আজাদ হিন্দ বাহিনীর বিচার প্রসঙ্গে পরিস্থিতি, বিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, সেনাদের সহায়তা, বিচারের বিরুদ্ধে প্রচারকার্য, বিচারের বিরুদ্ধে সংবাদপত্র ও পুস্তিকা প্রকাশ, বিচারের বিরুদ্ধে পোস্টার, মিছিল, সেনাবাহিনীতে প্রভাব, কলকাতায় বিক্ষোভ, ছাত্র আন্দোলন ও রশিদ আলী দিবস সম্পর্কে জানব
সামরিক বিচারালয়ে আজাদ হিন্দ বাহিনীর বিচার প্রসঙ্গে দিল্লির লালকেল্লায় আজাদ হিন্দ সেনাদের বিচার শুরু, আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রধান উকিল ভুলাভাই দেশাই এবং নেহরু, আজাদ হিন্দ বাহিনীর বন্দি সেনাদের বিচারকে কেন্দ্র করে সারা ভারতে প্রবল গণবিক্ষোভ সম্পর্কে আলোচনা।
আজাদ হিন্দ বাহিনীর বিচার
ঐতিহাসিক ঘটনা | আজাদ হিন্দ বাহিনীর বিচার |
স্থান | দিল্লীর লালকেল্লা |
সময় | মে, ১৯৪৫ খ্রি |
আইনজ্ঞ | জওহরলাল নেহরু, ভুলাভাই দেশাই |
প্রতিক্রিয়া | ছাত্র আন্দোলন, রশিদ আলি দিবস |
রশিদ আলি দিবস | ১২ ফেব্রুয়ারি |
ভূমিকা :- ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দের মে মাস থেকে আজাদ হিন্দ বাহিনীর বন্দি সেনাদের ভারত-এ পাঠানো শুরু হয় এবং ২৪ আগস্ট ভারত সরকার ঘোষণা করে যে ‘রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার’ অপরাধে দিল্লির লাল কেল্লায় সামরিক আদালতে তাদের প্রকাশ্য বিচার হবে।
আজাদ হিন্দ বাহিনীর বিচার কে ঘিরে পরিস্থিতি
এই বিচারকে কেন্দ্র করে সমগ্র ভারতে এক প্রবল উন্মাদনা দেখা দেয়, যা ব্রিটিশ শাসক কুলের মনে প্রবল ভীতির সঞ্চার করে। ব্রিটিশ লেখক ফিলিপ ম্যাসন-এর মতে এই ঐতিহাসিক বিচার ব্রিটিশ শাসনের মৃত্যুঘণ্টা ধ্বনিত করে।
ভারতে আজাদ হিন্দ বাহিনীর বিচার শুরু
ব্রিটিশ সরকার ২০ হাজার বন্দির মধ্যে কয়েকশো জনের প্রকাশ্য বিচারের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৪৫-এর ৫ নভেম্বর দিল্লির লালকেল্লায় একই সঙ্গে আজাদ হিন্দ বাহিনীর তিন সেনাপতি প্রেম কুমার সেহগল, শাহনওয়াজ খান এবং গুরবক্স সিং ধিলন এর প্রকাশ্য বিচার শুরু হয়।
আজাদ হিন্দ বাহিনীর বিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ
- (১) এই আজাদ হিন্দ বাহিনীর বিচারকে কেন্দ্র করে সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। জওহরলাল নেহরু, ভুলাভাই দেশাই, তেজবাহাদুর সপ্রু, কৈলাসনাথ কাটজু, আসফ আলি প্রমুখ কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ আইনজ্ঞ হিসেবে আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেনাদের পাশে দাঁড়ান। জওহরলাল নেহরু দীর্ঘ ২৫ বছর বাদে নিজের গায়ে তুলে নেন আইনজীবীর পোশাক।
- (২) কেবলমাত্র কংগ্রেসই নয় – মুসলিম লিগ, কমিউনিস্ট পার্টি, হিন্দু মহাসভা, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ, অকালি দল, শিখ লিগ, ইউনিয়নিস্ট পার্টি, জাস্টিস পার্টি নিজেদের বহুবিধ মতপার্থক্য সত্ত্বেও আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেনাদের মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে। জাতিধর্মবর্ণ, সামাজিক অবস্থান চিত্র ও রাজনৈতিক মতপার্থক্য নির্বিশেষে সারা ভারতের মানুষই এই আন্দোলনে শামিল হয়।
ভারতে আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেনাদের সহায়তা
