দেশীয় ইতিহাস চর্চা প্রসঙ্গে ভারতীয় ইতিহাস চর্চার সমস্যা, ঐতিহাসিকদের ব্যাখ্যার পার্থক্য, দেশীয় ইতিহাস চর্চায় অগ্ৰসর, দেশীয় ইতিহাস চর্চায় জাতীয় ইতিহাস রচনা, দেশীয় ইতিহাস চর্চায় হিন্দু চেতনার ইতিহাস, দেশীয় ইতিহাস চর্চায় মুসলিম চেতনার ইতিহাস, দেশীয় ইতিহাস চর্চায় আঞ্চলিক ইতিহাস, দেশীয় ইতিহাস চর্চায় জাতীয় ইতিহাস, দেশীয় ইতিহাস চর্চায় অর্থনৈতিক ইতিহাস, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস, ভারত বিদ্বেষী ইংরেজ ঐতিহাসিক ও ভারতের জাতীয় ইতিহাস রচনা সম্পর্কে জানবো।
দেশীয় ইতিহাস চর্চা
ঐতিহাসিক ঘটনা | দেশীয় ইতিহাস চর্চা |
নদীয়া কাহিনী | কুমুদনাথ মল্লিক |
সত্যার্থ প্রকাশ | স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী |
ফল অব দ্য মুঘল এম্পায়ার | যদুনাথ সরকার |
ইকনমিক হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া | রমেশচন্দ্র দত্ত |
ভূমিকা :- ইতিহাস হল দেশ, কাল ও মানুষের কাহিনি। ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ও তাঁর মনোভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ, ঐতিহাসিকরাই তাঁদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে তথ্য নির্বাচন করেন, ঘটনাবলি সাজান, বিষয়বস্তু ব্যাখ্যা করেন এবং ইতিহাস রচনা করেন।
ভারতে দেশীয় ইতিহাস চর্চার সমস্যা
- (১) ঐতিহাসিকদের দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যাখ্যা-সংক্রান্ত পার্থক্যের জন্য ভারত-এর ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সমস্যার সৃষ্টি হয়। ইংরেজ ঐতিহাসিকরাই সর্বপ্রথম ভারতের আধুনিক ইতিহাসচর্চা শুরু করেন।
- (২) যেহেতু ভারতে রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার এবং অর্থনৈতিক শোষণ চালানোই সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের প্রধান লক্ষ্য ছিল, সেহেতু অতীত তাদের কাছে অবান্তর। বর্তমানই তাদের কাছে একমাত্র সত্য। তাই ইংরেজরা বিজেতার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ভারতের ইতিহাস রচনা করেন।
- (৩) অপরপক্ষে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ভারতীয় জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকরা ক্রমে ভারতের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে ইংরেজদের দৃষ্টিভঙ্গির ত্রুটিগুলি উপলব্ধি করতে থাকে। ফলে ভারতীয় ঐতিহাসিকরা ইংরেজদের চেয়ে পৃথক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ভারতের ইতিহাসচর্চা শুরু করে।
ঐতিহাসিকদের ব্যাখ্যার পার্থক্য
- (১) বিভিন্ন ঐতিহাসিকের পৃথক পৃথক মনোভাবের জন্য একই বিষয় নিয়ে লেখা দুজন ঐতিহাসিকের ইতিহাস গ্রন্থ পৃথক হতে পারে। তা ছাড়া ঐতিহাসিকের হাতে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন তথ্য আসে বলে ইতিহাস সর্বদা পরিবর্তনশীল।
- (২) এজন্য পলাশির যুদ্ধ সম্পর্কে পরস্পরবিরোধী ব্যাখ্যা উপস্থাপন করে ইংরেজ ঐতিহাসিক এস. সি. হিল সিরাজদ্দৌলাকে এবং ভারতীয় ঐতিহাসিক ব্রিজেন গুপ্ত ইংরেজদের দায়ী করেছেন।
- (৩) ইতিহাসের এরূপ পৃথক পৃথক ব্যাখ্যার জন্যই হয়তো আগাথা ক্রিস্টির উপন্যাসে একটি ছোট্ট মেয়ে তার স্কুলের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে ইতিহাস সম্পর্কে বলে, “এত রকমের বাজে জিনিসও পড়ানো হয়, যেমন – ইতিহাস। প্রত্যেক বইতে পৃথক বর্ণনা।”
ই. এইচ. কার -এর বক্তব্য
এজন্য ঐতিহাসিক ই. এইচ. কার বলেছেন, “ইতিহাসের পাঠ শুরু করার আগে ঐতিহাসিককে জানো।”
ভারতে দেশীয় ইতিহাস চর্চায় অগ্ৰসর
ইংরেজ ঐতিহাসিকদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ভারতীয় ঐতিহাসিকরাও ভারতের ইতিহাস রচনায় অগ্রসর হয়েছেন।
দেশীয় ইতিহাস চর্চায় জাতীয় ইতিহাস রচনা
- (১) প্রথমদিকের ঐতিহাসিকগণ জাতীয় ইতিহাস রচনায় অগ্রসর হন। তবে কোনো কোনো দেশীয় ঐতিহাসিক জাতীয়তাবাদের সঙ্গে হিন্দুত্ববাদ বা ইসলামকে যুক্ত করে ফেলেন।
- (২) তা ছাড়া প্রথমদিকে অধিকাংশ ভারতীয় ঐতিহাসিক প্রধানত আঞ্চলিক ইতিহাস ও দেশীয় রাজপুরুষদের জীবনী রচনায় গুরুত্ব দেন। পরবর্তীকালে জাতীয় ইতিহাস রচনা গুরুত্ব পায়।
ভারতে দেশীয় ইতিহাস চর্চায় হিন্দু চেতনার ইতিহাস
- (১) ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের পরবর্তীকালে ভারতীয়দের মধ্যে উপনিবেশবাদ-বিরোধী জাতীয়তাবাদী চেতনা শক্তিশালী হতে শুরু করে। জাতীয়তাবাদীরা ক্রমে দাবি তুলতে থাকে যে, ভারতীয়দের সামাজিক ও ধর্মীয় প্রথায় হস্তক্ষেপ করার অধিকার বিদেশি শাসকদের নেই। জাতীয়তাবাদের সঙ্গে হিন্দু চেতনা যুক্ত হয়ে পড়ে।
- (২) হিন্দু ঐতিহ্যকে জোরালোভাবে তুলে ধরার উদ্দেশ্যে অন্য সম্প্রদায়কে কলঙ্কিত করার পদক্ষেপও নেওয়া হয়। আর্য সমাজের নেতা স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী তাঁর সত্যার্থপ্রকাশ এর শেষ দুটি অধ্যায়ে বাইবেল ও কোরানের তাঁর সমালোচনা করেন। তাঁর কাছে কোরান হল অজ্ঞতার দলিল এবং মুসলিমরা হল ধর্মান্ধতার মূর্ত প্রতীক।
- (৩) বিনায়ক দামোদর সাভারকার মনে করতেন যে, “যেদিন মামুদ গজনী সিন্ধুনদ পার হয়েছিলেন, সেইদিন হিন্দুদের সঙ্গে মুসলমানদের জীবনমরণের সংগ্রাম শুরু হয়েছিল।”
দেশীয় ইতিহাস চর্চায় মুসলিম চেতনার ইতিহাস
- (১) হিন্দু চেতনার প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে কোনো কোনো মুসলিম জাতীয়তাবাদী এদেশের ইতিহাস রচনায় অগ্রসর হন। তাঁরা পশ্চিম এশিয়ার ইসলামের গৌরবের ইতিহাস এবং এদেশে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য তুলে ধরেন।
- (২) তাদের মতে, হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে চিরন্তন সংঘাতই ইতিহাসের নির্মম সত্য। মৌলানা শওকৎ আলি তাঁর প্রবন্ধে লেখেন যে, “হিন্দু ও মুসলিমরা হাজার বছর একসঙ্গে থাকলেও দুটি সংস্কৃতির মিলিত হয়ে এক হওয়ার কোনও সুযোগ নেই। মামদোতের নবাবও বলেন যে, “প্রায় বারশো বছর ধরে ভারতে পাকিস্তান বিদ্যমান রয়েছে।”
পরাধীন ভারতে দেশীয় ইতিহাস চর্চায় আঞ্চলিক ইতিহাস
ভারতীয় ঐতিহাসিকদের উদ্যোগে রচিত আঞ্চলিক ইতিহাস গ্রন্থগুলির মধ্যে অন্যতম হল –
- (১) কুমুদনাথ মল্লিক রচিত ‘নদীয়া কাহিনী’ (১৯১০),
- (২) সুরেন্দ্রনাথ সেন রচিত ‘অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সিস্টেম অব দ্য মারাঠাস’ (১৯২৩),
- (৩) ব্রিজেন গুপ্ত রচিত ‘সিরাজ-উদ-দৌলা’ (১৯৩৫),
- (৪) কালীকিঙ্কর দত্ত রচিত ‘বেঙ্গল সুবাস ১৭৪০-৭০’ (১৯৩৬),
- (৫) নরেন্দ্রকৃষ্ণ সিংহ রচিত ‘রাইজ অব শিখ পাওয়ার’ (১৯৩৬),
- (৬) কালীকিঙ্কর দত্ত রচিত ‘দ্য সানতাল ইনসারেকশন অব ১৮৫৫-৫৭’ (১৯৪০),
- (৭) মহাদেব গোবিন্দ রানাডে রচিত ‘রাইজ অব মারাঠা পাওয়ার’ (১৯৪০),
- (৮) সরদেশাই রচিত ‘নিউ হিস্ট্রি অব দ্য মারাঠাস্ (১৯৪৬-৪৮),
- (৯) নরহরি কবিরাজ রচিত ‘ওয়াহাবি অ্যান্ড ফরাজি রেবেলস অব বেঙ্গল’ (১৯৮২)।
দেশীয় ইতিহাস চর্চায় জাতীয় ইতিহাস
ভারতের জাতীয় ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রেও দেশীয় ঐতিহাসিকরা প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। এসব গ্রন্থে ভারতে ইংরেজ শাসনের ত্রুটি বিচ্যুতিগুলি তুলে ধরা হয়। জাতীয় ইতিহাস গ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল –
- (১) দাদাভাই নওরোজি রচিত ‘পোভার্টি অ্যান্ড আন-ব্রিটিশ স্কুল ইন ইন্ডিয়া’ (১৯০১),
- (২) রমেশচন্দ্র দত্ত কর্তৃক দুই খণ্ডে রচিত ‘ইকনমিক হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া’ (১৯০২ ও ১৯০৪),
- (৩) যদুনাথ সরকার কর্তৃক চার খণ্ডে রচিত ‘ফল অব দ্য মুঘল এম্পায়ার’ (১৯৩২-৫০),
- (৪) শশীভূষণ চৌধুরী রচিত ‘সিভিল ডিসটারবেন্স ডিউরিং ব্রিটিশ রুল ইন ইন্ডিয়া’ (১৯৫৫),
- (৫) ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার কর্তৃক সম্পাদিত এগারো খণ্ডে বিভক্ত ‘হিস্ট্রি অ্যান্ড কালচার অব দ্য ইন্ডিয়ান পিপল’ (১৯৫১-৭৭) প্রভৃতি।
ভারতে দেশীয় ইতিহাস চর্চায় অর্থনৈতিক ইতিহাস
বিভিন্ন ভারতীয় ঐতিহাসিক এদেশের কৃষিব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। ভারতীয় অর্থনৈতিক ইতিহাস সম্পর্কে এদেশের ঐতিহাসিকদের লেখা গ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল –
- (১) অমলেশ ত্রিপাঠী রচিত ‘ট্রেড অ্যান্ড ফিনান্স ইন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি’ (১৯৫৬),
- (২) নরেন্দ্রকৃষ্ণ সিংহ রচিত তিন খণ্ডের ইকনমিক হিস্ট্রি অব বেঙ্গল’ (১৯৫৬-৭০ ).
