বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন

বিজ্ঞানী বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন প্রসঙ্গে তার জন্ম, পিতৃপরিচয়, শিক্ষা, ধারাবাহিক প্রকাশ, সমাজ সংস্কার মূলক কাজ, ভ্রাম্যমান লাইব্রেরি স্থাপন, বীমা কোম্পানি স্থাপন, হাসপাতাল তৈরি, বৈজ্ঞানিক গবেষণা, আবিষ্কার সমূহ, আমেরিকার সংবিধান রচনা ও তার মৃত্যু সম্পর্কে জানবো।

বিজ্ঞানী বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন

ঐতিহাসিক চরিত্রবেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন
জন্ম৬ জানুয়ারি, ১৭০৬ খ্রি:
দেশআমেরিকা
পরিচিতিদার্শনিক, বিজ্ঞানী
খ্যাতিআমেরিকার সংবিধান রচনা
মৃত্যু১৭ এপ্রিল, ১৭৯০ খ্রি:
বিজ্ঞানী বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন

ভূমিকা :- আমেরিকার ইতিহাসে যদি বহুমুখী ব্যক্তিত্বের অধিকারী কোনো পুরুষের নাম করতে হয় যিনি একাধারে ছিলেন মুদ্রাকর, দার্শনিক, রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, রাষ্ট্রের সংবিধানের রচয়িতা, বিজ্ঞানী, আবিষ্কারক, যাঁর সম্বন্ধে দেশবাসী শ্রদ্ধা অবনত চিত্তে বলেছিল আমাদের হিতৈষী মহাজ্ঞানী পিতা-সেই মানুষটির নাম বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন। শুধু আমেরিকার নন, সমগ্র মানব জাতির তিনি হিতৈষী বন্ধু।

বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের জন্ম

এই মহাজ্ঞানী কর্মযোগীর জন্ম আমেরিকার বোস্টন শহরে ১৭০৬ সালের জানুয়ারি মাসে।

মুদ্রাকর বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের বংশ পরিচয়

তাঁর বাবা ধর্মীয় কারণে ইংল্যান্ড ত্যাগ করে আমেরিকায় গিয়ে বসবাস আরম্ভ করেন। বেঞ্জামিনের আগে তাঁর মা চোদ্দটি সন্তানের জন্ম দেন। তাঁর বাবা অতিকষ্টে এই বিরাট সংসার প্রতিপালন করতেন।

বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের ছেলেবেলা ও শিক্ষা

  • (১) ছেলেবেলায় বেঞ্জামিন কোনোদিনই আর্থিক সচ্ছলতার মুখ দেখেন নি। যখন তাঁর আট বছর বয়স, বাবা তাঁকে গ্রামের স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। কয়েক বছর স্কুলের খরচ মেটালেও শেষ পর্যন্ত আর পারলেন না।
  • (২) বেঞ্জামিনকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে এনে নিজের সাবান তৈরির কারখানায় ঢুকিয়ে দিলেন। কিন্তু এই কাজে কিছুতেই মন বসল না বেঞ্জামিনের। ব্যবসার প্রতি কোনোদিন তাঁর কোনো আকর্ষণ ছিল না। তাঁর আগ্রহ ছিল সমুদ্রে ভেসে বেড়াবার।

দার্শনিক বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের স্ত্রী

১৭৭৩ সালে মৃত্যু পর্যন্ত মিসেস রীড ছিলেন বেঞ্জামিনের সুযোগ্য স্ত্রী।

বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের ধারাবাহিক প্রকাশ

১৭৩৩ সাল নাগাদ পুওর রিচার্ডস আলমানাক নামে একটি ধারাবাহিক প্রকাশ করলেন। এই রচনা অল্পদিনেই জনপ্রিয় হয়ে উঠল। ধনী ও খ্যাতিমান ব্যক্তি হিসাবে বেঞ্জামিন ক্রমশই ফিলডেলফিয়া শহরে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন।

সমাজসংস্কারমূলক কাজে বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের অংশগ্ৰহণ

অর্থ উপার্জনের সাথে সাথে সমাজসংস্কারমূলক কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লেন বেঞ্জামিন। ইতিমধ্যে তিনি ফিলাডেলফিয়া শহরে একটি সংস্থা স্থাপন করেছিলেন। নাম “ডুটো”। এর উদ্দেশ্য ছিল সমাজের উন্নতিতে পারস্পরিক সহায়তা। এই সংস্থায় তিনি যেসব প্রবন্ধ পাঠ করতেন সেই অনুসারে নানান সমাজসংস্কার মূলক কাজকর্ম পরিচালনা করতেন।

বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের ভ্রাম্যমান লাইব্রেরি স্থাপন

