মন্ত্রী মিশন -এর পটভূমি, মন্ত্রী মিশন গঠন, মন্ত্রী মিশনের সদস্য, ভারতে মন্ত্রী মিশন, ঐকমত্যের অভাব, মন্ত্রী মিশনের পরিকল্পনা পেশ, পরিকল্পনার প্রস্তাব সমূহ, প্রস্তাব সমূহের প্রতিক্রিয়া, লীগের সম্মতির কারণ, কংগ্রেসের সম্মতির কারণ, মন্ত্রী মিশনের ত্রুটি ও গুরুত্ব সম্পর্কে জানবো।
মন্ত্রী মিশন
ঐতিহাসিক ঘটনা | মন্ত্রী মিশন |
সময়কাল | ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দ |
সদস্য | স্যার পেথিক লরেন্স, এ ভি আলেকজান্ডার, স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস |
ভারতে আগমন | ২৪ মার্চ, ১৯৪৬ |
উদ্দেশ্য | ক্ষমতা হস্তান্তর |
ভূমিকা:- ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটেনে শ্রমিক দল ক্ষমতা লাভ করলে ভারতীয়দের হাতে শাসনক্ষমতা হস্তান্তরের সম্ভাবনা স্পষ্ট ওঠে। ঐ বছরের ৪ ডিসেম্বর ভারত সচিব স্যার পেথিক লরেন্স ব্রিটিশ পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষে (হাউস অব লর্ড) ঘোষণা করেন যে, ভারতের স্বাধীনতা সংক্রান্ত আলোচনার জন্য শীঘ্রই পার্লামেন্টের একটি প্রতিনিধি দল ভারতে পাঠানো হবে।
মন্ত্রী মিশন গঠনের পটভূমি
নৌ-বিদ্রোহ ও অপরাপর বিদ্রোহ এবং প্রবল গণ-বিক্ষোভের ফলে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় রাজনীতির বাস্তব রূপটি উপজাতি করতে সক্ষম হন। এই পরিস্থিতিতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করার উদ্দেশ্যে মন্ত্রী মিশন গঠিত হয়।
মন্ত্রী মিশন
১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১৯শে ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ নৌ-বিদ্রোহ শুরু হওয়ার পরদিনই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লেমেন্ট এটলী ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পুনরায় ঘোষণা করেন যে, ভারতের স্বাধীনতা সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনার জন্য ব্রিটিশ মন্ত্রী সভার তিন সদস্যকে নিয়ে গঠিত একটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন প্রতিনিধি দল ভারতে পাঠানো হবে। এই দলটি ‘মন্ত্রী মিশন’ বা ‘ক্যাবিনেট মিশন (Cabinet Mission) নামে পরিচিত।
মন্ত্রী মিশনের সদস্য
এই দলের সদস্য ছিলেন ভারত সচিব স্যার পেথিক লরেন্স, বাণিজ্য সভার (Board of Trade) সভাপতি স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস এবং নৌবাহিনীর প্রধান (First Lord of Adminalty) এ.ভি. আলেকজাণ্ডার।
ভারতে মন্ত্রী মিশন
২৪ শে মার্চ এই প্রতিনিধি দল দিল্লীতে পৌঁছায়। তাঁরা ভারতে বিভিন্ন ব্যক্তি ও দলের সঙ্গে ১৮২টি বেঠক করেন এবং ৪৭২ জন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির সঙ্গে আলোচনায় বসেন। ভারতীয় নেতৃবৃন্দ ঐকমত্যে আসতে ব্যর্থ হন।
ভারতীয় নেতৃবৃন্দ-এর ঐকমত্যের অভাব
মন্ত্রী মিশনের সদস্যদের সঙ্গে আলোচনায় ভারতীয় নেতৃবৃন্দ কোনো ঐকমত্যে পৌঁছোতে ব্যর্থ হন। এই ব্যর্থতার কারণগুলি ছিল –
- (১) একদিকে গান্ধিজি দ্বিজাতি তত্ত্বের বিরুদ্ধে ও ভারতের অখণ্ডতার পক্ষে বক্তব্য রাখেন, অন্যদিকে জিন্না পৃথক পাকিস্তান-এর দাবিতে অনড় থাকেন।
- (২) শিখ নেতা গিয়ানি কর্তার সিং পৃথক শিখিস্তানের দাবি করেন।
