গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের কৃতিত্ব প্রসঙ্গে চরিত্র, নিষ্ঠাবান মুসলমান, সামরিক দক্ষতা, আলাউদ্দিনের কঠোরতা ত্যাগ, ন্যায় পরায়ণতা, সকল মুসলিমের প্রতি সমান দৃষ্টিভঙ্গি, শাসন নীতি, রাজতান্ত্রিক আদর্শ, সাম্রাজ্য বিস্তার ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতা সম্পর্কে জানবো।
গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের কৃতিত্ব
ঐতিহাসিক ঘটনা | গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের কৃতিত্ব |
সুলতান | গিয়াসউদ্দিন তুঘলক |
সিংহাসন লাভ | ১৩২০ খ্রি |
বংশ | তুঘলক বংশ |
পূর্ববর্তী বংশ | খলজি বংশ |
উত্তরসূরি | মহম্মদ বিন তুঘলক |
মৃত্যু | ১৩২৫ খ্রি |
ভূমিকা :- সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলক ছিলেন সুলতানি যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শাসক। সমকালীন ঐতিহাসিকগণ এবং আধুনিক গবেষকরাও তাকে ন্যায়পরায়ণ, দায়িত্বশীল ও গঠনমূলক শাসনকর্তা বলে মনে করেন।
গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের চরিত্র
ঐতিহাসিক বরণীর মতে, গিয়াসউদ্দিনের চরিত্র বহু গুণে ভূষিত ছিল। সমকালীন যুগের কলুষতা থেকে মুক্ত না হলেও, বহু শাসকের চরিত্রে যে কলুষতা ছিল, সুলতান গিয়াসউদ্দিন তার থেকে মুক্ত ছিলেন। তিনি নিজে মদ্যপান করতেন না এবং রাজ্যে মদ্যপান বন্ধ করার জন্য নিষেধাজ্ঞা জারী করেন।
নিষ্ঠাবান মুসলমান গিয়াসউদ্দিন তুঘলক
তিনি নিষ্ঠাবান মুসলমান ছিলেন, কিন্তু ধর্মোন্মাদ ছিলেন না। ব্যক্তিগত ধর্মমতের প্রতি অনুরাগ বশত তিনি অন্য ধর্মাবলম্বী প্রজাদের নিগ্রহ করেন নি। প্রকৃত ধার্মিকের উদারতা ও ন্যায়পরায়ণতা তার চরিত্রে ছিল।
গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের সামরিক দক্ষতা
সেনাপতি হিসেবে তিনি ছিলেন প্রথম শ্রেণীর। বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্রোহ দমন ও মোঙ্গল আক্রমণ দমন তার সামরিক দক্ষতার পরিচয় দেয়।
গিয়াসউদ্দিন তুঘলক কর্তৃক আলাউদ্দিনের কঠোরতা ত্যাগ
সুলতান গিয়াসউদ্দিন তাঁর শাসন নীতির ক্ষেত্রে এক অসাধারণ মধ্যপন্থা নীতি নেন। আলাউদ্দিন খলজির বহু নীতিকে তিনি গ্রহণ করলেও, তার প্রয়োগের জন্য তিনি আলাউদ্দিনের কঠোরতা ও দমন নীতি ত্যাগ করেন।
গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের ন্যায়পরায়ণতা ও দৃঢ়তা
ন্যায়পরায়ণতা ও দৃঢ়তা নিয়ে তিনি তাঁর নীতিগুলিকে কার্যকরী করে সিংহাসনের সঙ্গে জনসাধারণের যোগসূত্র স্থাপন করতে সক্ষম হন। একদিকে তিনি মুসলিম অভিজাতদের প্রতি উদারতা দেখান, অপরদিকে তিনি বংশ মর্যাদা অপেক্ষা যোগ্যতাকেই বেশী সমাদর জানান। গিয়াসউদ্দিন বলবন-এর মত তিনি জাতিগত অহমিকাকে অথবা বংশমর্যাদাকে কখনও প্রশ্রয় দেননি।
সকল মুসলিমের প্রতি গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের সমান দৃষ্টিভঙ্গি
তিনি নিজে পিতার দিক থেকে তুর্কীবংশীয় হলেও, হিন্দুস্থানী মুসলিমদের কখনও বলবনের মত নীচু চোখে দেখতেন না। তিনি তুর্কী ও হিন্দুস্থানী সকল শ্রেণীর মুসলিমকে সমান চোখে দেখতেন, সমান সুযোগ দিতেন।
ঐক্য স্থাপনে উদ্যোগী গিয়াসউদ্দিন তুঘলক
ভারতবাসী সকল সম্প্রদায়ের মুসলিমের মধ্যে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ স্থাপন ছিল তাঁর লক্ষ্য। এজন্য তিনি তার আইনগুলিকে এমনভাবে রচনা করেন যার ফলে সকল সম্প্রদায় সমান মর্যাদা ও সুযোগ পায়। তাছাড়া যোগ্যতাকেই তিনি রাজকর্মচারী পদে নিয়োগের মানদণ্ড বলে মনে করতেন।
গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের শাসন নীতি
