আলাউদ্দিন খলজির দাক্ষিণাত্য অভিযান প্রসঙ্গে দেবগিরি রাজ্য, বরঙ্গল রাজ্য, দ্বারসমুদ্র রাজ্য, পাণ্ড্য রাজ্য, দাক্ষিণাত্য অভিযানের কারণ, আধুনিক মত, সাফল্যের কারণ সম্পর্কে জানবো।
আলাউদ্দিন খলজির দাক্ষিণাত্য অভিযান
ঐতিহাসিক ঘটনা | আলাউদ্দিন খলজির দাক্ষিণাত্য অভিযান |
সুলতান | আলাউদ্দিন খলজি |
প্রধান সেনাপতি | মালিক কাফুর |
দেবগিরি জয় | ১৩০৬-০৭ খ্রি: |
বরঙ্গল জয় | ১৩০৯ খ্রি: |
হোয়শল সাম্রাজ্য জয় | ১৩১১ খ্রি: |
ভূমিকা :- চতুর্দশ শতকে আলাউদ্দিনের রাজত্বকালে বিন্ধ্য পর্বতের দক্ষিণে কোনো কেন্দ্রীয় রাজশক্তির অস্তিত্ব ছিল না। আমীর খসরুর খাজাইন-উল-ফুতুহা থেকে জানা যায় যে, দক্ষিণে এই সময় ৪টি হিন্দু রাজ্য ছিল।
হিন্দু দেবগিরি রাজ্য
- (১) বিন্ধ্য পর্বতের দক্ষিণ-পশ্চিমে দেবগিরি রাজ্য। আধুনিক মহারাষ্ট্রের কিছু অংশ এর অন্তর্গত ছিল। দেবগিরির রাজা ছিলেন রামচন্দ্রদেব। তিনি ছিলেন যাদববংশীয়। জালালউদ্দিন খলজির রাজত্বকালে দেবগিরির ধন-দৌলতের খবর পেয়ে আলাউদ্দিন দেবগিরি আক্রমণ করেন।
- (২) রামচন্দ্রদেব আলাউদ্দিনকে বার্ষিক কর দিতে প্রতিশ্রুত হলেও পরে তিনি এই প্রতিশ্রুতি ভাঙেন। তাছাড়া গুজরাটের রাজা কর্ণ ও তার কন্যা দেবলাদেবীকে তিনি আলাউদ্দিনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে আশ্রয় দেন। রায়করণকে তিনি ইলিচপুর অধিকার করার সুযোগ দেন। এই ইলিচপুর জেলা তিনি অগ্রে আলাউদ্দিনকে দিতে প্রতিশ্রুতি দেন। প্রতিশ্রুতি ভাঙায় আলাউদ্দিন বিরক্ত হন।
হিন্দু রাজ্য বরঙ্গল
বিন্ধ্য পর্বতের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে তেলেঙ্গানা বা বরঙ্গল রাজ্য অবস্থিত ছিল। কাকতীয় বংশীয় প্রতাপরুদ্রদেব তেলেঙ্গানা শাসন করতেন। তার রাজধানী ছিল বরঙ্গল।
দ্বার সমুদ্র রাজ্য
কৃষ্ণা নদীর দক্ষিণে ছিল দ্বার সমুদ্র রাজ্য। হোয়সল বংশীয় তৃতীয় বীর বল্লাল এখানে শাসন করতেন।
পাণ্ড্য রাজ্য
সর্ব দক্ষিণে ছিল পাণ্ড্য রাজ্য। এর রাজধানী ছিল মাদুরাই।
আলাউদ্দিন খলজির দাক্ষিণাত্য অভিযানের কারণ
সুলতান আলাউদ্দিন কি কারণে দক্ষিণ ভারত বিজয়ে উদ্যম দেখান সে সম্পর্কে বিভিন্ন ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। যেমন –
(ক) লুন্ঠন তত্ত্ব
- (১) কেবলমাত্র লুণ্ঠনের জন্যই আলাউদ্দিন দক্ষিণে অভিযান চালান এই মত অনেকে গ্রহণ করেন না। দক্ষিণের ধনসম্পদ লুণ্ঠনের জন্য আলাউদ্দিনের লোভ হয়ত ছিল। প্রথম দেবগিরি অভিযানের সময় থেকে তিনি দক্ষিণের অপরিমিত ধনরত্নের সন্ধান পান একথা সত্য।
- (২) তৎকালীন ভৌগোলিক পরিবেশে আলাউদ্দিন দক্ষিণকে তার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করার অসুবিধা বুঝতেন। ডঃ ইউ. এন. দের মতে, “আলাউদ্দিন দক্ষিণের হিন্দু রাজ্যগুলিকে ধাপে ধাপে করদ রাজ্যে পরিণত করার নীতি নেন। তাছাড়া আলাউদ্দিনের হাতে ছিল ৪,৭৫,০০০ সেনা। উত্তর ভারত জয়ের পর এই বিরাট সেনাদলকে নিষ্ক্রিয় রাখা সম্ভব ছিল না।
- (৩) কাজেই আলাউদ্দিন এই বাহিনীকে দক্ষিণে পাঠান। সুতরাং আলাউদ্দিনের সাম্রাজ্যবাদের পশ্চাতে তার সামরিক একনায়কতন্ত্র, রাজ্য বিস্তারের স্পৃহা, সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা ও সংহতি, লুণ্ঠনের লক্ষ্য এবং দক্ষিণে করদ রাজ্য স্থাপনের দৃষ্টিভঙ্গি কার্যকরী ছিল।
- (৪) উত্তর ভারতের কৃষি সম্পদ দীর্ঘকাল লুণ্ঠন করার পর এই অঞ্চলে এমন কিছু উদ্বৃত্ত অর্থসম্পদ ছিল না, যা সুলতানি সম্রাট আলাউদ্দিনকে প্রয়োজন মত অর্থের যোগান দিতে পারে। দক্ষিণে বহুকাল কোনো বৈদেশিক আক্রমণ হয়নি। এজন্য দক্ষিণের রাজারা পুরুষানুক্রমে তাদের উদ্বৃত্ত সম্পদ সঞ্চিত করেন।
- (৫) রাজ দুর্গ, প্রাসাদ, মন্দিরগুলি ধনসম্পদে পরিপূর্ণ ছিল। প্রত্যক্ষদর্শী আমীর খসরু, সমকালীন লেখক বরণী, ইসামি প্রমুখ সকলেই দক্ষিণের বিশাল ধনসম্পদের কথা বলেছেন। ১২৯৬ খ্রিস্টাব্দে আলাউদ্দিন তাঁর প্রথম দেবগিরি অভিযান-এর সময় দক্ষিণে সঞ্চিত ধন-রত্নের কথা জানতে পারেন।
- (৬) সিংহাসনে বসার পর ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে বরঙ্গলে একটি অভিযান পাঠান। এই অভিযান বিফল হয়। সুতরাং আলাউদ্দিন উপযুক্ত প্রস্তুতি নিয়ে ১৩০৭ খ্রিস্টাব্দে আলাপ খান ও নসরৎ খানের নেতৃত্বে দেবগিরির বিরুদ্ধে সেনাদল পাঠান।
- (৭) ডাঃ কে. এস. লাল আলাউদ্দিনকে সুলতান মামুদ-এর সঙ্গে তুলনা করেছেন। সুলতান মামুদ উত্তর ভারত লুঠ করেন; আলাউদ্দিন দক্ষিণ ভারত লুঠ করেন। দক্ষিণের রাজ্যগুলিকে লুঠ করার পর এবং হিন্দু রাজাদের বার্ষিক রাজস্ব দিতে প্রতিশ্রুতি দিতে বাধ্য করার পর আলাউদ্দিন দক্ষিণের রাজ্যগুলিকে নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেননি।
- (৮) তাছাড়া রাজপুতানার রাজ্য জয়ের পর শাসন স্থাপন করতে গিয়ে আলাউদ্দিন বহু বাধার সম্মুখীন হন। সুতরাং এই অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি দক্ষিণের রাজাদের কর দানের প্রতিশ্রুতি ও আনুগত্য লাভকেই তার অভিযানের লক্ষ্য হিসেবে নেন।
(খ) ধর্মপ্রচার তত্ত্ব
কোনো কোনো ঐতিহাসিক আলাউদ্দিনের দক্ষিণী অভিযানকে দাক্ষিণাত্যে ইসলাম ধর্ম ও সংস্কৃতি প্রবর্তনের প্রথম প্রয়াস বলে মনে করেন। এই ধারণার কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। সমকালীন কোনো লেখক বরণী বা ইসামী একথা বলেননি। আলাউদ্দিন দক্ষিণের ধনরত্ন ও আনুগত্য পেয়েই সন্তুষ্ট হন। তিনি ধর্ম প্রচারের কোনো চেষ্টা করেননি।
আলাউদ্দিন খলজির দাক্ষিণাত্য অভিযান সম্পর্কে আধুনিক মত
- (১) ডঃ কে. এস. লাল প্রমুখ ঐতিহাসিকেরা আলাউদ্দিনের দাক্ষিণাত্য অভিযানের প্রকৃতি বিচার করে বলেছেন যে, “প্রকৃতপক্ষে উত্তরে সুলতান মামুদের অভিযানের যে লক্ষ্য ছিল দক্ষিণে আলাউদ্দিনের তাই ছিল”। অর্থাৎ লুণ্ঠন ছিল তাঁর লক্ষ্য।
- (২) কিন্তু ডঃ ইউ এন দে নামে এক গবেষক আমীর খসরুর ও ইসামীর বিবরণ এবং একটি সমকালীন জৈন রচনার ভিত্তিতে বলেছেন যে, আলাউদ্দিন ধাপে ধাপে দক্ষিণের রাজ্যগুলিকে করদ রাজ্যে পরিণত করার নীতি নেন।
- (৩) তিনি চেয়েছিলেন যে, দক্ষিণের রাজ্যগুলি তার সার্বভৌমত্ব স্বীকার করবে। তাকে বার্ষিক কর দেবে ও তাঁর আদেশ পালন করবে। এজন্য তিনি দেবগিরিকে কেন্দ্র করে তার আধিপত্যকে দৃঢ় করার চেষ্টা করেন। নিছক লুণ্ঠন তার লক্ষ্য ছিল একথা বলা যায় না।
- (৪) বিভিন্ন লেখকদের মতামত বিচার করে একথা মনে করা সঙ্গত যে আলাউদ্দিনের দাক্ষিণাত্য নীতির পশ্চাতে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উভয় প্রকার লক্ষ্য কাজ করেছিল। অর্থনৈতিক দিক থেকে দক্ষিণের সঞ্চিত ধনরত্ন দখলের লক্ষ্য নিশ্চয়ই আলাউদ্দিনের ছিল।
- (৫) কিন্তু এই সঙ্গে আরও কতকগুলি সংশ্লিষ্ট অর্থনৈতিক কারণও ছিল। রাজপুতানা ও মালব জয়ের পর এবং মোঙ্গল যুদ্ধে জয়লাভের পর আলাউদ্দিনের হাতে ছিল ৪ লক্ষ ৭৫ হাজার সেনা। এই বিশাল সেনাদলকে তিনি নগদ বেতন, প্রতি সৈন্যকে ২৩৪ টঙ্কা হারে দিতেন।
- (৬) এই সেনাদলকে কাজে লাগাতে দক্ষিণ ভারতই ছিল একমাত্র উপযুক্ত ক্ষেত্র। কাজেই পরিস্থিতির চাপের ফলে তিনি দক্ষিণে অভিযানের নীতি নিতে বাধ্য হন। এই বিশাল সেনাদলের ব্যয়ভার বহন করার জন্য তাঁর নগদ টাকার দরকার হয়েছিল।
- (৭) রাজনৈতিক দিক থেকে রাজপুতানা ও মালব জয়ের পর ভৌগোলিকভাবে দক্ষিণের রাস্তা তার কাছে খুলে যায়। একেই দক্ষিণে ছিল সঞ্চিত ধনভাণ্ডার। তদুপরি মালব জয়ের ফলে দক্ষিণের দরজা তাঁর কাছে উন্মুক্ত হয়। দক্ষিণে এমন কোনো রাজা ছিলেন না যিনি আলাউদ্দিনকে প্রতিহত করতে সক্ষম ছিলেন। কাজেই ইতিহাসের ও পরিস্থিতির প্রভাবে আলাউদ্দিন দক্ষিণে অভিযান পরিচালনা করেন।
সুলতান আলাউদ্দিন খলজির দেবগিরি জয়
- (১) বিন্ধ্যের দক্ষিণে আলাউদ্দিনের বাহিনীর সফলতা ছিল বিস্ময়কর। মাখনের তালের ওপর ছুরি চালালে যেমন অবলীলাক্রমে তা বিদীর্ণ হয়, তেমনই দক্ষিণের রাজ্যগুলি সুলতানি বাহিনীর চাপে দ্রুত ভেঙে পড়ে।
- (২) ১৩০৬-৭ খ্রিস্টাব্দে আলাউদ্দিনের সেনাপতি মালিক কাফুর দেবগিরির রামচন্দ্রদেবকে পরাস্ত করেন। যতদূর জানা যায় রায়করণ যিনি রামচন্দ্রদেবের আশ্রয়ে ছিলেন তিনি আত্মহত্যা করেন। রায়করণের কন্যা দেবলাদেবী এলোরা গুহায় সেনাপতি আলাপ খানের হাতে বন্দিনী হন।
- (৩) তাকে দিল্লীতে আনা হলে সুলতানের পুত্র খিজির খানের সঙ্গে তার বিবাহ হয়। রামচন্দ্রদেব দিল্লীতে এসে বশ্যতা জানান এবং রায়-রায়ান উপাধি পান। অতঃপর তিনি দক্ষিণে সুলতানি অভিযানের প্রধান সাহায্যকারিতে পরিণত হন। তিনি তার কন্যা ঝাট্যপালীর সঙ্গে আলাউদ্দিনের বিবাহ স্বীকার করে নেন।
আলাউদ্দিন খলজির তেলেঙ্গানা জয়
- (১) এরপর মালিক কাফুর ১৩০৯ খ্রিস্টাব্দে বরঙ্গল বা তেলেঙ্গানা আক্রমণ করেন। দেবগিরির রামচন্দ্র দেব তাঁকে বহু রসদ দ্বারা সাহায্য করেন এবং তেলেঙ্গানা দুর্গে যাওয়ার পথ দেখিয়ে দেন। রাজা প্রতাপরুদ্র তেলেঙ্গানা দুর্গে আত্মরক্ষার চেষ্টা করলে কাফুরের সেনাদল দুর্গ অবরোধ করে।
- (২) সুলতানি সেনার চাপ সহ্য করতে না পেরে প্রতাপরুদ্র আত্মসমর্পণ করেন। তিনি তার সঞ্চিত ধনরত্ন, ৭ হাজার ঘোড়া, ১০০ হাতি, ও একটি বিখ্যাত হীরক সুলতানকে দেন। আলাউদ্দিনের বশ্যতা স্বীকার করে তিনি নিয়মিত কর দিতে প্রতিশ্রুতি দেন। মালিক কাফুর এই ধনরত্নসহ দিল্লীতে ফিরে আসেন।
সুলতান আলাউদ্দিন খলজির দ্বারসমুদ্র জয়