  • (১) সমাজের প্রতি সমস্যার প্রতি তাঁর ছিল তীক্ষ্ণ দৃষ্টি । তিনি দেখেছিলেন দেশে উপযুক্ত গ্রন্থাগারের অভাব। অধিকাংশ মানুষই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অর্থের অভাবে বই কিনতে পারে না। সর্বত্র লাইব্রেরী স্থাপন করাও ব্যয়সাধ্য ব্যাপার।
  • (২) তাই ১৭৩০ সালে তিনি স্থাপন করলেন ভ্রাম্যমান লাইব্রেরী। আমেরিকায় এই ধরনের লাইব্রেরী এই প্রথম। এর জনপ্রিয়তা দেখে অল্পদিনেই আরো অনেক ভ্রাম্যমান লাইব্রেরী পড়ে ওঠে।

অর্থনীতিবিদ বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের আমেরিকায় বীমা কোম্পানি স্থাপন

১৭৩৭ সালে তিনি আমেরিকাতে প্রথম স্থাপন করলেন বীমা কোম্পানি। এই কোম্পানির কাজ ছিল আগুনে পুড়ে যাওয়া সম্পত্তির ক্ষতিপূরণ দেওয়া।

বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের ফিলাডেলফিয়া এ্যাকাডেমি গঠন

১৭৪৯ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন ফিলাডেলফিয়া এ্যাকাডেমি। এই এ্যাকাডেমি তাঁর জীবন কালেই পরিণত হয়েছিল ফিলাডেলফিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে।

দার্শনিক বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের আমেরিকায় প্রথম হাসপাতাল তৈরি

  • (১) বেঞ্জামিনের দৃষ্টিভঙ্গি যে কতখানি ব্যাপ্ত ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় হাসপাতাল নির্মাণের কাজে। ডাক্তার না হয়েও তিনি অনুভব করেছিলেন হাসপাতাল নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা। তাঁর বন্ধু ডাক্তার বন্ডকে পরামর্শ দিলেন হাসপাতাল তৈরির কাজে হাত দিতে।
  • (২) বেঞ্জামিনের আন্তরিক সহযোগিতায়, ডাক্তার বন্ডের প্রচেষ্টায় ১৭৫১ সালে আমেরিকায় গড়ে উঠল প্রথম হাসপাতাল। এইসব বহুমুখী কাজের মাধ্যমে বেঞ্জামিন হয়ে উঠেছিলেন আমেরিকার সর্বজন শ্রদ্ধেয় মানুষ।

বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের বৈজ্ঞানিক গবেষণা শুরু

  • (১) ১৭৪০-৪১ সাল নাগাদ তিনি বৈজ্ঞানিক গবেষণা কাজকর্ম শুরু করেন। আবিষ্কারক হিসাবে তার প্রথম উদ্ভাবন খোলা উনুন (Open stove)। এই উনুন অল্পদিনেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।
  • (২) বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে বিদ্যুৎ শক্তির প্রতি আগ্রহ ছিল সব চেয়ে বেশি। একদিন আকাশে ঘুড়ি ওড়াতে ওড়াতে আকাশের বিদ্যুৎ চমক দেখে প্রথম অনুভব করলেন আকাশের বিদ্যুৎ আর কিছুই নয়, বিদ্যুৎ এক ধরনের ইলেকট্রিসিটি।
  • (৩) ইতিপূর্বে মানুষের ধারণা ছিল আকাশে যে বিদ্যুৎ চমকায় তা দেবরাজ ডিউসের হাতের অস্ত্র। যখন তিনি মানুষকে ধ্বংস করতে চান তখনই তার এই অস্ত্র প্রয়োগ করেন। তাই আকাশে বিদ্যুৎ চমকালে মানুষ ভীত স্বন্ত্রস্ত হয়ে পড়ত, পূজা-অর্চনা করত। ফ্রাঙ্কলিন সেই ভ্রান্ত ধারণাকে চিরদিনের জন্য মুছে দিলেন।
  • (৪) তখন লিডেন জার উদ্ভাবিত হয়েছে। এই যন্ত্রের সহায্যে দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবার পর তিনি প্রমাণ করলেন বৈদ্যুতিক শক্তি দু ধরনের। একটিকে বলে নেগেটিভ, অন্যটিকে বলে পজেটিভ। তাঁর আবিষ্কৃত এই নতুন তত্ত্ব বৈদ্যুতিক গবেষণার ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী সংযোজন।

বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের আবিষ্কার সমূহ

  • (১) আধুনিক কালে আমরা যে টিউব লাইট দেখি তা উদ্ভাবনের ক্ষেত্রেও তাঁর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বৈদ্যুতিক শক্তি সংক্রান্ত এইসব আবিষ্কার, এই সব আবিষ্কারের গবেষণাপত্র তিনি প্রথম পেশ করেন লন্ডনের রয়াল সোসাইটিতে। তার পর থেকেই তাঁর খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
  • (২) ইংল্যান্ডে থাকাকালীন সময়ে সমুদ্রস্রোত, তার গতি, প্রকৃতি সম্বন্ধে কয়েকটি গবেষণাপত্র রয়াল সোসাইটিতে জমা দেন। এছাড়া তিনিই প্রথম বাইফোকাল লেন্সের ব্যবহার শুরু করেন। তাঁর বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার এবং এই সম্পর্কিত বিভিন্ন রচনা অল্পদিনেই ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের বিজ্ঞানী মহলে সাড়া জাগাল।
  • (৩) এই সমস্ত দেশের বিজ্ঞানীরা তাকে বিপুলভাবে সম্মান জানাল। ইংল্যান্ডের রয়াল সোসাইটি তাঁকে তাদের সদস্য হিসাবে নির্বাচিত করল। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডক্টর উপাধিতে ভূষিত করল।

পেনসিলভেনিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তি বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন

ইতিমধ্যে তিনি হয়ে উঠেছিলেন পেনসিলভেনিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তি। জনগণের তরফ থেকে তাঁকে সংসদ নির্বাচিত করা হল (১৭৫০)। এই সময় থেকে তিনি ক্রমশই রাজনৈতিক কাজকর্মে জড়িয়ে পড়লেন। তিনি চেয়েছিলেন আমেরিকার সমৃদ্ধি, শ্রীবৃদ্ধি।

প্রতিনিধি হিসেবে বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ

তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা বিচক্ষণতার জন্য তিনি আমেরিকার বিভিন্ন রাজ্যের তরফ থেকে প্রতিনিধি হিসাবে একাধিকবার ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড গিয়েছেন। যেখানেই তিনি গিয়েছেন সেখানেই পেয়েছেন অভূতপূর্ব সম্মান আর সম্বর্ধনা।

আমেরিকায় ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ

এদিকে সমস্ত দেশ জুড়ে ইংল্যন্ডের বিরুদ্ধে আমেরিকার অধিবাসীদের মনে ক্ষোভ জমে উঠতে থাকে। আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দেখা দিল।

দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের অবদান

  • (১) ১৭৭৫ সালের ১৯শে এপ্রিল আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ আরম্ভ হল। পরের মাসেই ফিলাডেলফিয়া শহরে আমেরিকান কংগ্রেসের অধিবেশন বসল। এখানেই জর্জ ওয়াশিংটনকে আমেরিকান বাহিনীর প্রধান হিসাবে নির্বাচিত করা হল।
  • (২) দেশের এই স্বাধীনতা যুদ্ধে অসাধারণ সাংগঠনিক প্রতিভা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন বেঞ্জামিন। তাঁকে আমেরিকার প্রতিনিধি হিসাবে পাঠানো হল ফ্রান্সে। তিনি অল্পদিনেই ফ্রান্সের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার জন্য অস্ত্র ও সৈন্য সংগ্রহ করলেন।

আমেরিকার সংবিধান রচয়িতা বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন

  • (১) ১৭৮৩ সালে আমেরিকার স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর তিনি দেশের উন্নয়নের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তাঁকে পেনসিলভেনিয়ার শাসন পরিষদের সভাপতি হিসাবে নির্বাচিত করা হল। নতুন আমেরিকা গড়ে উঠবার পর নতুন শাসনতন্ত্র রচনার প্রয়োজন দেখা দিল।
  • (২) তাই ডাক পড়ল বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের। তিনি আরো কয়েকজনের সহযোগিতায় রচনা করলেন আমেরিকার সংবিধান। এই সংবিধানের মধ্যে দিয়ে তিনি আধুনিক গণতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপন করলেন।
  • (৩) এই সময় তাঁর বয়স হয়েছিল একাশি। এই বয়সেও তিনি ছিলেন তরুণদের মতই উদ্যমী কর্মঠ। সকল মানুষের প্রতি ছিল তাঁর আন্তরিক ভালবাসা।

বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের দাসপ্রথা বিলোপের প্রয়াস

জীবনের অন্তিম পর্যায়ে এসে নিগ্রো দাসদের দুরবস্থা দেখে বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন। তাই দাসপ্রথা বিলোপের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি যে কাজের সূত্রপাত করেন, উত্তরকালে লিঙ্কন তা সমাপ্ত করেন।

বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের মৃত্যু

১৭৯০ সালে সামান্য রোগভোগের পর তাঁর মৃত্যু হয়।

উপসংহার :- বিজ্ঞান, দর্শন, রাজনীতি, অর্থনীতি-সর্বক্ষেত্রেই অসংখ্য রচনার মধ্যে দিয়ে তিনি নিজের অসামান্য প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। সমস্ত জীবন সেই লক্ষ্য পথেই অগ্রসর হয়েছেন। তাই তাঁর সম্বন্ধে এমাসর্ন বলেছেন, তিনি ছিলেন মানবজাতির সবচেয়ে হিতৈষী বন্ধু।

(FAQ) বিজ্ঞানী বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন কে ছিলেন?

একজন লেখক, চিত্রশিল্পী, রাজনীতিবিদ, রাজনীতিক, বিজ্ঞানী, সঙ্গীতজ্ঞ, উদ্ভাবক, রাষ্ট্রপ্রধান, কৌতুকবিদ, গণআন্দোলনকারী এবং কূটনীতিক।

২. আমেরিকার সংবিধান রচনা করেন কে?

বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন।

৩. আমেরিকায় প্রথম হাসপাতাল নির্মাণ করেন কে?

বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন।

৪. আমেরিকায় প্রথম বীমা কোম্পানি স্থাপন করেন কে?

বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন।

Leave a Comment