সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠার পটভূমি হিসেবে লণ্ডন ঘোষণাপত্র, আটলান্টিক সনদ, ওয়াসিংটন সম্মেলন, মস্কো ঘোষণা, তেহরান ঘোষণা, ডাম্বারটন ওক্স সম্মেলন, ইয়াল্টা সম্মেলন ও সানফ্রান্সিসকো সম্মেলন সম্পর্কে জানবো।
সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠার পটভূমি
ঐতিহাসিক ঘটনা | সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের পটভূমি |
প্রতিষ্ঠা | ২৪ অক্টোবর, ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ |
উদ্দেশ্য | বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা |
প্রেক্ষাপট | দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ |
পূর্ববর্তী প্রতিষ্ঠান | জাতিসংঘ |
প্রেক্ষাপট | প্রথম বিশ্বযুদ্ধ |
ভূমিকা :- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির পর ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ২৪ শে অক্টোবর ‘সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ’ প্রতিষ্ঠিত হলেও এর উদ্যোগ শুরু হয়েছিল বেশ কয়েক বছর পূর্বেই।
সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠায় লণ্ডন ঘোষণাপত্র
১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে ইংল্যান্ড, কানাডা, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতিনিধিরা লন্ডনে সমবেত হয়ে একটি ঘোষণাপত্র মারফত বিশ্বের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা গঠনের প্রস্তাব করেন। এই ঘোষণাপত্র ‘লন্ডন ঘোষণাপত্র’ নামে পরিচিত।
সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠায় আটলান্টিক সনদ
১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ৯ ই আগস্ট মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল নিউ ফাউন্ডল্যান্ডের কাছে উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে ‘প্রিন্স অব ওয়েলস্’ নামে এক যুদ্ধজাহাজে গোপন বৈঠকে মিলিত হন এবং যুদ্ধোত্তর পর্বে বিশ্বশান্তি ও বিভিন্ন জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার সম্পর্কে এক ঘোষণাপত্র প্রকাশ করেন। এই ঘোষণাপত্র ‘আটলান্টিক সনদ’ নামে পরিচিত। এই সনদে ভবিষ্যৎ জাতিপুঞ্জের বীজ সুপ্ত ছিল। এই সনদে মোট আটটি নীতির কথা বলা হয়েছে। এগুলি হল –
- (১) ভবিষ্যতে কোনও রাষ্ট্র কোনোপ্রকার বিস্তার নীতি গ্রহণ করবে না,
- (২) সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের জনগণের মতামত উপেক্ষা করে কোনও রাষ্ট্রের সীমা নির্ধারণ করা হবে না,
- (৩) পরাধীন জাতিগুলির স্বাধীনতা লাভের অধিকার এবং নিজ রাষ্ট্রে জনসাধারণের ইচ্ছানুযায়ী সরকার গঠনের অধিকার থাকবে,
- (৪) ব্যবসা-বাণিজ্য ও অন্যান্য অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র-বৃহৎ, বিজিত-বিজেতা সব রাষ্ট্রেরই সমান অধিকার থাকবে,
- (৫) সামাজিক নিরাপত্তা, জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন, শ্রমিকদের অবস্থার উন্নয়ন প্রভৃতি ব্যাপারে বিভিন্ন রাষ্ট্র পারস্পরিক সহযোগিতার নীতি গ্রহণ করবে,
- (৬) নাৎসি ও ফ্যাসিবাদী শক্তির পরাজয়ের পর প্রত্যেক রাষ্ট্র যাতে বৈদেশিক আক্রমণের ভীতি ও অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক অনটন থেকে মুক্ত হয়ে অভ্যন্তরীণ উন্নয়নে আত্মনিয়োগ করতে পারে তার অনুকুল পরিবেশ গঠন করা হবে,
- (৭) বিশ্বের সমুদ্রপথগুলি সব রাষ্ট্রের জন্য সমভাবে উন্মুক্ত থাকবে এবং
- (৮) সমস্ত রাষ্ট্রকে অস্ত্রশস্ত্র, সামরিক সাজসরঞ্জাম ও সেনাবাহিনীর সংখ্যা হ্রাস করে পৃথিবীর শান্তি ও নিরাপত্তা বিধানে সচেষ্ট হতে হবে।
আটলান্টিক সনদে স্বাক্ষর
অল্পদিনের মধ্যেই ফ্রান্স, পোল্যান্ড, বেলজিয়াম, চেকোশ্লোভাকিয়া, যুগোশ্লাভিয়া, গ্রিস, নরওয়ে, সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রভৃতি আরও ১৫টি রাষ্ট্র এই সনদে স্বাক্ষর করে।
সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠায় ওয়াশিংটন সম্মেলন
১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে আমেরিকার রাজধানী ওয়াশিংটনে এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, সোভিয়েত রাশিয়া, চীন প্রভৃতি ২৬টি দেশের প্রতিনিধিবর্গ আটলান্টিক সনদের মূল নীতিগুলি মেনে নিয়ে ‘সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের ঘোষণাপত্র’ নামে এক দলিলে স্বাক্ষর করেন। এটি ‘রাষ্ট্রসঙ্ঘের ঘোষণা’ বা ‘ইউনাইটেড নেশনস্ ডিক্লারেশন’ নামে পরিচিত। এই দলিলে আটলান্টিক সনদের সব শর্তই সন্নিবিষ্ট ছিল। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট বিশিষ্ট ইংরেজ কবি লর্ড বায়রন-এর ‘চাইল্ড হেরাল্ড” নামক কবিতা থেকে ‘ইউনাইটেড নেশনস্’ শব্দ দুটি চয়ন করেছিলেন।
সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠায় মস্কো ঘোষণা
১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ৩০শে অক্টোবর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত রাশিয়া, ব্রিটেন ও চিনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীগণ মস্কোয় মিলিত হয়ে একটি যুগ্ম ইস্তাহার প্রকাশ করেন। তাঁরা এই ইস্তাহারে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার উদ্দেশ্যে একটি আন্তর্জাতিক সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা ব্যক্ত করেন। তারা বলেন যে, বিশ্বের শান্তিকামী সব দেশের জন্যই এই সংগঠনের দ্বার উন্মুক্ত থাকবে। এই ইস্তাহার বা ঘোষণাপত্র ‘মস্কো ঘোষণা’ নামে পরিচিত।
সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠায় তেহরান ঘোষণা
১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ১লা ডিসেম্বর চার্চিল, রুজভেন্ট ও স্ট্যালিন তেহরানে এক সম্মেলনে মিলিত হয়ে যুদ্ধ-সংক্রান্ত ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা করেন এবং যুদ্ধাবসানে পৃথিবীতে স্থায়ী শাস্তি প্রতিষ্ঠার কথাও ঘোষণা করেন। এই ঘোষণায় তাঁরা ক্ষুদ্র-বৃহৎ সমস্ত রাষ্ট্রের সহযোগিতায় পৃথিবী থেকে সমস্ত রকম অনাচার, অত্যাচার, দাসত্ব, দমননীতি ও অসহিষ্ণুতা দূর করে পৃথিবীতে এক বৃহত্তর রাষ্ট্র-পরিবার গঠনের সংকল্প ঘোষণা করেন। এই ঘোষণায় একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান স্থাপনের প্রয়োজনীয়তাও স্বীকৃত হয়।
সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠা ডাম্বারটন ওক্স সম্মেলন
- (১) ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ওয়াশিংটনের সন্নিকটে ডাম্বারটন ওক্স্ নামক স্থানে ইংল্যান্ড, আমেরিকা, সোভিয়েত রাশিয়া, চিন প্রভৃতি বৃহৎ রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের কাঠামো ও রূপরেখা নিয়ে বিশদ আলোচনা করেন।
- (২) স্থির হয় যে, জাতিপুঞ্জের একটি সাধারণ সভা, নিরাপত্তা পরিষদ, সদর দপ্তর, বিচারালয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ এবং একটি সামরিক স্টাফ কমিটি থাকবে। এই সংগঠনের প্রধান লক্ষ্য হবে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বিধান।
- (৩) বিশ্বের সব শান্তিকামী দেশই এই সংস্থার সভ্য হওয়ার যোগ্য এবং সমস্ত সভ্যই সমমর্যাদা ও কর্তৃত্বের অধিকারী। এই সম্মেলনে বৃহৎ রাষ্ট্রগুলির ‘ভেটো’ বা নিরাপত্তা পরিষদে একক বিরোধিতায় কোনও প্রস্তাব নাকচ করার অধিকার নিয়ে মতপার্থক্য দেখা দেয়। স্থির হয় যে, পরে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।
সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠায় ইয়াল্টা সম্মেলন
১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে ক্রিমিয়ার ইয়াল্টা নামক স্থানে রুজভেল্ট, চার্চিল ও স্ট্যালিন এক সম্মেলনে মিলিত হন। ইয়াল্টা সম্মেলন -এ ‘ভেটো’ সমস্যা নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় এবং স্থির হয় যে, জাতিপুঞ্জের সনদের খসড়া চূড়ান্ত করার জন্য আগামী ২৫শে এপ্রিল আমেরিকার সানফ্রান্সিসকো শহরে এক সম্মেলন আহ্বান করা হবে।
সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠায় সানফ্রান্সিসকো সম্মেলন
১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ২৫শে এপ্রিল থেকে ২৬শে জুন পর্যন্ত আমেরিকার সানফ্রান্সিসকো শহরে বিশ্বের ৫০টি দেশের প্রতিনিধিবর্গ সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের উদ্দেশ্য, নীতি, গণতন্ত্র প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে বিশদ ও পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা করেন এবং ৫১টি রাষ্ট্র ২৬ শে জুন সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সনদে প্রথমবার স্বাক্ষর করে।
উপসংহার :- ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ২৪শে অক্টোবর থেকে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সনদ আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকরী হয়, অর্থাৎ এই দিনটিকে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের প্রতিষ্ঠা দিবস হিসেবে ধরা হয়।
(FAQ) সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠার পটভূমি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
২৪ অক্টোবর, ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে।
আন্তর্জাতিক শান্তি প্রতিষ্ঠা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।