রোমান ধর্ম ছিল প্রাচীন রোমের পলিথেইস্টিক ধর্মবিশ্বাস, যেখানে বিভিন্ন দেব-দেবী এবং প্রকৃতির শক্তি পূজিত হতো। এই ধর্মে দেবতাদের জন্য মন্দির, উৎসব এবং বলিদানের প্রথা প্রচলিত ছিল। রোমান ধর্মের কেন্দ্রীয় দেবতা ছিলেন জুপিটার, জুনো, এবং মিনার্ভা, এবং তারা গ্রিক দেবতাদের সাথে সমতুল্য বলে বিবেচিত হতেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, রোমান সাম্রাজ্যে খ্রিস্টধর্মের উত্থান হলে রোমান ধর্মপ্রথা ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যায়।
প্রাচীন রোমান ধর্ম
ঐতিহাসিক ঘটনা বা গল্প | রোমান ধর্ম |
ধর্মের ধরন | পলিথেইস্টিক (বহু দেবতার পূজা) |
প্রধান দেবতা | জুপিটার, জুনো, মিনার্ভা |
উপাসনা পদ্ধতি | দেবতাদের সম্মানে মন্দির, বলিদান, উৎসব |
ধর্মের উৎসব | সাতুর্নালিয়া, লেমুরিয়া, ফ্লোরালিয়া, লুপারকালিয়া |
আচার-অনুষ্ঠান | বলিদান, প্রার্থনা, অগুরী (প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করে ভবিষ্যদ্বাণী) |
ধর্মীয় গ্রন্থ | নির্দিষ্ট কোনো গ্রন্থ ছিল না, মৌখিক ও পৌরাণিক কাহিনির মাধ্যমে প্রচলিত ছিল |
ধর্মীয় স্থান | প্যানথিয়নসহ বিভিন্ন মন্দির |
বিলুপ্তি | খ্রিস্টধর্মের উত্থানের পর রোমান ধর্ম ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যায় (৪র্থ-৫ম শতাব্দী) |
ভূমিকা :- রোমের প্রাচীন ধর্ম ছিল বহু ঈশ্বরবাদী এবং পুরাণের কাহিনি নির্ভর। এই ধর্মে ভয়-ভীতি, কৌতূহল, পরলোকে বিশ্বাস প্রভৃতির প্রাধান্য ছিল। পরে এই ধর্মে নানান দেবদেবীর প্রাধান্য দেখা যায়। সেক্ষেত্রে মিশরীয় এবং পারসিক ধর্মের প্রভাবও এই ধর্মে পরিলক্ষিত হয়। শেষে বহুত্ববাদী এই পেগান ধর্মের জায়গা করে নেয় রাষ্ট্রীয় ধর্ম ‘খ্রিস্টধর্ম’।
রোমের দেবদেবী
এযুগে রোমানরা নানা দেবদেবীর উপাসনা করতেন। রোমের প্রাচীন বাৎসরিক ক্যালেন্ডার ‘নুমা’-তে ৪৫টি ধর্মীয় উৎসবের কাহিনি পাওয়া যায়। রোমানদের আরাধ্য দেবদেবীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন নুমেন, অ্যাপোলো, ডায়ানা, জিউস, জুপিটার, জুনো, মার্স, মারকিউরি, মিনার্ভা, সিবেল, ভেনাস প্রমুখ।
পরলোকে রোমানদের বিশ্বাস
রোমানরা পরকালে এবং আত্মায় বিশ্বাসী ছিলেন। তাই তাঁরা ধর্মের ক্ষেত্রে পারলৌকিক ক্রিয়াকলাপ এবং পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতেন। তাঁদের নানা পারিবারিক দেবদেবীও ছিলেন।
খ্রিস্টপূর্ব যুগে রোমের পুরোহিত শ্রেণি
প্রাচীন রোম-এ অগার নামক পুরোহিতরা ঈশ্বরের ইচ্ছা ও নির্দেশ মানুষের মধ্যে ব্যাখ্যা করতেন। পন্টিফরা প্রচলিত বিভিন্ন ধর্মীয় প্রথার মধ্যে সমন্বয় ঘটাতেন। রোমান কিংবদন্তি থেকে জানা যায় যে, রাজতান্ত্রিক রোমে নুমা পম্পিলিয়াস একটি স্থায়ী পুরোহিত শ্রেণি গঠন করেছিলেন। রোমে প্রধান পুরোহিতকে পন্টিফেক্স ম্যাক্সিমাস বলা হত। রোমে প্রজাতন্ত্রের সূচনা পর্বে রেক্স স্যাক্রোরাস নামক পুরোহিত পদ তৈরি করা হয়। এ ছাড়াও রোমে অন্যান্য পুরোহিত গোষ্ঠী ও পদ ছিল।
