আলাউদ্দিন খলজির বাজার দর নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে উপাদান, বাজার দর নিয়ন্ত্রণের কারণ, তিনটি নীতি, প্রচলিত এলাকা, মূল্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, মূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রশাসন ব্যবস্থা, মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতির ফলাফল ও মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতির বহাল থাকার কারণ সম্পর্কে জানবো।
আলাউদ্দিন খলজির বাজার দর নিয়ন্ত্রণ
ঐতিহাসিক ঘটনা | বাজার দর নিয়ন্ত্রণ |
প্রবর্তক | আলাউদ্দিন খলজি |
তারিখ-ই-ফিরোজশাহী | জিয়াউদ্দিন বরণী |
শাহানা-ই-মান্ডি | মালিক কাবুল |
দেওয়ান-ই-রিয়াসত | মালিক ইয়াকুব |
ভূমিকা :- আধুনিক জার্মানির নির্মাতা বিসমার্ক -এর মতো আলাউদ্দিনেরও বিশ্বাস ছিল, যে কোনো সমস্যার সমাধান করতে পারে একমাত্র তলোয়ার। এই বিশ্বাসেই তিনি বিশাল এক স্থায়ী সেনাবাহিনী গঠন করেন। জিয়াউদ্দিন বরণীর মতে, অল্প বেতনে এই বিশাল সেনা পালনের উদ্দেশ্যই আলাউদ্দিনের বাজার দর নিয়ন্ত্রণের প্রেরণা ছিল।
বাজার দর নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে উপাদান
- (১) আলাউদ্দিন খলজির বাজার দর নিয়ন্ত্রণ বা মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতি সম্পর্কে সমকালীন লেখক জিয়াউদ্দিন বরুনীর তারিখ-ই-ফিরোজ শাহী এবং ফুতুহা-ই-জাহান্দরী হতে প্রধান তথ্য পাওয়া যায়। এছাড়া শেখ নাসিরুদ্দিন চিরাগের রচনা খয়ের-উল-মজলিস ও আমীর খসরুর খাজাইন-উল-ফুতুহা থেকেও কিছু তথ্য পাওয়া যায়।
- (২) তবে শেষের দুই গ্রন্থ তেমন নির্ভরযোগ্য নয়। কারণ, আলাউদ্দিনের মৃত্যুর পরে এগুলি রচিত হয় এবং বরণীর মত ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে এগুলি লেখা হয়নি। আলাউদ্দিনের অর্থনৈতিক সংস্কার বা মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতি সম্পর্কে বরণীর রচনাই হল প্রধান ঐতিহাসিক উপাদান।
আলাউদ্দিন খলজির বাজার দর নিয়ন্ত্রণ এর কারণ
সুলতান আলাউদ্দিন খলজির বাজার দর নিয়ন্ত্রণের কারণগুলি –
(ক) বরণির ব্যাখ্যা
- (১) জিয়াউদ্দিন বরণীর রচনা থেকে জানা যায় যে, ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে আলাউদ্দিন একাধারে চিতোর-এর যুদ্ধ ও মোঙ্গল আক্রমণের সম্মুখীন হন। যদিও তিনি নিজ বাহুবলে এই সংকট থেকে পরিত্রাণ পান, কিন্তু ভবিষ্যতে মোঙ্গল আক্রমণ এবং রাজ্যজয়ের জন্য আলাউদ্দিনকে বিরাট সেনাদল রাখতে হয়।
- (২) আলাউদ্দিনের রাজ্যজয় এবং বিজিত অঞ্চল থেকে সম্পদ লুণ্ঠনের ফলে রাজধানী দিল্লী ও সন্নিহিত অঞ্চলে বাজারে প্রচুর মুদ্রার আমদানী হয়। বাজারে মুদ্রার পরিমাণ বাড়ায় জিনিষ পরের দর দাম বৃদ্ধি পায়। তিনি সেনাদের যে হারে বেতন দিতেন তার দ্বারা তার সেনাদলের ও কর্মচারীদের পক্ষে দ্রব্যমূল্য বাড়ায় জীবনধারণ দুস্কর হয়।
- (৩) ফিরিস্তার মতে আলাউদ্দিনকে প্রায় ৫০ হাজার ক্রীতদাস কর্মচারীর ভরণ-পোষণ করতে হত। ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দের পর আলাউদ্দিন বেশ কয়েকটি ব্যয়বহুল প্রাসাদ তৈরি করেন। এই সকল কারণে তার বিরাট পরিমাণ অর্থের দরকার হয়।
- (৪) যদিও তিনি ভূমি রাজস্বের হার বাড়ান এবং দেবগিরি হতে বহু অর্থ আনেন, হিসেব করে দেখা যায় যে ৫/৬ বৎসরের মধ্যে বাড়তি খরচ মেটাতে এই সকল অর্থ নিঃশেষ হয়ে যাবে। এমতাবস্থায় তিনি বিশ্বাসভাজন মন্ত্রীদের পরামর্শ নেন।
- (৫) তারা বলেন যে, যদি আলাউদ্দিন বেতন না বাড়িয়ে, জিনিষপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন তবে তার সরকারের বর্তমান আয় অনুসারে সেনাদলের প্রতি সেনাকে বছরে ২৩৪ টঙ্কা হারে বেতন দিলেই চলবে। জিনিষপত্রের দাম কম থাকলে এই টাকায় সেনাদল তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহ করতে পারবে।
- (৬) বরণীর মতে, সামরিক বাহিনীর স্বার্থেই সুলতান মূল্য নিয়ন্ত্রণ চালু করেন। বরণীর মতে এজন্য আলাউদ্দিন নিয়ম করেন যে, একটি অশ্বযুক্ত এক অশ্বারোহী সেনার বেতন হবে বছরে ২৩৪ টঙ্কা। যদি সেই ব্যক্তির একটি অতিরিক্ত অশ্ব থাকে তবে তাকে অতিরিক্ত ৭৮ টঙ্কা দেওয়া হবে। বরণীর এই মতই বেশীর ভাগ ঐতিহাসিক গ্রহণ করেন।
- (৭) তবে ফিরিস্তার বিবরণ থেকে জানা যায় যে আলাউদ্দিন পদাতিক সেনার বাৎসরিক বেতন ৭৮ টঙ্কা ধার্য করেন। সরকার থেকে অশ্বারোহী সেনাকে একটি ঘোড়া দিলে সেই অশ্বারোহীর বেতন হয় ১৫৬ টঙ্কা। যদি সেই ব্যক্তি আরও একটি ঘোড়া নিজে আনে তবে আরও ৭৮ টঙ্কা। মোট ২৩৪ টঙ্কা সেক্ষেত্রে বেতন হয়।
- (৮) যাই হোক বরণীর মতে মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতির দ্বারা বাজারে জিনিষ পত্রের দাম কমান হলে এই বেতন দ্বারা আলাউদ্দিনের সেনা ও কর্মচারীরা জীবিকা নির্বাহ করতে পারে। সামরিক প্রয়োজনই ছিল আলাউদ্দিনের মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতির উদ্দেশ্য।
(খ) সুফী লেখকের ব্যাখ্যা
- (১) এই সময় সুফী সন্ত শেখ নাসিরুদ্দিন চিরাগ তার খয়ের-উল-মজলিসে আলাউদ্দিনের মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতির এক দ্বিতীয় ব্যাখ্যা দিয়েছেন। আলাউদ্দিন মনে করতেন যে, জনসাধারণ হল খালক-ই-খুদাই। জনসাধারণের স্বার্থরক্ষা ছিল তার ব্রত।
- (২) তিনি মনে করতেন যে, ন্যায্য অথবা নিম্ন দামে প্রয়োজনীয় দ্রব্যসম্ভার জনসাধারণকে সরবরাহ করতে পারলে তার নৈতিক কর্তব্য পালন করা হবে। এই উদ্দেশ্য পূরণের জন্যই তিনি মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতি চালু করেন। আমীর খসরু তার রচনা খাজাইন-উল-ফুতুহাতেও মোটামুটি একই অভিমত দিয়েছেন।
- (৩) আমীর খসরুর মতে “জাহাঙ্গীর” বা রাজ্যবিজেতা অপেক্ষা “জাহান্দার” বা কল্যাণকামী প্রশাসক শ্রেষ্ঠ। আলাউদ্দিনের দ্বিতীয় ভূমিকার তিনি প্রশংসা করেছেন। এই ভূমিকার মধ্যে ছিল জনসাধারণের জন্য সস্তা দরে খাদ্যশস্য ও অন্যান্য দ্রব্য সরবরাহ।
(গ) বাজার দর নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে সুফী মতের সমালোচনা
আধুনিক গবেষক কে এস লাল বলেন যে সুফী লেখকের এই ব্যাখ্যা খুব নির্ভরযোগ্য নয়। কারণ,
- (১) এই রচনা আলাউদ্দিনের মৃত্যুর ৫০ বৎসর পরে শোনা কথার ওপর নির্ভর করে রচিত হয়। অন্য কোনো সমকালীন লেখক সুফী ব্যাখ্যাকে সমর্থন করে মত প্রকাশ করেননি।
- (২) একমাত্র নির্ভরযোগ্য সমকালীন লেখক বরণী মূলানিয়ন্ত্রণ নীতির সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ব্যাখ্যা দিয়েছেন। আলাউদ্দিনের স্তুতিবাচনের জন্য তিনি তাঁর রচনা লিপিবদ্ধ করেন। খাজাইন-উল-ফুতুহা আলাউদ্দিনের দরবারে পাঠের উদ্দেশ্যে রচিত হয়। আমীর খসরু ছিলেন আলাউদ্দিনের দরবারী সাহিত্যিক। তিনি খুব নিরপেক্ষ লেখক ছিলেন বলে অনেকে মনে করেন। না।
(ঘ) জরুরি অবস্থায় সরবরাহ রক্ষা
- (১) ডঃ কে এস লালের মতে আলাউদ্দিনের রাজত্বকাল ছিল যুদ্ধ-বিগ্রহে পূর্ণ। যুদ্ধ-বিগ্রহের জন্য পণ্য চলাচল ও সরবরাহ ব্যবস্থা খুবই বিপর্যস্ত হত। ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে মালিক তার্ঘি দিল্লী আক্রমণ করলে যমুনা পার হয়ে দিল্লীতে খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা বিপর্যন্ত হয়।
- (২) এর ফলে শহরে যে সকল বণিকের গুদামে খাদ্য মজুত থাকত তারা অনেক বেশী দরে খাদ্য বিক্রি করত। যাতে রাজধানীতে এরূপ অবস্থা ভবিষ্যতে না দেখা দেয় এবং বাজার দরের স্বাভাবিক হার বজায় থাকে এই উদ্দেশ্যে আলাউদ্দিন মূল্য নিয়ন্ত্রণ করেন।
- (৩) এজন্য তিনি সরকারী গুদামে খাদ্য মজুত। নিয়মিত পরিমাণে খাদ্য ক্রয়ের ব্যবস্থা এবং নিয়ন্ত্রিত দরে জিনিষপত্র বিক্রয়ের ব্যবস্থা চালু করেন।
(ঙ) ন্যায্য হারে মূল্য স্থির
- (১) ডঃ ইউ এন দে আলাউদ্দিনের মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতির এক স্বতন্ত্র ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর মতে, আলাউদ্দিন সেনাদলকে কম হারে বেতন দিতেন বরণীর এই সিদ্ধান্ত গ্রহণযোগ্য নয়। ষোড়শ শতকে আকবর ২৪০ টঙ্কা এবং শাহজাহান ২০০ টঙ্কা বেতন দিতেন।
- (২) সেই তুলনায় চতুর্দশ শতকে আলাউদ্দিনের ২৩৪ টঙ্কা বেতনকে কম হার বলা চলে না। আলাউদ্দিন উৎপাদন মূল্য অপেক্ষা কম হারে দ্রব্যমূল্য ধার্য করেন একথাও ঠিক নয়। বরণী স্বীকার করেছেন যে, ফিরোজ শাহ তুঘলক-এর আমলে খাদ্যদ্রব্যের দাম যা ছিল আলাউদ্দিনের আমলে তাই ছিল।
(চ) মূল্যবৃদ্ধি ও মুদ্রাস্ফীতি রোধ
- (১) ডঃ ইউ এন দের মতে, আলাউদ্দিনের আমলে দিল্লী ছিল একটি জনবহুল নগরী। রাজধানীতে সর্বদা একটি শক্তিশালী সেনাদল হাজির থাকত। নানা অঞ্চল থেকে লোকজন রাজধানীতে আসত এবং বাণিজ্য উপলক্ষে বহু বণিক ও নগরে আসত। এর ফলে দিল্লীতে লোকসংখ্যা বাড়ে এবং মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়।
- (২) লোকসংখ্যা বৃদ্ধি ও মুদ্রাস্ফীতির জন্য খাদ্য ও অন্যান্য দ্রব্যের দাম বাড়ে। আলাউদ্দিন এই মূল্যবৃদ্ধি রোধ ও জনসাধারণের মধ্যে খাদ্য সরবরাহ অব্যাহত রাখার জন্যই তাঁর মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতি চালু করেন। তিনি উৎপাদন মূল্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই এই মূল্যমান ধার্য করেন।
- (৩) ডঃ নিজামীও বলেছেন যে, বরণী তারিখ-ই-ফিরোজশাহী গ্রন্থে “বাব-আবাদ” কথাটি ব্যবহার করেছেন যার অর্থ হল উৎপাদন মূল্যের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা। সুতরাং এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, সামরিক প্রয়োজন এবং মুদ্রাস্ফীতিজনিত মূল্যবৃদ্ধি বন্ধ করার জন্য আলাউদ্দিন উৎপাদন মূল্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতি চালু করেন।
বাজার দর নিয়ন্ত্রণের তিনটি নীতি
তাঁর মূল্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা তিনটি নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। যথা –
- (১) সৈন্য ও কর্মচারীদের ২৩৪ টঙ্কা হারে নির্দিষ্ট বেতন প্রদান।
- (২) দ্রব্যমূল্য নির্ধারিত মূল্য তালিকার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা।
- (৩) নিয়মিতহারে নির্ধারিত মূল্যে খাদ্যদ্রব্যের যোগান দেওয়া।
বাজার দর নিয়ন্ত্রণ নীতি প্রচলিত এলাকা
- (১) এখন প্রশ্ন হল আলাউদ্দিনের মূল্য নিয়ন্ত্রণনীতি কেবলমাত্র দিল্লী অথবা সাম্রাজ্য-এর সকল স্থানে প্রচলিত ছিল। এই মূল্য নিয়ন্ত্রণনীতির সুফল কেবলমাত্র সেনাদল ও সরকারী কর্মচারীরা অথবা জনগণও ভোগ করত।
- (২) বরণীর তারিখ-ই-ফিরোজ শাহীর মতে আলাউদ্দিনের এই মূল্য নিয়ন্ত্রনীতি কেবলমাত্র দিল্লী শহরে সীমাবদ্ধ ছিল। সাম্রাজ্যর অন্যান্য অঞ্চলে তা কার্যকরী করা হয়নি। কিন্তু বরণীর এই মত আধুনিক ঐতিহাসিকদের কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হয়নি।
- (৩) বরণীর অন্য গ্রন্থ ফতোহা-ই-জাহান্দারীতে বরণী দেশের সর্বত্র সস্তা দরে খাদ্য বিক্রয় করা উচিত বলে মন্তব্য। করেছেন। আলাউদ্দিনের সেনা ছাউনী কেবলমাত্র দিল্লীতেই ছিল না। প্রদেশের শাসনকেন্দ্র ও বিভিন্ন শহরে বা কসবাগুলিতেও সেনা ছাউনী ছিল।