- (৩) বি. বি. মিশ্র রচিত ‘দ্য ইন্ডিয়ান মিডল ক্লাস’ (১৯৬১),
- (৪) রণজিৎ গুহ রচিত ‘বুল অব প্রোপার্টি ফর বেঙ্গল’ (১৯৮২),
- (৫) বিনয়ভূষণ চৌধুরী রচিত ‘গ্রোথ অব কমার্শিয়াল এগ্রিকালচার ইন বেঙ্গল’ (১৯৬৪), সিরাজুল ইসলাম রচিত ‘দ্য পারমানেন্ট সেটলমেন্ট ইন বেঙ্গল’ (১৯৭১) প্রভৃতি।
দেশীয় ইতিহাস চর্চায় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস
ভারতীয় ঐতিহাসিকগণ এদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস-বিষয়ক বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল –
- (১) মহাদেব গোবিন্দ রানাড়ে রচিত ‘রেলিজিয়াস অ্যান্ড সোশ্যাল রিফর্মস’ (১৯০২),
- (২) শিবনাথ শাস্ত্রী রচিত ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ (১৯০৩) এবং ‘হিস্ট্রি অব ব্রাহ্ম সমাজ‘ (১৯১১),
- (৩) প্রদীপ সিংহ রচিত ‘নাইনটিনথ সেঞ্চুরি বেঙ্গল : অ্যাসপেক্টস অব সোশ্যাল হিস্ট্রি’ (১৯৬৫),
- (৪) সালাউদ্দিন আহমেদ রচিত ‘সোশ্যাল আইডিয়াস অ্যান্ড সোশ্যাল চেঞ্জ ইন বেঙ্গল’ (১৯৬৫),
- (৫) ড. রাখালচন্দ্র নাথ রচিত ‘উনিশ শতক : ভাবসংঘাত ও সমন্বয়’ (১৯৮৮) এবং দ্য নিউ হিন্দু মুভমেন্ট ১৮৮৬-১৯১১ (১৯৮১) প্রভৃতি।
ভারত বিদ্বেষী ইংরেজ ঐতিহাসিক
সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ ঐতিহাসিকদের অধিকাংশই ছিলেন ভারত-বিদ্বেষী। তাঁরা ভারতবাসীকে স্বশাসনের অনুপযুক্ত বলে মনে করতেন। তাঁরা মূলত ভারতীয়দের অনগ্রসরতা এবং ইংরেজদের জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরতেই বেশি আগ্রহী ছিলেন।
পরাধীন ভারতের জাতীয় ইতিহাস রচনা
ভারতীয় ঐতিহাসিকরা নিজেদের রচনায় ভারতের অতীত গৌরবের কথা তুলে ধরে জাতিকে উদ্দীপ্ত করেন। তাঁরা ঔপনিবেশিক আমলে ভারতের অর্থনৈতিক দুরাবস্থা ও দারিদ্র্যের জন্য ইংরেজ শাসনকে দায়ী করেন।
উপসংহার :- সবশেষে বলা যায় যে, রমেশচন্দ্র মজুমদার, নরেন্দ্রকৃষ্ণ সিংহ, কালীকিঙ্কর দত্ত প্রমুখ জাতীয়তাবাদী ইতিহাস রচনার যে ধারা সৃষ্টি করেছিলেন তা পরবর্তীকালে গতি হারিয়ে ফেলেছে।
(FAQ) দেশীয় ইতিহাস চর্চা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
কুমুদনাথ মল্লিক।
স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী।
যদুনাথ সরকার।
রমেশচন্দ্র দত্ত।
রমেশচন্দ্র মজুমদার ও নরেন্দ্রকৃষ্ণ সিংহ।