আলাউদ্দিন খলজির সমস্যা

আলাউদ্দিন খলজির সমস্যা প্রসঙ্গে অভ্যন্তরীণ সমস্যা হিসেবে অভিজাতদের চক্রান্ত, অন্তর্দ্বন্দ্ব, ইক্তা নির্ভর রাজস্ব ব্যবস্থা, উলেমা শ্রেণীর নিয়ন্ত্রণ ত্যাগ, শাসন ব্যবস্থা ডক্টর অমলেশ ত্রিপাঠীর মন্তব্য ও আলাউদ্দিনের রাজতান্ত্রিক আদর্শ সম্পর্কে জানবো।

আলাউদ্দিনের সমস্যাসমূহ

ঐতিহাসিক ঘটনাআলাউদ্দিনের সমস্যা
সুলতানআলাউদ্দিন খলজি
পূর্ব নামআলি গুরুশাস্প
সিংহাসনে আরোহণ১২৯৬ খ্রি:
পূর্বসূরিজালালউদ্দিন ফিরোজ খলজি
উত্তরসূরিসুলতান কুতুবউদ্দিন মোবারক খলজি
আলাউদ্দিনের সমস্যাসমূহ

ভূমিকা :- আলাউদ্দিন খলজি ছিলেন একজন প্রতিভাবান, বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন সুলতান। তিনি বুঝেছিলেন যে, সিংহাসন আরাম বা বিলাসের স্থান নয়।

আলাউদ্দিনের আভ্যন্তরীণ সমস্যা

চতুর্দশ শতকে দিল্লী সুলতানি সিংহাসনের সম্মুখে বহু সমস্যা ছিল। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে সুলতানের কর্তৃত্ব নিষ্কণ্টক ছিল না। যেমন –

(১) অভিজাতদের চক্রান্ত

উচ্চাকাঙ্ক্ষী অভিজাতরা সর্বদা সুলতানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের চক্রান্ত করত এবং ঘন ঘন বিদ্রোহের দ্বারা সুলতানের ক্ষমতাকে ধ্বসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করত।

(২) অন্তর্দ্বন্দ্ব

গিয়াসউদ্দিন বলবন-এর আমল থেকে দিল্লী সুলতানি অন্তর্দ্বন্দ্বে দুর্বল হয়ে পড়ার ফলে হিন্দু রাজারা স্বাধিকার প্রমত্ত হয়ে পড়ে এবং সুলতানি সাম্রাজ্য-এর সীমা একই স্থানে দাঁড়িয়ে থাকে। বিস্তার নীতি না থাকায় অভিজাতরা অলস ও অন্তর্দ্বন্দ্বে সময় কাটায়।

(৩) ইক্তা নির্ভর রাজস্ব ব্যবস্থা

সুলতানি রাজস্ব ব্যবস্থা ইক্তা নির্ভর হয়ে পড়ায় রাজকোষ শূন্য হয়ে যায়। এদিকে রাজ আদর্শের বিশেষ দুটি দিক লক্ষ্যণীয়। প্রথমত, খলজি সুলতানরা অর্থাৎ আলাউদ্দিন প্রমাণ করেন যে, সুলতানের পদ কোনো বিশেষ গোষ্ঠী বা জাতির একচেটিয়া নয়।

(৪) উলেমা শ্রেণির সমর্থন

দ্বিতীয় উলেমা শ্রেণীর অথবা খলিফার সমর্থন এবং অনুমোদন ব্যতীত সুলতান রাজ্য শাসন করতে সক্ষম। আলাউদ্দিন খলিফার ফর্মান লাভের কোনো উদ্যোগ নেন নি। তিনি নিজ যোগ্যতা ও সামরিক ক্ষমতার জোরেই তাঁর সিংহাসন রক্ষা করেন।

(৫) শরিয়তী আইন

দিল্লীর সুলতানরা মুসলিম রীতি অনুসারে শরিয়তী আইন মেনে চলতেন। শরিয়তী আইনের ব্যাখ্যাকার ছিলেন উলেমাগণ। ফলে উলেমাদের কথামত সুলতানকে আইন, বিচার, রাজস্ব ও প্রশাসন পরিচালনা করতে হত।

উলেমা শ্রেণির নিয়ন্ত্রণ ত্যাগ

আলাউদ্দিন এই ব্যাপারে উলেমাদের মতামতের গুরুত্ব দেননি। তিনি বিয়ানার বিখ্যাত কাজী মুঘিসুন্দিনকে বলেন যে, “আমি জানি না কি আপনাদের মতে বৈধ বা অবৈধ, রাষ্ট্রের পক্ষে আমি যা প্রয়োজনীয় মনে করি, আমি তাই করি।”

আলাউদ্দিনের শাসন ব্যবস্থা

তিনি এজন্য শরিয়তী ধরনের কর ব্যবস্থা বাদ দিয়ে প্রয়োজন মত নতুন কর স্থাপন করেন। শাসনব্যবস্থায় তিনি উলেমাদের পরামর্শ নিতেন না। কাজেই আলাউদ্দিনের শাসন ব্যবস্থাকে ধর্মাশ্রিত রাজতন্ত্র বলা যায় না। ব্যক্তিগতভাবে তিনি সুন্নী ধর্মে আস্থাবান ছিলেন। কিন্তু রাজ্যশাসনের ব্যাপারে তিনি নিজ মতে চলতেন।

ত্রিপাঠীর মন্তব্য

ডঃ ত্রিপাঠী মন্তব্য করেছেন যে, “আলাউদ্দিন প্রমাণ করেন যে ধর্মগুরু বা উলেমাদের চিন্তাধারা এবং শাসক হিসেবে সুলতানের চিন্তাধারা স্বতন্ত্র হতে বাধ্য” (The outlook of a King was very different from that of a clergy)

আলাউদ্দিনের রাজতান্ত্রিক আদর্শ

  • (১) আলাউদ্দিনের রাজতান্ত্রিক আদর্শকে বিচার করতে হলে তার হিন্দু নীতি আলোচনা করা দরকার। বরণীর মত গোঁড়া লেখক ফুতুহা-ই-জাহান্দারী গ্রন্থে দাবী করেছেন যে, “যে কোনো মুসলিম শাসকের উচিত বিধর্মীদের উচ্ছেদ করা।”
  • (২) কিন্তু আলাউদ্দিন মোল্লা সম্প্রদায়ের এই দাবীতে কর্ণপাত করেন নি। প্রকৃতপক্ষে সকল দিল্লী সুলতান বাস্তব বুদ্ধির দ্বারা বুঝেন যে ভারতবর্ষে অমুসলিমদের সঙ্গে মুসলিমদের পাশাপাশি বাস করতে হবে। আলাউদ্দিন এই কথা আরও ভালভাবে বুঝেন।
  • (৩) যে সকল হিন্দু রায়, রণক ঠাকুর তাঁর বশ্যতা স্বীকার করেন তিনি তাদের অধিকার বহাল রাখেন। তিনি হিন্দু সম্প্রদায়ের চিরাচরিত জীবনধারায় কোন হস্তক্ষেপ করেননি। এজন্য তাকে খাঁটি শরিয়তী মতের শাসক বলা চলে না।

হাবিবের মন্তব্য

অধ্যাপক হাবিবের মতে আলাউদ্দিন জানতেন যে অমুসলিম প্রজারা যে কর প্রদান করে তার দ্বারা সুলতানির ব্যয় নির্বাহ হয়। এজন্য তাদের ধর্মবিশ্বাসে আঘাত করার কথা তিনি কখনও ভাবেননি। কোনো কোনো ঐতিহাসিক প্রশ্ন করেন যে, আলাউদ্দিনের রাজতান্ত্রিক আদর্শকে ধর্মনিরপেক্ষ (Secular) বলা যায় কি না?

  • (১) ডঃ এ. এল. শ্রীবাস্তবের মতে, “আলাউদ্দিনই দিল্লীর প্রথম সুলতান হিসেবে এই কৃতিত্ব দাবী করতে পারেন যে, তিনি ধর্মীয় সম্প্রদায়কে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে আনেন এবং তাত্ত্বিক দিক হতে রাষ্ট্রকে ধর্মনিরপেক্ষ করার ক্ষেত্র তৈরি করেন।”
  • (২) যদিও আলাউদ্দিন বাক্তিগত জীবনে ইসলামের আদর্শ পালন করতেন, কিন্তু রাষ্ট্র শাসনের ক্ষেত্রে তিনি উলেমাদের বিধান মেনে চলতেন না। বৈদেশিক ক্ষেত্রে সুলতানি সিংহাসন মোঙ্গল আক্রমণের চাপে বিপন্ন হয়ে পড়ে।

উপসংহার :- আলাউদ্দিন সিংহাসনে নিজ অধিকার দৃঢ়ভাবে স্থাপন করার পর এই সকল সমস্যাগুলি সমাধানে আত্মনিয়োগ করেন। এই কারণে তাঁর রাজত্বকাল ছিল আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ক্ষেত্রে ঘটনাবহুল, বহু প্রকার সংস্কার ও শাসনতান্ত্রিক পরীক্ষার দ্বারা সূচিত। ইলবারি সুলতানদের অপেক্ষাকৃত ঘটনাহীন সাদামাটা শাসননীতির তুলনায় আলাউদ্দিনের শাসনকাল ছিল বহু বর্ণে রঞ্জিত ঘটনাবহুল যুগ।

(FAQ) আলাউদ্দিন খলজির সমস্যা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. কোন সুলতান উলেমা শ্রেণির বিধান মানতেন না?

আলাউদ্দিন খলজি।

২. ফুতুহা-ই-জাহান্দারী গ্ৰন্থ কার লেখা?

জিয়াউদ্দিন বরণী।

৩. খলজি বংশের শ্রেষ্ঠ সুলতান কে ছিলেন?

আলাউদ্দিন খলজি।

৪. আলাউদ্দিন খলজি কবে সিংহাসনে আরোহণ করেন?

১২৯৬ খ্রিস্টাব্দে।

Leave a Comment