শেরশাহের ধর্মনীতি

শেরশাহের ধর্মনীতি প্রসঙ্গে শিক্ষা লাভ, সুন্নি মুসলমান, শের শাহের ধর্মসহিষ্ণুতা নীতি, শের শাহের গোঁড়ামির বিরোধিতা, শেরশাহের ধর্ম সহিষ্ণুতা নীতির বিরোধিতা, জিজিয়া কর আদায়ের কারণ, মারবাড়ের বিরুদ্ধে জিহাদি জিগির, উলেমাদের প্রভাবে জিহাদ ঘোষণা, শেরশাহের উদার নিয়োগ নীতি ও ধর্মীয় উদারতা সম্পর্কে জানবো।

শেরশাহের ধর্মনীতি

ঐতিহাসিক ঘটনাশেরশাহের ধর্মনীতি
সম্রাটশেরশাহ
ধর্মসুন্নী মুসলমান
হিন্দু সেনাপতিব্রহ্মজিৎ গৌড়
নবজাগরণবৈষ্ণব ধর্ম
শেরশাহের ধর্মনীত

ভূমিকা :- শেরশাহ তাঁর শাসন কালে উদার ধর্ম নীতির পরিচয় রেখে গেছেন। তিনি নিজে সুন্নী মুসলমান হলেও অন্যান্য ধর্মের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন।

শেরশাহের শিক্ষা লাভ

শেরশাহ প্রথম জীবনে জৌনপুরে তাঁর শিক্ষালাভ করেন। জৌনপুর সেই সময় ইসলামীয় সাহিত্যের শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে বিখ্যাত ছিল। জৌনপুরের মাদ্রাসায় দরিদ্র ছাত্রদের বিনা মূল্যে বাসস্থান ও পাঠ দেওয়া হত। শেরশাহ এই মাদ্রাসায় আরবী, ফার্সী শেখেন। ইসলামীয় ধর্মশাস্ত্র সম্পর্কে তিনি এখানেই জ্ঞান লাভ করেন।

সুন্নী মুসলমান শেরশাহ

ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন নিষ্ঠাবান সুন্নী মুসলমান। শের শাহ শাসক হিসেবে তাঁর ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাসকে কখনও প্রজাদের ওপর চাপিয়ে দিতে চান নি।

শের শাহের ধর্মসহিষ্ণুতা নীতি

বাস্তববাদী শের শাহ জানতেন যে, তাঁর সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রজারা হিন্দু। ভারত-এর মাটিতেই তাঁর জন্ম হয়। এজন্য ভারতীয় ধর্মীয় সহনশীলতা তিনি লাভ করেন।

শেরশাহের ধর্মনীতি সম্পর্কে ডঃ কানুনগোর অভিমত

ডঃ কে. আর কানুনগো মন্তব্য করেছেন যে, “হিন্দুদের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি উদাসীন নিষ্ক্রিয় অনুমোদন ছিল না। তা ছিল সম্মানিত শ্রদ্ধার প্রকাশ।”

শের শাহের গোঁড়ামির বিরোধিতা

  • (১) শের শাহ তার অ-মুসলিম (হিন্দু) প্রজাদের প্রতি ছিলেন যথেষ্ট উদার, সদয় এবং ন্যায়পরায়ণ। তিনি হিন্দুদের ধর্মীয় উৎসব-অনুষ্ঠানে কোনো বাধা আরোপ করেন নি। হিন্দুদের মন্দিরে মূর্তি পুজোয় তিনি কোনো নিষেধাজ্ঞা দেন নি।
  • (২) শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণে তিনি কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায় বা শ্রেণীকে (হিন্দু) সন্তুষ্ট রাখার নীতি নেন, একথা ভাবলে ভুল হবে। ইসলামে বিশ্বাসী প্রকৃত মুসলমান হিসেবে তিনি এই হস্তক্ষেপ করার নীতি থেকে বিরত থাকেন। তিনি গোঁড়ামি পছন্দ করতেন না। হানাফি মত অনুসারে অন্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্মবিশ্বাসে তিনি আঘাত দিতেন না।

শেরশাহের ধর্মসহিষ্ণুতা নীতির বিরোধিতা

শের শাহের এই ধর্মসহিষ্ণু নীতির বিরুদ্ধে কোনো কোনো লেখক কয়েকটি বিচ্যুতির অভিযোগ করেন। তাঁদের মতে,

  • (১) শের শাহ বৈষম্যমূলক জিজিয়া কর লোপ করেন নি। তিনি রাজপুতানায় তার সামরিক অভিযানের সময় জেহাদের জিগির দেন। তিনি রায়সিন দুর্গের পুরাণমলের প্রতি ধর্মান্ধ আচরণ করেন।
  • (২) তিনি শিয়া ধর্মাবলম্বীদের প্রতি উদার ছিলেন না। তিনি দক্ষিণের শিয়া রাজ্যগুলিকে জয় করার বাসনা পোষণ করতেন। এই সকল বিচ্যুতি শের শাহের ধর্মান্ধতা প্রমাণের পক্ষে যথেষ্ট নয়।

শেরশাহ কর্তৃক জিজিয়া কর আদায়ের কারণ

  • (১) জিজিয়া করকে শরিয়তী অর্থে বৈষম্যমূলক ধর্মকর বলা হলেও, আসলে শের শাহ এই অর্থে জিজিয়া করকে গ্রহণ করেন নি। ডঃ নিজামী বলেছেন যে, জিজিয়া ছিল এক ধরনের অ-কৃষিকর।
  • (২) অন্তত শের শাহের ক্ষেত্রে এই করের ধর্মীয় ব্যাখ্যা করা উচিত হবে না। আমরা যদি হিন্দুদের প্রতি শের শাহের সামগ্রিক নীতির প্রেক্ষাপটে বিচার করি তাহলে জিজিয়াকে তিনি বৈষম্যমূলক কর হিসেবে আরোপ করেন – একথা বলা যাবে না।

শেরশাহের ধর্মনীতি সম্পর্কে ত্রিপাঠীর অভিমত

ডঃ ত্রিপাঠী মন্তব্য করেছেন যে, “তিনি উদার মতাবলম্বী সুলতানদের নীতিই অনুসরণ করেন এবং তাদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই জিজিয়া কর আদায় করেন” (He seems to have followed the policy of some broad-minded Sultans and continued to realize the ziziya)।

মারবাড়ের বিরুদ্ধে শেরশাহের জেহাদী জিগির

রাজপুতানায় তিনি মারবাড়ের রাজার বিরুদ্ধে সামরিক প্রয়োজনবশত জেহাদী জিগির দেন। সেনাদলকে উৎসাহিত করাই তার উদ্দেশ্য ছিল। মারবাড়ের অধিপতির কঠিন প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়ে রাজনৈতিক ও সামরিক কৌশল হিসেবে তিনি একটি অস্থায়ী ব্যবস্থা নেন। তার গোটা রাজ্যকাল ধরে তিনি সহিষ্ণুতা নীতি নেন।

উলেমাদের প্রভাবে শেরশাহের জেহাদ ঘোষণা

  • (১) শের শাহ উলেমাদের প্রভাবে এই জেহাদ ঘোষণা করেন, রক্ষণশীল ঐতিহাসিকদের এই ব্যাখ্যা আধুনিক গবেষকরা নাকচ করেছেন। দিল্লীর মসনদে বসার সময় রাজপুতদের উদীয়মান শক্তিকে তিনি অগ্রাহ্য করার কথা ভাবতে পারেন নি।
  • (২) বিশেষত রাজপুত রাজাদের হাতে ছিল কয়েকটি দুর্ভেদ্য দুর্গ। এই দুর্গগুলি হাতে না থাকায় হুমায়ুন-এর কি দুর্দশা হয় তা তিনি স্বচক্ষে দেখেন। কাজেই রায়সিনের পুরাণমল বা যোধপুরের মালদেবের বিরুদ্ধে তাঁর অভিযান ধর্মীয় বিদ্বেষপ্রসূত ছিল না।
  • (৩) বাংলার সুলতান মহম্মদ শাহের বিরুদ্ধে তিনি যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অভিযান করেন, রাজপুতানা অভিযানের ক্ষেত্রেও তাঁর একই লক্ষ্য ছিল। রায়সিনের অধিপতি পুরাণমল সম্পর্কে শের শাহের কাছে বাহাদুর শাহ অভিযোগ করেন যে, তিনি বন্দী মুসলিম নর-নারীদের প্রতি নির্যাতন করতেন এবং বন্দী মুসলিম নারীদের প্রতি অসম্মানজনক আচরণ করতেন। এই অভিযোগ শের শাহ সত্য বলে মনে করতেন।

শের শাহের উদার নিয়োগ নীতি

  • (১) তিনি তাঁর কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে হিন্দুদেরও যথেষ্ট সুযোগ দেন। নিজে ভারতীয় মুসলমান হয়ে, ভারতীয় বংশোদ্ভব নাগরিকদের জন্য তিনি নিয়োগের ক্ষেত্রে উদারনীতি নেন। গিয়াসউদ্দিন বলবন-এর মত সঙ্কীর্ণ নীতি তিনি নেন নি।
  • (২) শুধুমাত্র আফগানদের সকল পদ না দিয়ে রাজস্ব, প্রশাসন ও সামরিক বিভাগের দরজা যোগ্য হিন্দুদের জন্য তিনি খুলে দেন। তার অন্যতম বিখ্যাত সেনাপতি ছিলেন হিন্দু ব্রহ্মজিৎ গৌড়। তিনি হিন্দু খুৎ-মুকাদ্দমদের প্রতি কোনো বৈষম্য দেখান নি।
  • (৩) তবে একথা অবশ্য ঠিক যে, উচ্চ সরকারি পদের অধিকাংশ পদ তিনি আফগানদের দেন। রাজনৈতিক প্রয়োজনে, আফগানদের বশ্যতা লাভের জন্য তাকে এই কাজ করতে হয়। এই বিরুদ্ধ পরিস্থিতিতেও তিনি সম্ভাব্য স্থলে উদার নীতি নেন।

শেরশাহের ধর্মনীতি সম্পর্কে কানুনগোর মন্তব্য

ডঃ কানুনগোর মতে, তিনি হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের জন্যে হয়ত সক্রিয় উদ্যোগ নেননি, কিন্তু এই ঐকা বৃদ্ধি পেলে তিনি খুশী হন।

শের শাহের রাজতান্ত্রিক আদর্শ

  • (১) রাজতান্ত্রিক আদর্শের ক্ষেত্রেও শের শাহ ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতার উর্দ্ধে তার নিজস্ব প্রতিভার ছাপ রাখেন। দিল্লীর অধিকাংশ সুলতানদের মত তিনি খলিফার প্রতি আনুগত্য জানাতে বিরত থাকেন। এজন্য তিনি সুলতান-উল-আদিল, আল-আমির-আল-গাজি, শের শাহ, খুদ আল্লাহ খিলাফতু উপাধি নেন।
  • (২) তার রৌপ্য ও তাম্র মুদ্রাগুলিতে যে উপাধি ছাপা হয় তার দ্বারা তিনি খলিফার মর্যাদা দাবী করেন। এইদিক থেকে তিনি শুধু আকবরকে পথ প্রদর্শন করেন নি, তিনি ঠাণ্ডা মাথায় সুপরিকল্পিতভাবে এক নতুন রাজতান্ত্রিক আদর্শ ঘোষণা করেন যা উলেমাদের মতের দ্বারা প্রভাবিত ছিল না। তিনি গোড়ামি ও ধর্মান্ধতা পরিহার করতেন। তিনি উলেমাদের রাষ্ট্রের কাজে বিশেষ হস্তক্ষেপ করতে দেন নি।

সাহিত্যে শেরশাহের সমন্বয় নীতি

শের শাহের ধর্মসহিষ্ণু নীতি তাঁর দরবারের সাহিত্য কর্মে প্রতিফলিত হয়। তারই উৎসাহে মুসলিম সাহিত্যিকরা হিন্দী ভাষায় সাহিত্য রচনায় উৎসাহ দেখান। হিন্দী ছিল লোকের মুখের ভাষা। মালিক মহম্মদ জয়সী এই সময় পদ্মাবৎ কাব্য রচনা করেন।

শেরশাহের ধর্মীয় উদারতা

শের শাহের আমলে বৈষ্ণব ধর্মের নবজাগরণ ঘটে। মথুরা নবোদিত বৈষ্ণব ধর্মের পীঠস্থানে পরিণত হয়।

শেরশাহের আমলে স্থাপত্য রীতি

  • (১) শের শাহের স্থাপত্য রীতি তাঁর সমন্বয় নীতির সাক্ষ্য দেয়। তিনি ইন্দো-সারাসেনিয় স্থাপত্যের প্রকৃত বিবর্তন ঘটান। ডঃ কানুনগোর মতে, সাসারামে তার সমাধি ভবন বাইরের গঠনে মুসলিম স্থাপত্যের স্বাক্ষর বহন করছে। ভবনটির আভ্যন্তরীণ গঠনে হিন্দু স্থাপত্য রীতির প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
  • (২) কলা সমালোচক হ্যাভেলের মতে, এই সমাধি ভবনের পিরামিডের আকৃতি হিন্দু স্থাপত্যের চিহ্ন বহন করছে। এর সঙ্গে তিনি সারাসেনীয় স্থাপত্য শৈলীর মিলন ঘটান।

উপসংহার :- ডঃ ত্রিপাঠী মন্তব্য করেছেন যে শের শাহের স্থাপত্য এই তত্ত্ব প্রমাণ করে যে শিল্পকলার ক্ষেত্রে তিনি হিন্দু-মুসলিম-আফগান ও পারসীক স্থাপত্যের ভাল দিকগুলি গ্রহণ করেন।

(FAQ) শেরশাহের ধর্মনীতি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. শেরশাহের হিন্দু সেনাপতি কে ছিলেন?

ব্রহ্মজিৎ গৌড়।

২. শেরশাহের সমাধি কোথায় অবস্থিত?

বিহারের সাসারাম।

৩. শেরশাহের সময় কোন ধর্মের নবজাগরণ ঘটে?

বৈষ্ণব ধর্ম।

৪. শেরশাহের কোন ধর্মের অনুসারী ছিলেন?

সুন্নী মুসলমান।

Leave a Comment