- (১) শাসননীতির ক্ষেত্রে সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলক বহু উদ্ভাবনী শক্তি ও সংগঠন ক্ষমতার পরিচয় দেন। তিনি শাসন ব্যবস্থা থেকে দুর্নীতি দূর করেন, বিচার ব্যবস্থাকে নিরপেক্ষ করেন।
- (২) কৃষির উন্নতির জন্য তিনি বিশেষ প্রযত্ন নেন। আলাউদ্দিনের শোষণমূলক করনীতি পরিবর্তন করে, উৎপাদিত ফসলের ভাগ কর হিসেবে ধার্য করেন। তিনি প্রজাদের ওপর নির্যাতনমূলক এবং হিন্দুদের ওপর বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা লোপ করেন।
- (৩) ডাক ব্যবস্থা, সেচ ও রাস্তাঘাটের উন্নতি সাধন করেন। ডঃ আগা মেহেদি হোসেনের মতে, তাঁর সংস্কার ও শাসন নীতির জন্য গিয়াসুদ্দিন অত্যন্ত জনপ্রিয়তা পান।
সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের রাজতান্ত্রিক আদর্শ
- (১) গিয়াসউদ্দিন পিতৃতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের আদর্শ গ্রহণ করেন। অনাথ, আতুর ও দরিদ্রদের সাহায্য করাকে তিনি কর্তব্য মনে করতেন। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকলের মঙ্গল সাধন করার তিনি চেষ্টা করেন। তার শাসননীতি ছিল ন্যায়পরায়ণতা ও নিরপেক্ষতার দ্বারা সূচিত।
- (২) বরণী যথার্থ মন্তব্য করেছেন যে, “আলাউদ্দিন প্রচুর রক্তপাত, নির্যাতন ও বক্রনীতির দ্বারা যে সফলতা পান, সুলতান তুঘলক শাহ কোনো প্রকার অসৎ কাজ, নিষ্ঠুরতা বা হত্যা না করে মাত্র চার বৎসরে সেই সফলতা পান।”
গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের সাম্রাজ্য বিস্তার
সুলতানি সাম্রাজ্যের সীমা গিয়াসউদ্দিনের রাজত্বকালে সর্বাধিক বিস্তৃত হয়। দক্ষিণে তেলেঙ্গানা, পূর্বে বাংলা সুলতানি সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। কোনো বড় বিদ্রোহ বা অরাজকতা সুলতানি সাম্রাজ্যের শান্তিকে নষ্ট করেনি।
গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের ধর্মীয় সহিষ্ণুতা
যদিও গিয়াসউদ্দিন উলেমাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, কিন্তু এজন্য তিনি ধর্মান্ত, গোড়া, হিন্দু নির্যাতনকারী মুসলিম শাসকে পরিণত হননি। হিন্দুদের তিনি যেমন নির্যাতন করতেন না, তেমন তাদের ক্ষমতা ও শক্তিবৃদ্ধি তিনি নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি ধর্মান্তরকরণ বা হিন্দুমন্দির ধ্বংসের নীতি দ্বারা তাঁর শাসনকে কলঙ্কিত করেন নি।
ফিরোজ খলজির সাথে গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের তুলনা
- (১) খলজি বংশের স্থাপয়িতা জালালউদ্দিন ফিরোজ খলজির সঙ্গে তুঘলক বংশের প্রতিষ্ঠাতা গিয়াসউদ্দিন ফিরোজ তুঘলকের শাসন নীতির তুলনা করা যায়। উভয়ে ৫ বছর ধরে রাজত্ব করেন এবং উভয়ে দুর্ঘটনার ফলে নিহত হন।
- (২) উভয়ে বংশকৌলিন্য না থাকা সত্ত্বেও যোগ্যতার জোরে সিংহাসনে বসেন। বলবনের মৃত্যুর পর সুলতানি সংগঠনে যে ভাঙ্গন দেখা দেয় জালালউদ্দিন খলজি তা রোধ করেন। আলাউদ্দিনের মৃত্যুর পর যে ভাঙন ঘটে গিয়াসউদ্দিন তুঘলক তা প্রতিহত করেন। উভয়েই ছিলেন দক্ষ সেনাপতি।
উপসংহার :- গঠনমূলক সংস্কার এবং সুলতানি সাম্রাজ্যের বিস্তারের দিক থেকে বিচার করলে গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের স্থান জালালউদ্দিন অপেক্ষা অনেক উঁচুতে। তিনি যে উত্তরাধিকার রেখে যান তা সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলক ব্যবহার করেন।
(FAQ) গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের কৃতিত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
জালালউদ্দিন ফিরোজ খলজি।
গিয়াসউদ্দিন তুঘলক।
মহম্মদ বিন তুঘলক।
গিয়াসউদ্দিন তুঘলক।