আকবরের অভিভাবক বৈরাম খাঁ প্রসঙ্গে হুমায়ুনকে সাহায্য, আকবরের যোগ্য অভিভাবক, উজির পদ, দিল্লি উদ্ধারের সংকল্প, হিমুর আক্রমণ, পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ, আদিল শাহের হত্যা, সিকান্দার সুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা, লাহোর ও মুলতান জয়, জোনপুর জয়, তার কৃতিত্ব ও পতনের কারণ সম্পর্কে জানবো।
আকবরের অভিভাবক বৈরাম খাঁ
ঐতিহাসিক চরিত্র | বৈরাম খাঁ |
পরিচিতি | আকবর -এর অভিভাবক |
পদ | উজির |
মৃত্যু | ১৫৬০ খ্রি: |
ভূমিকা :- আকবরের হিতৈষী, বিপদের ও সঙ্কটের সময় নির্ভরযোগ্য মিত্র বৈরাম খাঁ, আকবরের পিতা হুমায়ুন -এর অধীনে চাকুরী নেন। বৈরাম খান ছিলেন পারসিক দেশীয় লোক। তিনি ছিলেন শিয়া ধর্মাবলম্বী।
বৈরাম খাঁ কর্তৃক হুমায়ুনকে সাহায্য
তিনি হুমায়ুনকে তাঁর রাজ্য পুনরুদ্ধারে বিশেষ সাহায্য করেন। এজন্য তিনি হুমায়ুনের বিশেষ আস্থা পান। হুমায়ুন তাকে আকবরের অভিভাবক নিয়োগ করেন। হুমায়ূনের মৃত্যুর পর বৈরাম খানের আনুগত্য ও বিশ্বস্ততার জন্য আকবর সিংহাসনে বসেন।
আকবরের যোগ্য অভিভাবক বৈরাম খাঁ
বৈরাম খাঁ তৈমুর বংশের প্রতি তার অবিচল আনুগত্য এবং সেবার জন্যই শুধুমাত্র আকবরের অভিভাবক হন নি। তাঁর অসাধারণ ফুটনৈতিক ও সামরিক দক্ষতা, পরিকল্পনা গঠনের ক্ষমতা এবং সাহস তাকে দরবারের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিজাতের মর্যাদা এনে দেয়। কাজেই আকবর তার বাল্যজীবনে এক অত্যন্ত বিশ্বস্ত ও যোগ্য অভিভাবকের নেতৃত্ব পান।
বৈরাম খাঁর উজীরের পদ গ্রহণ
আকবরের অভিভাবক হিসেবে বৈরাম খান খান-ই-খান উপাধি নেন। তিনি ‘ভকিলের’ বা উজীরের পদমর্যাদা গ্রহণ করেন।
বৈরাম খাঁর সময় হিমুর দিল্লি দখল
আকবরের অভিভাবক বৈরাম খাঁ পীর মহম্মদ শেরওয়ানিকে সেনাসহ তার্দ্দিবেগকে সাহায্যের জন্য দিল্লীর দিকে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু হিমু ইতিমধ্যে আগ্রা অধিকার করে দিল্লীর দিকে এগিয়ে আসেন। হিমু তুঘলকাবাদের যুদ্ধে তার্দ্দিবেগকে পরাস্ত করে দিল্লী অধিকার করেন। এই পরাজয়ের পর তার্দ্দিবেগ, পীর মহম্মদ প্রমুখ পাঞ্জাবে আকবরের শিবিরের দিকে পালান।
বৈরাম খাঁর দিল্লি উদ্ধারের সঙ্কল্প
দিল্লীর পতন হলে ভারত -এ মুঘল সাম্রাজ্য-এর ভবিষ্যৎ অন্ধকারময় হয়ে যায়। বৈরাম খাঁ উপলব্ধি করেন যে, পাঞ্জাবে সিকান্দর শূরের বিরুদ্ধে কালক্ষয় না করে অবিলম্বে দিল্লি উদ্ধার করা দরকার।
বৈরাম খাঁর বিরোধিতা
- (১) ইতিমধ্যে কর্তব্যে গাফিলতি করে দিল্লী হারাবার জন্য তার্দ্দিবেগকে বৈরাম খাঁ নিহত করেন। তাদিবেগের মত প্রবীণ তরী কর্মচারীকে হত্যা করায়, আকবর অন্যান্য কর্মচারীদের মনে বৈরামের বিরুদ্ধে ঘোর অসন্তোষ দেখা দেয়।
- (২) তারা মনে করেন যে, শিয়া ধর্মাবলম্বী, ইরানী বৈরাম নিজ উচ্চাকাক্ষা চরিতার্থ করার জন্য এরূপ প্রবীণ তুরানী বা মুঘলজাতীয় কর্মচারীকে পথের কাঁটা বলে নিহত করেছেন। এর ফলে আকবরের দরবারে ইরানী বৈরামের বিরুদ্ধে তুরানী বা তুর্কী জাতীয় আমীরদের বিরোধিতা দেখা দেয়।
বৈরাম খাঁর নেতৃত্বে হিমুর বিরুদ্ধে মুঘল বাহিনীর আক্রমণ
দিল্লির পতনের ফলে দিল্লী পুনরুদ্ধার করাকেই বৈরাম খান আপাতত প্রধান লক্ষ্য হিসেবে বেছে নেন। তাঁর নেতৃত্বে মুঘল বাহিনী দিল্লী উদ্ধারের জন্য এগিয়ে এলে পানিপথের প্রান্তরে হিমু তাদের গতিরোধ করেন। ইতিমধ্যে আকবরের সেনাপতি আলিকুলি খান অতর্কিত আক্রমণের দ্বারা হিমুর অরক্ষিত কামানগুলিকে অধিকার করে নিলে হিমুর বাহিনী দুর্বল হয়ে পড়ে।
পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ
এরপর হিমু ৫ই নভেম্বর, ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে পানিপথের প্রান্তরে মুঘল বাহিনীর সম্মুখীন হন এবং প্রবল বিক্রমে যুদ্ধ চালান। শুরু হয় পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ। দুর্ভাগ্যক্রমে হিমুর একটি চোখ মুঘল সেনার ছোড়া তীরে বিদ্ধ হলে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। এই সময় নেতার অভাবে আফগান বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।
বৈরাম খাঁর নেতৃত্বে হিমুর পতন
হিমু বন্দী অবস্থায় আকবরের শিবিরে আনীত হলে বৈরাম খাঁ নিজ হাতে তাঁর মাথা কেটে ফেলেন।
বৈরাম খাঁ কর্তৃক আদিল শাহের হত্যা
পানিপথের জয়ের পর বৈরাম খাঁ বিদ্রোহ দমনের জন্য বিভিন্ন দিকে বাহিনী পাঠান। হিমুর প্রভু মহম্মদ আদিল শাহকে বাংলার সুলতান খিজির খান ব্যক্তিগত শত্রুতাবশত হত্যা করলে আকবর অনেকটা স্বস্তি লাভ করেন।
সিকান্দার শাহর বিরুদ্ধে বৈরাম খাঁর যুদ্ধযাত্রা
পানিপথের যুদ্ধ জয়ের অব্যবহিত পরে বৈরাম খাঁ মুঘলের অন্যতম শত্রু সিকান্দার শাহ -এর বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। তিনি শিবালিক পার্বত্য অঞ্চল থেকে পাঞ্জাবে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করেন। মানকোট দুর্গে ৬ মাস মুঘল বাহিনীর বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার পর তিনি আত্মসমর্পণ করেন। বিহারে তাঁকে একটি জাগীর দেওয়া হলে, তিনি বিহারে চলে যান এবং সেখানেই মারা যান।
বৈরাম খাঁর লাহোর ও মূলতান জয়
সেনাপতি বৈরাম খাঁর নেতৃত্বে মুঘল বাহিনী লাহোর ও মুলতান অধিকার করে। ১৫৫৮ খ্রিস্টাব্দে আজমীরের শাসককে বিতাড়িত করে রাজপুতানার দরজা মুঘলের জন্য খুলে ফেলা হয়।
বৈরাম খাঁর জৌনপুর আক্রমণ
