ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়নের সংস্কার প্রসঙ্গে পুনর্গঠন ও সংস্কার সাধন, সংস্কারের স্থায়ীত্ব, ফিশারের মন্তব্য, ডেভিড টমসনের মন্তব্য, সাম্য নীতিকে কার্যকর, স্বাধীনতার আদর্শ বিসর্জন, সংস্কারের উদ্দেশ্য, সমন্বয় সাধন, শাসনতান্ত্রিক সংস্কার, অর্থনৈতিক সংস্কার, শিক্ষা সংস্কার, শিক্ষা সংস্কারের ত্রুটি, ধর্ম সংস্কার, আইন সংস্কার, আইন সংহিতার ত্রুটি, জনহিতকর কার্যাবলী ও নেপোলিয়নের সংস্কারের ফলাফল সম্পর্কে জানবো।
ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়নের সংস্কার
ঐতিহাসিক ঘটনা | নেপোলিয়নের সংস্কার |
বিপ্লবের সন্তান | নেপোলিয়ন |
ফরাসি বিপ্লবের বাণী | সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা |
ব্যাঙ্ক অফ ফ্রান্স | ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ |
ল্যুভর মিউজিয়াম | ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দ |
কোড নেপোলিয়ন | ১৮০৭ খ্রিস্টাব্দ |
সূচনা:- কেবল একজন সমরকুশলী সেনানায়ক বা রণনিপুণ যোদ্ধা হিসেবেই নয়— একজন সুশাসক, সংস্কারক ও সংগঠক হিসেবেও নেপোলিয়ন তাঁর অনন্য কীর্তির স্বাক্ষর রেখে গেছেন।
পুনর্গঠন ও সংস্কার সাধনে নেপোলিয়নের ভূমিকা
কনস্যুলেটের শাসনকালে (১৭৯৯-১৮০৪ খ্রিঃ) তাঁর প্রধান কাজ ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত ও বিপ্লব-স্নাত ফ্রান্স -এ শান্তি প্রতিষ্ঠা, আইন-শৃঙ্খলা প্রণয়ন, সরকারি কোষাগারে অর্থ সংগ্রহ করা এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে হানাহানি বন্ধ করে সহিষ্ণুতার পরিবেশ সৃষ্টি করা। এক কথায়, তখন দরকার ছিল পুনর্গঠন ও সংস্কার-সাধন।
নেপোলিয়নের সংস্কারের স্থায়ীত্ব
ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন তাঁর আত্মজীবনীতে লেখেন যে তাঁর চল্লিশটি যুদ্ধের চেয়েও ফ্রান্সে তাঁর সংস্কারগুলি অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ঐতিহাসিকরা তাঁর এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত। এই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে তাঁর সংস্কারগুলি ছিল স্থায়ী ও সুদূরপ্রসারী। অন্যদিকে তাঁর সাম্রাজ্য ছিল ক্ষণস্থায়ী।
নেপোলিয়নের সংস্কার সম্পর্কে ফিশারের মন্তব্য
ঐতিহাসিক ফিশার বলেন যে, “নেপোলিয়নের সাম্রাজ্য ক্ষণস্থায়ী হলেও তাঁর অসামরিক সংস্কারগুলি গ্রানাইট পাথরের শক্ত ভিত্তির উপর স্থায়ীভাবে নির্মিত হয়।”
নেপোলিয়নের সংস্কার সম্পর্কে ডেভিড টমসনের মন্তব্য
তাঁর উন্নয়নমূলক সংস্কারাবলীর প্রশংসা করে ডেভিড টমসন তাঁকে ‘অষ্টাদশ শতকের সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ প্রজাহিতৈষী শাসক’ বলে অভিহিত করেছেন।
নেপোলিয়ন কর্তৃক সাম্য নীতিকে কার্যকর
ঐতিহাসিক ফিশার-এর মতে, তিনি ফরাসি বিপ্লব -এর তিনটি আদর্শ – সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার মধ্যে কেবল সাম্য নীতিকেই কার্যকরী করেন। ফিলিপ গুয়েদালা-র মতে, তিনি স্বাধীনতার অধিকার কেড়ে নিলেও সাম্য নীতি প্রয়োগ করে তার ক্ষতিপূরণ করেন।
নেপোলিয়ন কর্তৃক স্বাধীনতার আদর্শ বিসর্জন
স্বাধীনতার আদর্শ অনুযায়ী পূর্বে ফ্রান্সে প্রজাতন্ত্র স্থাপিত হলেও তা চরম বিশৃঙ্খলায় পরিণত হয়। এর ফলে স্বাধীনতার আদর্শ বিসর্জন দিয়ে নেপোলিয়ন একটি কেন্দ্রীভূত স্বশাসন প্রতিষ্ঠা করেন।
নেপোলিয়নের সংস্কারের উদ্দেশ্য
তিনি বেশ কয়েকটি উদ্দেশ্য নিয়ে সংস্কারের কাজে অবতীর্ণ হন। যেমন –
- (১) তিনি একটি কেন্দ্রীভূত শাসন প্রবর্তন ও জনহিতকর কার্যাবলীর মাধ্যমে ফরাসি জাতির কৃতজ্ঞতাভাজন হতে চেয়েছিলেন।
- (২) বিপ্লবোত্তর যুগে দেশবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষারসঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তিনি একটি স্থায়ী ও শক্তিশালী সরকার গঠন করতে চান।
- (৩) প্রয়োজনীয় শাসন-সংস্কারের মাধ্যমে তিনি ব্যক্তিগত প্রভাব-প্রতিপত্তি ও যশ বৃদ্ধি করতে চান। তিনি নিজেই বলছেন যে, “আমি এমন গৌরব রেখে যেতে চাই যা ভবিষ্যৎ বংশধরদের কাছে উদাহরণ হয়ে থাকবে।”
- (৪) ফরাসি বিপ্লব ও দার্শনিকদের শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ নেপোলিয়নের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল বিপ্লবের সুফলগুলিকে (আইনের চোখে সমানাধিকার, বিশেষ অধিকার লোপ প্রভৃতি) স্থায়িত্ব প্রদান।
সমন্বয় বিধানে নেপোলিয়নের ভূমিকা
- (১) বিপ্লব সারা দেশে বিভিন্ন গোষ্ঠী, সম্প্রদায় ও দলের মধ্যে রেষারেষি এবং বিদ্বেষের পরিবেশ সৃষ্টি করে। এই অনৈক্য দেশের উন্নতির পথে অন্যতম প্রধান অন্তরায় ছিল। এই কারণে তিনি বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে বোঝাপড়ার উপর প্রবল গুরুত্ব আরোপ করেন।
- (২) দেশত্যাগী অভিজাত ও বিদ্রোহী যাজকদের সম্পর্কিত কঠোর আইনগুলি শিথিল করা হয়। রাজতন্ত্রী, জেকোবিন, জিরণ্ডিনদের প্রতি উদারনীতি গ্রহণ করা হয়। লা-ভেণ্ডি নামক স্থানের ক্যাথলিকদের ধর্মাচরণের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
- (৩) রাজনৈতিক কারণে নির্বাসিত লাফায়েৎ, ব্যারিকে প্রমুখ ব্যক্তিদের দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। ষোড়শ লুই-এর মৃত্যুদণ্ড, রোবসপিয়রের পতন প্রভৃতি উপলক্ষে অনুষ্ঠিত ‘জাতীয় উৎসব‘ বন্ধ করা হয়। এইভাবে তিনি এক সমন্বয়ের পরিবেশ গড়ে তোলেন।
নেপোলিয়নের শাসনতান্ত্রিক সংস্কার
- (১) নেপোলিয়নের প্রথম ও প্রধান কৃতিত্ব হল বিপ্লব এবং যুদ্ধ-বিধ্বস্ত ফ্রান্সে আইনের শাসন প্রবর্তন করে দেশবাসীর মনে শান্তি ও নিরাপত্তাবোধ সুনিশ্চিত করা। এই উদ্দেশ্যে তিনি একটি কেন্দ্রীভূত স্বৈরশাসন গড়ে তোলেন এবং শাসনব্যবস্থার প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজ আধিপত্য স্থাপন করেন।
- (২) প্রথম কনসাল হিসেবে তিনি সমস্ত ক্ষমতার অধিকারী হন। আইনসভা চারটি কক্ষে বিভক্ত হয়। একমাত্র নিম্নকক্ষের সদস্যরা নির্বাচিত হলেও বাকি তিন কক্ষের সদস্যরা প্রথম কনসাল কর্তৃক মনোনীত হতেন।
- (৩) প্রথম কনসালের সম্মতি ছাড়া কোনও বিল আইনসভায় পেশ করা যেত না বা আইনসভায় পাস হলেও কোনও বিল আইনের মর্যাদা পেত না। সমগ্র দেশকে মোট ৮৩টি প্রদেশ বা ডিপার্টমেন্টে বিভক্ত করা হয়। প্রদেশগুলি আবার ৫৪৭টি জেলা বা ক্যান্টনে বিভক্ত ছিল।
- (৪) প্রদেশ ও জেলাগুলির শাসনকর্তা অর্থাৎ ‘প্রিফেক্ট’ ও ‘সাব-প্রিফেক্ট’ এবং অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মচারী—এমনকী পৌরসভাগুলির প্রধান ‘মেয়র’-দেরও তিনি নিয়োগ করতেন। মন্ত্রী, আমলা, বিচারক, সেনাপতি—সব পদস্থ কর্মচারীই তাঁর দ্বারা নিযুক্ত হত।
- (৫) নির্বাচন দ্বারা সরকারি কর্মচারী নিয়োগ নিষিদ্ধ হয়। তিনি সর্বদা দক্ষ ব্যক্তিদেরই নিয়োগ করতেন। এর ফলে তাঁর প্রশাসন দক্ষ ব্যক্তিতে পূর্ণ ছিল। পুলিশ বিভাগের দায়িত্ব ছিল ফুচে (Fouche)-র হাতে। বিদেশ দপ্তর ছিল ট্যালিরান্ড (Tallyrand)-এর দায়িত্বে।
- (৬) লুই বোনাপার্ট দেখতেন অভ্যন্তরীণ দপ্তর। অর্থ দপ্তরের দায়িত্ব ছিল গোদিন (Goudin)-এর উপর। বিভিন্ন মন্ত্রী থাকলেও মন্ত্রিসভা বলে কিছু ছিল না। নেপোলিয়ন মন্ত্রীদের সঙ্গে পৃথক পৃথকভাবে আলোচনা করতেন। প্রশাসনিক, প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক নীতি-নির্ধারণ বা আইন প্রণয়ন-সংক্রান্ত প্রস্তাব উত্থাপন সব ক্ষমতাই তাঁর হস্তগত হয়।
- (৭) স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনমূলক প্রতিষ্ঠানগুলির ক্ষমতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়। এইভাবে তিনি ফ্রান্সে গণতন্ত্রের মুখোশে এক স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন।
নেপোলিয়নের অর্থনৈতিক সংস্কার
- (১) ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা। অধ্যাপক ডেভিড টমসন অর্থব্যবস্থা ও কর প্রথাকে পুরাতনতন্ত্রের ‘ক্যানসার’ (Cancer) বলে অভিহিত করেছেন। নেপোলিয়নের ক্ষমতা দখলের সময়ে ফ্রান্সের আর্থিক সংকট চরমে উঠেছিল।
- (২) এই অবস্থায় তিনি অর্থনৈতিক সংস্কারে মন দেন। গোদিন অর্থ দপ্তরের মন্ত্রী নিযুক্ত হন। সরকারি দপ্তরগুলিতে ব্যয়-সংকোচের নির্দেশ দেওয়া হয় এবং নেপোলিয়ন নিজেই সরকারি বাজেট পরীক্ষা করতে শুরু করেন।
- (৩) অর্থ দপ্তরকে দু’ভাগে বিভক্ত করে তিনি রাজস্ব দপ্তর ও অডিট দপ্তর তৈরি করেন। অডিট বিভাগ সরকারি ব্যয়ের হিসাব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করত। নেপোলিয়ন নিজে সর্বসমক্ষে অডিট রিপোর্ট পাঠ করে তার যথার্থতা যাচাই করতেন।
- (৪) তিনি ফরাসি জনসাধারণকে বোঝাতে সক্ষম হন যে, সরকারকে কর দেওয়া প্রতিটি নাগরিকের অবশ্য কর্তব্য। সবাইকে আয়কর দিতে বাধ্য করা হয়। নতুন কোনও কর ধার্য না করে প্রচলিত করগুলি আদায়ের ব্যাপারে জোর দেওয়া হয়।
- (৫) প্রত্যক্ষ কর অপেক্ষা পরোক্ষ কর আদায়ের উপর তিনি বেশি গুরুত্ব দেন এবং লবণ ও সুরার উপর পরোক্ষ কর আরোপিত হয়। তিনি প্রাদেশিক বা আঞ্চলিক সভাগুলির কর আদায়ের অধিকার বাতিল করেন। কর আদায় ব্যবস্থাকে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে আনা হয়। কর আদায়কারীরা ছিল রাষ্ট্রের বেতনভুক কর্মচারী।
- (৬) আর্থিক পুনর্গঠনের উদ্দেশ্যে তিনি ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে ‘ব্যাঙ্ক অব ফ্রান্স’ প্রতিষ্ঠা করেন। ঋণদান ও মুদ্রাব্যবস্থার সব দায়িত্ব এই ব্যাঙ্কের উপর অর্পিত হয়। তিনি পুনরায় সোনা ও রূপার মুদ্রা বাজারে চালু করেন।
- (৭) ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতির জন্য চেম্বার অব কমার্স বা বণিক সঙ্ঘের পুনর্গঠন, স্টক এক্সচেঞ্জ স্থাপন, রাস্তাঘাট নির্মাণ ও বন্দরগুলির উন্নয়নের কর্মসূচি নেওয়া হয়। ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে তিনি কৃষি ও শিল্পের উন্নতির দিকেও নজর দেন।
- (৮) তিনি শিল্প সংরক্ষণ নীতি গ্রহণ করেন। অবাধ বাণিজ্য নীতি নয়—তিনি মার্কেন্টাইল নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি বেকারদের কর্মসংস্থানের জন্য গঠনমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করেন।
নেপোলিয়নের শিক্ষা সংস্কার
- (১) নেপোলিয়নের শিক্ষা সংস্কারের মূল লক্ষ্য ছিল সম্রাট ও রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত নাগরিক গড়ে তোলা। প্রাথমিক শিক্ষা ছিল ‘কমিউন’ বা পুরসভার হাতে। তাঁর উদ্যোগে প্রচুর মাধ্যমিক, ফলিত বিজ্ঞান, কারিগরি, আইন, চিকিৎসা, শিক্ষক-শিক্ষণ ও সামরিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।
- (২) বিভিন্ন শহরে তিনি ২৯টি ‘লাইসি’ বা নির্বাচিত আবাসিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে সামরিক শিক্ষাও দেওয়া হত। ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুল ছিল ৩৭৭টিও সরকারি মাধ্যমিক স্কুল ৩৭০টি। আইন বিদ্যালয় প্যারিসেই ছিল ১২টি।
- (৩) সমগ্র দেশে যাতে একই ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তিত হয় সেই উদ্দেশ্যে ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ইউনিভার্সিটি অব ফ্রান্স’। এখান থেকেই সর্বস্তরের শিক্ষার পাঠ্যসূচি তৈরি হত। তাঁর লক্ষ্য ছিল ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার প্রসার। ছাত্ররা যাতে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা না করে সেজন্য ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পাঠ্যসূচি সংশোধন করা হয়।
