জর্জ ওয়াশিংটন

আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি জর্জ ওয়াশিংটন প্রসঙ্গে তার জন্ম, বংশ পরিচয়, ছেলেবেলা, শিক্ষা, বিবাহ, সেনাপ্রধান, আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ, সৈন সংগঠন, দরকারী মানুষ, প্রথম রাষ্ট্রপতি পদ গ্ৰহণ, দ্বিতীয়বারের জন্য রাষ্ট্রপতি পদ গ্ৰহণ ও তার মৃত্যু সম্পর্কে জানবো।

আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি জর্জ ওয়াশিংটন

ঐতিহাসিক চরিত্রজর্জ ওয়াশিংটন
জন্ম২২ ফেব্রুয়ারি, ১৭৩২ খ্রি:
দেশআমেরিকা
পরিচিতিআমেরিকার প্রথম রাষ্ট্রপতি
মৃত্যু১৪ ডিসেম্বর, ১৭৯৯ খ্রি:
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি জর্জ ওয়াশিংটন

ভূমিকা :- আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি জর্জ ওয়াশিংটন আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে কন্টিনেন্টাল আর্মির সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। তাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গঠনের প্রধান বলে উল্লেখ করা হয়। তিনি তার জীবদ্দশায় এবং এখনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতির জনক হিসেবে পরিচিত।

ওয়াশিংটনের জন্ম

১৭৩২ খ্রিস্টাব্দে ২২ ফেব্রুয়ারি আমেরিকায় ভার্জিনিয়াতে জর্জ ওয়াশিংটন জন্মগ্ৰহণ করেন।

ওয়াশিংটনের বংশ পরিচয়

তাঁর পূর্বপুরুষেরা ছিলেন ইংল্যান্ড-এর নর্দাম্পটন-সায়ারের অধিবাসী। জর্জের বাবা নিজের চেষ্টায় বেশ কিছু বিরাট বিরাট খামার গড়ে তুলেছিলেন। জর্জের বাবা প্রথম স্ত্রী মারা যাবার পর দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন। প্রথম স্ত্রীর একটি মাত্র ছেলে ছিল। দ্বিতীয় স্ত্রীর প্রথম সন্তান জর্জ।

ওয়াশিংটনের ছেলেবেলা

ছেলেবেলায় বাড়িতেই পড়াশুনা করতেন জর্জ। আর বাকি সময়ে খামার ঘুরে ঘুরে চাষবাস দেখাশুনা করতেন। যখন তাঁর এগারো বছর বয়স, অপ্রত্যাশিতভাবেই বাবা মারা গেলেন। জর্জের বৈমাত্রেয় ভাই লরেন্স শ্বশুরবাড়িতে থাকত। লরেন্সের শ্বশুর লর্ড ফেয়ারফ্যাক্স ছিলেন ভার্জিনিয়ার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি।

ওয়াশিংটনের শিক্ষা

লরেন্স জর্জকে নিয়ে এলেন নিজের কাছে। তিনিই জর্জের শিক্ষার বন্দোবস্ত করলেন। পাঁচ বছর ফেয়ারফ্যাক্স (Fairfax) পরিবারেই রয়ে গেলেন ওয়াশিংটন।

সহকারী সার্ভেয়ার ওয়াশিংটন

এই সময় সেনানডোয়া নামে এক উপত্যাকায় ষাট লক্ষ একর জমি কিনলেন লর্ড ফেয়ারফ্যাক্স। এই জমির মাপ করবার জন্য একদল সার্ভেয়ারকে সেখানে পাঠানো হল। জর্জ ওয়াশিংটনকে একজন সহকারী সার্ভেয়ার হিসাবে কাজে নিলেন ফেয়ারফ্যাক্স।

প্রধান সার্ভেয়ার ওয়াশিংটন

প্রতিকূলতা অসুবিধা সত্ত্বেও নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করলেন ওয়াশিংটন। যথাসময়ে কাজ শেষ হল। জর্জের কাজে খুশি হয়ে ফেয়ারফ্যাক্স তাঁকে প্রধান সার্ভেয়ারের পদে নিযুক্ত করলেন। তখন ওয়াশিংটনের বয়স মাত্র ১৭। দু’বছর প্রধান সার্ভেয়ার হিসাবে কাজ করলেন।

নিজের জমিদারিতে ওয়াশিংটনের প্রত্যাবর্তন

ভার্জিনিয়ার সেনাপতি হিসাবে তিনি মাত্র তিন বছর ছিলেন। তারপর স্বাস্থ্যের কারণে পদত্যাগ করে ফিরে এলেন নিজের জমিদারি মাউন্ট ভার্ননে।

ওয়াশিংটনের বিবাহ

এই সময় পরিচয় হল মার্থা ড্রামড্রিজের সাথে। ড্রামট্রিজ ছিলেন বিধবা, বিরাট জমিদারির মালিক। মার্থা আকৃষ্ট হলেন ওয়াশিংটনের ব্যক্তিত্বে। বিয়ে হল দুজনের। এই বিবাহিত জীবনে দুজনেই সুখী হয়েছিলেন। এর পরের সতেরো বছর তিনি জামিদারির কাজকর্ম নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন।

ভার্জিনিয়ার প্রতিনিধি ওয়াশিংটন

১৭৭৪ সালে ফিলাডেলফিয়া শহরে তেরোটি মার্কিন উপনিবেশের প্রতিনিধিদের প্রথম সম্মেলন বসল। জর্জ ওয়াশিংটন ছিলেন ভার্জিনিয়ার সবচেয়ে ধনী ও সম্মানীয় ব্যক্তি। তাঁকে ভার্জিনিয়ার প্রতিনিধি হিসাবে নির্বাচিত করা হল। এই অধিবেশনেই সমস্ত সদস্যদের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়ে উঠল ইংল্যন্ডের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ।

সেনাপ্রধান ওয়াশিংটন

পরের বছর দ্বিতীয় অধিবেশন বসল। এই অধিবেশনে সর্বসম্মতভাবে ওয়াশিংটনকে সমগ্র উপনিবেশের সেনাপ্রধান হিসাবে নিযুক্ত করা হল। ওয়াশিংটন স্ত্রীকে লিখলেন, “আমার ভাগ্য আমাকে এই পদ দিয়েছে।”

আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ

অবশেষে ৭ই জুন ১৭৭৬ তেরোটি প্রদেশের প্রতিনিধিরা সম্মিলিতভাবে আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণা করল। পাঁচজনের এক পরিচালনা গোষ্ঠী তৈরি হল। এর প্রধান হলেন টমাস জেফারেসন। ৪ঠা জুলাই ( 4th July) ১৭৭৬ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রচার করা হল। এতে স্বাধীনতা ঐক্যের কথা প্রচারিত হল। দেশের বিভিন্ন প্রদেশে শুরু হয়ে গেল ব্রিটিশ বাহিনীর সাথে আমেরিকানদের যুদ্ধ।

ওয়াশিংটনের সৈন সংগঠন

নানান প্রতিকূলতার মধ্যে ওয়াশিংটনকে তাঁর সৈন্যবাহিনী সংগঠিত করতে হয়েছিল। তাঁর সৈন্যদের মধ্যে খুব কমই ছিল নিয়মিত সৈন্য। তাদের যুদ্ধের অভিজ্ঞতাও ছিল না। উন্নত মানের অস্ত্রশস্ত্রও ছিল না। ওয়াশিংটন জানতেন তাঁর সেনাদলের সামর্থ্য নিতান্তই কম। তারা অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টের মধ্যে যুদ্ধ করে চলেছে। তাই পদমর্যাদার কথা ভুলে গিয়ে তাদের সাথে একাত্ম হয়ে গেলেন।

দরকারী মানুষ ওয়াশিংটন

ওয়াশিংটনের সৈনিকরা তাঁকে বলত “দরকারী মানুষ”। অথচ নিজের জীবনকে তিনি কখনো দরকারী বলে মনে করতেন না। একদিন অন্য সব সামরিক অফিসারদের সাথে খেতে বসেছেন, এমন সময় একটি রেড ইন্ডিয়ান ঘরে ঢুকে পড়ল। টেবিলের উপর রাখা মাংসের পুরো রোস্টটা তুলে নিয়ে খেতে আরম্ভ করল। তখন খাবারের ভীষণ অভাব। সকলে রেড ইন্ডিয়ানকে শাস্তি দেবার জন্য উঠে দাঁড়াতেই ওয়াশিংটন বাধা দিলেন। তিনি বললেন, ওকে ছেড়ে দাও, দেখে মনে হচ্ছে অনেকদিন ওর কিছু খাওয়া হয়নি।