- (৩) দলিত নেতা ড. আম্বেদকর যে-কোনো ধরনের সংবিধান রচনাকারী সংস্থার বিরোধী ছিলেন, কারণ তাঁর মত ছিল যে, এরূপ সংস্থায় বর্ণহিন্দুদের প্রাধান্য সুনিশ্চিত।
মন্ত্রী মিশনের পরিকল্পনা ঘোষণা
জাতীয় নেতৃবৃন্দ ঐকমত্যে পৌঁছোতে ব্যর্থ হলে মন্ত্রী মিশন ১৬ মে তার নিজস্ব পরিকল্পনা ঘোষণা করে। ভারতে দীর্ঘ আলোচনা ও পরিকল্পনা ঘোষণার কাজ শেষ করে মন্ত্রী মিশন ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ২৯ জুন ভারত ত্যাগ করে।
মন্ত্রী মিশনের পরিকল্পনা
এই মন্ত্রী মিশনের পরিকল্পনায় বলা হয় যে,
- (১) ব্রিটিশ শাসিত ভারত ও দেশীয় রাজ্যগুলিকে নিয়ে একটি যুক্তরাষ্ট্র গঠন করা হবে।
- (২) প্রদেশগুলিতে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তিত হবে এবং কেন্দ্রের হাতে কেবলমাত্র পররাষ্ট্র, দেশরক্ষা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার দায়িত্ব থাকবে।
- (৩)হিন্দু প্রধান প্রদেশগুলিকে ‘ক’, মুসলিম প্রধান প্রদেশগুলিকে ‘খ’ এবং বাংলা ও আসামকে ‘গ’ শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
- (৪) প্রদেশগুলি নিজেদের শাসনতন্ত্র নিজেরাই রচনা করবে এবং ইচ্ছে করলে একই স্বার্থবিশিষ্ট প্রদেশগুলি (যথা—ক, খ, গ) জোট বাঁধতে পারবে।
- (৫) প্রত্যেক শ্রেণি (ক, খ, গ) ও দেশীয় রাজ্যগুলির নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে সংবিধান সভা বা গণপরিষদ গঠিত হবে। এই গণপরিষদ ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের শাসনতন্ত্র রচনা করবে।
- (৭) শাসনতন্ত্র রচিত না হওয়া পর্যন্ত ভারতে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলির প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি অন্তবর্তীকালীন সরকার শাসন পরিচালনা করবে।
মন্ত্রী মিশনের পরিকল্পনার প্রতিক্রিয়া
কংগ্রেস এবং মুসলিম লিগ -এর মধ্যে চূড়ান্ত বিরোধের পরিস্থিতিতে মন্ত্রী মিশন তার পরিকল্পনাগুলির দ্বারা উভয় দলকে খুশি করার চেষ্টা করে। ফলে কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ উভয়ই এই পরিকল্পনা মেনে নেয়। কারণ,
(১) লিগের সম্মতির কারণ
সাম্প্রদায়িক নীতি অনুসারে প্রদেশগুলির শ্রেণিবিভাগ করায় তা পাকিস্তান গঠনের উপযোগী হবে মনে করে মুসলিম লিগ মন্ত্রী মিশনের প্রস্তাব মেনে নিয়েছিল। কংগ্রেস সভাপতি মৌলানা আজাদ বলেন, “প্রথমে বিরোধিতা করলেও বৈঠকের শেষ দিনে জিন্নাকে স্বীকার করতে হয় যে, মন্ত্রী মিশনের পরিকল্পনায় সংখ্যালঘু সমস্যার যে সমাধান দেওয়া হয়েছে, তার চেয়ে ন্যায্য সমাধান আর হয় না।”
(২) কংগ্রেসের সম্মতির কারণ
মন্ত্রী মিশনের প্রস্তাবে পৃথক “পাকিস্তান-এর কথা না থাকায় কংগ্রেস বিশেষ আপত্তি করেনি। তবে প্রস্তাবে সাম্প্রদায়িক নীতির প্রাধান্য থাকায় কংগ্রেস অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যোগ দিতে অস্বীকার করে, কিন্তু সংবিধান সভায় যোগ দিতে রাজি হয়।
মন্ত্রী মিশনের পরিকল্পনা সম্পর্কে আজাদের অভিমত
মৌলানা আজাদ বলেছেন, “মন্ত্রী মিশনের পরিকল্পনা কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ উভয়েরই মেনে নেওয়ার ঘটনা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জল অধ্যায় ছিল।”
মন্ত্রী মিশনের পরিকল্পনা সম্পর্কে বিশ্বম্ভর পাণ্ডের অভিমত