নেপোলিয়নের শিক্ষা সংস্কারের ত্রুটি
তাঁর শিক্ষা-সংস্কার ত্রুটিহীন ছিল না।যেমন –
- (১) মুখে জাতীয় শিক্ষার কথা বললেও শিক্ষার দরজা একমাত্র সম্পন্ন মধ্যবিত্তদের জন্যই উন্মুক্ত ছিল।সাধারণ মানুষের পক্ষে শিক্ষার ব্যয়ভার বহন করা সম্ভব ছিল না।
- (২) তিনি স্ত্রী-শিক্ষা বিস্তারে কোনও গুরুত্ব দেন নি। সরকারি ব্যয় হ্রাসের উদ্দেশ্যে নারীশিক্ষার দায়িত্ব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলির উপর ছেড়ে দেওয়া হয়।তাঁর মতে নারীশিক্ষার উদ্দেশ্য হল কর্তব্যপরায়ণা গৃহবধূ ও মাতা তৈরি করা।
- (৩) তাঁর প্রাথমিক শিক্ষার কোনও পরিকল্পনা ছিল না। প্রাথমিক শিক্ষাকে তিনি গির্জার হাতেই ছেড়ে দেন।
- (৪) শিক্ষায় উৎসাহ দেওয়া হলেও জনসাধারণকে স্বাধীন মতামত প্রকাশের অধিকার দেওয়া হয় নি। সংবাদপত্র ও পুস্তক প্রকাশের স্বাধীনতা ছিল না। সরকার-বিরোধী সংবাদপত্রের প্রকাশ বন্ধ করে দেওয়া হয়।
- (৫) নাটক ও নাট্যশালার উপর পুলিশি নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা হয়। এই অবস্থায় দেশে সৃজনশীল সাহিত্য ও শিল্পের বিকাশ সম্ভব ছিল না।
নেপোলিয়নের ধর্মসংস্কার
১৭৯১ খ্রিস্টাব্দের বিপ্লবী সংবিধান দ্বারা (‘সিভিল কনস্টিটিউশন অব দি ক্লার্জি)গির্জাকে রাষ্ট্রায়ত্ত করা হলে পোপের সঙ্গে ফরাসি রাষ্ট্রের বিরোধ বাধে। ক্যাথলিক প্রজারা এই ব্যবস্থা মানতে পারে নি। ধর্মীয় ক্ষেত্রে নেপোলিয়নের পদক্ষেপ গুলি হল –
(১) কনকর্ডাট
ধর্মের আধ্যাত্মিক ব্যাপারে নেপোলিয়নের কোনও মাথাব্যথা না থাকলেও রাজনৈতিক স্বার্থে তিনি খ্রিস্টীয় জগতের ধর্মগুরু পোপের সঙ্গে বিরোধ মিটিয়ে নেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন। এই উপলক্ষে ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে তিনি পোপ নবম পায়াস-এর সঙ্গে এক ‘ধর্ম-মীমাংসা চুক্তি বা ‘কনকর্ডাট’ (Concordat of 1801) স্বাক্ষর করেন।
(২) কনকর্ডাট -এর মূল বক্তব্য
ধর্ম মীমাংসা চুক্তি অনুসারে স্থির হয় যে, (ক) পোপ বিপ্লবী আমলে ফরাসি গির্জা ও গির্জার সম্পত্তির জাতীয়করণ মেনে নেবেন। (খ) ফরাসি সরকার রোমান ক্যাথলিক গির্জা ও ধর্মমতকে স্বীকৃতি দেবে। (গ) ভবিষ্যতে যাজকগণ সরকার কর্তৃক মনোনীত হবেন এবং পোপ তাঁদের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেবেন। (ঘ) রাষ্ট্র যাজকদের বেতন দেবে।
(৩) ধর্মীয় ঐক্য
ধর্ম মীমাংসা চুক্তির দ্বারা রাষ্ট্র ও পোপ উভয়েই লাভবান হন। পোপের সঙ্গে বিরোধ মেটায় ফ্রান্সে ধর্মীয় ঐক্য আসে এবং নেপোলিয়নের শক্তি বৃদ্ধি পায়। তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্যাথলিকদের সমর্থন লাভ করেন। যাজকদের উপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। কোবান-এর মতে, নানা ত্রুটি সত্ত্বেও এই চুক্তি ছিল নেপোলিয়নের এক বিরাট সাফল্য।
নেপোলিয়নের আইন সংস্কার
নেপোলিয়নের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ও গৌরবময় কীর্তি হল তাঁর ‘আইন সংহিতা’ বা ‘কোড নেপোলিয়ন’ (‘CodeNapoleon’)। এক্ষেত্রে তার পদক্ষেপ গুলি হল –
(১) আইনগত অনৈক্য
এতদিন পর্যন্ত ফ্রান্স ও বিভিন্ন প্রদেশে কোনও সাধারণ আইনবিধি প্রচলিত ছিল না। সমগ্র দেশে নানা ধরনের বৈষম্যমূলক, পরস্পর-বিরোধী এবং যুগের অনুপযোগী প্রায় ৩৬০টি বিভিন্ন ধরনের আইন প্রচলিত ছিল।এক কথায়, সমগ্র ফ্রান্সে কোনও আইনগত ঐক্য ছিল না।
(২) বিপ্লবী নেতৃবৃন্দের ব্যর্থতা
কনভেনশন ও ডিরেক্টরি যুগে বিপ্লবী নেতৃবৃন্দ এইসব পরস্পর-বিরোধী আইনগুলির মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করে সারা দেশে এক ধরনের আইন প্রণয়নের চেষ্টা করেন, কিন্তু এ কাজে তাঁরা সফল হন নি।
(৩) আইবিধি সংকলন
নেপোলিয়নের উদ্যোগে ফ্রান্সের চারজন বিশিষ্ট আইনজীবীকে নিয়ে গঠিত এক কমিশন চার বছরের (১৮০০-১৮০৪ খ্রিঃ) অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে ১৮০৪ খ্রিস্টাব্দে একটি আইনবিধি সংকলন করে।
(৪) কোন নেপোলিয়ন
আইনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য মোট ৮৪টি অধিবেশন বসে। এর মধ্যে ৩৬টি অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন স্বয়ং নেপোলিয়ন। ১৮০৭ খ্রিস্টাব্দে নেপোলিয়ন এর নামকরণ করেন ‘কোড নেপোলিয়ন’ বা ‘নেপোলিয়নের আইন সংহিতা”।
(৫) বিপ্লবের স্থায়ী ফল কোন নেপোলিয়ন
এই আইনবিধির মধ্যে ফ্রান্সের প্রাচীন আচার-অনুষ্ঠান, রোমান রীতি-নীতি এবং ফরাসি বিপ্লবী ঐতিহ্যের সমন্বয় লক্ষ্য করা যায়। এই আইনবিধি কোনওভাবেই ধর্মীয় বা রাজনৈতিক কুসংস্কার দ্বারা কলুষিত হয় নি। ‘কোড নেপোলিয়ন’-কে বিপ্লবের স্থায়ী ফল বলা যেতে পারে।
(৬) আইন সংহিতার বিভাগ
মোট ২২৮৭টি বিধি-সম্বলিত এই আইন সংহিতা তিনভাগে বিভক্ত।যথা –দেওয়ানি, ফৌজদারি ও বাণিজ্যিক আইন।
(৭) আইন সংহিতার বৈশিষ্ট্য
আইনের দৃষ্টিতে সমতা, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, যোগ্যতানুযায়ী সরকারি চাকরিতে নিয়োগ, বিপ্লবী ভূমিব্যবস্থার স্বীকৃতি, সামন্ততান্ত্রিক বৈষম্যের বিলুপ্তি এবং ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও সম্পত্তির অধিকারের স্বীকৃতি প্রভৃতি এই আইন সংহিতার কয়েকটি বৈশিষ্ট্য।
(৮) দ্বিতীয় জাস্টিনিয়ান