প্রাচীন রোমে সম্রাটের ওপর ঈশ্বরত্ব আরোপ
রোমান সভ্যতার সূচনা থেকেই ধর্মের সঙ্গে রাজনৈতিক সংযোগ দেখা যায়, যা আরও দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয় প্রজাতন্ত্র থেকে সাম্রাজ্যবাদে উত্তরণ কালে। সম্রাট পদের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য সম্রাটরা নিজেদের ঈশ্বরের সন্তান বা প্রতিনিধি বলে অভিহিত করতেন এবং ঈশ্বরের মহিমা প্রচার করতেন। এইভাবে তারা সর্বশক্তিমান হতেন। যেমন সম্রাট জুলিয়াস সিজার নিজেকে ভেনাসের পুত্র আইওনিয়ের বংশধর বলে দাবি করেন। সম্রাটরা আমৃত্যু এই সম্মানলাভ করতেন। কিন্তু এর ফলে রোমানদের সঙ্গে খ্রিস্টানদের সংঘাত শুরু হয়।
রোমান ধর্মের বিবর্তন
দীর্ঘ বিবর্তনের পথে রোমান ধর্ম তার সহজ-সরল রূপটি হারিয়ে জটিল ও বৃহত্তর রূপ লাভ করেছিল। প্রাথমিকভাবে এই ধর্মের উপর গ্রিক ও এট্টুস্কান প্রভাব প্রকট হলেও প্রজাতন্ত্রের শেষদিকে ক্রমশ গ্রিক প্রভাব হ্রাস পেতে থাকে। আর প্রাচ্য ধর্মের সঙ্গে রোমান ধর্মের সংযোগ দৃঢ় হয়। মিশর-এর আইসিস, পারস্যের মিথ্র বা মিত্র তথা সূর্যের উপাসনা এ সময়ে গুরুত্বলাভ করে। সাম্রাজ্যের যুগে সম্রাট ঈশ্বররূপে প্রতিভাত হওয়ায় তা রাষ্ট্রধর্মে স্থান করে নেয়। তবে এক্ষেত্রেও নানা গোষ্ঠীর অস্তিত্ব ছিল। ইহুদিদের প্রভাবও রোমান ধর্মের উপর পড়েছিল।
প্রাচীন রোমে খ্রিস্টধর্ম
- (১) রোমান সভ্যতার প্রথম দিকে রোমানদের সঙ্গে খ্রিস্টানদের বিরোধ ছিল। রোমান সম্রাট কনস্টানটাইন আনুমানিক ৩১২ খ্রিস্টাব্দে (মতান্তরে ৩১৩ খ্রি.) নিজে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হন। তখন থেকে খ্রিস্টধর্ম রোমান ধর্মের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। পরবর্তীকালে জুলিয়ানের মতো রোমান সম্রাটরা রোমের সনাতন ধর্মের পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করলেও তা ফলপ্রসূ হয় নি।
- (২) ৩১১ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ সম্রাট থিওডোসিয়াস খ্রিস্টধর্মকে রোমান রাষ্ট্র ধর্মের স্বীকৃতি দেন। ফলে পেগান ধর্মের অস্তিত্ব লুপ্ত হয় এবং একেশ্বরবাদী খ্রিস্টধর্ম প্রসার লাভ করে। রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পরও ইউরোপ-এ খ্রিস্টধর্মের প্রভাব ও প্রসার অব্যাহত ছিল।
- (৩) থিওডোসিয়াস রোমে পৌত্তলিক ধর্মের অনুশীলন নিষিদ্ধ করেন, ফলে পৌত্তলিক ধর্মের পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়নি সত্য। কিন্তু খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরাও বিশুদ্ধ খ্রিস্টান ধর্মতত্ত্ব রোমান সাম্রাজ্যে জনপ্রিয় করে তুলতে পারেননি। তাই রোমান ধর্ম মিথু বা অগ্নি উপাসনা এবং খ্রিস্টতত্ত্ব মিলিয়ে এক নতুন চরিত্র লাভ করে, যা ছিল রোমান ক্যাথোলিক ধর্মের আদিরূপ।
উপসংহার :- রোমান ধর্ম ছিল প্রাচীন রোমের একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উপাদান, যা বহু দেবতার পূজা এবং ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পরিচালিত হতো। এটি রোমান জনগণের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা এবং রাজনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। দেবতাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে মন্দির, বলিদান এবং উৎসবের মাধ্যমে রোমান ধর্মের আচার পালিত হতো। যদিও খ্রিস্টধর্মের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে রোমান ধর্ম ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যায়, এর প্রভাব ইতিহাস, স্থাপত্য এবং সংস্কৃতিতে এখনও দৃশ্যমান। রোমান ধর্মের ইতিহাস আমাদের বহুদেবতাবাদী ধর্ম এবং প্রাচীন ধর্মীয় বিশ্বাসের একটি চমৎকার উদাহরণ প্রদান করে।
(FAQ) রোমের ধর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
রোমান ধর্ম ছিল বহু দেবতাবাদী, যেখানে রোমানরা বিভিন্ন দেবতা এবং প্রকৃতির শক্তিকে পূজা করত। এই ধর্মে দেবতাদের প্রতি মন্দির, উৎসব ও বলিদানের মাধ্যমে শ্রদ্ধা জানানো হতো। প্রতিটি দেবতার নির্দিষ্ট ভূমিকা ছিল, যেমন জুপিটার ছিলেন প্রধান দেবতা, বজ্রপাত ও আকাশের দেবতা, জুনো ছিলেন বিবাহ ও মাতৃত্বের দেবী, এবং মিনার্ভা ছিলেন জ্ঞান ও কৌশলের দেবী।
হ্যাঁ, রোমান দেবতারা অনেকাংশে গ্রিক দেবতাদের সমতুল্য ছিলেন। রোমানরা গ্রিক পুরাণ ও দেবতাদের গ্রহণ করে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতিতে মিশিয়ে দিয়েছিল। যেমন, জুপিটার গ্রিক দেবতা জিউসের সমতুল্য, জুনো গ্রিক দেবী হেরার সমতুল্য এবং মিনার্ভা গ্রিক দেবী অ্যাথেনার সমতুল্য।
বলিদান ছিল রোমান ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। দেবতাদের সন্তুষ্ট করতে পশু বলিদান এবং খাবার উৎসর্গ করা হতো। বিভিন্ন উৎসব এবং আচার-অনুষ্ঠানে বলিদান সাধারণত সুশৃঙ্খলভাবে সম্পন্ন করা হতো।
রোমান ধর্ম ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়েছিল খ্রিস্টধর্মের বিস্তারের কারণে। ৪র্থ শতাব্দীতে রোমান সম্রাট কনস্টান্টাইন খ্রিস্টধর্মকে সমর্থন করেন এবং ৩৯২ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট থিওডোসিয়াস খ্রিস্টধর্মকে রোমান সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করেন, যার ফলে রোমান ধর্মের প্রভাব কমে যায়।
রোমান ধর্মের কিছু বিখ্যাত উৎসবের মধ্যে রয়েছে সাতুর্নালিয়া (ফসল তোলা উৎসব), ফ্লোরালিয়া (ফুলের দেবী ফ্লোরার সম্মানে উৎসব), লেমুরিয়া (আত্মাদের সম্মানে), এবং লুপারকালিয়া (ফেব্রুয়ারি মাসে উর্বরতার উৎসব)।