- (১) এরপর ১৩১১ খ্রিস্টাব্দে কৃষ্ণা নদী পার হয়ে কাফুরের নেতৃত্বে সুলতানি বাহিনী দ্বারসমুদ্র বা হোয়শল রাজ্য আক্রমণ করে। হোয়শল রাজ তৃতীয় বীরবল্লাল এই সময় দক্ষিণে পাণ্ড্য রাজ্যের সঙ্গে যুদ্ধে ব্যাপৃত ছিলেন। মুসলিম আক্রমণের সংবাদ পেয়ে রাজধানী রক্ষার জন্য তিনি ছুটে আসেন। বীর পাণ্ড্যও একটি সেনাদল তার সাহায্যের জন্য পাঠান।
- (২) কিন্তু সুলতানি সেনাদলের সঙ্গে যুদ্ধ অর্থহীন বুঝে বীরবল্লাল যুদ্ধ ত্যাগ করেন। তিনি তাঁর বহু ধনরত্ন, ঘোড়া ও হাতি কাফুরের হাতে তুলে দেন। আলাউদ্দিনের বশ্যতা স্বীকার করে বার্ষিক কর দিতে অঙ্গীকার করেন।
আলাউদ্দিন খলজির পাণ্ড্য রাজ্য জয়
- (১) এরপর কাফুর মাবার বা পান্ড্য রাজ্য আক্রমণ করেন। এই সময় পান্ড্য সিংহাসন নিয়ে দুই ভাই বীর পান্ড্য ও সুন্দর পান্ড্যের মধ্যে বিবাদ চলছিল। সুন্দর পাণ্ড্য তাঁর পিতাকে হত্যা করেন। জ্যেষ্ঠভ্রাতা বীর পাণ্ড্যকে উচ্ছেদ করে তিনি পান্ড্য সিংহাসন দখলের চেষ্টা চালান।
- (২) এই উদ্দেশ্যে সুন্দর পান্ড্য তাঁর ভ্রাতার বিরুদ্ধে মালিক কাফুরের সাহায্য চান। কাফুর এই ভ্রাতৃবিরোধের সুযোগ নিয়ে পাণ্ড্য রাজধানী মাদুরার দিকে সেনা চালিত করেন। বীর পান্ড্য রাজধানী ছেড়ে গেলে কাফুর মাদুরা নগরী নির্বিচারে লুণ্ঠন করেন।
- (৩) বীর পান্ড্য সম্মুখ যুদ্ধে না দিয়ে গেরিলা কায়দায় লড়াই চালান। কাফুর তাঁর পিছু নিয়ে তাকে ধরতে পারেন নি। কাফুর এই সময় সম্ভবত সেতুবন্ধ রামেশ্বরে আসেন এবং রামেশ্বরমের বিখ্যাত মন্দির ধ্বংস করেন। ১৩১১ খ্রিস্টাব্দে তিনি পান্ড্য দেশ থেকে বহু ধনরত্ন নিয়ে দিল্লীতে আসেন।
- (৪) বরণীর ভাষায় এই ধনরত্ন এক হাজার উটের পিঠে চড়িয়ে তিনি দিল্লীতে ঢুকেন। “ধনরত্নের ভারে উটগুলি কাতর শব্দ করছিল।” আমীর খসরুর মতে মালিক কাফুর পাণ্ড্য দেশ থেকে ৫১২টি হাতি, ৫ হাজার ঘোড়া ও ৫০০ মণ দামী রত্ন ও মুক্তা দিল্লিতে আনেন।
সুলতান আলাউদ্দিন খলজির সময় দেবগিরির চূড়ান্ত পতন
দেবগিরির রাজা রামচন্দ্রদেবের মৃত্যু হলে তার পুত্র শঙ্করদেব, পিতার প্রতিশ্রুতি ভেঙে দিল্লীতে কর প্রদান বন্ধ করেন। ১৩১৩ খ্রিস্টাব্দে এজন্য কাফুরকে দেবগিরিতে পাঠান হয়। কাফুর শঙ্করদেবকে যুদ্ধে নিহত করেন এবং দেবগিরি দিল্লীর সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। হোয়শল রাজ্যও দিল্লীর প্রতি পূর্ণ আনুগত্য জানায়।
আলাউদ্দিন খলজির দাক্ষিণাত্য অভিযানের সাফল্যের কারণ