এই আইনবিধির মূল নীতিগুলি পরবর্তীকালে ইউরোপ-এর বিভিন্ন রাষ্ট্র কর্তৃক গৃহীত হয়েছিল। নেপোলিয়ন নিজেও তাঁর যুদ্ধগুলির চেয়ে এই আইন সংহিতাকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করতেন। ঐতিহাসিক লেফেভর এই আইনবিধিকে সমাজে বাইবেলের সঙ্গে তুলনা করেছেন। এই আইনবিধির জন্য তাঁকে ‘দ্বিতীয় জাস্টিনিয়ান’ বলে অভিহিত করা হয়।
(৯) আইন সংহিতার ত্রুটি
বলা বাহুল্য, এই আইনবিধি একেবারে ত্রুটিহীন ছিল না। যেমন –
- (ক) এই আইনবিধিতে রোমান আইনকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়ায় প্রগতিশীলতার সব পথ বন্ধ হয়ে যায়।
- (খ) এতে নারী সমাজের মর্যাদা হ্রাস করা হয়। নারীকে পুরুষের অধীনে রাখা হয়। পারিবারিক সম্পত্তির উপর তাদের কোনও অধিকার ছিল না, স্বামীর সম্পত্তি ছাড়া তারা কোনও সম্পত্তি অর্জন, বিক্রি বা দান করতে পারত না। বিবাহ-বিচ্ছেদের অধিকার সংকুচিত করা হয়।
- (গ) স্ত্রী ও পুত্রের উপর স্বামী ও পিতার কর্তৃত্ব সুদৃঢ় করা হয়, যদিও ফরাসি বিপ্লবের আদর্শ হল সমানাধিকার।
- (ঘ) শ্রমিকদের অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া হয় নি।
(১০) আইন সংহিতার গুরুত্ব
ত্রুটি সত্ত্বেও এই আইনবিধির গুরুত্ব অপরিসীম। ফিশার বলেন যে, “ফরাসি বিপ্লবের সাময়িক অনাচার ও অনুদার নীতি বর্জন করে কোড স্থায়ী বিজয়কে সুনিশ্চিত করে।
নেপোলিয়নের জনহিতকর কার্য
নেপোলিয়ন নানা জনহিতকর কাজের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। যেমন –
(১) বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়ন
তিনি কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির দিকে নজর দেন। বেকার সমস্যা সমাধানের জন্য তিনি নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তাঁর আমলে বহু রাজপথ, খাল, বাঁধ, সেতু, বন্দর, পয়ঃপ্রণালী ও উদ্যান নির্মিত হয়।
(২) সৌধ সংস্কার ও নির্মাণ
তিনি ফ্রান্সের প্রাচীন সৌধগুলির সংস্কার করেন এবং বহু নতুন সৌধ নির্মাণ করেন। প্যারিস নগরীকে তিনি নতুন সাজে সজ্জিত করেন।
(৩) ল্যুভর মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠা
ভাস্কর্য ও শিল্পকলার অন্যতম সংগ্রহশালা ল্যুভর মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠা তাঁর অন্যতম কীর্তি।
(৪) লিজিয়ন অব অনার প্রদান
রাষ্ট্রের প্রতি সেবা ও আনুগত্যের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি সামরিক ও অসামরিক ব্যক্তিদের ‘লিজিয়ন অব অনার’ (Legion of Honour) নামক উপাধি দানের ব্যবস্থা করেন।
নেপোলিয়নের সংস্কারের ফলাফল
নেপোলিয়নের সংস্কার কার্যকলাপের ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। যেমন –
(১) শান্তি, স্থিতি ও সমৃদ্ধি ফিরিয়ে আনা