ঐতিহাসিক বিশ্বম্ভর নাথ পাণ্ডে বলেন, “মন্ত্রী মিশনের পরিকল্পনা ভারতের সংকটকালে জাতীয় ঐক্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে সর্বোত্তম ছিল।
মন্ত্রী মিশনের ত্রুটি
এই মন্ত্রী মিশনের প্রস্তাবগুলিতে কিছু ত্রুটি লক্ষ্য করা যায়। এই ত্রুটিগুলি হল –
(১) পাকিস্তানের পদধ্বনি
এই প্রস্তাবে সরাসরি ভারত বিভাগ বা পৃথক পাকিস্তানের দাবি স্বীকৃত না হলেও প্রদেশগুলিকে হিন্দুপ্রধান ও মুসলিমপ্রধান অঞ্চলে ভাগ করে এবং তাদের জোট বাঁধার অধিকার দিয়ে পরোক্ষে ভারত বিভাগের দরজা খুলে দেওয়া হয়। জিন্নার মনে হয়েছিল, এটা পাকিস্তান সৃষ্টির প্রথম পদক্ষেপ।
(২) দুর্বল যুক্তরাষ্ট্র
কেন্দ্রীয় সরকারকে প্রাদেশিক সরকারের তুলনায় দুর্বল করার ফলে প্রস্তাবিত যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো অনেক দুর্বল হয়ে যায়।
(৩) দুর্বল অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রস্তাব
প্রস্তাবিত অন্তর্বর্তীকালীন কেন্দ্রীয় সরকারকে সর্বাত্মক ক্ষমতা দানের কোনো প্রস্তাব এতে ছিল না।
(৪) দুর্বল সংবিধান সভা গঠনের প্রস্তাব
সংবিধান সভা বা গণপরিষদকে নতুন সংবিধান রচনার জন্য সার্বভৌম ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। পরে অবশ্য মন্ত্রী মিশন একটি ইস্তাহার প্রকাশ করে জানায় যে, অন্তবর্তীকালীন সরকার ও সংবিধান সভাকে যতটা সম্ভব স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতা দেওয়া হবে।
মন্ত্রী মিশনের গুরুত্ব
কিছু ত্রুটি সত্ত্বেও মোটের ওপর মন্ত্রী মিশনের প্রস্তাবগুলির যথেষ্ট গুরুত্ব ছিল। এই গুরুত্বগুলি হল –
(১) অখণ্ডতা রক্ষার প্রয়াস
মন্ত্রী মিশনের পরিকল্পনা ছিল ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে ভারতকে অবিভক্ত রেখে স্বাধীনতা দেওয়ার শেষ আন্তরিক প্রয়াস। মন্ত্রী মিশন স্পষ্টই উপলব্ধি করেছিল যে, ভারত বিভাগের দ্বারা সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান হবে না।
(২) দেশীয় রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব
এই পরিকল্পনার দ্বারাই সর্বপ্রথম দেশীয় রাজ্য-এর জনগণকে প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার দেওয়া হয়।
(৩) জটিলতা হ্রাস
এতদিন পর্যন্ত ইউরোপীয়, ইঙ্গ-ভারতীয় খ্রিস্টান, তপশিলি জাতি প্রভৃতি বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকে কেন্দ্র করে শাসনতান্ত্রিক আলোচনায় অহেতুক জটিলতার সৃষ্টি হত। কিন্তু মন্ত্রী মিশন হিন্দু, মুসলিম এবং পাঞ্জাবের ক্ষেত্রে শিখ ছাড়া অন্য কোনো সম্প্রদায়কে স্বীকৃতি দেয়নি। ফলে জটিলতা অনেক হ্রাস পায়।
উপসংহার:- মন্ত্রী মিশনের পরিকল্পনায় গণপরিষদ-এ কোনো অভারতীয় সদস্য গ্রহণের ব্যবস্থা না রাখার ফলে তাতে সম্পূর্ণ ভারতীয়করণ ঘটে এবং ভারতের নতুন সংবিধান রচনার ক্ষেত্রে গণপরিষদকে সার্বভৌম ক্ষমতা দেওয়া হয়।
(FAQ) মন্ত্রী মিশন সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
নৌ বিদ্রোহের পর।
স্যার পেথিক লরেন্স, এ ভি আলেকজান্ডার এবং স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস।
২৪ মার্চ ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে।
১৬ মে, ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে।
২৯ জুন, ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে।