আলাউদ্দিন খাঁ

সঙ্গীত সম্রাট আলাউদ্দিন খাঁ (১৮৬২-১৯৭২) ছিলেন উপমহাদেশের অন্যতম প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ এবং মাইহার ঘরানার প্রতিষ্ঠাতা। তিনি সেতার ও সরোদ বাজাতে পারদর্শী ছিলেন এবং শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে অসামান্য অবদান রেখেছেন। তিনি রবিশঙ্কর ও আলী আকবর খাঁর মতো কিংবদন্তি শিল্পীদের গুরু ছিলেন। তাঁর সৃষ্টি ও সঙ্গীত ভাবনা ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ

ঐতিহাসিক চরিত্রআলাউদ্দিন খাঁ
জন্ম১৮৬২ সাল, শিবপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, বাংলাদেশ
প্রধান উপকরণসরোদ, সেতার, তবলা
ঘরানামাইহার ঘরানা
উল্লেখযোগ্য শিষ্যরবিশঙ্কর, আলী আকবর খাঁ, অন্নপূর্ণা দেবী, পন্নালাল ঘোষ
সঙ্গীত জীবনভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে অবিস্মরণীয় অবদান
পুরস্কারপদ্মবিভূষণ (১৯৫৮), পদ্মভূষণ (১৯৫৪), সংগীত নাটক একাডেমি পুরস্কার (১৯৫২)
পরিচিতিভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রতিভাবান গুরু ও স্রষ্টা
প্রভাবভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে সৃজনশীলতা ও শিক্ষাদানের মাধ্যমে অবিস্মরণীয় প্রভাব
মৃত্যু৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭২, মাইহার, মধ্যপ্রদেশ, ভারত
আলাউদ্দিন খাঁ

ভূমিকা :- অধ্যবসায়, ধৈর্য, সাধনা আর নিষ্ঠা থাকলে একজন মানুষ যে যেকোনও ক্ষেত্রেই সাফল্যের চূড়ান্ত স্বীকৃতি লাভ করতে পারে-পৃথিবীর বহু মনীষীর জীবনে এই সত্য বারবার প্রমাণ হয়েছে। অতি সাধারণ দীনহীন অবস্থা থেকে কোনো মানুষ যখন কোনো বিষয়ে সর্বোচ্চ গৌরবের অধিকারী হন, তাঁর সাফল্যটাই তখন বড় হয়ে ওঠে সকলের চোখে। কিন্তু সেই গৌরব অর্জনের পথে তাঁকে যে কৃচ্ছতা, ত্যাগ, ধৈর্য ও অধ্যবসায়ের কঠোর পরীক্ষা দিতে হয়, তার সন্ধান রাখে কজন? অথচ সেই সফল সার্থক মানুষটির আসল পরিচয় বিধৃত থাকে পেছনে ফেলে আসা তাঁর জীবন-সংগ্রামের মধ্যেই। তাই হলো জীবনের ইতিহাস। এই ইতিহাসই একটি জীবনকে অমরত্বে উত্তীর্ণ করে, চিহ্নিত করে আদর্শ পুরুষরূপে। এমনি এক ইতিহাস-পুরুষ হলেন সঙ্গীত সম্রাট আলাউদ্দিন খাঁ। তাঁর জীবন ও সাধনার আদর্শ মানুষের চিরকালের প্রেরণার উৎস-স্বরূপ।

মহাসাধক মহাপুরুষ হয়ে ওঠার পথ

ঈশ্বরের অনুভূতি লাভের আকাঙ্ক্ষায় অধ্যাত্মমার্গের সাধকরা ঘরবাড়ি, আত্মীয়-পরিজন, সুখ-ভোগ, ধন-ঐশ্বর্য, সমস্ত কিছু ত্যাগ করে পাহাড়ে কন্দরে কঠিন সাধনায় মগ্ন হন। কখনো দেশে দেশে, পথে পথে ঘুরে বেড়ান, সাধু- সন্তের সঙ্গ করেন, শত শীত-গ্রীষ্ম, অনিদ্রা-অনাহারের যাতনা তাঁরা ভোগ করেন। তারপর ভবিষ্যতে তাঁরাই একদিন অভিষ্ট লাভ করে মহাসাধক মহাপুরুষ হয়ে ওঠেন।

সঙ্গীতগুরু ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ

যাঁরা সঙ্গীতের সাধনা করেন, তাঁদের জীবনও এই ঈশ্বর পাগল সাধকদেরই মতো ত্যাগ ও কৃচ্ছতার জীবন। সংসারের সবকিছু ত্যাগ করে গুরুর কৃপা লাভ করতে না পারলে সঙ্গীত জগতে প্রবেশের অধিকার লাভ করা যায় না। বহু লাঞ্ছনা, অপমান, অবহেলার কণ্টকে আকীর্ণ এই পথ। সম্পূর্ণভাবে গুরুমুখী সুর সাধনার পথ আর ধর্ম সাধনার পথ তাই অভিন্ন বলেই সিদ্ধান্ত করা হয়। সঙ্গীত সাধনার মাধ্যমে ঈশ্বর উপলব্ধিও সম্ভব। সঙ্গীতগুরু ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর জীবনই তার জ্বলন্ত উদাহরণ।

আলাউদ্দিন খাঁর জন্ম

১৮৬২ খ্রিস্টাব্দের ৮ই সেপ্টেম্বর, ত্রিপুরা জেলার ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার শিবপুর গ্রামে আলাউদ্দিন খাঁ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সদু খাঁ। সামান্য এক চাষী পরিবার হলেও আলাউদ্দিনের পরিবার গীতবাদ্যের চর্চার জন্য সুপরিচিত ছিল।

উত্তরাধিকার সূত্রে আলাউদ্দিন খাঁর সঙ্গীত প্রতিভা লাভ

সদু খাঁ নিজে তানসেন বংশীয় ওস্তাদ কাশিম আলি খাঁর কাছে সেতারে তালিম পেয়েছিলেন। উৎসব অনুষ্ঠানে তিনি সঙ্গীত পরিবেশন করতেন। উত্তরাধিকার সূত্রেই পিতার সঙ্গীত প্রতিভা লাভ করেছিলেন আলাউদ্দিন। পাঁচবছর বয়সেই পিতার কাছে সেতারে হাতেখড়ি হয়েছিল তাঁর। দাদার কাছে তবলার ঠেকাও রপ্ত করেছেন।

সুরের জগতের সঙ্গে আলাউদ্দিন খাঁর পরিচয়

সেই ছেলেবেলাতেই যাত্রার সঙ্গীত, জারী, সারি, বাউল, ভাটিয়ালী, কীর্তন ও পীরের পাঁচালি জাতীয় ধর্মসঙ্গীতের মাধ্যমে সুরের জগতের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘনিষ্ঠ হতে থাকে।

আলাউদ্দিন খাঁর পড়াশুনা

গ্রামের পাঠশালায় আলাউদ্দিনকে পড়াশুনা শেখার জন্য ভর্তি করা হয়েছিল। কিন্তু পড়াশুনার চাইতে সুরের প্রতিই তিনি বেশি আকর্ষণ বোধ করতেন। পীরের দরগায় বা সাধু-বৈরাগীর আখড়ায় গান শুনে তন্ময় হয়ে থাকতেন। সেতারের সুর তাঁকে পৃথিবীর সবকিছু ভুলিয়ে দিত। ছেলের অন্তরের টান কোন দিকে বুঝতে পেরে দূরদর্শী সদু খাঁ আর পড়াশুনার জন্য তাঁকে পীড়াপীড়ি করলেন না। স্কুল ছাড়িয়ে নিজেই ছেলেকে সেতারে তালিম দিতে লাগলেন। কিন্তু মা চাইতেন আলাউদ্দিন লেখাপড়া শিখে বড় মানুষ হোক। তাই কঠোর শাসনে রেখে পড়াশুনার দিকে তাঁর মন ফেরাবার চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু সুরের জগতের সন্ধান যে পেয়েছে, শুষ্ক পুঁথিগত বিদ্যার আকর্ষণে সে কি কখনো বাঁধা পড়ে।

কলকাতায় আলাউদ্দিন খাঁ

সুরের আকর্ষণেই আলাউদ্দিন একদিন সকলের অজ্ঞাতে বরিশালের ‘নাগদত্ত সিং’ যাত্রাদলের সঙ্গে ঘরের মায়া কাটিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। তারপর ঘুরতে ঘুরতে হাজির হলেন কলকাতায়। অজানা অচেনা জায়গা। হাতের পয়সাকড়িও শেষ হয়ে গেছে। সঙ্গের পুঁটলিতে বাড়তি কয়েকটা জামাকাপড় ছিল। তা-ও চুরি হয়ে গেছে। কোথায় যাবেন, কোথায় থাকবেন, কি খাবেন, কিছুই জানা নেই। এই অবস্থায় রাতের আশ্রয় হল ফুটপাথ। খিদে মেটালেন ভিক্ষে করে। দিনের পর দিন কাটতে লাগল। উত্তর কলকাতার এক ধনীর বাড়ির লঙ্গরখানায় ভিখিরিদের একবেলা খাবার দেওয়া হত। সন্ধান পেয়ে আলাউদ্দিন দুপুরের খাবারটা লঙ্গরখানায় খেতেন। রাতে ক্ষুধা মেটাতেন গঙ্গার জল দিয়ে। কাউকে কষ্ট বলেই মনে হতো না তাঁর।

আলাউদ্দিনকে গানের তালিম

মনে আশা ছিল, বাজনা বাজানো শিখবেন, উপযুক্ত গুরু নিশ্চয়ই খুঁজে পাবেন। একদিন সেই স্বপ্ন তাঁর সার্থক হল। পাথুরিয়াঘাটার সৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর আলাউদ্দিনের গান শুনে মুগ্ধ হলেন। তাঁরই যোগাযোগে তখনকার দিনের খ্যাতনামা সঙ্গীতশিল্পী ধ্রুপদ গায়ক গোপাল ভট্টাচার্য (নুলো গোপাল) আলাউদ্দিনকে গানের তালিম দিতে স্বীকৃত হলেন। তাঁর কাছেই গলা সাধার সঙ্গে সঙ্গে মৃদঙ্গ ও তবলা বাজানোও শিখতে লাগলেন আলাউদ্দিন। এই সময়ও ভরসা সেই লঙ্গরখানার একবেলা খাওয়া। বাকি বেলায় গঙ্গাজল। কিন্তু তাতে কী। মনে তাঁর অফুরন্ত উৎসাহ। উপযুক্ত গুরু পেয়েছেন। শিখতেও পারছেন মন-প্রাণ ঢেলে। এইভাবে কেটে গেল ৭টি বছর। সঙ্গীতগুরু গোপালচন্দ্রের মৃত্যু হল।

অর্কেস্ট্রা দলে আলাউদ্দিন খাঁ

সেই সময় মিনার্ভা থিয়েটারের সঙ্গীত পরিচালক হাবু দত্তের সংস্পর্শে এলেন আলাউদ্দিন। হাবু দত্তের পোশাকী নাম ছিল অমৃতলাল দত্ত। তিনি ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ-এর জ্ঞাতিভ্রাতা। তাঁর নিজের একটি ভাল অর্কেস্ট্রা দলও ছিল। সেই দল নাট্যকার গিরিশ ঘোষের থিয়েটারে গান ও নাচের সঙ্গে বাজাত। আলাউদ্দিনের স্থান হয়ে গেল অর্কেস্ট্রা দলে। তবলা বাদকের কাজ। রাতে দলের সঙ্গে তবলা ও পাখোয়াজ বাজাতেন তিনি। আর দিনের বেলাটা ডুবে থাকতেন নিজের রেওয়াজ নিয়ে। কিশোর আলাউদ্দিনের প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে হাবু দত্ত তাঁর জন্য সামান্য মাসোহারার ব্যবস্থা করে দিলেন। ফলে তাঁকে আর তখন লঙ্গরখানায় যেতে হত না। মন উৎসাহে ভরপুর। গান-বাজনার জগতে এসে মিশেছেন, রেওয়াজও করতে পারছেন মনের মতো। এই সময়েই তিনি বেহালা ও বংশীবাদন সহ আরও কতগুলো যন্ত্র শিখে নিলেন।

থিয়েটারে আলাউদ্দিন খাঁর নাম পরিবর্তন

বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের রূপকার নাট্যকার অভিনেতা গিরিশ ঘোষ থিয়েটারে আলাউদ্দিনের নাম বদলে দিয়েছিলেন। তিনি তাঁকে ডাকতেন প্রসন্ন বিশ্বাস নামে। নতুন কিছু শেখার প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল প্রবল। যখনই যা ভাল লেগেছে, তাই শিখে নিয়েছেন অনায়াসে। আয়ত্ত করার দক্ষতা ছিল তাঁর জন্মগত। থিয়েটারে থাকার সুবাদে বিচিত্র রকমের থিয়েটারি গানও কিছু আলাউদ্দিন রপ্ত করেছিলেন।

আলাউদ্দিন খাঁর বেহালা বাদন শিক্ষা

হাবু দত্তের দলে তিন বছর ছিলেন আলাউদ্দিন। এই সময়ের মধ্যে মেছোবাজারের হাজারী ওস্তাদের কাছে সানাইয়েরও তালিম নিয়েছেন। সেই সময়ে কলকাতায় ইডেন উদ্যানে বিলিতি ব্যান্ড বাজনা বাজত। সেই বাজনা শুনে আলাউদ্দিনেরও ইচ্ছে হল ইংরাজি বাজনা শিখবেন। ফোর্ট উইলিয়মের ব্যান্ডে বেহালা বাজাতেন লবো সাহেব। অনেক বাধা বিপত্তি কাটিয়ে তাঁর কাছে পৌঁছলেন আলাউদ্দিন। অল্পদিনের মধ্যেই শিখে নিলেন খাঁটি বিলিতি কায়দায় বেহালা বাজানো।

ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর বিবাহ

ইতিমধ্যে বাড়ি ছেড়ে আসার পর ৯ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। কী করে খবর পেয়ে এতদিন পরে একদিন বড় ভাই বংশীবাদক আফতাবউদ্দিন কলকাতা এসে উপস্থিত হলেন। তিনি ছোট ভাইকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন। ঘর ছেড়ে আবার যাতে পালাতে না পারেন সেইজন্য উপযুক্ত বন্ধনরজুরই ব্যবস্থা করেছিলেন আলাউদ্দিনের অভিভাবকেরা। রাতারাতি তাঁর বিয়ে দিয়েছিলেন। বিয়ের কনের নাম মদনমঞ্জরী। সবে নয় বছরের বালিকা।

আলাউদ্দিন খাঁর গৃহত্যাগ

সঙ্গীত-পাগল আলাউদ্দিনের মন পড়েছিল কলকাতার সঙ্গীতের জগতে। তাই বিয়ের রাতেই ঘুমন্ত নববধূর যৌতুকের টাকার পুঁটলি হাতিয়ে নিয়ে কাউকে কিছু না বলে ঘর ছেড়ে সোজা কলকাতায় চলে এলেন। এসেই একটি বেহালা ও একটি ক্ল্যারিওনেট কিনে ফেললেন।

ওস্তাদ আহমদ আলি খাঁর শিষ্য আলাউদ্দিন খাঁ

  • (১) এই সময়েই তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ হয়ে যায় ময়মনসিংহের জমিদার মুক্তাগাছার রাজার সঙ্গে। রাজা জগৎকিশোর তরুণ শিল্পীকে নিয়ে আসেন তাঁর দরবারে। সেই সময় আহমদ আলি নামে একজন প্রসিদ্ধ সরোদিয়া জমিদারের দরবারে ছিলেন। আলাউদ্দিনের মনে ইতিমধ্যে ধারণা সৃষ্টি হয়েছিল তিনি সঙ্গীত পারদর্শী হয়ে উঠেছেন। কিন্তু জমিদারের দরবারে আহমদ আলি খাঁর তোড়ি রাগিণীর আলাপ শুনে তাঁর সেই অহঙ্কার চূর্ণ হয়ে গেল।
  • (২) সুরের ঝঙ্কার তাঁর মনের গভীরে এমন আলোড়ন তুলল যে চোখের জল সামলাতে পারলেন না তিনি। উপলব্ধি করতে পারলেন তাঁর এতদিনের সাধনা শিক্ষা এই সঙ্গীতের তুলনায় অতীব তুচ্ছ। আলাউদ্দিনের চোখের সামনে সবকিছু মিথ্যে হয়ে গেল। কেবল রইলেন ওস্তাদ আহমদ আলি খাঁ। তাঁর পা জড়িয়ে ধরে আলাউদ্দিন বারবার কাতর স্বরে অনুরোধ জানাতে লাগলেন তাঁকে শিষ্য করে নেবার জন্য।
  • (৩) আলাউদ্দিনের আগ্রহ ও আকুলতা দেখে মুগ্ধ হলেন সদাশয় জমিদার। তিনি নিজেই আহমদ আলিকে অনুরোধ করলেন। শেষ পর্যন্ত সম্মত হলেন তিনি আলাউদ্দিনকে শেখাতে এবং সেই দিনই তাঁর কাছে নাড়া বেঁধে শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন আলাউদ্দিন। জমিদার জগৎকিশোর তাঁর একটি সরোদ সেদিন আলাউদ্দিনকে উপহার দিয়েছিলেন।

আলাউদ্দিনের সরোদ সাধনা

আহমদ আলি নতুন চেলাকে নিয়ে রামগড়ে নিজ গৃহে ফেরেন। এখানে আলাউদ্দিনের শুরু হল নতুন জীবন। সকাল-সন্ধ্যা তাঁকে গুরুর সেবাযত্ন আর তাঁর ঘরের কাজকর্ম নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হত। গৃহভৃত্যের মতো রান্না থেকে ঘর-সংসারের যাবতীয় কাজের দায়িত্বই যথাসময়ে পালন করতে হত আলাউদ্দিনকে। সেই সঙ্গে ছিল আহমদ আলির নিজস্ব ফাই ফরমাস। এই সব কিছুর ফাঁকেই নিভৃতে চলছিল আলাউদ্দিনের সরোদ সাধনার শিক্ষা। গুরু নিজ হাতে তাঁকে যা শেখাতেন তাতে মন ভরত না। তবু, নিরাশ হন নি তিনি। শিষ্যরূপে তিনি যে দয়ালু গুরুর পায়ে ঠাঁই পেয়েছেন তাতেই নিজেকে ধন্য মনে করতেন। আহমদ আলি যখন নিজে রাগ রাগিণীর আলাপ করতেন আলাউদ্দিন তা তন্ময় হয়ে শুনতেন। পরে নিজে গোপনে তা অভ্যাস করতেন। একবার যা তিনি শুনতেন তা তাঁর স্মৃতিতে গেঁথে যেত। ফলে এভাবেই আহমদ আলির নিজস্ব ঘরানার কাজ রপ্ত করে নিয়েছিলেন তিনি।

ব্যান্ড-মাস্টারের কাজে আলাউদ্দিন খাঁ

একদিন শিষ্যের সরোদ বাজনা শুনে আহমদ আলি চমৎকৃত হলেন। নিজ বংশের জিনিস অন্যের করায়ত্ত হচ্ছে দেখে তিনি তাঁকে জানালেন, তাঁর আর শেখাবার মতো কিছু নেই। পরামর্শ দিলেন, বিখ্যাত বীণকার উজির খাঁর কাছে শেখার চেষ্টা করতে। চার বছর রায়গড়ে থাকার পর আহমদ আলির কাছ থেকে বিদায় নিলেন আলাউদ্দিন। কিন্তু যাবেন কোথায়? নিরাশ্রয় অবস্থায় ঘুরতে ঘুরতে দৈবক্রমেই এই সময়ে এক নাইটক্লাবে ব্যান্ড-মাস্টারের চাকরি পেয়ে যান। কিন্তু চাকরিতে মন নেই তাঁর। কেবল গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য স্বীকার করতে হয়েছে।

রামপুরের নবাবের সামনে আলাউদ্দিন খাঁ

বিখ্যাত বীণকার উজির খাঁ রয়েছেন তাঁর সমস্ত মন জুড়ে। তাঁর কাছে যে আর্জি নিয়ে উপস্থিত হবেন, সেই উপায় নেই। খাঁ সাহেবের বাড়ির দেউরিতে পাহারা দিচ্ছে সশস্ত্র প্রহরী। ভেবে ভেবে উপায় বার করলেন আলাউদ্দিন। একদিন রামপুরের নবাববাহাদুর যখন তাঁর ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে হাওয়া খেতে বেরিয়েছেন, আলাউদ্দিন হঠাৎ সেই গাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। নবাবের হুকুমে আটক করা হল তাঁকে, বেয়াদবির শাস্তি পেতে হবে। আলাউদ্দিন এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলেন। তিনি নবাবসাহেবকে নিজের পরিচয় ও উদ্দেশ্যের কথা লিখে জানালেন।

উজির খাঁর শিষ্য রূপে আলাউদ্দিন খাঁ

আলাউদ্দিনের সঙ্গীতের প্রতি আকর্ষণ নবাববাহাদুরকে মুগ্ধ করল। তিনি তাঁকে প্রাসাদে ডেকে পাঠালেন। নবাবের আদেশে আলাউদ্দিন তাঁকে বেহালা বাজিয়ে শোনালেন। নবাব ছিলেন সমঝদার ও গুণগ্রাহী। তিনি তরুণ শিল্পীর প্রতিভার পরিচয় পেয়ে চমৎকৃত হলেন এবং ওস্তাদ উজির খাঁকে ডেকে আলাউদ্দিনের শিক্ষার ভার দিলেন। সেই রাতেই নাড়া বেঁধে আলাউদ্দিন উজির খাঁর শিষ্য তালিকাভুক্ত হলেন। ভারত বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী উজির খাঁ ছিলেন সঙ্গীতগুরু তানসেনের বংশধর। নবাবের অনুরোধে তিনি আলাউদ্দিনকে বীণা এবং সরোদ বাজনা শেখাতে রাজি হয়েছিলেন। নাড়া বাঁধার সময় তিনি নবাগত শিষ্যকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিলেন, “বিদ্যা কুপাত্রে দেব না, কুসঙ্গে যাব না, বিদ্যা ভাঙ্গিয়ে ভিক্ষা করব না, বাঈজী বারাঙ্গনাদের সঙ্গীত শেখাব না।”

ওস্তাদ আলাউদ্দিনকে উজির খাঁর শিক্ষা

নবাবসাহেব আলাউদ্দিন খাঁকে একদিন বলেছিলেন, সঙ্গীতবিদ্যা অর্থের বিনিময়ে উজির খাঁর কাছ থেকে কেউ লাভ করতে পারে না, কেবল তাঁর সেবা করেই তা লাভ করা সম্ভব। এই উপদেশ মেনে আলাউদ্দিন তাঁর সঙ্গীতগুরুর খেদমতে যত্নবান হলেন। গৃহভৃত্যের মতোই তিনি উজির খাঁর সমস্ত আদেশ নির্দেশ পালন করতেন। গোড়ার দিকে উজির খাঁ তাঁর পরিবারের বিদ্যা নবাগত শিষ্যটিকে দিতে গড়িমসি করছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি নিজ হাতে আলাউদ্দিনকে শিক্ষা দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।

উজির খাঁর মনোযোগ আকর্ষনে সফল আলাউদ্দিন খাঁ

ভারতের বহু গুণী শিল্পী সেই সময় রামপুরের নবাবের দরবারে নিযুক্ত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন উজির খাঁর সুযোগ্য শিষ্য মহম্মদ হুসেন খাঁ। তরুণ আলাউদ্দিনের একাগ্রতা দেখে তিনি তাঁকে বীণাবাদন শেখাতে শুরু করলেন। কিন্তু স্বয়ং উজির খাঁ তাঁর প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিলেন না। নবাব বাহাদুরের নিজস্ব একটি কনসার্ট দল ছিল। বিখ্যাত সব গুণী শিল্পী এই দলে নিযুক্ত ছিলেন। তাঁদের সঙ্গে বেহালা বাজাবার জন্য আলাউদ্দিনের প্রায়ই ডাক পড়ত। এইভাবেই তিনি আড়াই বছর পর উজির খাঁর মনোযোগ আকর্ষণ করতে সমর্থ হন।

আলাউদ্দিনের প্রতি মনোযোগী ওস্তাদ উজির খাঁ

অবশ্য উজির খাঁর জীবনের একটি বিয়োগান্ত ঘটনার প্রভাবও তাঁর মনোভাব পরিবর্তনে সাহায্য করেছিল। জ্যেষ্ঠপুত্র পিয়ার খাঁকে অত্যন্ত ভালবাসতেন উজির খাঁ। পুত্রকে তিনি উপযুক্ত শিক্ষায় দক্ষ করে তুলেছিলেন। হঠাৎ একদিনের অসুস্থতায় এই প্রাণাধিক প্রিয় পুত্রের মৃত্যু হলে উজির খাঁর মনে হল, আলাউদ্দিনের প্রতি সুবিচার করেন নি বলেই উপরওয়ালা তাঁকে পুত্রশোকের শাস্তি দিলেন। তারপর থেকে তিনি আলাউদ্দিনের প্রতি মনোযোগী হলেন এবং তাঁকে প্রকৃত পাঠ দিতে লাগলেন।

কলকাতায় আলাউদ্দিন খাঁর প্রত্যাবর্তন

দীর্ঘ বারো বছর গুরুর পদপ্রান্তে বসে সঙ্গীতের শিক্ষা গ্রহণ করলেন আলাউদ্দিন। অতি কঠোর সাধনার মধ্য দিয়ে তাঁকে অর্জন করতে হয়েছিল গুরুর প্রসন্নতা ও আশীর্বাদ। বারো বছর শিক্ষা গ্রহণের পর উজির খাঁ জানালেন আলাউদ্দিনের শিক্ষা সমাপ্ত হয়েছে, এখন তিনি স্বাধীনভাবে সঙ্গীতচর্চা করতে পারেন। সব মিলিয়ে দীর্ঘ আঠারো বছর রামপুরে অবস্থানের পর আলাউদ্দিন ফিরে এলেন কলকাতায়।

ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর সঙ্গীত দক্ষতা

দীর্ঘ সাধনার জীবনে আলাউদ্দিন সেতার, বাঁশী, বীণা, শানাই, বেহালা, সুরবাহার, সুরশৃঙ্গার, ক্ল্যারিওনেট, ফিডেন কর্নেট, প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র বাদনে দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। অবশ্য সরোদিয়া হিসেবেই তিনি সমধিক খ্যাতি অর্জন করেন। কণ্ঠসঙ্গীতের মধ্যে ধ্রুপদ, ধামার, হোলী ও আলাপ শিখেছিলেন। আবার তার-যন্ত্রের বাইরে ঢোল, খোল, তবলা, পাখোয়াজ বাজনাতেও তাঁর সমান দক্ষতা ছিল।

আলাউদ্দিন খাঁর শিষ্য মাইহারের রাজা

কলকাতায় আসার পর মধ্যপ্রদেশের মাইহারের রাজা ব্রজনাথ-সিং-এর সঙ্গে আলাউদ্দিনের যোগাযোগ হয়। রাজা তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। আলাউদ্দিন কোনো প্রকার গুরুদক্ষিণা নিতে রাজি হন নি। সারাজীবন অশেষ কষ্ট স্বীকার করে তিনি সঙ্গীতবিদ্যা অর্জন করেছিলেন। তাই তিনি সিদ্ধান্ত করেছিলেন সত্যিকার শিক্ষার্থীকে তিনি কোনো দক্ষিণা ছাড়াই শেখাবেন। শেষ পর্যন্ত রাজা আলাউদ্দিনকে তাঁর দেবোত্তর সম্পত্তির ম্যানেজার করে দেন। এই পদেই তিনি প্রায় ত্রিশ বৎসর নিযুক্ত ছিলেন। এতদিনে স্ত্রীকে দেশ থেকে নিয়ে এসে সংসার পাতার অবসর পেলেন আলাউদ্দিন। মাইহারেই প্রথম তিনি তাঁর সংসার জীবন আরম্ভ করেছিলেন।

নতুন নতুন বাদ্যযন্ত্র উদ্ভাবনে আলাউদ্দিন খাঁ

কিছুদিন পরেই রামপুর থেকে ডাক এল। গুরু উজির খাঁ তাঁকে জানালেন পুত্র পিয়ার খাঁর মৃত্যু হওয়ায় পুত্রপ্রতিম আলাউদ্দিনকেই পরিবারের সব বিদ্যা দিয়ে যেতে চান। আলাউদ্দিন তাই গুরুর কাছেই রয়ে গেলেন। উজির খাঁর মৃত্যু হলে, তিন বছর পর তিনি ফিরে এলেন কলকাতায়। সঙ্গে নিয়ে এলেন সেনী ঘরানার দুর্লভ সঙ্গীতধারা। মাইহারে আলাউদ্দিন উদ্ভাবন করলেন নতুন নতুন বাদ্যযন্ত্র-মনোহরা, কাষ্ঠতরঙ্গ, চন্দ্রসারং প্রভৃতি।

আলাউদ্দিন খাঁ কর্তৃক মাইহার ব্যান্ড গঠন

তিনি ঠিক করলেন নিরক্ষর দরিদ্র লোকদের সঙ্গীত শিক্ষা দেবার। ঢেঁড়া পিটিয়ে অনাথ, অন্ধ, নাম-পরিচয়হীন একশত জনকে সংগ্রহ করলেন সঙ্গীত শিক্ষা দেবার জন্য। এদের নিয়েই তিনি গঠন করলেন ভারত বিখ্যাত মাইহার ব্যান্ড। এছাড়াও বহু ছাত্রকে তিনি শিক্ষা দিয়ে ভারতের বিভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।

দুই হাতে সমান দক্ষ আলাউদ্দিন খাঁ

আলাউদ্দিনের সৃজনশীল প্রতিভার স্পর্শে সমৃদ্ধ হয়েছে ভারতীয় যন্ত্রসঙ্গীতের প্রতিটি ধারাই। তাঁর দক্ষতা এমনই অসাধারণ ছিল যে, তিনি বাঁ হাতে বাজাতে পারতেন যে যন্ত্র, তা ডান হাতেও বাজাতেন। উজির খাঁর কাছে শিক্ষনবিসীর সময় থেকেই তিনি তারের যন্ত্র বাজাতেন বাঁহাতে আর চামড়ার বাদ্য বাজাতেন ডান হাতে।

গৌরীপুরে আলাউদ্দিন খাঁ

এরপর গৌরীপুরের জমিদার বীরেন্দ্রকিশোর আচার্য চৌধুরীর আমন্ত্রণে আলাউদ্দিন কিছুদিন গৌরীপুরে বাস করেছিলেন। বীরেন্দ্রকিশোরকে তিনি শিখিয়েছিলেন সুরবাহার। তাঁরই আগ্রহে পন্ডিচেরী অরবিন্দ আশ্রমেও কিছুদিন অবস্থান করেছিলেন শিল্পী। শ্রী অরবিন্দ তাঁর বাজনা শুনে অভিভূত হয়েছিলেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন সঙ্গীত সাধনার মাধ্যমেও ঈশ্বরানুভূতি লাভ সম্ভব। আর আলাউদ্দিনকে মনে করতেন সেই ধারারই বিশিষ্ট সাধক।

আলাউদ্দিন খাঁর ইউরোপ পরিভ্রমন

১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে বিশ্ববিখ্যাত নৃত্যশিল্পী উদয়শঙ্করের প্রতিষ্ঠিত আলমোড়া কালচারাল সেন্টার-এর সঙ্গীত পরিচালক রূপে আলাউদ্দিন ইউরোপ পরিভ্রমণ করেন। তাঁর একক বাদ্য সর্বত্রই পাশ্চাত্যের শ্রোতাদের অকুণ্ঠ প্রশংসা ও শ্রদ্ধা অর্জন করে।

বিশ্বভারতীর ভিজিটিং প্রফেসর আলাউদ্দিন খাঁ

  • (১) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর বিশ্বভারতী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও (বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়) কিছুকালের জন্য তিনি ভিজিটিং প্রফেসরের পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন। এই সময় তাঁর সাধকরূপটি প্রত্যক্ষ করে অনেকেই বিস্ময়াবিষ্ট হয়েছেন। বিশিষ্ট সঙ্গীত-সাধক শান্তিদেব ঘোষ একদিনের বিবরণ এভাবে দিয়েছেন “বাংলাদেশের বাউলদের মনের মানুষের জন্য বিরহ-বেদনায় যেমন শাস্তি নেই, তেমনি ওস্তাদের সঙ্গীতের জন্য বিরহবেদনাও কোনও দিন মিটবে না”।
  • (২) একদিন আলাউদ্দিন খাঁকে অনুরোধ করা হল সকালে ভৈরবীর আলাপ শোনাবার জন্য। তিনি আনন্দের সঙ্গে রাজি হলেন। উঠেছিলেন শান্তিনিকেতন-এর পান্থশালা গৃহে। শোনাবার আগে বললেন যে, এটি তাঁর বড় প্রিয় রাগিণী আর বড় গম্ভীর রাগিণী। ঠুংরীর সঙ্গে জড়িত। তবে সে সুর তাঁর নিজের মনের ঠিক সুরে না বেজে ওঠা পর্যন্ত তা শুনে শ্রোতারা সকলে আনন্দ পাবে কিনা তিনি বলতে পারেন না। সবসময় তা বাজতে চায় না বলেই তাঁর মনে দুঃখের শেষ নেই।
  • (৩) কিন্তু সেদিন সকালে সবাই অবাক। তানপুরায় সুর বাজছে। নাতিকে (আলি আকবরের পুত্র ধ্যানেশ) সঙ্গে নিয়ে বসলেন। “আলাপে ভৈরবী-রাগিণীর রূপটি যেই মূর্তি ধরে উঠেছে ওস্তাদ তখনি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। অল্পক্ষণ চোখ বুজে চুপ করে থেকে আবার শুরু করলেন সেই আলাপ। শ্রোতারা নিঃশব্দে বসে। সকলেরই মনে এক শিহরণ। অপূর্ব এক বেদনার জাল রচনা করে চলেছে ওস্তাদের দুই হাত।”

আলাউদ্দিন খাঁর শিষ্য

ভারতীয় সঙ্গীতের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশিষ্ট অবদানের জন্য স্মরণীয় হয়েছেন সঙ্গীতাচার্য আলাউদ্দিনের শিষ্যরা। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য তাঁর পুত্র আলি আকবর, কন্যা অন্নপূর্ণা এবং জামাতা রবিশঙ্কর। এছাড়া বেনু-বংশীবাদক পান্নালাল ঘোষ, সঙ্গীত পরিচালক তিমিরবরণ ও তাঁর পুত্র ইন্দ্রনীল, সেতার শিল্পী নিখিল বন্দোপাধ্যায়, বেহালা শিল্পী শিশিরকণা, শরণরাণী ও রবীন ঘোষ প্রমুখ এবং আলাউদ্দিনের দুই ভ্রাতা বংশীবাদক আকতারউদ্দীন খাঁ ও সুরবাহারবাদক আয়েত আলী খাঁ।

ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শন

অনন্য সাধারণ প্রতিভার অধিকারী ছিলেন আলাউদ্দিন। তুলনারহিত ছিল তাঁর শিক্ষণপ্রতিভা। সৃজনশীল এই শিল্পীকে অকুন্ঠ শ্রদ্ধা ও স্বীকৃতি জানিয়েছে তাঁর দেশবাসী। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে হিন্দুস্থানী যন্ত্রসঙ্গীতের জন্য তাঁকে দেওয়া হয় সঙ্গীত আকাদেমী পুরস্কার। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে নির্বাচিত হন আকাদেমীর ফেলো। ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে রাষ্ট্রীয় পদ্মভূষণ এবং ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বভারতী কর্তৃক দেশিকোত্তম উপাধিতে ভূষিত করা হয় তাঁকে।

নিজের শেষ জীবনে আলাউদ্দিন খাঁ

শেষ জীবনে আলাউদ্দিন বেরিলীর পীরসাহেবের প্রভাবে যোগ, প্রাণায়াম ও ধ্যান শেখেন। মাইহারে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সারদেশ্বরী মঠ। সেখানে তিনি দেবী ভারতীর নিত্য সেবা পূজা ধ্যান করতেন।

আলাউদ্দিন খাঁর মৃত্যু

কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব আলাউদ্দিন খাঁ ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি প্রায় ১১০ বছর বেঁচেছিলেন।

উপসংহার :- আলাউদ্দিন খাঁ ছিলেন ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের এক অমূল্য রত্ন, যিনি তার সৃষ্টিশীলতা, প্রতিভা এবং শিক্ষাদানের মাধ্যমে এই সঙ্গীতকে সমৃদ্ধ করেছেন। মাইহার ঘরানার প্রতিষ্ঠা ও তার শিষ্যদের অসাধারণ সাফল্য তার সঙ্গীত জীবনের অন্যতম কীর্তি। সরোদ, সেতারসহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রে তার দক্ষতা এবং সঙ্গীতে তার গভীর অধ্যবসায় তাকে ভারতীয় সঙ্গীত জগতের এক মহানায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তার জীবন ও কর্ম ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক অনুপ্রেরণার উৎস এবং ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তার অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

(FAQ) ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. আলাউদ্দিন খাঁ কবে এবং কোথায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন?

আলাউদ্দিন খাঁ ১৮৬২ সালে শিবপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া (বর্তমান বাংলাদেশে) জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

২. তিনি কোন সঙ্গীত ঘরানার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন?

আলাউদ্দিন খাঁ মাইহার ঘরানার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন, যা ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে একটি প্রভাবশালী ঘরানা।

৩. আলাউদ্দিন খাঁর বিখ্যাত শিষ্যরা কারা ছিলেন?

তার উল্লেখযোগ্য শিষ্যদের মধ্যে রবিশঙ্কর, আলী আকবর খাঁ, অন্নপূর্ণা দেবী, এবং পন্নালাল ঘোষ অন্যতম।

৪. আলাউদ্দিন খাঁর প্রধান বাদ্যযন্ত্র কোনটি ছিল?

আলাউদ্দিন খাঁ সরোদ এবং সেতার বাজাতে পারদর্শী ছিলেন। তিনি অন্যান্য অনেক বাদ্যযন্ত্রেও দক্ষতা অর্জন করেছিলেন।

৫. আলাউদ্দিন খাঁ কোন কোন পুরস্কার পেয়েছিলেন?

তিনি পদ্মভূষণ (১৯৫৪) ও পদ্মবিভূষণ (১৯৫৮) পুরস্কারসহ বিভিন্ন সম্মাননা পেয়েছিলেন।

Leave a Comment