এই আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেনাদের সাহায্যের জন্য দেশের নানা স্থান থেকে অর্থ সাহায্য আসতে থাকে। মুক্তিপ্রাপ্ত সেনাদের জন্য জাতীয় কংগ্রেস অর্থ, খাদ্য এমনকি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতেও উদ্যোগী হয় এবং এইসব কাজে অর্থ সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন তহবিল গঠন করে। দেশের বিভিন্ন পৌরসভা, জেলাবোর্ড, প্রবাসী ভারতীয়, বিভিন্ন গুরুদ্ধার কমিটি, বোম্বাই ও কলকাতার চিত্রতারকারা – এমনকি বোম্বাই ও অমরাবতীর টাঙ্গাওয়ালারাও অর্থ সাহায্য করে।
আজাদ হিন্দ বাহিনীর বিচারের বিরুদ্ধে প্রচারকার্য
সারা দেশ জুড়ে পালিত হয় ‘আজাদ হিন্দ সপ্তাহ’ এবং ‘আজাদ হিন্দ দিবস’। দেশের নানা স্থানে আজাদ হিন্দ ফৌজ প্রতিরক্ষা তহবিল’, ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ পতাকা দিবস’ প্রভৃতি পালনের জন্য তীব্র উদ্দীপনা দেখা দেয়। ‘জয় হিন্দ’, ‘দিল্লি চলো’, ‘আজাদ হিন্দ সেনাদের মুক্তি চাই’ ‘লাল কেল্লা ভেঙে ফেলো’ প্রভৃতি ধ্বনিতে ভারতের আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে।
ভারতে আজাদ হিন্দ বাহিনীর বিচারের বিরুদ্ধে সংবাদপত্র ও পুস্তিকা প্রকাশ
বিভিন্ন সংবাদপত্রে অতি গুরুত্ব সহ প্রতিদিন মামলার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ প্রকাশিত হতে থাকে। প্রকাশিত হতে থাকে আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেনাদের কীর্তি কাহিনি সংবলিত অসংখ্য পুস্তিকা। এই পুস্তিকাগুলির মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল ‘বিশ্বাসঘাতক নয়,’ ‘দেশপ্রেমিক’ পুস্তিকাটি।
আজাদ হিন্দ বাহিনীর বিচারের বিরুদ্ধে পোস্টার
দেশের নানা অংশে বিভিন্ন হিংসাত্মক পোস্টার প্রকাশিত হতে থাকে। সারা দিল্লিতে লাল কালিতে লেখা একটি পোস্টারে শাসকশ্রেণিকে সতর্ক করে দিয়ে বলা হয় যে, “বিচারের ফলে নিহত একটি আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেনার মৃত্যুর বদলে ২০ টি ইংরেজ কুত্তাকে হত্যা করা হবে।” কলকাতা ও লাহোরে অনুরূপ পোস্টার মারা হয়।
ভারতে আজাদ হিন্দ বাহিনীর বিচারের বিরুদ্ধে মিছিল
দেশজুড়ে অনুষ্ঠিত হতে থাকে অসংখ্য ছোটো-বড়ো নানা মিছিল ও সভাসমিতি। বড়ো বড়ো সভাগুলিতে প্রায় ৫০ হাজার মানুষও যোগ দিত। দেশের সবচেয়ে বড়ো সভাটি অনুষ্ঠিত হয় ১৯৪৫-এর ডিসেম্বর মাসে কলকাতার দেশপ্রিয় পার্কে। এখানে ভাষণ দেন শরৎচন্দ্র বসু, জওহরলাল নেহরু ও বল্লভভাই প্যাটেল। এই সভায় প্রায় দুই-তিন লক্ষ জনসমাগম হয়, জওহরলাল নেহরুর মতে তা পাঁচ থেকে সাত লক্ষ।
সেনাবাহিনীতে আজাদ হিন্দ বাহিনীর বিচারের প্রভাব
আজাদ হিন্দ বাহিনীর প্রভাব থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীও মুক্ত ছিল না। সেনাবাহিনীর তিনটি শাখা স্থলবাহিনী, বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীতে এর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ইস্টার্ন কম্যান্ডের জি.ও.সি. ফ্রান্সিস টুকার বলেন যে, আজাদ হিন্দ ফৌজের ব্যাপারটি “ভারতীয় সেনাবাহিনীর সৌধকে টলমল করে দেয়”।
নেতাজির আজাদ হিন্দ বাহিনীর বিচারের বিরুদ্ধে কলকাতার বিক্ষোভ
আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচারাধীন বন্দি সৈনিকদের সমর্থনে কলকাতায় দুটি গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন ছিল ছাত্র আন্দোলন (২১-২৩ নভেম্বর, ১৯৪৫ খ্রি.) এবং রশিদ আলি আন্দোলন (১১-১৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৬ খ্রি.)
(ক) ছাত্র আন্দোলন
কলকাতার বিভিন্ন দলের অনুগামী বহু ছাত্র ঐক্যবদ্ধভাবে রাইটার্স বিল্ডিং-এর দিকে যাত্রা করে। পুলিশ তাদের পথ আটকালে ছাত্ররা অবস্থান-বিক্ষোভ শুরু করে। বিক্ষোভ চলাকালে পুলিশের গুলিতে দুজন ছাত্রের মৃত্যু হলে সমগ্র কলকাতায় আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। যত্রতত্র ধর্মঘট, অবরোধ, অগ্নিসংযোগ প্রভৃতি ঘটনা ঘটাতে থাকে। পুলিশ আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালালে ৩৩ জন নিহত ও অসংখ্য মানুষ আহত হয়।
(খ) রশিদ আমি দিবস পালন
- (১) বিচারে ইংরেজ সরকার আজাদ হিন্দ বাহিনীর ক্যাপ্টেন রশিদ আলিকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেয়। এর প্রতিবাদে কলকাতায় ১১ ফেব্রুয়ারি ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয় এবং রশিদ আলির মুক্তির দাবিতে কলকাতায় ১২ ফেব্রুয়ারি ‘রশিদ আলি দিবস’ পালিত হয়। কলকাতার সর্বত্র আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।
- (২) আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেনাদের মুক্তির দাবিতে দলমত নির্বিশেষে অনুষ্ঠিত বিশাল মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে চারিদিকে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ট্রাম, বাস, রেল, ডাকঘর প্রভৃতি আক্রান্ত হয়। বেসরকারি হিসেবে ২০০-এর বেশি মানুষ নিহত হয়।
আজাদ হিন্দ বাহিনীর বিচার সম্পর্কে গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্য
অধ্যাপক গৌতম চট্টোপাধ্যায় আজাদ হিন্দ বাহিনীর বিচারকে কেন্দ্র করে এই গণ-বিস্ফোরণকে ‘প্রায়-বিপ্লব’ বলে অভিহিত করেছেন।
ভারতে আজাদ হিন্দ বাহিনীর বিচার সম্পর্কে কবি সুকান্তের মন্তব্য
কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য কলকাতার এই গণ-আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতেই সেদিন লিখেছিলেন, “বিদ্রোহ আজ, বিদ্রোহ চারিদিকে, আমি যাই তারই দিন-পঞ্জিকা লিখে।”
আজাদ বাহিনীর বিচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের গুরুত্ব
আন্দোলনের চাপে শেষ পর্যন্ত সরকার নতিস্বীকারে বাধ্য হন। সীমান্তের গভর্নর কানিংহাম প্রধান সেনাপতিকে সব বিচার বাতিল করার পরামর্শ দেন। প্রধান সেনাপতি অকিনলেক ভারতীয় বাহিনীর আনুগত্যের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কায় ভীত ছিলেন। তাই তিনি নীতি পরিবর্তনের জন্য ইংল্যান্ড-এর সরকারের অনুমতি চেয়ে পাঠান। শেষ পর্যন্ত স্থির হয় যে, বর্বরোচিত ব্যবহারের অভিযোগ ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ের বিচার হবে না। অবশেষে সকল বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হয়।
উপসংহার :- ড. অমলেশ ত্রিপাঠি এই আন্দোলনের স্বরূপ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে লিখেছেন যে “মৃত (?) সুভাষ জীবিত সুভাষের চেয়ে ঢের বেশি শক্তিশালী প্রতিপন্ন হয়েছিল।”
(FAQ) আজাদ হিন্দ বাহিনীর বিচার সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
দিল্লীর লাল কেল্লায়
প্রেমকুমার সেহগল, শাহনওয়াজ খান ও গুরবক্স সিং ধিলন
১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে
১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে