আলাউদ্দিন খলজির দিল্লির সিংহাসন দখল

আলাউদ্দিন খলজির সিংহাসন লাভ ও দিল্লি অধিকার প্রসঙ্গে আরকালি খানের মূলতান গমন, আলাউদ্দিনের দিল্লী যাত্রা, রুকন উদ্দিনের পলায়ন, আলাউদ্দিনের দিল্লি দখল, ক্ষমতা দৃঢ়ীকরণ, সিংহাসন কন্টক মুক্ত করা ও সিংহাসন লাভে অভিজাতদের সমর্থন সম্পর্কে জানবো।

আলাউদ্দিন খলজির সিংহাসনারোহণ ও দিল্লি অধিকার

ঐতিহাসিক ঘটনাআলাউদ্দিন খলজির সিংহাসনারোহণ ও দিল্লি অধিকার
সুলতানআলাউদ্দিন খলজি
রাজত্ব১২৯৬-১৩১৬ খ্রি:
বংশখলজি বংশ
প্রতিষ্ঠাতাজালালউদ্দিন ফিরোজ খলজি
আলাউদ্দিন খলজির সিংহাসনারোহণ ও দিল্লি অধিকার

ভূমিকা :- জালালউদ্দিন খলজির হত্যার খবর পেয়ে তাঁর পত্নী মালিকাজাহান তার পুত্র রুকনউদ্দিন ইব্রাহিমকে দিল্লীর সুলতানি সিংহাসনে বসিয়ে দেন। তিনি জালালী মালিক বা অভিজাতদের ইক্তা দান করে তাঁর পুত্রের পক্ষে সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেন।

আরকালি খানের মূলতান গমন

জালালউদ্দিনের অন্যতম পুত্র আরকালি খান তার মাতার ব্যবহারে অসন্তুষ্ট হয়ে দিল্লী হতে দূরে মূলতানে চলে যান।

আলাউদ্দিনের দিল্লী যাত্রা

আলাউদ্দিন তার বাহিনী নিয়ে কারা বা অযোধ্যা থেকে দিল্লী যাত্রা করেন। পথে ধনরত্ন বিলিয়ে তিনি বহু সৈন্য-সামন্ত যোগাড় করেন। আলাউদ্দিন দেবগিরি থেকে আনীত ধনরত্নের দ্বারা অধিকাংশ জালালী অভিজাতদের কিনে নেন।

রুকন উদ্দিনের পলায়ন

আলাউদ্দিন দিল্লীর উপকণ্ঠে যমুনা তীরে উপনীত হলে রুকনউদ্দিনের সমর্থক সৈন্যদল আলাউদ্দিনের পক্ষে যোগ দেয়। রুকনউদ্দিন তার মাতাসহ দিল্লী থেকে মূলতানের দিকে পালিয়ে যান।

আলাউদ্দিনের দিল্লী দখল

আলাউদ্দিন বিনা বাধায় দিল্লী অধিকার করে ১২৯৬ খ্রিস্টাব্দের ৩রা অক্টোবর নিজেকে সুলতান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। দিল্লীর জনসাধারণের মধ্যে ধনরত্ন বিতরণ করে তাদের সমর্থন তিনি নিয়ে নেন।

সরকারি পদে নিয়োগ

সিংহাসনে বসার পর আলাউদ্দিন অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে তিন শ্রেণীর লোকেদের সরকারী পদে নিয়োগ করেন। যথা –

  • (১) যে সকল তুর্কী অভিজাত তখনও জীবিত ছিলেন তাদের বিভিন্ন পদ দেওয়া হয়।
  • (২) জালালউদ্দিনের আমলের যে সকল কর্মচারী আলাউদ্দিনের প্রতি বশ্যতা জানান তাদের বিভিন্ন পদ দেওয়া হয়।
  • (৩) এছাড়া আলাউদ্দিনের নিজের বিশ্বাসী লোকদেরও নিয়োগ করা হয়। এই তিন গোষ্ঠীর স্বার্থকে সম্মিলিত করে আলাউদ্দিন গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের সম্ভাবনা দূর করেন।

সমালোচনার পথ বন্ধ

  • (১) তিনি ইলবারী আমলের অভিজাত খাজা খতিরকে উজিরের পদে নিয়োগ করেন। জালালী অভিজাতরাও উচ্চপদ পান। আলাউদ্দিনের কনিষ্ঠ ভ্রাতা আসলাম খাঁ দরবারের প্রধান অভিজাতের পদ পান। তাঁর উপাধি হয় উলুগ খাঁ।
  • (২) আলাউদ্দিন সেনাদের ৩ মাসের বাড়তি বেতন পুরস্কার দেন। এইভাবে ব্যাপক উচ্চপদে নিয়োগ ও অর্থ বিতরন দ্বারা আলাউদ্দিন তাঁর পিতৃব্য হত্যার সমালোচনার পথ বন্ধ করেন।

বরণীর মন্তব্য

আলাউদ্দিনের এই বাস্তবনীতির প্রশংসা করে বরণী বলেছেন যে, “সুলতান আলাউদ্দিনের দরবার জালালী, আলাই ও মালিকদের সমবায়ে যেরূপ গঠিত হয়, এর আগে কখনও সেরূপ হয়নি।”

ক্ষমতা দৃঢ়ীকরণ

আলাউদ্দিন তাঁর রাজত্বের প্রথম দুই বৎসর তার ক্ষমতাকে দৃঢ় ভিত্তিতে স্থাপন করার কাজে ব্যয় করেন। তুর্কী ও জালালী অভিজাতদের প্রতি উদারতার দ্বারা তিনি তাদের আনুগত্য পান।

সিংহাসন কন্টকমুক্ত করা

তার ক্ষমতা দৃঢ় করার পর তিনি মূলতান আক্রমণ করে জালাউদ্দিনের দুই পুত্র আরকালি খান ও রুকনউদ্দিনকে হত্যা করে কারারুদ্ধ করেন এবং কারাগারে তাদের মৃত্যু হয়। এইভাবে আলাউদ্দিন তার সিংহাসনকে নিষ্কণ্টক করেন।

অভিজাতদের দমন

  • (১) এরপর তিনি তুর্কী ও জালালী অভিজাতদের দমন করার কাজে হাত দেন। বরণীর মতে, তুর্কী মালিকদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও সুলতানের সমকক্ষতা দাবী আলাউদ্দিন সহ্য করতে চাননি। এজন্য তিনি তাদের শেষ পর্যন্ত ধ্বংস করেন।
  • (২) যে সকল জালালী আমীর সুলতান জালালউদ্দিনের পক্ষ ছেড়ে তার পক্ষে চলে আসেন, তিনি তাদেরও বিশ্বাস করতেন না। প্রথম দুই বৎসর তিনি নিজ ক্ষমতা দৃঢ় করার জন্য তাদের বিভিন্ন পদ দেন।
  • (৩) মূলতানে জালালউদ্দিনের পুত্রদের কারারুদ্ধ করার পর তিনি এই সকল জালালী অভিজাতদের হয় হত্যা নয় অন্ধ করে দেন। অভিজাতদের ধন-সম্পত্তি, গৃহ, ইক্তা সকল কিছু বাজেয়াপ্ত করা হয়।
  • (৪) একমাত্র তিনজন জালালী আমীরকে তিনি অব্যাহতি দেন। এই তিনজন শেষ পর্যন্ত তাদের প্রভু জালালউদ্দিনের পক্ষ ত্যাগ করেননি। এজন্য আলাউদ্দিন তাদের সম্মান ও স্বীকৃতি দেন।

সিংহাসন লাভে অভিজাতদের সমর্থন

মামেলুক মালিক ও জালালী আমীরদের ধ্বংস করার পশ্চাতে আলাউদ্দিনের এক গূঢ় উদ্দেশ্য ছিল বলে ডঃ নিজামী বলেছেন। এই সকল অভিজাত তাকে সমর্থন না করলে আলাউদ্দিনের পক্ষে সহজে সুলতানি সিংহাসন লাভ সম্ভব হত না। এজন্য তারা আলাউদ্দিনের কাছে প্রচুর অর্থ নেন।

অভিজাতদের ধ্বংসের পশ্চাতে উদ্দেশ্য

  • (১) সুলতান জালালউদ্দিনের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে তার পক্ষে চলে আসায় এই অভিজাতদের আলাউদ্দিন প্রকৃত বিশ্বাস করতেন না। তাঁর আশঙ্কা ছিল যে, এঁরা সুযোগ পেলে তাঁর বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা করবেন।
  • (২) এই সকল মামেলুক ও জালালী অভিজাতরা মনে করতেন যে, আলাউদ্দিন তাদের সাহায্যেই সিংহাসনে বসেছেন। সুতরাং তারা আলাউদ্দিনের সমকক্ষতা চাইতেন। দরবারে বসেই এঁরা রাজদ্রোহিতামূলক আচরণ করেন। এজন্যই আলাউদ্দিন এদের ধ্বংস করেন।

উপসংহার :- আলাউদ্দিনের পরিকল্পনা ছিল ভারত -এর বিভিন্ন অঞ্চলে সুলতানি সাম্রাজ্য বিস্তার, শাসন ও অর্থনৈতিক সংস্কার। এরূপ দ্বিধাগ্রস্থ আমলাতন্ত্র নিয়ে তার পক্ষে রাজ্য জয়, মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিহত করা ও সংস্কার প্রবর্তন করা সম্ভব ছিল না। তবে অভিজাতদের দমন করতে আলাউদ্দিন ঘোর নিষ্ঠুরতা দেখান এতে সন্দেহ নেই।

(FAQ) আলাউদ্দিন খলজির সিংহাসন লাভ ও দিল্লি অধিকার সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. খলজি বংশের শ্রেষ্ঠ সুলতান কে ছিলেন?

আলাউদ্দিন খলজি।

২. কোন সুলতান সিকান্দার-ই-সানি নামে পরিচিত?

আলাউদ্দিন খলজি।

৩. কোন সুলতান প্রথম দাক্ষিণাত্য অভিযান করেন?

আলাউদ্দিন খলজি।

৪. আলাউদ্দিন খলজির রাজত্বকাল কত?

১২৯৬-১৩১৬ খ্রিস্টাব্দ।

Leave a Comment