বিপ্লব-বিধ্বস্ত ফ্রান্সে যখন চরম নৈরাজ্য চলছে, সমগ্র জাতি যখন চরম বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে সম্পূর্ণ দিশেহারা, রাজনৈতিক স্থিতি বলে যখন দেশে কিছু নেই, প্রজাতন্ত্র না রাজতন্ত্র—এই বিতর্কে মানুষ যখন বিভ্রান্ত, এই অবস্থায় নেপোলিয়ন দেশে শান্তি, স্থিতি ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ফিরিয়ে আনেন।
(২) শক্তিশালী ফ্রান্স
অধ্যাপক ডেভিড টমসন বলেন যে, “ফ্রান্সকে শৃঙ্খলায় আবদ্ধ করে বোনাপার্ট ফ্রান্সে আইনের শাসন ফিরিয়ে আনেন। মাত্র কয়েক বছরের সংস্কার প্রচেষ্টার মাধ্যমে ফ্রান্সের জনজীবনে তিনি নতুন প্রাণের সঞ্চার করেন এবং ফ্রান্স একটি শক্তিশালী দেশে পরিণত হয়।”
(৩) বিপ্লবের ভাবধারা প্রতিষ্ঠিত
নেপোলিয়ন ছিলেন বিপ্লবের ধারক ও বাহক—বিপ্লবের অগ্নিময় তরবারি। তাঁর সেনাদল যেখানেই গেছে, সেখানেই এসেছে পরিবর্তনের জোয়ার। ঐতিহাসিক রেড্ডাওয়ে (Reddaway) বলেন যে, যেখানেই নেপোলিয়নের সেনাবাহিনী। গেছে সেখানেই পুরাতনতন্ত্রের সমাধি রচিত হয়ে ফরাসি বিপ্লবের ভাবধারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
(৪) নেপোলিয়নের নিজস্ব উক্তি
নেপোলিয়ন এক সময় মন্তব্য করেছেন—“আমিই বিপ্লব” (“I am the Revolution.”)। আবার তিনি অন্যত্র বলেছেন, “আমি বিপ্লবের ধ্বংসকারী”। আপাতদৃষ্টিতে পরস্পর-বিরোধী বলে মনে হলেও বক্তব্যের মধ্যেই সত্যতা আছে।
(৫) বিপ্লবের সন্তান নেপোলিয়ন
ফ্রান্সবাসীকে তিনি স্বাধীনতা দেন নি, কিন্তু তিনি বিপ্লবের সাম্যনীতিকে গ্রহণ করে ‘কোড নেপোলিয়ন’-এর মাধ্যমে ফ্রান্সে আইন, বিচার, কর, চাকরির সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। বংশগত মর্যাদা অপেক্ষা প্রকৃত যোগ্যতাকে তিনিমর্যাদা দেন এবং সামন্ততান্ত্রিক বিশেষাধিকার লোপ করেন। এদিক থেকে তিনি সত্যই ‘বিপ্লবের সন্তান’।
(৬) ওয়েদালার মন্তব্য
ফিলিপ ওয়েদালা বলেন যে, নেপোলিয়নের সাম্রাজ্য বিপ্লবের সামনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করে, বিপ্লবের বিস্তারলাভে সাহায্য করেছে। ঐতিহাসিক ফিশার-এর মতে, “নেপোলিয়ন হলেন বিপ্লবের সন্তান।”
(৭) জর্জ রুদের মন্তব্য
ঐতিহাসিক জর্জ রুদে-র মতে, নেপোলিয়ন প্রকৃতপক্ষে বিপ্লবের সন্তান ছিলেন না। তিনি ফ্রান্সে জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সব প্রতিষ্ঠানের অবসান ঘটিয়ে ও ফরাসি বিপ্লবের স্বাধীনতার আদর্শ বিসর্জন দিয়ে সকল ক্ষমতা নিজে কুক্ষিগত করেন।
উপসংহার:- জর্জ রুদে-র মতে, প্রকৃতপক্ষে নেপোলিয়ন বুর্জোয়া স্বার্থই রক্ষা করেছিলেন। তিনি শ্রমিকদের মন জয় করতে পারেন নি। শ্রমিক-মালিক বিরোধে তিনি মালিকদের পক্ষই অবলম্বন করেন।
(FAQ) নেপোলিয়নের সংস্কার সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
নেপোলিয়ন বোনাপার্ট।
১৮০১ খ্রিস্টাব্দে, নেপোলিয়ন ও পোপের মধ্যে।
নেপোলিয়ন বোনাপার্ট।
নেপোলিয়ন বোনাপার্ট।