অতঃপর বৈরামের নির্দেশে মুঘল সেনাপতিরা সম্বল, কাল্পি জয় করার পর জৌনপুর আক্রমণ করে। পূর্ব ভারতের গাঙ্গেয় উপত্যকার প্রবেশ পথে জৌনপুর ছিল এক প্রধান রক্ষা স্থান। জৌনপুরের আফগান শাসক ইব্রাহিম শূর পরাজিত হলে, আফগানদের শেষ রক্ষা ব্যূহ ভেঙ্গে পড়ে।
বৈরাম খাঁর গোয়ালিয়র দুর্গ আক্রমণ
১৫৫৭ খ্রিস্টাব্দে বিজয়ী মুঘল বাহিনী গোয়ালিয়র দুর্গ আক্রমণ করে। নর্মদার উত্তরে গোয়ালিয়র ছিল সর্বাপেক্ষা দুর্ভেদ্য দুর্গ। গোয়ালিয়রের আফগান শাসক পরাজিত হলে উত্তর ভারতের নাভিকেন্দ্রের ওপর আকবরের অবিসংবাদী আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। বৈরাম খাঁ তার উজীরত্বের আমলে এইভাবে মুঘল শাসনের স্থায়ী ভিত্তি রচনা করেন।
বৈরাম খাঁ কর্তৃক আকবরের শক্তিকে গ্ৰানাইটের ভিত্তি প্রদান
- (১) ঐতিহাসিক জন রিচার্ডসের মতে, সুলতানী আমল হতে উত্তর ভারত বা মুসলিম শাসকরা যে অঞ্চলকে হিন্দুস্থান বলতেন তা ছিল কাবুল থেকে উত্তর প্রদেশের জৌনপুর, পাঞ্জাব থেকে আজমীর ও গোয়ালিয়র পর্যন্ত বিস্তৃত। তার মধ্যে প্রকৃত শক্তিকেন্দ্র ও সামরিক ব্যূহ ছিল লাহোর, দিল্লী, আগ্রা, জৌনপুর ও গোয়ালিয়র।
- (২) এই অঞ্চল জয় করার ফলে পরবর্তীকালে অবশিষ্ট ভারতে আকবরের সাম্রাজ্য বিস্তার সহজসাধ্য হয়। যদিও বৈরাম খাঁ রনথম্বোর ও মালব দখলে ব্যর্থ হন, তথাপি তিনি আকবরের শক্তিকে গ্রানাইটের ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেন।
বৈরাম খাঁর কৃতিত্ব
এইভাবে বৈরাম খানের শাসনকালে তার বিচক্ষণতার ফলে আকবরের সিংহাসন নিষ্কণ্টক হয়। কাবুল থেকে জৌনপুর এবং পাঞ্জাব থেকে আজমীর পর্যন্ত আকবরের সার্বভৌম ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়।
বৈরাম খাঁর পতনের কারণ
- (১) বৈরাম খাঁ কিন্তু বেশীদিন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকতে পারেন নি। মুঘল দরবারের সুন্নী ও তুরানী অভিজাতরা বৈরামের বিরুদ্ধে ঘোর অসন্তুষ্ট ছিলেন। কারণ বৈরাম ছিলেন শিয়া ও পারসিক। তার বিরুদ্ধে দরবারে গোপন ষড়যন্ত্র দেখা দেয়।
- (২) ঐতিহাসিক আবুল ফজল তাঁর আকবরনামা গ্ৰন্থে বলেছেন যে, বৈরাম খান হাতে সর্বময় ক্ষমতা পেয়ে স্বৈরাচারী ও অহঙ্কারী হয়ে পড়েন। তার ব্যক্তিগত আচরণ ঔদ্ধত্যপূর্ণ এবং অসহনীয় হয়ে ওঠে। এমনকি বৈরাম স্বয়ং আকবরের পারিবারিক খরচার বরাদ্দ অর্থ কমিয়ে দেন। সরকারি হস্তী বাহিনীর দায়িত্ব বৈরাম, আকবরের হাত থেকে কেড়ে নেন।
- (৩) এই সকল কারণে আকবর তার অভিভাবক ও প্রতিনিধির সম্পর্কে আস্থা হারিয়ে ফেলেন। এছাড়া মুঘল দরবারের সুন্নীগোষ্ঠী মনে করতেন যে, বৈরাম নিজ আত্মীয় এবং শিয়া ধর্মাবলম্বীদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখান। তিনি সুন্নী অভিজাতদের নায্য মর্যাদা ও বিভিন্ন পদ থেকে বঞ্চিত করেন।
