ার মধ্যে হয়। এই কারণে বহু জার্মানের কাছে জার্মানির পরাজয়, ভার্সাই চুক্তি ও ওয়েমার প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা ছিল সমার্থক।
(২) প্রজাতন্ত্রের প্রতি সহানুভূতি নেই
এই চুক্তি স্বাক্ষরকারী সরকার জনসাধারণের কাছে ‘দেশদ্রোহী” ও ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলে চিহ্নিত হয়েছিল। শুরু থেকেই এই প্রজাতন্ত্রের প্রতি সাধারণ জার্মানদের কোনও শ্রদ্ধা বা সহানুভূতি ছিল না।
(খ) সরকারে সংহতির অভাব
ওয়েমার প্রজাতন্ত্রে সরকারের সংহতির বিশেষ অভাব ছিল। যেমন –
(১) দুর্বল ভিত্তি
শুরু থেকেই এই প্রজাতন্ত্রের ভিত্তি ছিল অতি দুর্বল। জার্মানির সাধারণ মানুষ প্রজাতন্ত্রকে কখনোই সুনজরে দেখে নি। আনুপাতিক হারে প্রতিনিধিত্বের সুযোগ থাকায় জার্মানির বেশ কয়েকটি দল আইনসভায় প্রতিনিধি পাঠাবার সুযোগ পায়।
(২) প্রজাতন্ত্রের প্রতি অনাস্থা
এখানে কোনও দলের একক প্রাধান্য ছিল না। বিভিন্ন দলের সমন্বয়ে এই প্রজাতন্ত্র স্থাপিত হয়, যদিও প্রজাতন্ত্রের প্রতি অনেকেরই কোনও আস্থা ছিল না। এইজন্য ওয়েমার প্রজাতন্ত্রকে বলা হয় ‘প্রজাতন্ত্রীশীল প্রজাতন্ত্র’।
(৩) বিভিন্ন দলের মধ্যে সংহতি ও ঐক্যের অভাব
মন্ত্রিসভাগুলি ছিল যৌথ এবং বিভিন্ন দলের মধ্যে কোনও সংহতি বা কোনও ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি ছিল না। ১৯১৯ থেকে ১৯৩৩ সালের মধ্যে জার্মানিতে ২১টি মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। এ থেকেই এই প্রজাতন্ত্রের দুর্বলতা উপলব্ধি করা যায়।
(গ) প্রতিকূল সামাজিক পরিবেশ
ওয়েমার সংবিধান ছিল একটি আদর্শ প্রজাতান্ত্রিক সংবিধান। এ সত্ত্বেও কিন্তু এই সংবিধানকে কার্যকর করার জন্য উপযুক্ত সামাজিক পরিকাঠামো গড়ে তোলা হয় নি। কারণ,
(১) স্বৈরাচারী আমলাদের প্রাধান্য
শাসন বিভাগ, বিচার বিভাগ এবং সমাজব্যবস্থার সর্বস্তরেই ছিল কাইজারের আমলের রাজতন্ত্রবাদী, সামন্ততান্ত্রিক, স্বৈরাচারী আমলাদের প্রাধান্য। প্রজাতন্ত্র সম্পর্কে তাদের ঘোরতর অনীহা ছিল এবং তারা প্রজাতান্ত্রিক সরকারের কোনও নির্দেশই মানত না।
(২) টমসন ও কর্ণওয়েলের মন্তব্য
অধ্যাপক ডেভিড টমসন বলেন যে, এই সামাজিক কাঠামোর মধ্যে প্রজাতন্ত্রের টিকে থাকার সম্ভাবনা ছিল অতি ক্ষীণ। আর, ডি. কর্ণওয়েল বলেন যে, ওয়েমার প্রজাতন্ত্র জার্মানির পরাজয়-কালে জন্মলাভ করায় এবং জনসাধারণের সক্রিয় সমর্থন না পাওয়ায় গোড়া থেকেই ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ হতে থাকে।
(ঘ) ডঃ স্ট্রেসম্যানের মৃত্যু
- (১) বিচক্ষণ কূটনীতিক গুস্তাভ স্ট্রেসম্যানের সুদক্ষ পরিচালনায় ওয়েমার প্রজাতন্ত্র জার্মানির জনজীবনে বেশ কিছু পরিবর্তন এনেছিল।
- (২) জার্মানিতে অর্থনৈতিক পরিবর্তন আসছিল, বেকারত্ব কমছিল, পশ্চিমি দেশগুলি জার্মানি সম্পর্কে তাদের পুরোনো ধারণা পরিবর্তন করছিল, জার্মানির সঙ্গে তাদের সুসম্পর্ক গড়ে উঠছিল এবং লিগের সদস্য হিসেবে ইউরোপীয় রাজনীতিতে জার্মানি মর্যাদা পেতে শুরু করেছিল।
- (৩) ঠিক এই অবস্থায় ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে স্ট্রেসম্যানের মৃত্যু ওয়েমার প্রজাতন্ত্রকে পতনের দিকে ঠেলে দেয় এবং তার অবসান আসন্ন হয়ে ওঠে।
(ঙ) গণতান্ত্রিক শাসনের ব্যর্থতা
জার্মানিতে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার কোনও ঐতিহ্য ছিল না। জনগণ সামরিক শক্তিনির্ভর স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সঙ্গেই পরিচিত ছিল। যেমন –
(১) ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের অসহযোগিতা
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা সফল করতে গেলে প্রয়োজন ছিল গণতান্ত্রিক দেশ ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স -এর স্বতঃস্ফূর্ত সাহায্য। জার্মানি তা পায় নি।
(২) কঠোর শর্তে সন্ধি
মিত্রশক্তি যদি নমনীয় শর্তে জার্মানির সঙ্গে সন্ধি করত বা ক্ষতিপূরণের ব্যাপারে উদার হত, তাহলে হয়তো জার্মানির অবস্থা অন্যরকম হত।
(৩) মিত্রপক্ষের সক্রিয়তা
জার্মানিকে কোনোপ্রকার সাহায্য নয় বরং জার্মানিকে চিরতরে পঙ্গু করে রাখতেই তারা সক্রিয় ছিল। এছাড়া, প্রজাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা জার্মানির নতুন প্রজন্মকে কোনোভাবেই আকৃষ্ট করতে পারে নি।
(চ) অর্থনৈতিক দুরবস্থা
যুদ্ধোত্তর জার্মানির বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতি, খাদ্যাভাব প্রভৃতি অর্থনৈতিক সংকট প্রজাতন্ত্রকে শোচনীয় পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় ক্ষতিপুরণ সমস্যা। জার্মান মার্কের দাম শোচনীয়ভাবে পড়ে যায়। ডাওয়েজ পরিকল্পনা-র মাধ্যমে ঋণ হিসেবে জার্মানিতে মার্কিন অর্থ আসছিল। এর দ্বারা একদিকে যেমন জার্মানি ক্ষতিপূরণের অর্থ শোধ করছিল, অন্যদিকে তেমনি জার্মানির ভেঙে পড়া অর্থনীতিও চাঙ্গা হচ্ছিল।
(ছ) মহামন্দা
এই অবস্থায় বিশ্বব্যাপী মহামন্দা জার্মান অর্থনীতির উপর প্রবল আঘাত হানে। এই ধাক্কা থেকে সরকারকে রক্ষা করা আর সম্ভব ছিল না। রবার্ট এরগ্যাং বলেন যে, “অর্থনৈতিক মন্দা ওয়েমার প্রজাতন্ত্রের দিকে মৃত্যুবান ছুঁড়ে দেয়।”
(জ) নাৎসি দলের প্রতি জনগণের সমর্থন
সরকার মহামন্দা মোকাবিলায় ব্যর্থ হলে প্রজাতন্ত্র-বিরোধী দলগুলি সরকারের বিরুদ্ধে প্রচারে নামে। কর্মহীন মানুষ, বন্ধ কলকারখানার শ্রমিক, সাধারণ মানুষ নানা প্রচার-অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে নাৎসি দল -এর প্রতি সমর্থন জানায়।
উপসংহার:- জাতীয় জীবনের এই চরম হতাশার দিনে ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে হিটলার ওয়েমার প্রজাতন্ত্রের পতন ঘটিয়ে জার্মানির ক্ষমতা দখল করেন। তিনি হন ফ্যুয়েরার বা জার্মানির সর্বোচ্চ নেতা।
(FAQ) ওয়েমার প্রজাতন্ত্রের পতনের কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়াম।
ওয়েমার প্রজাতন্ত্র।
ফ্রেডারিখ ইবার্ট।
হিটলার ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে।