দক্ষিণ ভারতের বিদ্যাসাগর কান্দুকুরি বীরসালিঙ্গম পানতুলু -র জন্ম পরিচয়, প্রথম জীবন, শিক্ষা, কর্মজীবন, প্রধান উদ্দেশ্য, সমাজের উন্নতি বিধানে ভূমিকা, রাজনীতি, গ্রন্থ রচনা সম্পর্কে আলোচনা করা হল।
কান্দুকুরি বীরসালিঙ্গম পানতুলু
ঐতিহাসিক চরিত্র | বীরসালিঙ্গম পানতুলু |
জন্ম | ১৬ ই এপ্রিল, ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দ |
পেশা | শিক্ষকতা |
উপাধি | দক্ষিণের বিদ্যাসাগর |
মৃত্যু | ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ |
ভূমিকা :- রায়বাহাদুর কান্দুকুরি বীরসালিঙ্গম ছিলেন ব্রিটিশ ভারত -এর মাদ্রাজ প্রদেশের একজন বিখ্যাত সমাজ সংস্কারক।
বীরসালিঙ্গমের জন্ম পরিচয়
কান্দুকুরি বীরসালিঙ্গম পানতুলু ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১৬ এপ্রিল পূর্ব গোদাবরী জেলার ঐতিহাসিক শহর রাজামুন্দ্রির এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
বীরসালিঙ্গমের প্রথম জীবন
মাত্র ৬ মাস বয়সে বীরসালিঙ্গম পানতুলু -র স্মলপক্স হয়েছিল। ৪ বছর বয়সে তার বাবা মারা যায়। তারা কাকা ভেঙ্কটারাত্মম তাকে দেখাশোনার দায়িত্ব নেন।
বীরসালিঙ্গমের শিক্ষা
তিনি প্রথমে রাস্তার স্কুলে এবং পরে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াশোনা করেন।
বীরসালিঙ্গমের কর্মজীবন
বীরসালিঙ্গম পানতুলু কর্মজীবনের প্রথমে কোরাঙ্গি গ্রামের একজন শিক্ষক ছিলেন।
বীরসালিঙ্গমের জীবনে প্রভাব
রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, কেশব চন্দ্র সেন প্রমুখের দ্বারা তিনি প্রভাবিত হয়েছিলেন। ব্রাহ্মসমাজ -এর ধারণা তিনি পছন্দ করতেন এবং রাজামাহেন্দ্র ভরমে একটি ব্রাহ্মমন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
বীরসালিঙ্গমের প্রধান উদ্দেশ্য
মানুষের নৈতিক উন্নতি ঘটিয়ে সামাজিক উন্নতির পথ প্রশস্ত করাই ছিল বীরসালিঙ্গম পানতুলু মূল উদ্দেশ্য।
পণ্ডিত বীরসালিঙ্গম
তেলেগু, সংস্কৃত এবং হিন্দি ভাষার একজন পন্ডিত ছিলেন বীরসালিঙ্গম পানতুলু।
বিরোধী ও সমর্থক বীরসালিঙ্গম
তিনি জাতিভেদ, অস্পৃশ্যতা, পৌত্তলিকতা, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, গণিকাবৃত্তি, রক্ষিতা পোষণ প্রভৃতির বিরোধী এবং বিধবাবিবাহ, অসবর্ন বিবাহ, নারীশিক্ষা প্রভৃতির উগ্ৰ সমর্থক ছিলেন।
বীরসালিঙ্গম তেলুগু সাহিত্যের জনক
বীরসালিঙ্গমই প্রথম তেলুগু ভাষায় উপন্যাস, নাটক, প্রকৃতিবিজ্ঞান ও ইতিহাস গ্ৰন্থের রচনা করেন। বীরসালিঙ্গম পানতুলু মনে করতেন সহজবোধ্য তেলুগু ভাষায় গ্ৰন্থ রচিত হওয়া উচিত।
তেলুগু সাংবাদিকতার জনক বীরসালিঙ্গম
১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘বিবেকবর্ধিনী’ নামে তেলুগু পত্রিকা প্রকাশ করেন। পরে তাঁর উদ্যোগে চিন্তামণি, সতীহিতবোধিনী, সত্যবাদী প্রভৃতি সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়।
