যুক্তরাজ্যের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ, রাষ্ট্রনায়ক এবং লেখক উইনস্টন চার্চিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নেতৃত্ব দেন। তার দৃঢ় নেতৃত্ব এবং অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্য ব্রিটেনের জনগণকে যুদ্ধকালীন কঠিন সময়ে সাহস ও প্রত্যয় দিয়েছিল। চার্চিল একজন প্রতিভাবান লেখকও ছিলেন এবং তার সাহিত্যিক কৃতিত্বের জন্য ১৯৫৩ সালে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। তার ঐতিহাসিক ভূমিকা এবং বিচক্ষণ রাজনীতি বিশ্ব ইতিহাসে তাকে একজন কিংবদন্তী ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে।
রাজনীতিক উইনস্টন চার্চিল
ঐতিহাসিক চরিত্র | উইনস্টন চার্চিল |
পুরো নাম | উইনস্টন লিওনার্ড স্পেন্সার চার্চিল |
জন্ম | ৩০ নভেম্বর, ১৮৭৪ খ্রি |
দেশ | ইংল্যান্ড |
পেশা | রাজনীতিবিদ, লেখক, সামরিক কর্মকর্তা |
প্রধান পদবী | যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী |
প্রধান সময়কাল | ১৯৪০-১৯৪৫ এবং ১৯৫১-১৯৫৫ |
বিখ্যাত বক্তৃতা | “We shall fight on the beaches” |
গুরুত্বপূর্ণ কাজ | দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ব্রিটেনের নেতৃত্ব |
উল্লেখযোগ্য পুরস্কার | ১৯৫৩ সালে সাহিত্যিক নোবেল পুরস্কার |
মৃত্যু | ২৪ জানুয়ারি, ১৯৬৫ খ্রি |
ভূমিকা :- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবিস্মরণীয় নায়ক, ধুরন্ধর রাজনীতিক, কৌশলী সমরবিদ ও বাস্তববাদী লেখক উইনস্টন চার্চিল ইতিহাসের এক বিস্ময় পুরুষ। এই কীর্তিমান পুরুষ তাঁর অবিস্মরণীয় কর্ম-কৃতিত্বের ধারক ইংরাজ জাতির ইতিহাসকে উজ্জ্বল করেছেন। সম্পূর্ণ নাম ছিল উইনস্টন লিওনার্ড স্পেনসার চার্চিল। তবে সংক্ষেপিত উইনস্টন চার্চিল নামেই বিশ্বময় তাঁর পরিচিতি। এই নির্ভীক আত্মপ্রত্যয়ী মানুষটির সব চেয়ে বড় পরিচয় ছিল, পরাজয়ে তিনি কখনো ভেঙ্গে পড়তেন না। বরং পরাজয়কেই তিনি তাঁর কূটকৌশল ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞা প্রসাদে জয়মুখী করে তুলতেন। উইনস্টনের রক্তেই ছিল রাজনীতি আর যুদ্ধ। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তাঁর অতুলনীয় সাহিত্য প্রতিভা। তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের সমস্ত কীর্তিকাহিনী যদি কোনদিন মানুষ ভুলেও যায়, তাঁর অতুলনীয় সাহিত্যকীর্তির জন্য তিনি চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
উইনস্টন চার্চিলের জন্ম
১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দের ৩০শে নভেম্বর ব্রেনহেইম প্রাসাদে জন্মগ্রহণ করেন উনস্টন চার্চিল। তাঁর পিতা লর্ড র্যানডলফ চার্চিল ছিলেন ব্রিটেনের বিচক্ষণ রাজনীতিক।
রাজনীতিক উইনস্টন চার্চিলের পরিবার