- (৪) তাহলে শুধু দিল্লীতে অবস্থিত সেনারাই এই সুবিধা ভোগ করত এমন কথা ভাবা যায় না। মোরল্যান্ড (Moreland) অবশ্য মনে করেন যে, যেহেতু দিল্লীতে আলাউদ্দিনের প্রধান সেনাদল ছিল, সেহেতু আলাউদ্দিন দিল্লীকে দেশের অপর সকল অঞ্চল থেকে আলাদা করে মূল্য নিয়ন্ত্রণ একমাত্র সেখানেই চালু করেন। ডঃ কে এস লালও তাই মনে করেন।
- (৫) কিন্তু ডঃ নিজামী অবশ্য মনে করেন যে ফিরিস্তার বিবরণই এক্ষেত্রে বেশী গ্রহণযোগ্য। ফিরিস্তার মতে সাম্রাজ্যের সর্বত্র বিশেষত “কসবা” বা শহর অঞ্চলগুলিতে মূল্যনিয়ন্ত্রণ চালু করা হয়। আলাউদ্দিন মালিক ইয়াকুবকে দেওয়ান-ই-রিয়াসৎ নিয়োগ করে সাম্রাজ্যের সকলস্থানে মূল্য নিয়ন্ত্রণ কার্যকরী করেন।”
- (৬) অন্তত দিল্লী নগরে সাধারণ লোকেরাও বাজারে সরকারের নির্ধারিত মূল্যে খাদ্যশস্য কিনতে পারত। আলাউদ্দিন দিল্লী শহরের শুধু সেনাদের নিয়ন্ত্রিত মূল্যে জিনিষপত্র কেনার সুযোগ দেননি। সর্ব সাধারণ সেই সুযোগ পায়। খাদ্যশস্যের মানও বেশ ভাল ছিল।
- (৭) কিছুকাল পরে ইবন বতুতা দিল্লীতে নির্ধারিত মূল্যে বিক্রিত চাউলের মান বেশি ভাল বলেই মন্তব্য করেছেন। ডঃ কে. এস লাল ও ডঃ পি- শরন প্রমুখ বলেছেন যে, আলাউদ্দিন কেবলমাত্র দিল্লীতে সেনাদলের স্বার্থে জবরদস্তী করে জিনিষপত্রের দাম একতরফাভাবে বেঁধে দেন। এতে কৃষক ও বণিকরা দারুন ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
- (৮) ডঃ শরনের মতে, “আলাউদ্দিনের এই ব্যবস্থা ছিল পুরোপুরি যৌক্তিকতাহীন, ভ্রান্তভাবে পরিকল্পিত এবং কৃত্রিম ও অর্থনৈতিক নিয়মের বিরোধী।” ডঃ শরনের এই মন্তব্য অধিকাংশ ঐতিহাসিক অন্যায় ও কঠোর বলে মনে করেন। ডঃ নিজামী বরণীর থেকে দেখিয়েছেন যে, আলাউদ্দিন “উৎপাদন মূল্য” (বারওয়ান্দ) বিবেচনা করেই জিনিষপত্রের দাম ধার্য করেন।
আলাউদ্দিন খলজির মূল্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা
- (১) সুলতান আলাউদ্দিন তার কর্মচারীদের সাহায্যে প্রতি দ্রব্যের মূল্য তালিকা স্থির করেন। এজন্য তিনি ৮টি আদেশনামা বা জবিতা জারি করেন। খাদ্যশস্য, কাপড়-চোপড় ছাড়া ঘোড়া, গাভী, দাস-দাসীদেরও তিনি মূল্য স্থির করে দেন।
- (২) হিন্দু নায়েক ও মুলতানী বণিক যারা প্রধানত খাদ্য ও কাপড়ের পাইকারী ব্যবসা করত, তাদের নাম নথিভুক্ত করা হয় এবং তাদের আত্মীয়-স্বজনকে জামিন রাখা হয়। এই বণিকদের দায়িত্ব ছিল দিল্লীর বাজারে পাইকারী হারে খাদ্য, বস্ত্রের যোগান দেওয়া।
- (৩) কোনো বণিক খাদ্য সরবরাহে শিথিলতা দেখালে তাকে কঠিন দৈহিক শাস্তি দেওয়া হত। শাস্তির ভয়ে নায়েক ও মুলতানীরা হাজার হাজার ভারবাহী পশুর পিঠে চড়িয়ে মাল দিল্লীতে আনত। দিল্লীর খুচরো ব্যবসায়ীরা নির্ধারিত দামে এই সকল দ্রব্য বিক্রি করতে বাধা ছিল।
- (৪) আমীর খসরুর মতে, খুচরো ব্যবসায়ীরা আলাউদ্দিনের আদেশে পাথরের বাটখারার বদলে সঠিক মাপের লোহার বাটখারা ও মাপের কাঠি ব্যবহার করতে বাধ্য হয়। আলাউদ্দিনের আদেশে গম প্রতি মণ ৭ জিতল, যব ৪ জিতল, চাউল ৫ জিতল হারে বিক্রি হত।
- (৫) দিল্লীর নানা স্থানে ও দোয়াবে সরকারী গুদাম তৈরি করে খাদ্য মজুত রাখা হত। অনাবৃষ্টি ও অনটনের সময় এই খাদ্য বিক্রি হত। যাতে ধনী লোকেরা সকল খাদ্য কিনে না নেয়, এজন্য নিয়ম করা হয়, কোনো পরিবার আধ মণের বেশি খাদ্য কিনতে পারবে না।
- (৬) খাদ্যশস্যের বাজার ছাড়া কাপড় চোপড় ও অন্যান্য শিল্পদ্রব্যের বাজারের নাম ছিল সের-ই আদল। এই সকল জিনিষপত্র বহুদূর থেকে মূলতানী বণিকরা আমদানি করত। এছাড়া দাস-দাসী ও পশু বিক্রির জন্য আলাদা বাজার ছিল।
মূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রশাসন ব্যবস্থা
- (১) আলাউদ্দিন তার মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতিকে কার্যকরী করার জন্য মালিক কাবুলকে শাহানা-ই-মাণ্ডির পদে বসান। এই সৎ কর্মচারাটি তার বহু সমর্থক সহকারীদের সাহায্যে মূল্য তালিকা স্থির করতেন, ব্যবসায়ীদের নাম, ধামের খবর রাখতেন এবং অশ্বারোহী সেনার দ্বারা বিদ্রোহী কৃষকদের খাদ্য বিক্রি করতে বাধ্য করতেন।
- (২) তিনি অবাধ্য বণিকদের শায়েস্তা করতেন। আলাউদ্দিন দোয়াবের কৃষকদের নাগদ টাকার পরিবর্তে শস্য দ্বারা রাজস্ব দিতে বাধ্য করেন। এই শস্য দিল্লীর ও দোয়ারের গুদামে জমা হত। বাজারে নায্য দামে জিনিষপত্র প্রকৃতই বিক্রি হচ্ছে কিনা তা জানার জন্য আলাউদ্দিন গুপ্তচর নিয়োগ করতেন।
- (৩) মালিক কাবুল খাদ্যশস্য ও অন্যান্য বাজারের মূল্য নিয়ন্ত্রক হিসেবে যথেষ্ট যোগ্যতার পরিচয় দেন। মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতিকে সর্বত্র অধিকতর কার্যকরী করার জন্য আলাউদ্দিন দেওয়ান-ই-রিয়াসতের পদ তৈরী করে তার বিশ্বাসভাজন মালিক ইয়াকুবকে এই পদে নিয়োগ করেন। শাহানা-ই-মান্ডির দপ্তরকে দেওয়ান-ই-রিয়াসতের অধীনে আনা হয়। তার অধীনে অশ্বারোহী সেনা ও বহু কর্মচারী রাখা হয়।
মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতির ফলাফল
আলাউদ্দিন খলজির বাজারদর নিয়ন্ত্রণের ফলাফলগুলি হল –
- (১) আলাউদ্দিন খলজির মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতির ফলে আলাউদ্দিনের শাসনকালে তেমন কোনো বড় দুর্ভিক্ষ হয়নি। সুফী লেখকরা আলাউদ্দিনের মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতির প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। হামিদ, কালাদার, ফিরোজ শাহের রাজত্বকালে আলাউদ্দিনের মূল্য নিয়ন্ত্রণের ফলে জনজীবনে সুখ স্বাচ্ছন্দের কথা উল্লেখ করেছেন।
- (২) একথা ঠিক যে আলাউদ্দিনের নীতির ফলে অন্তত বিশেষ কয়েকটি শ্রেণীর উপকার হয়। সেনাদলের লোক, নিয়মিত বেতনভোগী কর্মচারীরা এই ব্যবস্থায় উপকৃত হয় তাতে সন্দেহ নেই। এই মূল্য নিয়ন্ত্রণের ফলে দিল্লীর লোকেরা বিশেষভাবে উপকৃত হয়। খরা বা দুর্ভিক্ষের সময় দিল্লীতে খাদ্যের অভাব হয়নি।
- (৩) অধ্যাপক পি শরন আলাউদ্দিনের মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতির ফলাফল সাধারণভাবে খুব খারাপ ছিল বলে মনে করেন। দিল্লীর অভিজাত, কর্মচারী, সেনাদল সস্তায় জিনিষপত্র পেয়ে সুখে থাকলেও কারিগর শিল্পী ও শিল্পদ্রব্যের উৎপাদকরা ধ্বংস হতে থাকে বলে অধ্যাপক শরন মনে করেন।
- (৪) কারণ, শিল্পদ্রব্যের দাম কমাবার ফলে কারিগর শ্রেণীর মজুরীর হার কমে যায়। সর্ব্বাপেক্ষা ক্ষতিগ্রস্থ হয় কৃষক শ্রেণী। খালিসা জমির চাষীরা সরকারকে ফসলের ভাগ দিয়ে রাজস্ব পরিশোধ করার পর উদ্বৃত্ত ফসল নির্ধারিত দামে বিক্রি করতে বাধ্য হলে তাদের অবস্থা খুব খারাপ হতে পারে।
- (৫) এজন্য পি শরন আলাউদ্দিনের মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতিকে যুক্তিহীন, জবরদস্তিমূলক ব্যবস্থা বলে অভিহিত করেছেন। ডঃ কে এস লাল বলেন যে, আলাউদ্দিনের মৃত্যুর পর তার মূল্য নিয়ন্ত্রনীতি ভেঙে পড়ে। তার কারণ হল যে, আলাউদ্দিন অর্থনৈতিক নীতি চাহিদা ও সরবরাহের সামজস্য রেখে মূল্য নিয়ন্ত্রণ করেন নি।
- (৬) এজন্য দোয়াব ও দিল্লীর সন্নিহিত অঞ্চলের কৃষক ও কারিগরদের দুঃখ-কষ্টের সীমা ছিল না। বণিকরাও নায্য লাভ করার সুযোগ পায় নি। সকলেই আলাউদ্দিনের দমনমূলক নীতির ভয়ে তটস্থ ছিল। আলাউদ্দিন যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন তার এই নীতি সফল ছিল।
বাজার দর নিয়ন্ত্রণ নীতি বহাল থাকার কারণ
ঐতিহাসিক বরণীর মতে,
- (১) আলাউদ্দিন তার নির্ধারিত দাম মেনে চলতে সকলকে ভয়ানক জবরদস্তি করেন।
- (২) আলাউদ্দিন যে ৫০% হারে কর ধার্য করেন তা পরিশোধ করতে কৃষকরা নিম্নমূল্যে খাদ্যশস্য বিক্রি করতে বাধা হয়।
- (৩) বাজারে মুদ্রা সঙ্কট থাকায়, খোলা বাজারে ক্রেতার সংখ্যা বেশী ছিল না।
- (৪) আলাউদ্দিন একমাত্র সৎ ও দক্ষ কর্মচারীর সহায়তায় তার নীতিকে কার্যকর করেন।
উপসংহার :- ডঃ বি. পি. সাকসেনা মন্তব্য করেছেন যে আলাউদ্দিনের মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতি ছিল সুলতানি যুগের সর্ব্বোত্তম মহান প্রশাসনিক ব্যবস্থা। ফিরিস্তার মত উল্লেখ করে বলেছেন যে, আলাউদ্দিনের রাজত্বের শেষ দিন পর্যন্ত তার মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতি কার্যকরী ছিল।
(FAQ) আলাউদ্দিন খলজির বাজার দর নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
আলাউদ্দিন খলজি।
বিশাল সেনাবাহিনী গঠন।
মালিক কাবুল।
মালিক ইয়াকুব।