সমাজের উন্নতি বিধানে
বীরসালিঙ্গম পানতুলু সমাজের উন্নতি বিধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
- (১) জাতিভেদ, অস্পৃশ্যতা ও দলিত শ্রেণির ওপর উচ্চবর্ণের শোষণ-পীড়নের তিনি তীব্র নিন্দা করেন।
- (২) মানুষের নৈতিক উন্নতি ঘটিয়ে সামাজিক উন্নতির পথ প্রশস্ত করাই ছিল তাঁর মূল লক্ষ্য।
- (৩) ব্রিটিশ সরকারের পদস্থ আমলা বিচারকদের দুর্নীতি ও অত্যাচারের কাহিনি জনসমক্ষে তুলে ধরে তিনি এর বিরোধিতা করেন।
- (৪) তিনি কয়েকটি সমাজসেবামূলক সংস্থা গড়ে তোলেন। যেমন ‘সংঘ সংস্কার সমাজম’ (১৮৭৬ খ্রি.), ´প্রার্থনা সমাজম’ (১৮৭৮ খ্রি.) এবং ‘স্ত্রী পুনর্বিবাহ সমাজম’ ( ১৮৮০ খ্রি.)।
শিক্ষার প্রসারে বীরসালিঙ্গম
বীরসালিঙ্গম পানতুলু নারী শিক্ষার একজন উৎসাহী সমর্থক ছিলেন। এর জন্য তিনি বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
- (১) বীরসালিঙ্গম তার বিভিন্ন বিদ্রুপাত্মক রচনা ও নাটকে নারীশিক্ষা-বিরোধীদের তীব্র বিদ্রুপ করেন।
- (২) তিনি দোয়ালেশ্বর (১৮৭৪ খ্রি) ও রাজামুন্দ্রিতে (১৮৮৪ খ্রি) একটি করে বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
- (৩) বীরসালিঙ্গম ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে রাজামুন্দ্রিতে হিতকারিনী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
- (৪) এই সময় তিনি তার যাবতীয় সম্পত্তি রাজামুন্দ্রি বিদ্যালয় ও রাজামুন্দ্রি বিধবা হোমকে দান করেন।
- (৫) বীরসালিঙ্গম বয়স্ক মহিলাদের জন্য বিদ্যালয়, হরিজনদের জন্য বিদ্যালয় ও শ্রমিকদের জন্য নৈশ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
নারীকল্যাণ
বীরসালিঙ্গম উপলব্ধি করেছিলেন যে, নারীর সার্বিক উন্নতি ছাড়া সমাজের প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই নারীকল্যাণের উদ্দেশ্যে তিনি একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
(১) বাল্যবিবাহের বিরোধিতা
বাল্যবিবাহের বিরোধিতায় বীরসালিঙ্গম পানতুলু বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছিলেন। যেমন –
- (ক) দক্ষিণ ভারতে ব্যাপক ভাবে প্রচলিত বাল্যবিবাহ কন্যা-শুল্কম (বিবাহের জন্য কন্যা ক্রয়) -এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে তিনি সোচ্চার হয়েছিলেন।
- (খ) তিনি শাস্ত্রের উদাহরণ দিয়ে প্রমাণ করেন যে, বাল্যবিবাহ শাস্ত্রসম্মত নয়।
- (গ) বাল্যবিবাহ বন্ধ করার জন্য বীরসালিঙ্গম ‘রাজামুন্দ্রি সমাজসংস্কার সমিতি’ প্রতিষ্ঠা করেন।
(২) বহুবিবাহের বিরোধিতা
বীরসালিঙ্গম পানতুলু পুরুষদের বহুবিবাহের প্রতিবাদ করেন। তিনি ‘সত্যরাজাচার্য পূর্বদেশ যাত্রালু’ নামক নাটকের মাধ্যমে পুরুষদের বহুবিবাহের বিরুদ্ধে তীব্র বিদ্রুপ করেন।
(৩) বিধবাবিবাহে উদ্যোগ
বিধবাবিবাহের ক্ষেত্রে বীরসালিঙ্গম উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন।