সৈনিকদের সুযোগ-সুবিধার প্রতি ওয়াশিংটনের নজর

তাঁর দলের সৈনিকদের সুযোগ-সুবিধার দিকে তাঁর ছিল তীক্ষ্ণ নজর। একদিন কোনো একটি ক্যাম্পে একজন সৈনিক ঠাণ্ডা লেগে খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েছিল৷ সমস্ত রাত ধরে কাশছিল। শেষ রাতে হঠাৎ দেখতে পেল কেউ তার তাঁবুতে ঢুকছে। কাছে আসতেই চমকে উঠল স্বয়ং ওয়াশিংটন তাঁর কষ্ট দেখে চা নিয়ে এসেছেন।

আমেরিকার জয় লাভ

প্রথম দিকে ইংরেজ বাহিনী সাফল্যলাড করলেও শেষ পর্যন্ত তারা পিছু হটতে বাধ্য হল। দীর্ঘ পাঁচ বছর মরণপণ সংগ্রামের পর অবশেষে ইংরেজ সেনাপতি কর্ণওয়ালিশ ১৭৮১ সালে আত্মসমর্পণ করলেন। যুদ্ধে জয়ী হল আমেরিকানরা।

যুদ্ধ জয়ে ওয়শিংটনের ভূমিকা

এই যুদ্ধ জয়ের পেছনে ওয়শিংটনের ভূমিকার ছিল সবেচেয়ে বেশি। তাঁর ইচ্ছাশক্তি, সৈনিকদের প্রতি ভালবাসা এবং শৃঙ্খলাবোধ এই যুদ্ধে তাঁকে বিজয়ী নায়কের গৌরব দিয়েছিল।

ওয়শিংটনের সেনাপতির পদ ত্যাগ

আমেরিকায় স্বাধীনতা যুদ্ধের নায়ক হয়েও তার কোনো উচ্চাশা ছিল না। তিনি নিজের কর্তব্য শেষ করে প্রধান সেনাপতির পদ ত্যাগ করলেন। ফিরে এলেন নিজের জমিদারিতে। কিন্তু আমেরিকার মানুষ চাইছিল তাঁর অসামান্য কর্মকুশলতাকে কাজে লাগাতে।

আমেরিকার প্রথম রাষ্ট্রপতি জর্জ ওয়াশিংটন

১৭৮৭ সালে দেশের সংবিধান তৈরি করার জন্য সমস্ত প্রদেশের প্রতিনিধিরা সম্মিলিত হলেন। ওয়াশিংটনও সেখানে যোগ দিলেন। নতুন সংবিধানের রূপরেখা বর্ণনা করে সদস্যরা ঐক্যবদ্ধভাবে জর্জ ওয়াশিংটনকে রাষ্ট্রপতি হিসাবে নির্বাচিত করলেন। তিনি হলেন আমেরিকার প্রথম রাষ্ট্রপতি।

ওয়াশিংটন কর্তৃক দেশ ও জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান

  • (১) রাষ্ট্রপতি পদের দায়িত্বভার গ্রহণ করে প্রথমেই তিনি দেশ ও সমস্ত জাতিকে শান্তিপূর্ণভাবে ঐক্যবদ্ধ হবার আহ্বান জানালেন। তিনি জানতেন দেশের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন মত ও বিরোধী পক্ষ। সকলের সাহায্য ছাড়া এই শিশু রাষ্ট্রকে কখনোই গড়ে তোলা সম্ভবপর নয়।
  • (২) তাই তিনি তাঁর মন্ত্রিসভায় দুটি বিরোধী পক্ষকে একত্রিত করবার চেষ্টা করলেন। আলেকজান্ডার হ্যামিলটন ছিলেন রক্ষণশীল দলের প্রধান এবং ধনতন্ত্রের জোরালো সমর্থক। তাকে দেশের রাজস্ব বিভাগের ভার দেওয়া হল এবং টমাস জেফারসন ছিলেন গণতন্ত্রের সমর্থক, তাঁকে স্বরাষ্ট্র বিভাগের দায়িত্ব দিলেন।