দক্ষিণে আলাউদ্দিনের এই সামরিক সাফল্য ব্যাখ্যার দাবী রাখে। সমকালীন ঐতিহাসিকরা ও প্রত্যক্ষদর্শী আমীর খসরুর রচনাগুলি থেকে আলাউদ্দিনের এই সফলতার কারণ জানা যায়। যেমন –
(১) হিন্দু রাজাদের পারস্পরিক বিরোধ
দক্ষিণের হিন্দুরাজাদের মধ্যে পারস্পরিক বিরোধের ফলে তারা জোটবদ্ধ হয়ে দিল্লীর সেনাদলকে বাধা দিতে পারেন নি। এই রাজাদের মধ্যে ঐক্য না থাকায় আলাউদ্দিন ধাপে ধাপে দক্ষিণের রাজ্যগুলিকে জয় করার সুযোগ পান। মালিক কাফুর হিন্দু রাজাদের এই বিরোধকে তার নিজ স্বার্থে লাগান।
(২) সুলতানী সেনাকে সাহায্য
মালিক কাফুর দেবগিরির রাজা রামচন্দ্রদেবের সাহায্যে তেলেঙ্গানা জয় করেন। হোয়শল রাজ্যের বিরুদ্ধে তিনি তেলেঙ্গানার রাজা প্রতাপরুদ্রের সহায়তা পান। এই সকল রাজারা সুলতানী সেনাদের খাদ্য ও রসদ যোগান এবং গুপ্ত রাস্তা দেখিয়ে দেন।
(৩) সেনাদের ত্রুটিপূর্ণ পোশাক
দক্ষিণের হিন্দু সেনারা সামাজিক দিক থেকে সুলতানি সেনার সমকক্ষ ছিল না। আমীর খসরুর মতে এই সেনারা একটি কটি বস্ত্র পরে খালি মাথায় ও খালি গায়ে যুদ্ধ করত। তাদের দেহকে সুরক্ষিত করার জন্য কোন বর্ম বা চর্ম ছিল না।
(৪) সেকেলে অস্ত্রশস্ত্র
দক্ষিণী সেনাদের লোহার ঢাল ছিল না। তারা বাঁশ বা বেতের ঝুড়িকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করত। এর দ্বারা সুলতানী সেনার বল্লম বা তীরের আঘাত প্রতিহত করা যেত না। হিন্দু সেনারা ছিলেন নগ্নপদ। তারা এজন্য রুক্ষ্ম পাথুরে পথে ছুটতে পারত না। সুলতানি অশ্বারোহী বর্মধারী সেনাদের সাথে নগ্নপদ ও নগ্নগাত্র হিন্দু সেনা এঁটে উঠতে পারেনি।
(৫) জাত বিচার
হিন্দু সেনাদের মধ্যে ছিল ভয়ানক ছোঁয়া-চুয়ির বাতিক। গোখাদক যবন সেনার সঙ্গে দেহের সংযোগ যাতে না ঘটে এজন্য তারা ব্যস্ত থাকত। দ্রুত যুদ্ধ শেষ করে স্নান করে শুচি হওয়ার জন্য তারা ব্যস্ত থাকত। সেনাদের এই মনোভাবের জন্যে হিন্দুরা প্রতিরোধ গড়তে পারেনি।
উপসংহার :- সর্বোপরি বলা যায় যে, আলাউদ্দিনের উন্নত রণকৌশল ও তাঁর বিখ্যাত সেনাপতিদের বিশেষত, মালিক কাফুরের নেতৃত্ব তাঁকে জয়যুক্ত করে।
(FAQ) আলাউদ্দিন খলজির দাক্ষিণাত্য অভিযান সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
ধনরত্ন লুন্ঠন।
ধনরত্ন লুন্ঠন।
১৩০৬-৭ খ্রিস্টাব্দে।
রামচন্দ্রদেব।
মালিক কাফুর।