- (ক) তিনি ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে বিধবাবিবাহ সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন।
- (খ) বীরসালিঙ্গম পানতুলু -র উদ্যোগে রাজামুন্দ্রিতে ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দের ১১ ডিসেম্বর ভারতের প্রথম বিধবাবিবাহ অনুষ্ঠিত হয়।
- (গ) তিনি মহীশূরে (১৯০৭ খ্রি) এবং ব্যাঙ্গালোরে (১৯১০ খ্রি) একটি করে বিধবা-আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন।
(৪) উপপত্নীর বিরোধিতা
বীরসালিঙ্গম ধনী ও অভিজাত ব্যক্তিদের উপপত্নী বা রক্ষিতা পোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। এর বিরুদ্ধে তিনি দক্ষিণ ভারতে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলেন।
দক্ষিণ ভারতের বিদ্যাসাগর
বীরসালিঙ্গম বিধবাবিবাহের উগ্ৰ সমর্থক ছিলেন বলে মহাদেব গোবিন্দ রাণাডে তাকে ‘দক্ষিণ ভারতের বিদ্যাসাগর’ বলে অভিহিত করেছেন।
অন্ধ্রের রামমোহন
তেলুগু গদ্য সাহিত্যের উন্নতির জন্য বীরসালিঙ্গম পানতুলু কে অন্ধ্রের রামমোহন রায়ও বলা হয়।
তেলুগু রেনেসাঁর জনক বীরসালিঙ্গম
সমাজ সংস্কারে বীরসালিঙ্কমের প্রভূত অবদানের জন্য তাকে তেলেগু নবজাগরণ বা রেনেসাঁর জনক বলা হয়।
রাজনীতিতে বীরসালিঙ্গম
১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশন -এ বীরসালিঙ্গম একজন সদস্য হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
আধুনিক অন্ধ্রপ্রদেশের নবী
মূলত বীরসালিঙ্গমের সমাজ সংস্কারে অভূতপূর্ব অবদান রাখার স্বীকৃতি হিসেবে মানুষ তাকে অন্ধ্রপ্রদেশের নবী নামে ডাকে।
বীরসালিঙ্গম রচিত গ্ৰন্থ
বীরসালিঙ্গম ছিলেন তেলুগু সাহিত্যের জনক।
- (১) তিনিই প্রথম তেলুগু উপন্যাস, নাটক, প্রকৃতিবিজ্ঞান ও ইতিহাস গ্রন্থের রচয়িতা।
- (২) জোনাথন সুইফট-এর গ্যালিভার ট্রাভেলস-এর অনুসরণে বীরসালিঙ্গম রচনা করেন ‘সত্যরাজা পূর্বদেশ যাত্রালু’
- (৩) গোল্ডস্মিথের ভিকার অফ ওয়েকফিল্ড-এর অনুসরণে বীরসালিঙ্গম পানতুলু রচনা করেন ‘রাজশেখর চরিত্র’।
- (৪) তেলুগু সাহিত্যের বিবর্তন ও গতিপ্রকৃতির ওপর লেখা তার প্রামাণিক গ্রন্থটি হল ‘ দ্য লাইভস অব তেলুগু পোয়েটস’।
কান্দুকুরি বীরসালিঙ্গম পানতুলুর মহাপ্রয়াণ
১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ৭১ বছর বয়সে এই মহান ব্যক্তি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
(FAQ) কান্দুকুরি বীরসালিঙ্গম পানতুলু সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
কান্দুকুরি বীরসালিঙ্গম পানতুলুকে।
কান্দুকুরি বীরসালিঙ্গম পানতুলুকে।
উনিশ শতকের মধ্যভাগে দক্ষিণ ভারতের সমাজ সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ছিলেন বীরসালিঙ্গম পানতুলু।
কান্দুকুরি বীরসালিঙ্গম পানতুলুকে।
রাজশেখর চরিত্র।