ওয়াশিংটনের সঠিক সিদ্ধান্ত

  • (১) ওয়াশিংটন জানতেন দেশের সামনে এখন সমস্যা। একমাত্র যোগ্যতম ব্যক্তিরাই এই সমস্যার সমাধান করতে পারে। তাই সমস্ত দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে জেফারসন ও হ্যামিলটনকে রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বভার অর্পণ করেছিলেন। তাঁর এই সিদ্ধান্ত ছিল সঠিক।
  • (২) হ্যামিলটন ছিলেন সুদক্ষ সেনাপতি, দার্শনিক, আইনজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ। তিনি নানান কর বসিয়ে ইউনিয়ন সরকারের আয় বৃদ্ধির দিকে নজর দিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যে ঋণ হয়েছিল, সেই ঋণভার রাজ্য সরকারের হাত থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে তুলে দিলেন। জাতীয় ব্যাঙ্ক স্থাপন করা হল।

ওয়াশিংটনের বৈদেশিক নীতি

অভ্যন্তরীণ উন্নতির সাথে সাথে বিদেশী রাষ্ট্রের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলবার দিকে নজর দিলেন ওয়াশিংটন। এমনকি ব্রিটেনের সাথেও তিনি চেষ্টা করতে লাগলেন নতুন কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে।

ফরাসি বিপ্লবে ওয়াশিংটনের নিরপেক্ষ নীতি

১৭৮৯ সালে যখন ফরাসী বিপ্লব শুরু হল, তিনি বিপ্লবীদের সমর্থন করলেও নিরপেক্ষতার নীতি গ্রহণ করলেন। এর ফলে আমেরিকা প্রতিটি বিবদমান দেশেই বাণিজ্য করবার সুযোগ পেল।

দ্বিতীয়বারের রাষ্ট্রপতি ওয়াশিংটন

দেশের রাষ্ট্রপতি হিসাবে অসাধারণ যোগ্যতা প্রদর্শনের জন্য ১৭৯২ সালে তাঁকে দ্বিতীয়বারের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হিসাবে নির্বাচিত করা হল। দ্বিতীয় বারে নির্বাচন কাল শেষ হল।

ওয়াশিংটন কর্তৃক তৃতীয়বারের রাষ্ট্রপতি পদ প্রত্যাখ্যান

তাঁকে সকলেই অনুরোধ জানাল তৃতীয় বারের জন্য নির্বাচিত হতে। তিনি সবিনয়ে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বললেন, “ঈশ্বরকে ধন্যবাদ আমি কর্মক্ষম স্বাস্থ্যবান রয়েছি… শুধুমাত্র সেই কারণেই আমি এই পদ চাই না এটা শুধু অযৌক্তিক নয়, অপরাধ হবে যদি আমি পদ আঁকড়ে থাকি। হয়ত অপর কেউ আমার চেয়েও আরো ভালভাবে তার দায়িত্ব পালন করতে পারবে।”

উপসংহার :- তিনি ইংল্যান্ডের ক্রমওয়েলের মতই এক নতুন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা, কিন্তু ক্রমওয়েলের মত তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল না। তাঁকে যে মহান দায়িত্বভার অর্পণ করা হয়েছিল। তিনি সেই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছিলেন। তার পর সেই দায়িত্ব অন্যের উপর তুলে দিয়ে নিঃশব্দে বিদায় নিয়েছিলেন।

(FAQ) আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি জর্জ ওয়াশিংটন সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. জর্জ ওয়াশিংটন কে ছিলেন?

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি।

২. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতির জনক হিসেবে পরিচিত কে?

জর্জ ওয়াশিংটন।

৩. আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে সর্বাধিনায়ক কে ছিলেন?

জর্জ ওয়াশিংটন।

৪. জর্জ ওয়াশিংটন কতবার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন?

পর পর ২ বার।

Leave a Comment