বৌদ্ধ ধর্মের আলোচনায় উল্লেখযোগ্য নারী সুজাতা প্রসঙ্গে বৌদ্ধ ধর্মের ভিত্তি গঠন, গৌতম বুদ্ধের পরিচয়, গৌতম বুদ্ধ ও সুজাতার প্রথম সাক্ষাৎ, সুজাতা কর্তৃক গৌতম বুদ্ধকে ধর্মসাধনায় উদ্দীপন, সুজাতার অন্নদানে সজীব গৌতম বুদ্ধ, সুজাতার পরিচয়, সুজাতা কর্তৃক গৌতম বুদ্ধকে বনদেবতা রূপে পূজা, গৌতম বুদ্ধের সাথে সুজাতার কথোপকথন এবং সুজাতা ও বুদ্ধদেব সম্পর্কে কবিতা বিষয়ে জানব।
প্রাচীন ভারতের বৌদ্ধ যুগের বিখ্যাত নারী সুজাতা প্রসঙ্গে ভূম্যধিকারীর পত্নী সুজাতা, সুজাতা ও গৌতম বুদ্ধের প্রথম সাক্ষাৎ, বনদেবতা রূপে গৌতম বুদ্ধকে সুজাতার পূজা, গৌতম বুদ্ধ ও সুজাতার কথোপকথন এবং সুজাতা ও গৌতম বুদ্ধকে নিয়ে রচিত কবিতা সম্পর্কে জানব।
বৌদ্ধ নারী সুজাতা
ঐতিহাসিক চরিত্র | সুজাতা |
পরিচয় | সেনানী গ্ৰামের ভূম্যধিকারীর পত্নী |
গৌতম বুদ্ধের পূজা | বনদেবতা জ্ঞানে |
প্রথম সাক্ষাৎ | উরুবিল্ব নামক স্থানে |
বুদ্ধদেব কে প্রদান | পায়সান্ন |
ভূমিকা :- ভারতবর্ষ-এর ইতিহাস আলোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, বৌদ্ধযুগ নানাদিক দিয়েই আমাদের দেশকে বাহ্যসম্পদ ও আভ্যন্তরীণ জ্ঞানগরিমায় সর্বতোভাবে গরীয়ান করে তুলেছিল। বুদ্ধদেব অহিংসার যে পবিত্র ধর্ম প্রচার করেছিলেন তা এককালে পৃথিবীর বহু দেশেই ব্যাপ্ত হয়ে পড়েছিল।
বৌদ্ধ ধর্মের ভিত্তি গঠন
বুদ্ধদেব জীবিতকালে যে সমুদয় উপদেশ প্রদান করেছিলেন, তাঁর তিরোভারের পর শিষ্যগণ সম্মিলিত হয়ে সে সমুদয় উপদেশ সংগ্রহ করেছিলেন। কালক্রমে তার থেকেই বৌদ্ধ ধর্ম-এর ভিত্তি গঠিত হয়েছিল ।
গৌতম বুদ্ধের পরিচয়
বুদ্ধদেব প্রায় আড়াই হাজার বছরেরও পূর্বে, বর্তমান কাশীর প্রায় পঞ্চাশ মাইল উত্তরে নেপাল-এর তরাই অঞ্চলে প্রাচীন কপিলাবস্তু নগরে জন্মগ্ৰহণ করেন। কপিলবাস্তু নগরে শাক্যগণের রাজধানী ছিল। গৌতমের পিতা শুদ্ধোদন ও মাতার নাম ছিল মায়াদেবী। জন্মের অব্যবহিত পরেই তাঁর মৃত্যু হল। পরবর্তীতে যশোধরার সাথে গৌতমের বিবাহ হয় এবং তাদের একটি পুত্র সন্তান হলে গৌতম গৃহ ত্যাগ করে বোধি লাভ করে বুদ্ধদেব নামে পরিচিত হন।
সুজাতা ও গৌতম বুদ্ধের প্রথম সাক্ষাৎ
সেই সময়ে গৌতম বুদ্ধ-এর বোধি লাভের স্থান উরুবিল্ব (কারও মতে সেনানী) নামে পরিচিত। আজকাল যার নাম বুদ্ধগয়া। তখন ঐ স্থানটি বড় সুন্দর ছিল। চারিদিকে ছোট ছোট পাহাড়, সবুজ শস্যে ভরা মাঠ। গ্রামের পাশ দিয়ে নৈরঞ্জনা নদী কুলকুল রবে বয়ে চলেছে। বোধি লাভের উদ্দেশ্যে ধ্যানে বসার পূর্বে সিদ্ধার্থ স্নান করে সবে অশ্বত্থতলায় বসেছেন, এমন সময় একজন ধনী ব্যক্তির পত্নী সুজাতা তাঁর সম্মুখে এক বাটি পায়সান্ন উপস্থিত করলেন।
সুজাতা কর্তৃক গৌতম বুদ্ধকে ধর্মসাধনায় উদ্দীপন
বৌদ্ধসঙ্ঘের প্রথম অবস্থায় সেখানে স্ত্রীলোকের প্রবেশাধিকার ছিল না। এমন কি বুদ্ধদেব নিজে স্ত্রীলোকের সংস্পর্শ হতে দূরে থাকতে চেষ্টা করতেন। কিন্তু আমরা দেখতে পাই যে, বুদ্ধদেবের বুদ্ধত্ব লাভের পূর্বে সুজাতার পায়সান্ন দান তাঁকে নবজীবন দান করে ধর্মসাধনায় উদ্দীপিত করেছিল। কাজেই বুদ্ধদেবের সাধনার মূলেও নারীর সুকোমল মঙ্গলহস্ত বিদ্যমান দেখতে পাওয়া যায়।
সুজাতার অন্নদানে সজীব গৌতম বুদ্ধ
বুদ্ধদেব যখন ছয় বছর কঠোর তপস্যা করে ম্রিয়মাণ হয়ে পড়লে এই মহীয়সী মহিলার অন্নদানেই তাঁকে সজীব করেছিল।
সুজাতার পরিচয়
সুজাতা সেনানী নামক গ্রামের ভূম্যধিকারীর পত্নী ছিলেন। তাঁর সন্তান না হওয়ায় তিনি বনদেবতার নিকট মানত করেছিলেন যে, পুত্র লাভ হলে নিজ হাতে পায়সান্ন দ্বারা বনদেবতার পূজা দেবেন।
সুজাতা কর্তৃক গৌতম বুদ্ধকে বনদেবতা রূপে পূজা
- (১) যথা সময়ে সুজাতার একটি পুত্রসন্তান হল। পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করার তিন মাস পর সুজাতা বনদেবতার পূজা দেবার সঙ্কল্প করলেন। নিকটবর্তী অরণ্যে যে বৃক্ষে বনদেবতা বাস করতেন বলে লোকে মনে করত, সুজাতা তার সম্মুখস্থ ভূমি পরিষ্কার করতে এবং তার চারিদিক লোহিত বর্ণের সুত্রদ্বারা পরিবেষ্টিত করতে রাধা নামে একজন পরিচারিকাকে প্রেরণ করলেন।
- (২) সেই সময়ে সিদ্ধার্থ উরুবিল্ব বনে তপস্যা করছিলেন। রাধা তাঁকেই বনদেবতা মনে করে সুজাতার নিকট এসে বলল যে, বনদেবতা মূর্তি পরিগ্রহ করে তরুতলে আবির্ভূত হয়েছেন। এই কথা শুনে সুজাতা বনস্পতি সমীপে উপস্থিত হলেন এবং বুদ্ধদেবকে বনদেবতা মনে কর ভক্তির সাথে প্রণাম করলেন।
সুজাতার সাথে গৌতমের কথোপকথন
- (১) বুদ্ধদেব সুজাতাকে বললেন, ‘বৎসে, কি আনিয়াছ? সুজাতা কহিলেন “ভগবন, সদ্যপ্রসূত শত গাভীদুগ্ধে পঞ্চাশটি গাভী পোষণ করিয়াছি, তাহাদের দুগ্ধে পঁচিশটি, তাহাদের দুগ্ধে আবার বারটি গাভী হৃষ্ট; এই দ্বাদশ গাভীর দুগ্ধ পান করাইয়া আমার পালের মধ্যে ভাল ভাল ছয়টি গরু বাছিয়া তাহাদের দুধ দুহিয়া লই।
- (২) সেই দুগ্ধ সুগন্ধি মসলায় উৎকৃষ্ট তণ্ডুল সহযোগে পাক করিয়া আনিয়াছি। আমার ব্রত এই যে, দেবতার অনুগ্রহে আমার একটি সন্তান জন্মগ্রহণ করিলে এই অন্নদানে দেবার্চনা করিব। প্রভো! এখন সেই পায়সান্ন লইয়া তোমার নিকটে আসিয়াছি, প্রসন্ন হইয়া গ্রহণ কর।”
- (৩) বুদ্ধ সুজাতাকে আশীর্বাদ করে বললেন “তুমি যেমন তোমার ব্রত পালন করিয়া সুখী হইয়াছ, আমিও যেন সেইরূপ আমার জীবনব্রত সাধন করিতে সমর্থ হই।” এই দুগ্ধপানে তিনি শরীরে বল পাইয়া সেই স্থান হইতে বোধিবৃক্ষতলে গিয়া ধ্যানমগ্ন হইলেন; সেই ধ্যানে তিনি বুদ্ধত্ব প্রাপ্ত হইলেন ৷
সুজাতা ও বুদ্ধদেব সম্পর্কে কবিতা
বুদ্ধের প্রতি সুজাতার এই ঘটনাটি অবলম্বনে একটি অতি সুন্দর কবিতা আছে। আমরা এখানে সেই কবিতাটি উদ্ধৃত করলাম। বুদ্ধদেবকে বনদেবতা ভ্রমে সুজাতা পায়সান্ন দিতে গিয়ে বলছেন,
কে তুমি হেথা বিজনে বসি?
নর, কি ঋষি, দেবতা?
অঙ্গ ছাপি পুণ্যপ্রভা চমকে!
দীপ্ত তব বদন নব,
ভগ্ন যেন সবিতা,
নিরখি নর-নয়ন সদা ঝলকে।
ক্লান্ত নহে কান্ত তনু
করি কঠোর সাধনা;
নহ ত প্ৰভু তাপস তবে নহ গো।
সুপ্তিহীন নয়নে ঝরে
দীপ্তি মাখা করুণা ;
ধেয়ান রত ঋষি ত তুমি নহ গো।
দেবতা তুমি জনৎভূমে
এসেছ প্রভু এসেছ,
ফুটাতে প্রীতি কঠোর হৃদিশিলাতে।
হরিতে পাপ বাসনা তাপ
এসেছ প্রভু এসেছ,
মরণ নাশি অমৃত রাশি বিলাতে।
জগৎ যবে শরণ লবে
চরণে তব কাদিয়া,
পিপাসা ক্ষুধা মিটাতে সুধা ঢালিয়া,
বিশ্বপাতা অন্নদাতা।
পূজিব তবে কি দিয়া?
লবে কি এহি অন্ন কৃপা করিয়া?
উপসংহার :- বুদ্ধদেবের তপঃসিদ্ধির মূলে এই মহীয়সী মহিলার এই পায়সান্ন দান যে কত বড় ফলপ্রদ হয়েছিল, তা না বললেও চলে। প্রাচীন ভারতের এই মহিলার সুন্দর ছবিটি আমাদের চিত্তকে আনন্দে অভিষিক্ত করে, রমণীর স্নেহময়ী মাতৃমূর্তি নয়নসমক্ষে প্রতিভাত হয়।
(FAQ) বৌদ্ধ ধর্মের আলোচনা উল্লেখযোগ্য নারী সুজাতা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
সুজাতা সেনানী নামক গ্রামের ভূম্যধিকারীর পত্নী ছিলেন।
গৌতম বুদ্ধ ধ্যানে বসার পূর্বে সুজাতার হাতে আনা পায়সান্ন ভক্ষণ করেছিলেন।
বনদেবতা।