- (৪) তারা আশঙ্কা করেন যে, বৈরাম শেষ পর্যন্ত সুখী ধর্মমতকে দমিয়ে শিয়া ধর্মমতকে প্রাধান্য দেবেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি শিয়া ধর্মাবলম্বী শেখ গদাইকে সদর-উস-সুদূরের পদে নিয়োগ করেন। এইভাবে বৈরামের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জমে ওঠে।
- (৫) আকবরের ধাত্রীমাতা মহম আনাগা ও তার পুত্র বৈরামের বিরুদ্ধে আকবরকে প্রভাবিত করেন। তাছাড়া আকবর বয়ঃপ্রাপ্ত হলে অভিভাবকদের নিয়ন্ত্রণ তার পক্ষে অসহনীয় হয়ে ওঠে। তিনি নিজ হাতে ক্ষমতা নিতে ব্যর্থ হন।
বৈরাম খাঁর পদচ্যুতি
আকবর বৈরামের আচরণ তীক্ষ্ণভাবে লক্ষ্য করছিলেন। বৈরাম, পীর মহম্মদকে তাঁর পদ থেকে অন্যায়ভাবে সরিয়ে সেই পদে জনৈক শিয়া ধর্মাবলম্বী পারসিককে নিয়োগ করলে আকবর একটি ফর্মান জারী করে বৈরাম খানকে পদচ্যুত করেন।
বৈরাম খাঁর মক্কা যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ
সেনাপতি বৈরাম খাঁ মক্কায় যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলে তাকে সাম্রাজ্যের সীমান্তে পৌঁছে দেওয়ার জন্য আকবর পীর মহম্মদকে নিয়োগ করেন। কিন্তু বৈরাম এতে অপমানিতবোধ করে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। কিছুদিন পরে বৈরাম বশ্যতা স্বীকার করেন। সম্রাট তাঁকে ক্ষমা প্রদর্শন করে মক্কা যাত্রার অনুমতি দেন।
বৈরাম খাঁর হত্যা
মক্কা যাওয়ার পথে গুজরাটের পাটানে জনৈক আফগান পূর্ব শত্রুতাবশত বৈরামকে হত্যা করে। বৈরামের বিধবা পত্নী সেলিমা বেগমকে আকবর বিবাহ করেন। বৈরামের পুত্র আবদুর রহিমকে আকবর পুত্রবৎ পালন করেন।
বৈরাম খাঁ সম্পর্কে স্মিথের মন্তব্য
ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ মন্তব্য করেছেন যে, তৈমুর বংশের দুঃসময়ে যে বৈরাম খান তাদের বিশ্বস্ত সেবক ছিলেন; আকবরের শৈশবকালে যে বৈরাম খান একনিষ্ঠভাবে বিশ্বস্ততার সঙ্গে তার সেবা করেন, তার প্রতি আকবর নায্য ব্যবহার করেন নি। বৈরামের বিরোধী পক্ষ তাকে অপমানিত করে বিদ্রোহ করতে বাধ্য করে। নবীন সম্রাট এই স্বার্থপর লোকেদের কথায় প্রভাবিত হয়ে তাঁর বিশ্বস্ত কর্মচারীর প্রতি অবিচার করেন।
উপসংহার :- আকবরের উচিত ছিল বৈরাম খাঁর প্রতি যথাযোগ্য মর্যাদা দেখিয়ে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করা। তা না করায় তাঁর মহানুভবতা ক্ষুণ্ণ হয়েছে।
(FAQ) বৈরাম খাঁ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
আকবরের অভিভাবক।
১৫৬০ সালে।
মাক্কা।
শিয়া মুসলিম।