চার্চিল পরিবারের দশম পুরুষ প্রথম চার্চিল ছিলেন ডরমেটের ক্যাভিলিয়র স্কোয়ার। ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম চার্লসের পক্ষে তিনি যুদ্ধ করেছিলেন। প্রথম চার্চিলের পুত্র মার্লবরোর ডিউক ছিলেন সেই সময়ের বিখ্যাত যোদ্ধা। উইনস্টনের পিতা সপ্তম ডিউকের পুত্র লর্ড র্যানডলফ চার্চিল ছিলেন বিজ্ঞ রাজনীতিক ও দক্ষ যোদ্ধা। তিনি টোরি গণতান্ত্রিক দলের প্রতিষ্ঠাতা নেতা। স্বাভাবিক ভাবেই উইনস্টন পারিবারিক উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছিলেন অসাধারণ সমর প্রতিভা। উইনস্টনের মা ছিলেন মার্কিন মহিলা, নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক লিওনার্ড জেরোমের কন্যা। উইনস্টন সাহিত্য প্রতিভা লাভ করেছিলেন তাঁর মাতৃকুলের তরফ থেকে। দুই পরিবারের দুই প্রতিভার মিলন ঘটেছিল উইনস্টনের মধ্যে।
উইনস্টন চার্চিলের ছেলেবেলা
ছেলেবেলা থেকেই উইনস্টন ছিলেন চিন্তাশীল। কিন্তু পড়াশুনায় ছিলেন অমনোযোগী। তাঁর বাইরের প্রকৃতি আর অন্তঃপ্রকৃতি ছিল বিপরীতধর্মী। পরিণত বয়সেও এই বৈপরীত্য ছিল তাঁর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। পড়াশুনায় অমনোযোগী হলেও সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান হিসেবে হ্যারোতেই লেখাপড়া শুরু হয়েছিল তাঁর। কিন্তু জুনিয়র স্কুলের গন্ডি পার হতে পারেন নি তিনি। হ্যারোতে অকৃতকার্য হয়েছিলেন দুবার। পুত্রের পড়াশুনার এহেন কৃতিত্বে স্বভাবতঃই চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন র্যানডলফ চার্চিল। কিন্তু পুত্রের সহজাত স্বভাব অনুধাবন করতে ব্যর্থ হন নি তিনি।
সামরিক বিদ্যালয়ে উইনস্টন চার্চিল
ডানপিটে স্বভাবের বালক উইনস্টন ছোট ভাইয়ের সঙ্গে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলতেই বেশি ভালবাসতেন। এই খেলায় উইস্টনের পুতুল-সৈন্য-সজ্জার কৌশল ও চাতুর্য দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন বিচক্ষণ র্যানডলফ। তাই হ্যারোতে দুবার অকৃতকার্য হবার পর তিনি ছেলেকে ভর্তি করিয়ে দিলেন স্যান্ডহার্স সামরিক বিদ্যালয়ে। স্যান্ডহার্সে আসার পর উইস্টনের প্রতিভার স্বাভাবিক স্ফুরণ ঘটল। এখানে তিনি সামরিক বিদ্যার সঙ্গে রাজনৈতিক পাঠও গ্রহণ করলেন।
সমাজ সংস্কারের কাজে উইনস্টন চার্চিল
স্যান্ডহার্সের শিক্ষা যখন শেষ হল, উইনস্টনের তখন বয়স কুড়ি বছর। ততদিনে তিনি তাঁর জীবনের লক্ষ্য স্থির করে নিয়েছেন। রাজনীতিক পিতার আদর্শ অনুসরণ করে সমাজ সংস্কারের কাজে আত্মনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
অশ্বারোহী বাহিনীতে উইনস্টন চার্চিল
যৌবনে পদার্পণ করে উইনস্টন পিতার প্রতিষ্ঠিত টোরি দলে যোগ দিলেন। কিছুদিন পরেই র্যাডলফ পরলোকগমন করলেন। ইতিমধ্যে উইনস্টন চতুর্থ হাল্কা অশ্বারোহী বাহিনীতে নিয়োগপত্র পেয়ে গেলেন। কিন্তু এই কাজে সন্তুষ্ট হতে পারলেন না তিনি। সৈনিক হিসাবে বাস্তব যুদ্ধের অভিজ্ঞতা লাভের জন্য তিনি উদগ্রীব হয়ে উঠলেন।
কিউবাতে উইনস্টন চার্চিল
১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে গ্রীষ্মকালীন অবকাশ যাপনের জন্য উইনস্টন চলে গেলেন কিউবা। সেখানে স্পেন-এর সরকারি ফৌজে যোগ দিলেন। কিউবার বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে বাস্তব অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের প্রথম সুযোগ এভাবে লাভ করলেন তিনি। যুদ্ধ-সাংবাদিকের হাতেখড়িও তাঁর হয় প্রথম কিউবাতেই। যুদ্ধের বিবরণ লিখে নিজের খরচেই তিনি নিয়মিত পাঠাতেন ডেইলি গ্রাফিক্স পত্রিকায়।
ভারতে উইনস্টন চার্চিল
১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে দেশে ফিরে এলেন। সেই বছরেই নিজের রেজিমেন্টের সঙ্গে চলে এলেন ভারত-এ। ভারতে তখন যুদ্ধাবস্থা না থাকায় পোলো খেলা নিয়েই কিছুদিন ব্যস্ত রইলেন উইনস্টন। তারপরেই এসে গেল যুদ্ধে যাবার সুযোগ। সীমান্ত প্রদেশে বিদ্রোহীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। তাদের দমন করার জন্য ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে মালাকান্দা গিরিপথে সৈন্য পাঠানো হল। উইনস্টন এই অভিযানে স্থান পাবেন আশা করেছিলেন। কিন্তু তাঁকে পাঠানো হল না। নিরাশ হলেন না তিনি। ডেইলী টেলিগ্রাফ ও এলাহাবাদ পাইওনীয়ারের পক্ষে সমর প্রতিবেদক হয়ে উইনস্টন মালাকান্দা অভিযানে অংশ নিলেন।
উইনস্টন চার্চিলের গ্রন্থ
ফিরে এসে রণাঙ্গনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে তিনি একটি বই লিখলেন। তাঁর এই প্রথম বইটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই তিনি সাহিত্যিক সম্মান পেলেন। জনপ্রিয় বই থেকে এই সময় প্রচুর অর্থাগমও হয়েছিল তাঁর। বইটিতে সরকারের সামরিক অব্যবস্থার সমালোচনা ছিল। এর ফলে সামরিক কর্তৃপক্ষের রোষে পড়তে হল তাঁকে।
নিজ খরচে উইনস্টন চার্চিলের অভিযান
১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে সুদানে গাজীরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে বসল। তাদের দমনের জন্য একটি অভিযানের আয়োজন করা হল। এই অভিযানে অংশ গ্রহণের জন্য উইনস্টন উদগ্রীব হলেন। কিন্তু তিনি মালাকান্দা অভিযানে সামরিক বাহিনীর সমালোচনা করেছিলেন। তাই সামরিক কর্তৃপক্ষ তাঁকে অভিযানে গ্রহণ করতে সম্মত হলেন না। উইনস্টন কিন্তু দমলেন না। তিনি নানা ভাবে চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত ২১ তম ল্যান্সারে শর্ত সাপেক্ষে যুক্ত হলেন। শর্তটি হল, উইনস্টনকে নিজের খরচে অভিযানের সঙ্গে যেতে হবে।
মিশরে উইনস্টন চার্চিল
সমর প্রতিবেদক হিসেবে যথেষ্টই সুনাম অর্জন করেছিলেন চার্চিল। তাই এবারে মর্নিংপোস্ট পত্রিকা তাঁকে তাদের সমর সাংবাদিক হিসেবে নিয়োগ করল। চার্চিলের অভিলাষ পূর্ণ হল। তিনি মিশর-এ চলে গেলেন এবং নির্দিষ্ট ল্যান্সারে যোগ দিলেন। দুই পক্ষের যুদ্ধ হল ওমডারম্যান অঞ্চলে। বিদ্রোহী গাজীদের রণকৌশলে এক সুরক্ষিত নালায় ইংরাজ রেজিমেন্টের প্রায় এক চতুর্থাংশ সৈন্য নিহত হল। চার্চিল নির্ভীক পদক্ষেপে এগিয়ে গিয়ে ছত্রভঙ্গ দলকে সংহত করে ব্রিটিশ রণকৌশলের এক অপূর্ব অধ্যায় রচনা করলেন।
রাজনৈতিক জীবনে উইনস্টন চার্চিল
যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ইংল্যান্ডে ফিরে এসে কলম নিয়ে বসলেন চার্চিল। লিখলেন দু খন্ডে রিভার ওয়ার। পাঠক মহলে উচ্চ প্রশংসা লাভ করল বইটি। সাহিত্য জগতে প্রতিষ্ঠা লাভের সঙ্গে সঙ্গে প্রচুর অর্থের মালিক হলেন তিনি। রিভার ওয়ারের সাফল্যে চার্চিল সৈনিক জীবন থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নিলেন। কারণ সেনাবাহিনী থেকে এই সময় তিনি যে মাইনে পেতেন, লেখা থেকে তার চাইতেও বেশি রোজগার করছিলেন। চার্চিল সামরিক বাহিনী ছেড়ে এবারে ফিরে এলেন রাজনৈতিক জীবনে।
বুয়র এলাকায় উইনস্টন চার্চিল
১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে ওল্ডহাম কেন্দ্রের উপনির্বাচনে অবতীর্ণ হলেন চার্চিল। কিন্তু রাজনীতির প্রথম যুদ্ধেই হেরে গেলেন। সেই বছরেই আরম্ভ হল বুয়র যুদ্ধ। চার্চিল মর্নিংপোস্ট পত্রিকার সমর সাংবাদিক হিসেবে চলে গেলেন বুয়র এলাকায়। সেখানে দুর্ভাগ্যবশতঃ শত্রুবাহিনীর হাতে বন্দি হলেন তিনি। তাঁকে পাঠানো হল প্রিটোরিয়ার বন্দিশালায়। কিন্তু বন্দিশালাতে নিষ্ক্রিয় রইলেন না চার্চিল। জেল থেকে পালাবার পরিকল্পনা করলেন। পরে একদিন গভীর রাতে পাঁচিল টপকে জেল থেকে বেরিয়ে এলেন।
দক্ষিণ আফ্রিকায় উইনস্টন চার্চিল
চার্চিল এর পরে চলে এলেন দক্ষিণ আফ্রিকায়। বুয়র শাসক তাঁকে ধরার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হল। দক্ষিণ আফ্রিকার হাল্কা অশ্বারোহী বাহিনীতেই এবারে যোগ দিলেন চার্চিল। এই বাহিনী নিয়ে তিনি সবার প্রথমে লেডিস্মিথ-এ পৌঁছলেন। জোহান্সবার্গ তখনো ছিল বুয়রদের দখলে। চার্চিল গ্রাহ্যের মধ্যে আনলেন না। তিনি শত্রুবাহিনীর চোখে ধুলো দিয়ে জোহান্সবার্গ হয়ে একসময় ইংল্যান্ডে ফিরে এলেন।
পার্লামেন্টে উইনস্টন চার্চিল
আবার রাজনীতিতে আবির্ভূত হলেন। ওল্ডহাম নির্বাচন কেন্দ্রে উপনির্বাচনে পরাজিত হয়েছিলেন চার্চিল। কিন্তু ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে এই পুরনো নির্বাচন কেন্দ্র থেকেই তিনি পার্লামেন্টে নির্বাচিত হলেন। চার্চিলের জীবনে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হল। পার্লামেন্টে অনতিকালের মধ্যেই তিনি বাগ্মী হিসেবে পরিচিতি লাভ করলেন। ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে যোসেফ চেম্বারলিন শুল্ক সংস্কারের সূচনা করেছিলেন। চার্চিল এই সংস্কারের তীব্র বিরোধিতা করেন।
লিবারেল পার্টিতে উইনস্টন চার্চিল
এরপর নিজের টোরি দলের সঙ্গে মতবিরোধ হওয়ায় তিনি তাঁর বন্ধু লয়েড জর্জের লিবারেল পার্টিতে যোগ দেন। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে লিবারেল পার্টি দেশের শাসন ক্ষমতা লাভ করে। চার্চিল লিবারেল পার্টির প্রার্থী হিসেবে উত্তর-পশ্চিম ম্যানচেস্টার কেন্দ্র থেকে জয়ী হয়েছিলেন। তিনি লাভ করলেন উপনিবেশ বিষয়ক উপ-সচিবের দায়িত্ব এবং অবিলম্বে কমনস সভার মাধ্যমে ব্রিটিশ উপনিবেশগুলিকে স্বায়ত্বশাসন দেওয়ার বিষয়ে উদ্যোগ নেন।
উইনস্টন চার্চিলের বিবাহ
পরবর্তী নির্বাচনে চার্চিল ডান্ডি থেকে নির্বাচিত হয়ে পার্লামেন্টের সদস্য হন। এই সময়ই তিনি বিয়ে করেন তাঁর পূর্ববর্তী নির্বাচনকেন্দ্র ম্যানচেস্টারের এয়ারলাই কাউন্টার পৌত্রী নীলনয়না ক্লিমেন্টাই হোজায়াইয়ারকে। তাঁদের দাম্পত্য জীবন সুখের হয়েছিল।
স্বরাষ্ট্র সচিব উইনস্টন চার্চিল
ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়েই চার্চিল লাভ করেছিলেন তাঁর রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতা। মাত্র ৩৭ বছর বয়সেই গ্রেট ব্রিটেনের স্বরাষ্ট্র সচিবের দায়িত্ব লাভ করেছিলেন তিনি। পরবর্তীকালে নৌবাহিনীর দায়িত্ব লাভ করে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর যুগোপোযোগী সংস্কার সাধন করেন।
উইনস্টন চার্চিলের যুদ্ধের প্রতি সহজাত আকর্ষণ
- (১) যুদ্ধবিগ্রহ সম্পর্কে চার্চিলের সহজাত আকর্ষণ তাঁকে বরাবরই সজাগ রাখত। ইউরোপ-এ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-এর সূত্রপাত হবার আগেই চার্চিল তার আভাস পেয়েছিলেন। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ নৌবাহিনীকে তিনি মন্ত্রিসভার ‘অগোচরেই যুদ্ধকালীন তৎপরতার সঙ্গে সক্রিয় করে তুলেছিলেন। বিশাল নৌ-মহড়াও সম্পূর্ণ করেছিলেন তিনি। এর ফল সমগ্র ইংরাজ জাতির পক্ষেই শুভ হয়েছিল।
- (২) যুদ্ধে সাফল্যের পাশাপাশি পরাজয়ও বরণ করতে হয়েছে তাঁকে। কিন্তু পরাজয় কখনো তাঁর মনকে মুষড়ে ফেলতে পারেনি। পরাজয়কে বীরের মতোই গ্রহণ করেছেন। ব্রিটেনের উপকূল রক্ষার জন্য তিনি যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন, নৌ ও বায়ু পরিষেবা যথেষ্ট জোরদার হয়েছিল। তথাপি ফরাসী চ্যানেলের দিকে জার্মান বাহিনীর অগ্রগতি প্রতিরোধ করতে পারেন নি।
- (৩) তুরস্ক আক্রমণ অসফল হলে নৌবাহিনীর দায়িত্বে থাকা চার্চিল পরাজয়ের নৈতিক দায়িত্ব স্বীকার করেছিলেন। পরিণতিতে ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে নবগঠিত কোয়ালিশন সরকার চার্চিলকে আব নৌবাহিনীর দায়িত্বে রাখতে চায় নি। চার্চিল পদত্যাগ করে পুনরায় সামরিক বাহিনীতেই ফিরে গিয়েছিলেন।
মন্ত্রিসভায় উইনস্টন চার্চিল
চার্চিলের বন্ধু ও রাজনৈতিক সহকর্মী লয়েড জর্জ ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। চার্চিলের রাজনৈতিক প্রতিভার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন তিনি। তাই চার্চিলকে মন্ত্রিসভার অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু টোরি পার্টির সদস্যদের বিরোধিতায় শেষ পর্যন্ত জর্জকে সংকল্প ত্যাগ করতে হয়। তবে পরের বছর, ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে চার্চিল মন্ত্রিসভার অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন।
চ্যান্সেলর অব এসচেকার উইনস্টন চার্চিল
এইভাবেই পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর পথ অতিক্রম করতে হয়েছে চার্চিলকে। নির্বাচনে দফায় দফায় যেমন পরাজিত হয়েছেন, তেমনি সেই পরাজয়কে জয়মুখী করে তুলতেও বিলম্ব হয়নি তাঁর। নির্বাচনে জয়লাভ করেই পার্লামেন্টে ফিরে এসেছেন। টোরি পার্টির প্রার্থী হিসেবে ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে নির্বাচনে জয়ী হয়ে তিনি চ্যান্সেলর অব এসচেকারের দায়িত্ব নিয়েছিলেন।
বলডউইনের সঙ্গে উইনস্টন চার্চিলের বিতণ্ডা
১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে নির্বাচনে জয়ী হয়ে লেবার পার্টি ক্ষমতায় আসে। সেই কালে চার্চিল নির্দ্বিধায় ম্যাকডোনাল্ডের সমালোচনা করেছিলেন এবং ভারতের স্বায়ত্বশাসনের বিষয়ে গোলটেবিল বৈঠক নিয়ে বলডউইনের সঙ্গে বিতন্ডায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন।
উইনস্টন চার্চিলের রাজনীতি ত্যাগ
সেই সময় ইংলন্ডের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই নড়বড়ে হয়ে পড়েছিল। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল রাজনৈতিক অস্থিরতা। ফলে ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে নির্বাচিত সরকার গঠন করা সম্ভব হল না, গঠিত হল জাতীয় সরকার। চার্চিল সাময়িকভাবে রাজনীতি থেকে সরে গিয়ে নিজের লেখালিখিতে মনোনিবেশ করলেন। তাঁর রচিত হিস্ট্রি অব দ্য ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড ওয়ার এবং হিজ লাইফ অব মালবরো পাঠকমহলে বিপুল সমাদর লাভ করে।
চিত্রকর উইনস্টন চার্চিল
লেখক-সাংবাদিক ও রাজনীতিক চার্চিলের আরও একটি পরিচয় হল, তিনি ছিলেন একজন দক্ষ চিত্রশিল্পী। তাঁর অঙ্কিত ছবির নিচে তিনি চার্লস মোরিন নাম সই করতেন। প্যারিসে তাঁর চিত্রকলার একটি প্রদর্শনী হয়েছিল এবং সেখানে প্রচুর ছবি ভাল দামে বিক্রি হয়েছিল।
নৌবাহিনীর দায়িত্বে উইনস্টন চার্চিল
সেই রাজনৈতিক অস্থিরতার পরিবেশে বিচক্ষণ রাজনীতিক চার্চিল ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীকে বারবার বহিরাক্রমণ সম্পর্কে সজাগ করে দিয়েছিলেন। সময়টা ছিল ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দ। সামরিক বিশারদ চার্চিলের কথা সেই সময় কর্তৃপক্ষ বিশেষ আমলে আনেন নি। কিন্তু পরবর্তী একবছরের মধ্যেই রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঘোরালো হয়ে উঠল এবং চার্চিলের আশঙ্কাই সত্য প্রমাণিত হল। বাধ্য হয়ে ব্রিটেনকে সেই সময় সমর বিষয়ে একটি নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। চেম্বারলিন মন্ত্রিসভার রদবদল ঘটালেন এবং নৌবাহিনীর দায়িত্বে চার্চিলকে নিয়ে আসা হল।
উইনস্টন চার্চিলের জয়জয়কর
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হলে প্রথম দিকে কয়েক মাস ব্রিটিশ নৌবাহিনীকেই যুদ্ধ সামাল দিতে হয়েছিল। স্থলবাহিনী জার্মান আক্রমণ প্রতীক্ষায় ফরাসীর ট্রেঞ্চে অবস্থান নিয়েছিল। বিমানবাহিনীও ব্যস্ত ছিল প্রচার পুস্তিকা ছড়ানোর কাজে। ব্রিটিশ নৌবাহিনী তার প্রথম ছয় মাসের যুদ্ধে জার্মানির ইউ বোটকে ডুবিয়ে দিতে সমর্থ হয়েছিল। চার্চিলের হল জয় জয়কার।
প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল
জার্মান বাহিনী ডেনমার্ক ও নরওয়ে আক্রমণ করলে প্রধানমন্ত্রী চেম্বারলিন এমনই বেসামলা হয়ে পড়লেন যে তাঁর নিজের দলের সদস্যদেরই সমালোচনার মুখে পড়লেন। শেষ পর্যন্ত তাঁকে পদত্যাগ করতে হল যখন জার্মান বাহিনী হল্যান্ড ও বেলজিয়াম আক্রমণ করে বসল। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ১১ই মে তারিখে চার্চিল গ্রেট ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করলেন।
বিজয়ী নায়ক উইনস্টন চার্চিল
যুদ্ধ জর্জরিত দেশের নিরপত্তা রক্ষার জন্য সেই সময় সমর বিশারদ চার্চিল যে সামরিক কৌশল গ্রহণ করেছিলেন তাতে দেশের অখন্ডতা অক্ষুণ্ণ ছিল। চার্চিল হয়ে উঠেছিলেন দ্বিতীয় মহাসমরের বিজয়ী নায়ক। মহাযুদ্ধের অবসান হল ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ৮ই মে। কৃতজ্ঞ ইংরাজ জাতি বিজয়ী সমর নায়ককে তাঁদের জাতীয় নায়ক হিসেবে বরণ করে নিল।
নির্বাচনে উইনস্টন চার্চিলের পরাজয়
যুদ্ধ শেষ হলে দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল। কিন্তু নির্বাচনে হেরে গেল চার্চিলের পার্টি। ক্ষমতাসীন হল লেবার পার্টি। নেতৃত্বে রইলেন ক্রিমেন্ট এটলী। চার্চিলের বয়স তখন ৭০ বছর। রাজা ষষ্ঠ জর্জ চার্চিলকে নাইট উপাধি দিয়ে সম্মানিত করতে চাইলেন। কিন্তু তখনো রাজনৈতিক জীবন থেকে অবসর নেবার ইচ্ছা ছিল না তাঁর। তাই তিনি নাইট হুড গ্রহণ করে রাজনৈতিক জীবনের পরিসমাপ্তি টানতে চাইলেন না।
দ্বিতীয় বার ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল
এর পরও বিরোধী দলের নেতা হিসেবে চার্চিল জাতির সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে চার্চিলের দলই নির্বাচিত হল। দ্বিতীয় বারের মতো ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী হবার পর বাজা ষষ্ঠ জর্জ পূর্বে তাঁকে যে সম্মানে ভূষিত করতে চেয়েছিলেন সেই সম্মান তিনি গ্রহণ করলেন ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের হাত থেকে।
উইনস্টন চার্চিলের প্রতি সম্মাননা
তাঁর সাহিত্য সাধনার স্বীকৃতিও চার্চিল লাভ করেছিলেন ওই একই বছরে। ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে সাহিত্যের নোবেল পুরস্কার দিয়ে তাঁকে সম্মানিত করা হয়েছিল। বিশ্বসাহিত্যে চার্চিলের অবিস্মরণীয় অবদান আ হিস্ট্রি অব ইংলিশ স্পিকিং পিপলস ও ছয়খন্ডে প্রকাশিত দ্য সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার।
উইনস্টন চার্চিলের প্রধানমন্ত্রীর পদ ত্যাগ
১১৫৫ খ্রিস্টাব্দে আশি বছর বয়সে চার্চিল প্রধানমন্ত্রীর পদ ত্যাগ করে রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
রাজনীতিক উইনস্টন চার্চিলের মৃত্যু
১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে ৯১ বছর বয়সে দুই শতাব্দীর অবিস্মরণীয় পুরুষ উইনস্টন চার্চিল পরলোক গমন করেন।
উপসংহার :- উইনস্টন চার্চিল ছিলেন ব্রিটেনের এক অসামান্য নেতা, যিনি তার দক্ষ নেতৃত্ব, অপ্রতিরোধ্য মনোবল, এবং অনুপ্রেরণাদায়ক বক্তৃতার মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং সংকটকালীন দৃঢ় নেতৃত্ব কেবল ব্রিটেনের জনগণকেই নয়, সারা বিশ্বকে তার প্রতিভার প্রতি শ্রদ্ধাশীল করেছে। পাশাপাশি, তার সাহিত্যিক প্রতিভা ও ইতিহাস বিষয়ক লেখনী তাকে নোবেল পুরস্কারের মতো সম্মান এনে দিয়েছে। চার্চিলের জীবন ও কাজ ইতিহাসে চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে, যা ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য প্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করবে।
(FAQ) উইনস্টন চার্চিল সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
উইনস্টন চার্চিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অসাধারণ নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং তার অনুপ্রেরণামূলক বক্তৃতাগুলি ব্রিটিশ জনগণের মনোবল ধরে রাখতে সহায়তা করেছিল।
চার্চিল ছিলেন একজন প্রতিভাবান লেখক যিনি ইতিহাস এবং আত্মজীবনীমূলক বই লিখতেন। তার লেখালেখির জন্য তিনি ১৯৫৩ সালে নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পান।
তার “We shall fight on the beaches” বক্তৃতাটি সবচেয়ে স্মরণীয় এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেনের দৃঢ়তার প্রতীক হয়ে আছে।
চার্চিলের নেতৃত্বের বিশেষত্ব ছিল তার অসীম সাহস, দূরদর্শী পরিকল্পনা এবং শক্তিশালী ও অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্য যা ব্রিটেনের জনগণকে সংকটকালে আশাবাদী ও সংগঠিত রাখে।
তার বহুল পরিচিত সাহিত্যিক কাজ “The Second World War” এবং “A History of the English-Speaking Peoples”।